আমাদের ছোটবেলায় দু’টি পত্রিকা নিয়মিত আমাদের বাড়িতে নেওয়া হত। প্রথমটি ‘দেশ’, অন্যটি ‘সোভিয়েত দেশ’। ‘দেশ’ সেসময়ে সাপ্তাহিক ছিল। আমি তখন কলেজের প্রথম বর্ষে। আমি আর আমার তিন বছরের বড় দিদি মুখিয়ে থাকতাম কবে খবরের কাগজওয়ালা এসে ‘দেশ’ দিয়ে যাবে।
সবে ইস্কুলের পাট শেষ করে কলেজে ঢুকেছি। যদিও বিএ ক্লাসে আমার বিষয় ছিল ইংরেজি, বাড়িতে বাংলা-ইংরেজি দুটি ভাষায় সাহিত্য পাঠের এমনই এক আবহে আমার বড় হয়ে ওঠা যে আমার দু’রকম সাহিত্যের প্রতিই অনুরাগ ছিল। সাগরময় ঘোষ ছিলেন তখন ‘দেশ’-এর সম্পাদক। আর ‘দেশ’ পত্রিকার মাধ্যমেই আমার প্রথম পরিচয় যাযাবর, সমরেশ বসু, রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর প্রমুখ সাহিত্যিকদের লেখার সঙ্গে। রমাপদ চৌধুরীর লেখা ‘বনপলাশীর পদাবলি’ তখন ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে ‘দেশ’-এ। সপ্তাহান্তে ‘দেশ’ এলে আমাদের দু’বোনের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত, কে আগে সেটা হস্তগত করবে। দুজনেই সাগ্রহে প্রতীক্ষা করতাম ‘বনপলাশীর পদাবলী’র পরবর্তী পর্বের জন্য।
সেই শনিবার আমার ভাগ্য বোধহয় সুপ্রসন্ন ছিল। প্রথমে আমার হাতেই ‘দেশ’টা এল। পরীক্ষার পাট সবে চুকেছে। তাই পড়তে বসার তাড়া নেই আর তা নিয়ে মায়ের বকুনিরও ভয় নেই। পত্রিকা হাতে পেয়েই একেবারে দুড়দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে চিলেকোঠার ঘরে। সূচিপত্র দেখে শুধু ‘বনপলাশীর পদাবলি’র পাতা খুঁজে বের করার অপেক্ষা। তারপরে মগ্ন হয়ে পড়া এক অজানা গ্রামের কথায়। সেখানকার মানুষের অতি সাধারণ যাপন-চিত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠা। সে ছিল আমার মতো ষোলো পেরুনো এক শহুরে তরুণীর পক্ষে বিরল অভিজ্ঞতা।
কিন্তু সেদিন সেই পড়ার মধ্যে কোথায় যেন একটা ছন্দপতনের আভাস পেলাম। মনে হল, লেখক তাঁর পদাবলির সূত্ররচনায় কোথাও যেন খেই হারিয়ে ফেলেছেন। একবার, দু’বার পড়লাম, কিন্তু সূত্র খুঁজে পেলাম না। আমার প্রিয় কথাশিল্পীর লেখা পড়ে আমি সেদিন হতাশ। স্থির করলাম অবিলম্বে এ বিষয়ে লেখকের সঙ্গে কথা বলতেই হবে। তাঁকে উত্তর দিতেই হবে আমার প্রশ্নের। সে কালে তো আর মুঠো ফোনের চল ছি্ল না। ফোন বলতে তখন একমাত্র ভরসা গোল ডায়াল বসানো কালো ল্যান্ডফোন। আর ফোন নম্বর খুঁজে পেতে কলকাতা টেলিফোনের সেই বিশাল এক ডায়রেক্টরি, যাতে কলকাতার সব অধিবাসী, প্রতিষ্ঠানের নামধাম লেখা থাকতো
ফাঁকা ঘর দেখে একদিন বেলাবেলি আনন্দবাজার অফিসে ফোন লাগালাম। অপারেটর ফোনে উত্তর দিলেন। বললাম, “রমাপদ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।” অবিলম্বে লেখক ফোন ধরলেন। বেশ গম্ভীর গলার আওয়াজ। ততক্ষণে আমার সাহস তলানিতে এসে ঠেকেছে। নিজের বুকের ভিতরকার ধুকপুকুনির আওয়াজ নিজের কানে শুনতে পাচ্ছি। জিজ্ঞাসা করলেন আমার পরিচয় এবং ফোন করার কারণ। পরিচয়? বললাম, “আমি কলেজে পড়ি। ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী।” অর্বাচীন প্রশ্নটিও চোখকান বুজে করেই ফেললাম। উত্তরে লেখক মনে হল খুকখুক করে একটু হেসে উঠলেন। তারপরেই সস্নেহে জিজ্ঞাসা করলেন কলেজের নাম এবং কোথায় থাকি। জানালেন আমার কলেজের অনতিদূরেই ওঁর বাড়ি আর এসব গুরূত্বপূর্ণ আলোচনা ফোনে না করে সামনাসামনি হওয়াই কাম্য। কাজেই একদিন যদি কলেজ থেকে আমি ওঁর বাড়িতে চলে যাই তাহলে কথা হবে। ফোন ছাড়বার আগে ওঁর ঠিকানা এবং কীভাবে কোথা দিয়ে যেতে হবে তার নির্দেশও দিতে ভুললেন না।
আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে আমার প্রশ্ন শুনে উনি যারপরনাই বিরক্ত হবেন। তার পরিবর্তে ওঁর কথায় আমি প্রায় হতবাক হয়ে গেলাম। ওঁর মাপের একজন সাহিত্যিক আমার মতো এক অতি উদ্ধত ডেঁপো মেয়েকে এ ভাবে প্রশ্রয় দিতে পারেন সেকথা কল্পনাও করতে পারিনি।
অবশেষে এক সন্ধ্যায় বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার নাম করে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। শাস্ত্রে নাকি বলেছে কোনও মহৎ কর্ম সাধনে সামান্য মিথ্যাভাষণে পাপ হয় না। আর এ তো সত্যিই মহতী কর্ম! সেই ষাটের দশকে এক তরুণী কন্যা অপরিচিত এক পুরুষের সঙ্গে সন্ধ্যার আঁধারে দেখা করতে যাবেন, তা সে পুরুষের সাহিত্যিক হিসেবে যতই খ্যাতি থাকুক না কেন, এসব ছিল ভাবনারও অতীত। মধ্যবিত্ত যে কোনও পরিবারেই এসব কাণ্ডকারখানা একেবারে অকল্পণীয় ছিল, তা সে পরিবারের মানুষজন যতই শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত হোন না কেন। কাজেই নিরূপায় হয়েই এটুকু মিথ্যার আশ্রয় সেদিন নিতে হয়েছিল।
গড়িয়াহাট মোড় থেকে কালিঘাটগামী ট্রামে উঠে নামলাম গিয়ে আমার কলেজের স্টপ কালিঘাট ট্রাম ডিপোতে। ট্রাম থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে একটু খোঁজখবর করে পৌঁছে গেলাম প্রিয় লেখকের বাড়ি। দরজায় ঘন্টি বাজাতে নিজে এসে দরজা খুলে দিলেন খোদ রমাপদবাবু। ‘আমি রমাপদ চৌধুরী। আসুন ভিতরে।’ গলা উঁচু করে নাম ধরে ডাকলেন স্ত্রী সুষমাকে। পরদা সরিয়ে ছোটখাট চেহারার যে ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকলেন তাঁর স্মিতমুখ দেখে একটু যেন মনে ভরসা পেলাম। বসবার ঘরে সোফার এক কোণে প্রায় জড়োসড়ো হয়ে আমি বসেছি আর আমার উল্টো দিকের সোফাতে লেখক। স্ত্রীকে একটু চায়ের ব্যবস্থা করতে বললেন।
আমাকে কথা বলার প্রায় কোনও সুযোগই না দিয়ে নিজেই আমার লেখাপড়া, আমার পছন্দের বই, আমি লেখালিখি করতে চাই কিনা বা কী আমার পছন্দের গান ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় নিয়ে এমন ভাবে প্রশ্নোত্তর শুরু করলেন যে নিমেষে আমার সঙ্কোচ, শঙ্কা সব দূর হয়ে গেল। সহজভাবেই কথা বলতে শুরু করলাম। সুষমাদেবী যখন চা নিয়ে ঢুকলেন, ততক্ষণে আমাদের আড্ডা বেশ জমে উঠেছে যদিও তখন পর্যন্ত উনি আমাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করছেন। সুষমাদেবীই এটা লক্ষ্য করে স্বামীকে একটু মৃদু অনু্যোগ করলেন। ‘কী কাণ্ড! এইটুকু একটা মেয়েকে তুমি আপনি বলছ? আমি কিন্তু আলপনাকে তুমি করেই বলবো। বুঝলে মেয়ে?’ এবারে আমি আরো অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, ‘নিশ্চয়, আপনারা দুজনেই আমাকে তুমি করে বলুন. please!’ ‘বনপলাশীর পদাবলি’ নিয়ে আমার প্রশ্নের সদুত্তরও দিয়েছিলেন সেদিন রমাপদবাবু।
গল্প করতে করতে ঘড়ির কাঁটা কতটা এগিয়ে গেছে সেদিকে খেয়াল ছিল না আমাদের। বৌদিই সে কথা মনে করিয়ে দিলেন স্বামীকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমিও উঠে পড়লাম। রমাপদবাবু বললেন ‘এত সন্ধ্যায় আর একা গিয়ে কাজ নেই তোমার। চলো আমি তোমাকে একটু এগিয়ে দিই।’ আজও মনে পড়ে সেদিন তিনি ট্রামে করে আমাকে গড়িয়াহাটের মোড় পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, ট্রাম থেকে নেমে হেঁটে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমি বাড়িতে আসবার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। বলেছিলেন আর একদিন আসবেন।
২০১৮ সালে কাগজে রমাপদ চৌধুরীর মৃত্যুসংবাদ পড়ে পুরনো সব কথা মনে পড়তে লাগল। সেদিনের পরে আরও বেশ কয়েকবার গেছি ওঁর বাড়িতে। বিএ পাশ করে আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা শুরু করেছিলাম। সেই সঙ্গে কালান্তর পত্রিকায় শিক্ষানবিশী হিসেবে কাজ। তখন দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল না। তবু যখনই কোথাও দেখা হয়েছে, আমি এগিয়ে গিয়ে কথা বললে সব সময়ে ওঁর ব্যবহারে একটা স্নেহের স্পর্শ পেয়েছি। ইতিমধ্যে আমার সঙ্গে সাংবাদিক-লেখক শংকর ঘোষের বিবাহ হয়েছে। ওঁর আনন্দবাজারের দীর্ঘদিনের সহকর্মী বন্ধু সন্তোষকুমার ঘোষের জ্যেষ্ঠা কন্যার বিয়েতে নিমন্ত্রিত হয়ে দুজনেই হাজির হয়েছি। রমাপদবাবুও আমন্ত্রিত। শংকর ঘোষের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। উনি এসে প্রথমে কথা শুরু করলেন। ওঁদের দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা আছে, সেকথা আমার জানা ছিল না। নানা বিষয়ে কথা বলছেন ওঁরা। আমাকে দেখতে পেয়ে রমাপদ আমার কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। ওঁর কথা বলার ধরন দেখে আমার বুঝতে বাকি রইল না যে উনি আমাদের বিয়ের কথা জানেন না। এই সময়ে সন্তোষবাবুও ওখানে ছিলেন। উনি রমাপদবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন আমার পরিচয় উনি জানেন কিনা। রমাপদবাবু বললেন, ‘বিলক্ষণ, আলপনাকে আমি চিনব না? ও যখন কলেজে পড়ে তখন থেকে চিনি ওকে।’ সন্তোষ ঘোষ হেসে বললেন, ‘আরে ওর আরও একটা পরিচয় আছে। আলপনা তো আমাদের শংকরের বৌ।’ এবারে রমাপদবাবুর অবাক হওয়ার পালা। তার পরে তিন বন্ধু মিলে খুব খানিক হাসাহাসি হলো। বিয়েতে আমি ওঁকে নিমন্ত্রণ করিনি কেন, তা নিয়েও অনুযোগ করতে ছাড়লেন না।
যে বয়সে রমাপদ চৌধুরীর ‘বনপলাশীর পদাবলি’ পড়ে ওঁর লেখার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম, পরবর্তীকালে যখন ওঁর লেখা ‘এখনই’ বা আরও পরে ‘যে যেখানে দাঁড়িয়ে’ পড়েছি, তখন বুঝেছি গুণমানে ওঁর লেখা ‘বনপলাশীর পদাবলি’র থেকে কতটা এগিয়ে গিয়েছে। ওঁর লেখার মধ্যে এমন একটা অনাড়ম্বর ভাব ছিল, যা পড়ে মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না। রমাপদ চৌধুরী যে শুধুমাত্র সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাই নয়, সম্পাদনার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ এবং কঠিন।এর ফলে অনেক সময়ে তিনি অপ্রিয় হয়েছেন তাঁর অনুজ সাহিত্যিকদের কাছে। লেখার ভালো-মন্দ বিচার করতে তিনি কোনওদিন কারও সঙ্গে অন্যায় সমঝোতা করেননি।
নিজের লেখা নিয়েও তিনি বোধহয় ছিলেন খানিকটা নিরাসক্ত। তা নাহলে খ্যাতির মধ্য গগনে থাকাকালীন কী করে লেখা থেকে স্বেচ্ছা-অবসর নিতে পারলেন? এখানেই রমাপদ চৌধুরীর অনন্যতা।
পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি বই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।
‘দিনের পরে দিন : রমাপদবাবুর স্মৃতি’— এই লেখাটির কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। পুরো লিখাটি আমি পড়লাম। এটা পড়ে আমার মনে হল এটা সম্পূর্ণ মনগড়া একটা গল্প। একটানা 30 বছর ধরে রমাপদ চৌধুরীর সহকারী হিসেবে কাজ করার সুবাদে ওঁকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমার সঙ্গে ওঁর কী সম্পর্ক আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ‘হারানো খাতা’র ৬ পাতার ভূমিকাটি পড়লেই সেটা বুঝতে পারবেন। আমি বলছি এই লেখাটির মধ্যে কোনও সত্যতা সত্যতা নেই।
সিদ্ধার্থ সিংহ
8777829784