উপশম
জীবন, বিচ্ছেদচিহ্ন। ঝোড়ো হাওয়া লেগে থাকে গায়ে,-
আলো নশ্বরতা বোঝে। ফাঁকা বারান্দার মেঝে থেকে
উষ্ণতার গন্ধ ওঠে, বলে, বেঁচে আছ, ভাবো, আজও, বেঁচে আছ।
একটুকরো দু’টুকরো সূর্য লিখি, বলি, পেলাম না তোমায়।
আকাশ দরিদ্র নয়, তবু সে গরিব, তাই নীল হয়ে থাকে…
দূরের বারান্দা থেকে মনে হয় কেউ যেন তাকিয়ে রয়েছে
ইশারা
পথ অন্ধকার যার, তারও থাকে দূরের লণ্ঠন;
কে আলো দেখায়? সে-ও এই রাস্তা
পেরিয়ে গিয়েছে?
বোঝে না, যে হাঁটে। তার মনে হয়
এ রাস্তায় কেউ নেই আর।
কোনওদিন কেউ আগে এ রাস্তায় হাঁটেনি কখনও।
শুধু দেখে, আলো আছে দূরের লণ্ঠনে।
পথই কি লণ্ঠন তার?
পথই তবে আলো?
ভিক্ষা
তোমাকে বলিনি কিছু, হাত পেতে চাইনি একফোঁটা
রোদ্দুর, জীবনধর্ম, পাথরের ফাঁকে ফাঁকে জলের স্বভাব,-
আকাশে বাড়িয়ে দেওয়া দুটি হাত শূন্য রেখে চেয়েছে আজান
তোমাকে বলিনি, আজও নিজের কাছেই নিজে হাত পেতে আছি
দেহাতি গানের পরে যেমন গুনগুন করে একাকী গায়ক;
মন যত আলো চায়, রোদ তত কড়া হয়ে ওঠে,-
প্রার্থনাগীতির পরে ফাঁকা নাটমন্দিরের মতো…
চক্র
ঝাঁপিয়ে পড়েছে জল, এত অস্থিরতা ভালো নয়, প্রবাহের কোনও
জন্মমৃত্যু নেই, ভাসিয়েই দাও তোমার যা-কিছু, প্রতিটি গোধূলি
ভেসে যায়, যে ঘাট বাউল হয়ে আছে, তারও গায়ে শ্যাওলা জমে,-
ঘাই মারে মাছ, পুনরায় ডুবে যায়, একটু একটু করে যেখানে গভীর
রয়েছে প্রবাহ। কত সহজেই তুমি উদাসীনতার কথা বলো,-
আমি বুঝি কাগজের ছোট ছোট নৌকাগুলি ভাসাব আবার।
ওই পথে ভোরবেলা আসে, আলো পড়ে বিপদসীমায়, ভাঙা পাড়ে,-
বাঁধা ডিঙিনৌকোয়, জালে, দূরে যে ধানক্ষেত, তার রক্তমাংসে, ঘামে।

সারথি
আলো যায় অন্ধকারে, যেতে হয়,-
যেমন তোমার ছায়া শুধু তুমি নও
অসংখ্য রাস্তার মধ্যে
একটি আশ্চর্য রাস্তা রয়েছে কোথাও
যেখানে বিকেলবেলা আছে।
জীবন গরিব, তবু দীন নয়, –
অন্ধকারও আলো।
ঝোড়ো হাওয়া থেমে গেলে
ঝড় তবু, গন্ধ হয়ে থাকে।
ভ্রমণকাহিনি
কী ময়ূর আদর তুমি, ঘন ঘন চৌকাঠ পেরিয়ে
মাটিতে পায়ের ছাপ হয়ে আছ মন
তুমি একা তীর্থযাত্রী নও
প্রতিটি ঘরেই আছে অচেনা বাউল, সারাদিন
যেভাবে পেরিয়ে যাবে ধুলো।
তুমি একা নও পর্যটক,-
একটি পায়ের ছাপে আরও কত পায়ের ছাপ পড়ে,-
কত মন মিশে যায় কত মনে
কত চোখ
অন্ধ হয়ে যায়।
তুমি একা নও সে চৌকাঠ…
সমস্ত পায়ের ছাপ মাটিতে সমাধি হয়ে যায়।
নাবিক
কেন তোমাকেই লিখি প্রতিবার, জানো কিছু?
লোকে বলে প্রেমের কবিতা। আমি বুঝি চিঠিপত্র কিছু
বড়জোর লিখি হয়তো, দু’ তিন লাইন। ভাঙা নৌকোয় বসে
এ নদী পেরনো যায় না। জোয়ার-ভাঁটায় শুধু ওঠানামা করি।
এরই ফাঁকে ঝড়জল আসে, প্রতিটি মানুষই শুধু হেরে যায়,
হেরে যেতে যেতে, হেসে ওঠে। জিতে যাওয়া, কত বড় হেরে
যাওয়া ছিল, কেন ঘুম হয় না বহুদিন, কেন মাঝেমাঝে
রাত্রিবেলা বুকের ভিতরে কিছু ওঠানামা করে? এ জীবন বোঝা
যায় না, লোকে বলে সুখী হও। আহা! সুখী হও, সুখী হও, ঘরে
অন্নপূর্ণা থাক, যশলাভ হোক। ভালোবাসো তুমি তাও? ভালোবাসি
আমি? কী বলে সম্বোধন করব তোমাকে এখন? প্রতিটি ঠিকানা শুধু
অস্থায়ী অতিথিনিবাস। তুমি আছ?

স্নানযাত্রা
এ ভাঙা শহর থেকে তোমার কাছেই চলে যাব
সমুদ্রযাত্রায়, আমি চোখ রাখি তোমার দুচোখে,-
কাকে দেখি, কে আমায় দেখে?
নোনা হাওয়া মিশে যাচ্ছে রক্তের ভিতর
বালিঘর-বালিঘর খেলা শেষে
তোমার সঙ্গেই আমি স্নান করতে যাব।
আমায় দেখে যে, আমি তাকে তবু চিনিনি কখনও
আমি যাকে দেখি, সেও চিনেছে কি আমার দু চোখ?
এখন তোমার জন্য দুঃখ নেই কোনও।
বালিঘর বারবার ভেঙে দিয়ে
আবার নতুন করে বালিঘর তৈরি করি রোজ।
অপরাজিত
যে পথ নরক, তারও সূর্যোদয় হয়
এঁদো মজা খালের উপর
ঝুঁকে থাকে মরচে ধরা সাঁকো।
কচুরিপানার স্বর্গ, ফাঁকফোকরে
পচা ফুল, ঘাম-রক্ত
পুরোনো সংসার।
যে পথ নরক, তারও ডিঙিনৌকো আছে
দূরে আলো দেখা যায়
কাছে অন্ধকার।
*ছবি সৌজন্য: Carre de Artistes, Unsplash
হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা লেখার শুরু নয়ের দশকে। কবি ও লেখক হিসেবে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দুইই পেয়েছেন বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে। মোংপো লামার গল্প, সব গল্প কাল্পনিক, রুদ্রবীণা বাজো, বিপন্ন বিস্ময়গুলি, এসো ছুঁয়ে থাকি এই লেখকের কিছু পূর্বপ্রকাশিত বই।
ঘোরের মধ্যে পড়ে উঠলাম,টানা,এই ঐশ্বর্যমণ্ডিত কবিতাগুলো…
একটানা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম ঐশ্বর্যমণ্ডিত কবিতাগুলো…
শান্ত ও স্নিগ্ধ স্বর,,,,,আকুলতা,,,খুব হৃদয়সংবেদী,,,
এই একমুঠো কবিতা দৃশ্যমান উপস্থিতির আড়ালে অতলস্পর্শী অনুভব। আয়না নয়, বরং একপ্রকার জানলা যা নতুন দিগন্ত মেলে ধরে। A new figuration বা প্রকৃতপ্রস্তাবে transfiguration.
পাঠে মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেলো।