পৃথিবীর এক ঘোরতর অসুখ চলছে। প্রথম বিশ্ব, তৃতীয় বিশ্ব যে যার মতো করে প্রাণপণ লড়াই করছে। এক নতুন সংক্রমণের আতঙ্কে বিশ্ববাসী আজ একই খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে। প্রতিরোধের রাস্তায় নেমে একের পর এক স্বাস্থ্যসচেতনতার নির্দেশিকায়, চিকিৎসকদের পরামর্শে, পোস্টারে, কার্টুনে যে যে ভাবে যতটুকু পারছে, চেষ্টা চালাচ্ছে।

অতিসংক্রামক এই ব্যাধি রুখে দিতে প্রাথমিক শর্ত পরিচ্ছন্নতা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। এ দেশে তাই খেপে খেপে অনেকগুলো লকডাউনে, আমাদের বেঁচে থাকার সমীকরণটাই কেমন বদলে গেল। প্রথম পর্যায়ে গৃহবন্দি মানুষ যে যার মতো করে নিজেকে চিনলেন নতুন করে। কেউ নতুন নতুন পদ রান্না করলেন, কেউ বা অনেক দিন পর রংতুলি নিয়ে বসলেন। খুব ভালো কথা। কিন্তু তারপর? যে মানুষ প্রতিদিন সকাল হতেই বাদুড়ঝোলা হয়ে অফিসে ছোটেন, যে ছেলে প্রতিদিন মাঠে গিয়ে একবারটি ফুটবলে পা ছোঁয়ায়, যে যুবক সারাদিন কম্পিটিটিভ পরীক্ষার জন্য নিজেকে তৈরি করে সন্ধ্যায় বন্ধুর সঙ্গে ফাঁকা রাস্তায় একটু হাঁটতে বেরোয়, যে গৃহবধূর প্রাত্যাহিক একঘেয়ে যাপনে একমাত্র আলো গড়িয়াহাটের ভিড় আর ফুটপাতের কেনাকাটা; দিনের পর দিন বাড়িতে থাকতে থাকতে, নিজের আপনজন ও পৃথিবীকে সুস্থ দেখার সংকল্পে জারিত হতে হতে তাদের একবারও কি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়নি, যে সবকিছু খুলে যাক এবার?

দম বন্ধ করে দিচ্ছে এই অনন্ত গৃহযাপন। পরিবার আর সোশাল মিডিয়ায় চব্বিশ ঘণ্টা সক্রিয় থেকেও কি মনে হয়নি নিজেকে ভীষণ একা? একের পর এক মৃত্যুসংবাদ ফুটে উঠেছে খবরে, প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের পরিসংখ্যান। দৈনিক রুটিনের ফাঁকে আটকে থাকতে থাকতে কখন যে এসে হানা দিয়েছে শূন্যতা আমরা বুঝতে পারিনি। সে-ও এক অসুখ।

মনের অসুখ। যা এক মারণ ভাইরাসের সমান্তরালে হয়তো আমাদের গ্রাস করেছে প্রতিদিন। আমরা অনুভব করেছি তার ভয়াবহতা। তাকে আমরা নাম দিতে চাই বা না-চাই সে আমাদের চারপাশের অসুখগুলোর মতোই আছে আর থাকবে। ডিপ্রেশন বা অবসাদ এমনই এক মনের অসুখ।

ডিপ্রেশন আর পাঁচটা অসুখের মতোই আরও একটি অসুখ। সারা পৃথিবীতে প্রায় ত্রিশ কোটি মানুষ এই অসুখে আক্রান্ত (WHO ২০১৫-র তথ্য অনুযায়ী)। এবং সারা পৃথিবীতে আক্রান্তের নিরিখে ভারতের স্থান পঞ্চম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম। এই পরিসংখ্যানও দিন দিন বাড়ছে এবং পাল্টাচ্ছে। এই সামান্য তথ্যের নিরিখেই অসুখটা যে যথেষ্ট পরিমাণ গুরুত্ব দাবি করে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এবং যে কোনও অসুখের ক্ষেত্রে ডাক্তারেরা যেমন প্রথমে ডায়াগনোসিস, বা রোগ সনাক্তকরণ এবং তারপর তার চিকিৎসা করে থাকে, এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়।

কোনও মানুষ অবসাদে ভুগলে সে নিজেই সেটা একসময় বুঝতে পারে অনেকক্ষেত্রে। স্বাভাবিক ভাবেই এরও কিছু লক্ষণ ও উপসর্গ রয়েছে। ঘুমের রুটিন বদলে যাওয়া, অকারণ উদ্বেগ, সব কিছুতে অনীহা… এছাড়াও আরও অনেককিছু প্রাথমিক উপসর্গ হিসেবে দেখা দিতে পারে। সে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না। এর পরের ধাপে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে এই সমস্যাগুলো জানিয়ে নিঃসংশয় হতে হয় তিনি ডিপ্রেশনে ভুগছেন কিনা। এবং অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট মাত্রায় ওষুধ শুরু করতে হয়। ওষুধ ছাড়াও আনুষঙ্গিক আরও কিছু চিকিৎসাপদ্ধতি আছে। ডিপ্রেশনের অনেক প্রকারভেদও আছে। সে অন্য আলোচনার বিষয়। তবে আপনার অসুখের জন্য প্রয়োজনীয়টুকু আপানার ডাক্তারই আপনাকে বলে দেবেন।

বেশ কিছু অসুখের মতো এর চিকিৎসাও ক্ষেত্রবিশেষে দীর্ঘস্থায়ী, যেমন ডায়াবেটিস বা হাই ব্লাডপ্রেশারে হয়। মোদ্দা কথা নিয়মিত ডাক্তারের সঙ্গে সংযোগ রাখা জরুরি। আর তার সঙ্গে কখনও কখনও সাইকোলজিস্টের কাউন্সেলিং যা চিকিৎসার একটা অংশ বৈ আর কিছুই নয়। আরও একটা কথা, এমন নয় যে ডিপ্রেশনের কোনও নিদিষ্ট বয়স আছে, বা বেশি বয়সেই হয়। অনেকক্ষেত্রে অল্প বয়েসেও কেউ ডিপ্রেশনের শিকার হতে পারেন। এমনকি শিশুরাও হতে পারে।

কিন্তু ব্যাপারটা যতটা সহজ ভাবে বলা হলো, খুব দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমাদেরই গড়ে তোলা নানান অর্থহীন সংস্কার তা হতে দেয় না। এই অসুখকে আজও আমরা অনেকখানি ব্রাত্য করে রেখেছি। আশপাশের মানুষজনদের কাছে এই জাতীয় সমস্যাগুলো খুলে বলার জায়গাও অনেকের নেই। অথচ অনেকে ক্ষেত্রেই সে চিনতে পারে তার সমস্যার জায়গাটা। কিন্তু সেগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করার পরিসর খুঁজে পায় না। সব থেকে বড়ো কথা, অনেকেই তার পরিচিত কেউ অবসাদে ভুগছে শুনলে নিজের নিজের মত করে জাজমেন্টাল হয়ে ওঠেন। ভালো থাকা, ও আনন্দে থাকার নানান পরামর্শ বাতলে দেন। কেউ কেউ কত সহজে একে দুঃখবিলাসিতা নাম দিয়ে ফেলেন।কিন্তু অসুখ তো বিলাসিতা নয়! তার চিকিৎসা প্রয়োজন। সেটা না করলে এই মানসিক অবসাদ আর পাঁচটা অসুখের মতো আক্রান্তকে ভয়াবহ পরিনতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।

এই অসুখের আর একটা দিক হল আত্মহত্যাপ্রবণতা। সেটাও কিন্তু রোগীর চয়েস নয়। বাধ্যতা। আর পাঁচটা রোগের মত এই রোগের একটা পরিণতিমাত্র। কতক্ষণ আর সে একা নিজের সঙ্গে নিজে লড়াই করবে?

রবিবার ঘটে যাওয়া এক তরুণ অভিনেতার আত্মহত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়া এখন উত্তাল। এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তিনি আত্মহত্যা করেছেন মানসিক অবসাদের কারণে। এই লকডাউন পিরিয়ডে এবং তার আগেও বেশ কিছুদিন ধরে তিনি ডিপ্রশনে ভুগছিলেন বলে পুলিশ সূত্রে খবর। এই সংবাদ অত্যন্ত বেদনাদায়ক সন্দেহ নেই। সব থেকে বড়ো কথা, এই অতিমারীর দুর্দিনে এ বছর পর পর আমাদের বেশ কয়েকজম প্রিয় মানুষকে আমরা হারিয়েছি। এঁদের অধিকাংশই কোনও না কোনও শারীরিক অসুস্থতা বা অতিমারীর শিকার হয়েছেন বলে জানি। খুব সাম্প্রতিক কোনও মৃত্যুর কারণ হিসাবে মানসিক অবসাদকে পাইনি আমরা। এখনও সঠিক ভাবে জানা নেই এই তরুণ প্রতিভাবান অভিনেতা কতদিন ধরে ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন। তাঁর মর্ত্যুর কারণের অন্তর্তদন্তও করতে চাই না এই ভয়ানক খারাপ একটা সময়ে। কিন্তু দিনের পর দিন বাড়িতে থাকতে থাকতে কিছু মানুষ নানা মানসিক অসুস্থতার শিকার হচ্ছেন, এ কথা অস্বীকার করি কী করে! সব মানসিক অসুস্থতাই ডিপ্রেশন নয়, এবং ডিপ্রেশনেরও বিবিধ কারণ আছে। কিন্তু অসুখ যাই হোক না কেন, শরীরিক বা মানসিক, তার চিকিৎসা করতে হয়। তার সঙ্গে দরকার এ বিষয়ে সচেতনতা। আর এই সচেতনতার সংজ্ঞায় কিন্তু শরীর ও মন মিলেমিশে থাকে, এবং দু’টোই কিন্তু সমান ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এবং আন্তঃসম্পর্কযুক্ত।

আমাদের অসুখ করলে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। সে শরীরের হোক বা মনের। এখানে কুণ্ঠার কোনও কারণ নেই। আবার শরীরের ডাক্তারকে মনের অসুখের কথা বলবেন না, এমনটাও নয়। সত্যি বলতে এমন কোনও বিভাজনই হয় না। ডাক্তার ডাক্তারই। তিনি বড়জোর প্রয়োজনে আপনাকে অন্য কোনও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে বলতে পারেন। তাঁকে নিজের যে কোনও অসুস্থতার কথা জানাতে দ্বিধা করবেন না। অনেকেই হয়তো অন্যান্য অনেক দীর্ঘস্থায়ী অসুখের মত এই ডিপ্রেশনের সঙ্গে যুঝে চলেছেন অনেক বছর ধরে। ডাক্তার দেখিয়েছেন। ওষুধ খাচ্ছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা জরুরি। এই ওষুধের ডোজ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি নিয়মিত নজরদারিতে রাখা প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, অন্যান্য শরীরিক সমস্যা নিয়ে যদি অন্য ডাক্তারের কাছেও যান তাহলেও তাঁকে যে ওষুধগুলো আপনি খাচ্ছেন, বিস্তারিত জানান। কোনও রকম সংকোচ করবেন না। এমন কখনওই নয় যে আপনার জেনেরাল ফিজিশিয়ান আর সাইকিয়াট্রিস্ট দু’জন আলাদা গ্রহের মানুষ। দু’জনেরই কাজ শেষপর্যন্ত আপনাকে সুস্থ রাখা।

একটা মৃত্যুকে ঘিরে সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে হাজারও পোস্ট। নানামুনির নানা মত। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ডিপ্রেশন ব্যাপারটা যে আমরা কিছুটা জানি না বা বুঝি না, তেমন তো নয়। তাহলে তাকে অ্যাড্রেস করতে কেন এত সংকোচ, কেন এত দ্বিধা? আজ এই ভয়ংকর অতিমারীর সংক্রমণকে কেন্দ্র করে আমরা যে এত সচেতনতার প্রচার চালাচ্ছি, পরিজনকে আগলাতে স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে নিতে এতটুকু পিছপা হচ্ছি না, প্রথম দিকে একটু অসুবিধা হলেও অভ্যেস করে নিচ্ছি, কারণ তার প্রয়োজনটা উপলব্ধি করেছি আমরা!

ঠিক সেভাবেই যদি আমরা ডিপ্রেশন নামক একটি অসুস্থতাকে কেবলমাত্র একটি অসুস্থতা হিসেবে দেখি এবং তাকে এড়িয়ে না গিয়ে তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নিই, অন্যের সমস্যাগুলো যদি একটু মন দিয়ে শুনি, তাকে গুরুত্ব দিই, চারপাশকে যদি আরও একটু সচেতন করে তুলি মানসিক স্বাস্থ্যের এই দিকটা নিয়ে, তাহলে আমাদের পৃথিবীটা মনে হয় আরও দ্রুত সেরে উঠবে।

পেশায় চিকিৎসক। স্নাতকোত্তর শেষ করে বর্তমানে কলকাতা মেডিকেল কলেজে কর্মরত। পাশাপাশি আশৈশব ভালবাসার টানে শিল্প ও সাহিত্যচর্চায় নিমগ্ন। বেশ কিছু বছর ধরে যুক্ত রয়েছেন প্রচ্ছদ, গ্রন্থচিত্রণ ও ক্যালিগ্রাফির কাজে। এছাড়া কার্টুন আঁকিয়ে হিসেবে দীর্ঘদিন যুক্ত আছেন কার্টুনদলের সঙ্গে। লেখালিখির শুরু মূলত কবিতার হাত ধরে। প্রকাশিত কবিতার বই 'প্রচ্ছদ শ্রমিকের জার্নাল'।

One Response

  1. লেখাটি পড়ে ভালো লাগলো। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে এই Covid 19 আক্রান্ত যেমন অনেক সময়েই socially stigmatised হচ্ছেন তেমনি মানসিক অবসাদে আক্রান্ত মানুষও একই ভাবে ব্রাত্য হয়ে পড়েন। এই সময় তার পারিবারিক সহযোগিতা খুবই জরুরী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *