“গুল্মে পর্নে,
লতিকার কর্ণে,
ঢলঢল স্বর্ণে
ঝলমল দোলো দুল,
ঝিঙ্গে ফুল”
বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম ঝিঙে ফুলের সৌন্দর্যে মোহিত হলেও এপার কিংবা ওপার, দুই বাংলার রসনাপ্রেমীরা আর ক’টা দিন সবুর করে ঝিঙে ফুলকে কচকচে সবুজ সবজিতে পরিণত হতে দিয়েছেন। “টিপ টিপ বরষা পানি”তে ভিজে রবিনা টন্ডনের মতো আবেদন ছড়ানো খাঁজকাটা গায়ের সতেজ ঝিঙের সঙ্গে ওপারে জমেছে পোস্তর প্রেম, এপারে কুচো চিংড়ির। তা প্রেমটা যেমন তেমন হোক না কেন, পরিণতি একই; এক থালা ভাতের সঙ্গে মুখগহ্বর হয়ে পাকস্থলির অন্তঃপুরে হারিয়ে যাওয়া!

Bangladeshi recipe
বাংলাদেশে চিংড়িমাছ দিয়ে ঝিঙের তরকারি এক্কেবারে বর্ষা স্পেশাল! ছবি সৌজন্য – gazipurkotha.com

বর্ষার খাবার নিয়ে আষাঢ়ে গপ্পো ফাঁদার ফরমায়েশে প্রথমেই ঝিঙের নামটা মনে আসার একটা কারণ আছে। সেটা হচ্ছে বর্ষায় বাজারে গেলেই ঝিঙে, চিচিঙ্গে আর ধুন্দল; প্রায় একই রকম দেখতে তিনটে সবজির নাম প্রায়ই গুলিয়ে ফেলা আর একটার বদলে অন্যটা নিয়ে এসে বাড়িতে গিন্নির ঝাড়ি খাওয়া। কানের লতিতে ঝুলে থাকা দুলের আদলে ঝিঙেফুলের বর্ণনা করে বিদ্রোহী কবি আসলে জানিয়ে দিয়েছেন, বর্ষাকালটা হচ্ছে ঝুলন্ত সবজির। টানা বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট প্লাবিত, বন্যায় ভেসে যায় ফসলের মাঠ। এসময় মানুষ আশ্রয় নেয় উঁচু জায়গায় আর সবজির আশ্রয় মাচায়। ঝিঙে, ধুন্দুল, কাঁকরোল, বরবটি, চালকুমড়ো… বর্ষার সবজিগুলো বেশিরভাগই চাষ করা হয় মাচা পদ্ধতিতে।

Bangladeshi recipe
বর্ষা মানেই কচু ঘেঁচু। কচুর মুখি, কচুর লতি, কচুর শাক। তাতে একটু ইলিশের কাঁটা পড়লে আর কথা নেই। ছবি সৌজন্য – womenscorner.com

গ্রীষ্মের খরতাপকে বিদায় দিয়ে বর্ষার নবীন ধারা ভিজিয়ে তোলে ধরিত্রীর বুক। শুকিয়ে যাওয়া নদনদী আর খালে বিলে নামে দু’কূল উপচানো পানির ঢল। নতুন পানির এই স্রোতে খেলা করে হরেক রকম দেশি প্রজাতির মাছ। শিং, মাগুর, টাকি, বেলে, বোয়াল, শোল, পুঁটি-সহ অনেক রকমের মাছ ধরতে গ্রামীন জনপদে বাড়ে ব্যস্ততা। বাঁশের তৈরি নানান রকম মাছ ধরার সরঞ্জাম আর কাঠের নৌকা তৈরির ব্যস্ততা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হেঁশেলে গিন্নিদের ঝক্কিও বাড়ে। কারণ, নানা রকম দেশি ছোট মাছের বাটি চচ্চড়ি, হাতমাখা ঝোল কিংবা তাজা মাছের কড়কড়ে ভাজা খাওয়ার এই তো সময়!

Bangladeshi recipe
চুনো মাছের বাটি চচ্চড়ি জমে বর্ষার ভেজা দিনেই! ছবি সৌজন্য – cookpad.com

তবে শহুরে জীবনে এসবের সময়টাই বা কোথায়? অফিস শুরু বা শেষের সময়ে “কেরানিমারা বৃষ্টি” তো আছেই। সঙ্গে বন্যার অজুহাতে সবজির বাজারে আগুন। তলিয়ে গেছে মরিচের ক্ষেত, তাই ঝালের চেয়ে দাম বেশি। তবুও পেট ভরাতে জল কাদা পাড়িয়ে, জুতোর আয়ুক্ষয় করে বাজারে পা রাখতেই হয়। কখনও লটারি জেতার মতো দাম কমে আসা ইলিশের খোঁজ করে হঠাৎ পেয়ে যাওয়া, সঙ্গে আলুটা বেগুনটা নিয়ে বাড়ির পথ ধরা। ইলেকট্রিকের তারগুলো যেন শনের মতই পলকা, একটুখানি হাওয়া দিলেই ছিঁড়ে গিয়ে বিপত্তি। চার্জলাইটের আবছা আলোয় বৃষ্টিভেজা দিনের শেষে গিন্নির এগিয়ে দেওয়া আদা দেওয়া এক কাপ কড়া লিকার চা, সঙ্গে সর্ষের তেল আর কাঁচামরিচ ও পেঁয়াজ কুঁচি দিয়ে মাখানো মুড়ির যে রোম্যান্টিক মুড, তার কাছে কোথায় লাগে পাঁচ তারার পুলসাইড ক্যান্ডেল লাইট ডিনার!

Bangladeshi recipe
বর্ষার সন্ধেয় আদা চায়ের সঙ্গে মুড়ি বা চিঁড়েভাজা। সঙ্গে যদি থাকে ছোলাভাজা, চালভাজা কি কাঁঠালবিচি ভাজা, আর কী চাই? ছবি সৌজন্য – prothomalo

বাংলাদেশে রান্নার বাইবেল বলা যেতে পারে প্রয়াত রন্ধনশিল্পী সিদ্দিকা কবিরের “রান্না খাদ্য পুষ্টি” বইখানাকে। সেই বইতে আছে বর্ষার বেশ কিছু খাবারের রেসিপি। “বর্ষার সবজি নিরামিষ রান্না”-র রেসিপিতে আছে পেঁপে, চালকুমড়ো, মিষ্টি কুমড়ো, মুখিকচু, ডাঁটা, মিষ্টি আলু, পটল ও ঢ্যাঁড়শ-সহ নানা মৌসুমি সবজি দিয়ে লাবড়া রান্নার প্রক্রিয়া। একই বইয়ে লেখিকা আষাঢ় মাসের নিরামিষের রেসিপি দিয়েছেন; তাতে ঝিঙে, কাঁঠালের বিচি, চালকুমড়ো, পটল, ডাঁটা, আলু, বেগুন, মিষ্টি কুমড়োর শাক-ডাঁটায় পড়েছে পাঁচফোড়নের বাগাড় (ফোড়ন)। বৃষ্টিতে ভিজে হালকা জ্বর-কাশি এই সময়টায় হয়েই থাকে। তখন বর্ষার সবজির স্যুপ হতে পারে দারুণ দাওয়াই। কুচি করা মাংসের সঙ্গে বরবটি, চালকুমড়ো, পটল, চিচিঙ্গে, ঝিঙে, গাজর, শসা এই সব সবজির সঙ্গে খানিকটা নুডলস মিশিয়ে স্যুপ বানানোর উপায়ও বাতলে দিয়েছেন সিদ্দিকা কবির।

Bangladeshi recipe
কচুর সঙ্গে ইলিশের প্রেম কজনা বোঝে! মুখি কচু দিয়ে ইলিশের মাথা, সে-ও কি ভোলা যায়? ছবি সৌজন্য – youtube.com

শুনেছি ঘটি বাড়িতে নাকি কচু ঘেঁচু ঢোকে না! বাংলাদেশে ওসবের বালাই নেই। তবে শহুরে গিন্নির কুলোপানা চক্কর আছে। কচুর শাক কিংবা কচুর লতি, আঁশ ছাড়িয়ে রান্নার উপযোগী করাটা কম ঝক্কির নয়। তাতে হাত চুলকাবেই। তাই বলে কি খাওয়া বন্ধ থাকবে? মোটেও না। মানকচু, দুধকচু, কচুর শাক, কচুর ঘন্ট; বর্ষায় কত ভাবেই না খাওয়া হয় কচু। কচুর মুখি দিয়ে ইলিশ মাছের মাথা রান্নাটা যে একবার চেখে দেখেছে, তার কাছে মুড়োঘন্টকে মনে হবে আলুনি! কচু আর চিংড়ির জুটিটা কেমন, সেটা চেখে দেখতে কলকাতার নিউ মার্কেট অঞ্চলের বাংলা খাবারের রেস্তোঁরাগুলোতে ঢুঁ মেরে আসতে পারেন। শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল হলেও বর্ষায় অনেকের কাছেই শাপলা উপাদেয় সবজি। শাপলার ডাঁটা খাওয়া হয় কচুর লতির মত করেই। শাপলা দিয়ে ইলিশ, শাপলা দিয়ে চিংড়ি, শাপলা দিয়ে শুঁটকিও খাওয়া হয় বাংলাদেশে। বৃষ্টির জলে লকলকিয়ে বাড়ে পুঁই শাক, ডাঁটা শাক, কলমি শাকও। গরম ভাতের থালায় একহাতা কচকচে সবুজ শাক আর পাশে একখানা সর্ষের তেলে ভাজা শুকনো মরিচ… আর কী লাগে!

Bangladeshi recipe
বর্ষাকাল আর খিচুড়ি সমার্থক। তবে শীতের মতো ভুনি খিচুড়ি নয়। বর্ষায় জমে ল্যাটকা খিচুড়ি! ছবি সৌজন্য – cookpad.com

বর্ষার খাবারের গল্পে খিচুড়ি না থাকলে কী হয়! কে যেন বলেছিল, বর্ষায় ল্যাটকা খিচুড়ি ভাল আর ভুনাখিচুড়ি শীতে! আমার অবশ্য খিচুড়ি নিয়ে অত বাছবিচার নেই, খিচুড়ি মানেই ভালো! মেঘলা দিনে আলসে লোকের বাজার না যাওয়ার অজুহাত হলো খিচুড়ি। ঘরে থাকা চারটে ডাল-চাল চড়িয়ে দিয়ে তারপর একটা ডিম ফেটে ভেজে নিয়ে খেয়ে ফেলা মানুষ আমি। তবে ঐ যে, ভালোর তো কোনও শেষ নেই! তাই খিচুড়ির চালটা যদি হয় সরু আর সুগন্ধী, তাতে যদি মেশে ভাজা মুগের ডাল আর ছোট দানার দেশি মশুর, তাতে দেওয়া হয় ঘিয়ের বাগাড় আর সঙ্গে থাকে চালের গুঁড়োর ব্যাটারে ডুবিয়ে চাক চাক করে কাটা বেগুন ভাজা, পটল ভাজা, মুচমুচে ভাজা আলু আর আমের আচার, তাহলেও অমত নেই। আর উপরওয়ালা যদি জুটিয়ে দেন ডিমের কষা, ইলিশ ভাজা কিংবা হাঁসের মাংস, তাহলে তো একেবারে ইদের খুশি!

Bangladeshi recipe
কুমড়োপাতায় ইলিশ ভাপে বর্ষায় মাখো মাখো! ছবি সৌজন্য – notoutofthebox.com

খিচুড়ির সঙ্গে জলের রুপোলি রানির গল্প এলেও ইলিশ আসলে একাই বর্ষার নায়িকা। স্রেফ ভাজা ইলিশ আর সেই মাছভাজার তেলের সঙ্গে একটা কাঁচামরিচ হলেই ভাতের সঙ্গে আর কিছু না হলেও চলে। এছাড়া সর্ষে ইলিশ, ইলিশের পানিখোলা, কচুর মুখি দিয়ে ইলিশ, ইলিশের মাথা দিয়ে কচুর শাক বা কচুর লতি, পটল দিয়ে ইলিশের ঝোল, লাউ বা কুমড়ো পাতায় ইলিশ পাতুরি… ইলিশ নিয়ে আহ্লাদের শেষ নেই। তবে সবগুলো রান্নাতেই ইলিশ ঐশ্বর্য রাই, সঙ্গের সবজিটি অভিষেক বচ্চনের মতোই হ্যাজাকের পাশে মিটমিটে মোমবাতি।

Bangladeshi recipe
চলতে পারে লাউপাতায় ইলিশের পাতুরিও! ছবি সৌজন্য – facebook.com

ছুটির মেঘলা বিকেলগুলোতে জলজমা রাস্তার কাদা পাড়িয়ে ইয়ারদোস্তদের সঙ্গে গুলতানি করতে বেরোবার বদলে বিছানায় কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতেই বেশি ভাল লাগে! বেশ একটা আরামদায়ক ভাতঘুমের পর গায়ের ম্যাজম্যাজানি কাটাতে আদা আর লেবু দেয়া এক কাপ গরমাগরম কড়া লিকারের চায়ের জন্য মন করে আইঢাই। জলেভেজা ন্যাতানো সন্ধ্যাটাকে ঘরোয়া আয়োজনে মুচমুচে করে তোলা যায় চালভাজা, কাঁঠালের বিচি ভাজা, সর্ষের তেলে কাঁচা লঙ্কা আর পেঁয়াজের ঝাঁজের সঙ্গে চানাচুর আর বাদাম মেশানো ঝালমুড়ি দিয়ে। এছাড়াও গিন্নি সদয় হলে চায়ের সঙ্গে জুটতে পারে ডালবাটার পেঁয়াজু (পেঁয়াজি), পুঁই পাতার বড়া, মুচমুচে বেগুনি কিংবা খাস্তা নিমকপারা (কুচো নিমকি)।

Bangladeshi recipe
বর্ষার ন্যাতোনে সন্ধে মুচমুচে করে তুলতে পুঁইপাতার বড়ার জুড়ি নেই। ছবি সৌজন্য -youtube.com

ফলের ভাণ্ডারে গ্রীষ্ম টেক্কা দিলেও ঠিক পেছনেই ধেয়ে আসা বর্ষার ভাঁড়ারও নেহায়েৎ ফাঁকা নয়। কালোজাম বাজারে পাওয়া যাবে মোটে একটা সপ্তাহের জন্য, এরপরই উধাও। পাকা জামের মধুর রসে মুখ নয়, জামা কাপড়ও রঙিন হয়েছে সরষের তেল, নুন, মরিচগুঁড়ো আর কাঁচামরিচ মিশিয়ে বন্ধ কৌটোয় ঝাঁকিয়ে বানানো জামভর্তা খেতে গিয়ে। এছাড়াও লটকন, আমড়া, পেয়ারা, জামরুল, ডেউয়া, বাতাবিলেবু (জাম্বুরা নামেই বেশি পরিচিত) এই সবই বর্ষার ফল। আম কাঁঠালের মতো মিষ্টি না হলেও বৃষ্টিবাদলের মৌসুমে জ্বর-সহ নানান রোগ সারাতে বর্ষার ফলগুলো খুবই উপকারি।

Bangladeshi recipe
সরষের তেল, নুন, মরিচগুঁড়ো আর কাঁচামরিচ মিশিয়ে বন্ধ কৌটোয় ঝাঁকিয়ে বানানো হয় জামভর্তা। ছবি সৌজন্য – khaidai.com

কবির কাছে বর্ষা মানেই কদম আর কৃষকের কাছে বন্যার অশনী সংকেত। শহুরে পথিকের কাছে আপদ আর বহুতল নিবাসীর বৃষ্টিবিলাস। তবু নিয়ম মেনে বর্ষা আসে, গাভীর মত চড়ে বেড়ানো মেঘ থেকে ঝরে বৃষ্টির ফোঁটা। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ভূতুড়ে সন্ধ্যায় টিনের চালে সেই বৃষ্টির ঝংকার শুনতে শুনতে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে একগাল ঝালমুড়ি চিবুতে চিবুতে বেসুরো গলায় মনটা গেয়ে উঠতেই পারে, “আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে!”

সামীউর রহমানের জন্ম সিলেটে। কর্মসূত্রে রয়েছেন ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। বর্তমানে ঢাকার দ্য নিউ এজ সংবাদপত্রে ক্রীড়াসাংবাদিক। এছাড়া ক্যানভাস ম্যাগাজিনে নিয়মিত রসনা-লিখন করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *