পূর্বভারতের যে কোনও সংস্থার বিপণন ক্যালেন্ডারে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব দুর্গাপুজো। জুতো, বই, প্রসাধন, গয়না, খাবার সবই যদিও বিক্রি হয় এই সময়, তবু একটা জিনিসের বিক্রি সব কিছুকে ছাড়িয়ে যায়। পুজোতে একটা অন্তত নতুন জামা বা শাড়ি কিনবেন না, এমন মানুষের সংখ্যা বেশ কম। আজকালকার প্রজন্ম সারা বছর জামাকাপড় কেনে। তবু পুজোতে মায়ের দেওয়া শাড়ি বা দিদির কাছ থেকে পাওয়া জামার মোহ কম নয়।
অষ্টমীতে নতুন শাড়ি বা পাঞ্জাবি পরে অঞ্জলি না দিলে আর পুজোর মানে কী? মনে পড়ে, ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে নতুন জামা বা জুতো কিনে আনার কথা? বালিশের পাশে নতুন জামা নিয়ে ঘুমোতে গেছি হয়তো আমরা অনেকেই। করোনা-পরবর্তী নিউ নরমালে বেচাকেনা অনেকটাই অনলাইন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। গড়িয়াহাট বা নিউমার্কেট চষে ফেলে পছন্দের জামা কেনার হিড়িক কমেছে অনেকটাই। একটা ওড়না কিনতে এ দোকান থেকে ওই দোকান, কমছে সে প্রবণতাও। ভিড় এড়াতে মুঠোফোন ভরসা। সংক্রমণের ভয় এড়াতে বড় নামীদামি পোশাক বিপণিতে যেতে পারছেন না? তাহলে দোকানই আসবে আপনার শোবার ঘরে!
পোশাকের ধরন, মাপ, ঝুল কতটা হবে, হাতা লম্বা না ছোট? এ রকম কিছু ফিল্টার লাগালেই উঠে আসবে আপনার পছন্দের পোশাক আপনার চোখের সামনে। তাতেও মন ভরল না? কুছ পরোয়া নেই। ফেসবুকে লাইভ শোয়ের মাধ্যমে দেদার শাড়িজামা বিক্রি করছেন অনেকেই। স্ক্রিনশট নিয়ে হোয়াটস্যাপ করুন আর বুক করে ফেলুন পছন্দের জিনিস। “মনে রেখো পাড়ের শাড়ি” পেয়ে যেতেই পারেন সেখানে। এ এক আশ্চর্য সব পেয়েছির দেশ।
কমবয়সী যুবতি থেকে বয়স্ক গৃহবধূ, সবাই এই পেশাকে নিজের করে নিতে চাইছেন। অনেকেই আবার ভিন্ন পেশাতে প্রথিতযশা, তবু তারা খুলে ফেলছেন বুটিক। সঙ্গীতশিল্পী লোপামুদ্রা মিত্র থেকে সিনেমা-টেলিভিশানের চেনা মুখ রচনা বন্দোপাধ্যায়, শাড়ি বা পোশাকের মাধ্যমে ক্রেতাদের আরও কাছে পৌছতে চাইছেন। মানুষ এই মাধ্যমে জানছেন অনেক কিছু। বাংলার ধনেখালি বা বেগমপুরী সুতির কাপড় উঠে আসছে আধুনিক সাজের মানচিত্রে। জামদানি কাজ হচ্ছে জ্যাকেট বা ধুতিতে। আধুনিকা কর্পোরেট তন্বী বেছে নিচ্ছেন কাঁথা কাজের কুর্তা। বাচ্চার জন্যে সুন্দর সুতির পাঞ্জাবি। কলেজ পড়ুয়া তরুণী আবার স্বচ্ছন্দ ইক্কতের অফ শোল্ডার ড্রেসে। সকলেই চাইছেন সবার মতো না হয়ে কিছু আলাদা পোশাক। আর এই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যেই পাখা মেলছে সহস্র বুটিক, সাধ আর সাধ্যের মধ্যে ফিউশন যাঁরা ঘটিয়েই ছাড়বেন।

পনেরোশো টাকার বেনারসি থেকে পাঁচ হাজার টাকার ব্লাউজ, পাঁচশো টাকার সুতির শাড়ি থেকে পনেরো হাজার টাকার পৈথানি সিল্ক, কী নেই এঁদের সম্ভারে! ফোনের ডেটা খরচা করে স্বপ্নের জগতে ঢুকে পড়াই যায়। বরের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে? অফিসে বসের শেষ মুহূর্তের মেল আপনাকে পুজো শপিং থেকে আটকাবে? বাড়িতে বাবা মায়ের সঙ্গে খিটিমিটি নাকি বাচ্চার অনলাইন ক্লাসের চাপ? এই সবের হাত থেকে মুক্তি পেতে আপনার চাই ফেসবুক শপিংয়ের মলম। হাকোবা ব্লাউস হোক বা গামছা শাড়ি, সবাই কিনে ফেলল আর আপনি পিছিয়ে থাকবেন? অতএব মন চল নিজ “অনলাইন” নিকেতনে, দিনের শেষে যতই আপনার ক্রেডিট কার্ড বিদ্রোহ করুক না কেন!
তবে একটা কথা স্বীকার না করে উপায় নেই, এই মাধ্যম খুলে দিচ্ছে অনেক নতুন রাস্তা। অনেককে সাহস জুগিয়েছে স্বপ্ন দেখার। সাধারণ গৃহবধূ যেমন তাঁর সামান্য পুঁজি লাগিয়ে শাড়ি, গয়না ইত্যাদি ফেসবুক পেজ বা লাইভের মাধ্যমে বিক্রি করছেন, ভয় কাটিয়ে শিখছেন ক্রেতার মন্তব্য পড়ে তাঁদের রুচি বুঝতে, অনভ্যস্ত হাতে শিখছেন ছবি তুলতে বা ভিডিও করতে। বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি হচ্ছে ফেসবুকে শুধুমাত্র ছোট ও অসংগঠিত বিক্রেতাদের একটা প্লাটফর্ম তৈরি করে দেবার জন্যে। হোয়াটসাপের মাধ্যমে চলছে কথাবার্তা, ছবি দেখে জামা পছন্দ হলে ক্রেতা টাকা পাঠাচ্ছেন ডিজিটাল পেমেন্ট অ্যাপের মাধ্যমে। কুরিয়রের যাবতীয় তথ্য পাঠিয়ে দিচ্ছেন বিক্রেতা। জিনিস পৌঁছলে তার ওপেনিং ভিডিও করাও জরুরি।
বিশ্বভারতী থেকে বুনন নিয়ে পড়াশোনা করা সেঁওতি ও সুমন তাঁতির ঘর থেকে বুনিয়ে আনা কাপড়ে রং ধরাচ্ছেন হলুদ বা গুড় দিয়ে। বানাচ্ছেন বিভিন্ন ধরনের ড্রেস। মানুষকে বোঝাচ্ছেন, ফ্যাশন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, ইকো ফ্রেন্ডলিও। শুধু মাত্র একটি ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তাঁদের “দর্জি” ব্যাবসা চলছে। হাতে তৈরি বাংলার তাঁতের কাপড়ের ড্রেস হয়ে উঠছে ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। পুঁথিগত বিদ্যাকে কার্যকরী বিদ্যাতে পরিণত করতে গিয়ে ক্রমাগতই শিখছেন জীবনের নানা পাঠ। সেঁওতি মনে করেন, আজ থেকে দশ বছর আগেও এমন সুবিধা সবার কাছে ছিল না।

একটি নামকরা ব্যাঙ্কে চাকুরিরতা সুনন্দিতা রায়বর্মণ সন্তানের জন্মের সময় চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে নিজের গ্রাহক পরিষেবার ধারণা কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলেন নিজের বুটিক। সারা ভারতের সবরকম হ্যান্ডলুম শাড়ি মিলবে তাঁর বুটিকে। পাঁচ বছরে শুধু তিনটে শাখাই নয়, এতটাই সাফল্য পেয়েছে সুনন্দিতার বুটিক, যে তাঁর স্বামী দিব্যাশিসও চাকরি ছেড়ে এসে যোগ দিয়েছেন এই ব্যবসায়। গ্রাহকের সঙ্গে সুসম্পর্কই তাঁর ব্যবসার মূলধন। শাড়ি কেনাতেই শেষ নয়, পাড় লাগিয়ে তাকে পরার যোগ্য করে গ্রাহকের বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি নিখরচায়।
ছোটবেলা থেকে বাবার হাত ধরে শাড়ি চিনতে শিখেছেন অরিত্র দত্ত। সুতো নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন খেলনার মতোই। বাবার পরিচয়ের বাইরে আজ তিনি বাংলার তাঁতের শাড়ির বিপণি খুলে ফেলেছেন। স্ত্রী পৌলমীকে সঙ্গে নিয়ে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই লাইভ করছেন তাঁরা। অরিত্র মনে করেন, শাড়ি শুধু ক্রেতাকে দেখালেই হবে না, তার সম্পর্কে জানতে হবে, নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। তিনি মনে করেন অরিজিনাল জিনিস চিনতে গেলেও ন্যূনতম অভিজ্ঞতা লাগে। অরিত্র বলেন, দোকানে ক্রেতাকে একটার পর একটা শাড়ি খুলে দেখানোতে যে আনন্দ, দুটো কথা বলে যে শান্তি, লাইভে শুধু ফোনের সামনে কথা বলে তার আমেজ পাওয়া যায় না। তাঁর চিন্তা এই নেটফ্লিক্স, অ্যামাজ়নের দুনিয়াতে গ্রাহককে এনগেজ করা নিয়েও। ক্রেতাকে ভাল জিনিসটাই ঠিক দামে দেব, এই তাঁর পণ।

এ তো গেল বিভিন্ন ধরনের বিক্রেতার গল্প। আর ক্রেতারা? করোনা জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে বেশ কিছু স্বাধীনতা। বহু বিধিনিষেধের ঘেরাটোপে বন্দি আজ জীবন। পেশায় চিকিৎসক অপালা ভট্টাচার্য যেমন হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় বিভিন্ন ছোট বুটিকের লাইভ দেখেন। শাড়ি থেকে চুড়ি, পুজোর কেনাকাটা অনেকটাই সেরে ফেলেছেন এইভাবে। তিনি মনে করেন, এতে তাঁর অনেকটা স্ট্রেসও কমে। নাহলে নিজের চাকরি, ছেলের পড়াশোনা সামলে শপিং করতে বেরনোর সময় কোথায়? মন ভালো রাখতেই টুকিটাকি কেনাকাটা করে চলেন তিনি। কিনেই হোয়াটসাপের মাধ্যমে দেখিয়ে নেন নিজের ছোটবেলার বন্ধুদের।
মুম্বই থেকে প্রিয়াঙ্কা রায়চৌধুরী মায়ের কাছে পুজোর শাড়ি পৌঁছে দিতে পেরেছেন এই রকমই এক ছোট ব্যবসায়ীর হাত ধরে। ২০১৪ সাল থেকে রীতিমতো খোঁজখবর করে অনলাইন কেনাকাটা করেন তিনি। মনে করেন, আসল জিনিস পেতে গেলে একটু খাটতেই হবে। শাশুড়ি মায়ের পুজোর শাড়ি পৌঁছে দিতে ভরসা করেন এঁদের ওপরেই। অধ্যাপিকা শুচিস্মিতার মেয়ের নাচের অনুষ্ঠানের জন্যে দরকার ছিল সিন্ডারেলার পোশাক, ঘরে বসেই শুচিস্মিতা কিনে ফেলেছেন একটি অনলাইন সাইট থেকে।
এদিকে নিউ ইয়র্ক থেকে ছেলে বৌমা যখন মনে করে পুজোর শাড়ি পাঠায় প্রতিবারই জলে ভরে ওঠে বেলঘরিয়ার সুমিত্রাদেবীর চোখ। তিন বছর ছেলেকে সামনে দেখতে পাননি, কিন্তু ছেলের মনের কাছে আজও তাঁর উপস্থিতি। শাড়িটা তুলে রাখেন ভিডিও কলে ছেলেকে দেখাতে হবে ভেবে।
আরও পড়ুন: অম্লানকুসুম চক্রবর্তীর কলমে: আউট ফর ডেলিভারি
ভালোমন্দে মিলিয়ে এই অনলাইন কেনাকাটা কিন্তু চিরস্থায়ী জায়গা করে নিচ্ছে আমাদের জীবনে। অনেকেই অন্যভাবে দেখতে শিখছেন জীবনকে। জীবন ক্ষণস্থায়ী, তাই শখ অপূর্ণ রাখব না, এমনটাও ভাবছেন অনেকেই। আবার আরও বেঁধে বেঁধে থাকার কথাও ভাবছেন কেউ কেউ। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের উৎসব দুর্গাপুজো। তাই নিজের দামি শাড়ি কেনার খরচা একটু বাঁচিয়ে আমরা কিন্তু পারি আর কিছু মানুষকে সাহায্য করতে। যে সন্তান বাবাকে হারিয়েছে মহামারীতে, যার চাকরি চলে গেছে, যার ব্যবসা ধুঁকছে ক্রমাগত লোকসান না সইতে পেরে, উৎসবের অধিকার কিন্তু তাদেরও।
চুঁচুড়ার স্কুলশিক্ষিকা মানালি বসু যেমন চেষ্টা করছেন অনাথাশ্রমের মেয়েদের হাতে পুজোতে অন্তত একটা করে নতুন জামা তুলে দিতে। নিজের সন্তানের পাশাপাশি আমরা যদি আমাদের সবজিওয়লা বা কাজের মাসির সন্তানের জন্যেও একটা নতুন জামা অন্তত কিনে দিতে পারি, আসে পাশের জগতটা একটু হলেও ঝলমলে হবে না কি? আনন্দময়ীর আগমনে এইটুকু হোক না হয় আমাদের অবদান।
কর্পোরেট সংস্থায় এইচ আর-এর ভূমিকায় যুক্ত সিলভার পছন্দ গান, খাওয়াদাওয়া আর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা। লেখালেখি করেন শখে আর অনুরোধে।
খুব ভালো লাগল, আমাদের মনের দরজা অনেক টা উন্মুক্ত হোল। বয়ন শিল্পের
বিশ্ব কে এবার আমরা হাতের মুঠোয় ধরতে পারব।
খুব ভালো লিখেছো সিলভা,,
Meaningful analysis of present day on line marketing system. Behavior and strategies of buyer and sellers of such market are well explained with examples. New commerce easily defined.
Very good, mimi.