তিনি গেয়েছিলেন ‘ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি’। তিনি চলে গেলেন, আর ‘বিদায়ের পাত্রখানি’ ভরা রইল তাঁর সুমধুর সংগীতসুধায়। সুমিত্রা সেন। রবীন্দ্রসংগীতের খ্যাতকীর্তি শিল্পী। কিছুদিন ধরেই অসুস্থ, নব্বই ছুঁই-ছুঁই এই শিল্পী প্রয়াত হলেন ৩ জানুয়ারি ভোরে। ‘ভোরের আকাশ রাঙা হল রে/…পথ হল সুন্দর’।
১৯৩৩ সালে উত্তর কলকাতায় জন্ম। প্রথমে তাঁর নাম ছিল ‘অরুণা’ (ডাকনাম: বুলবুল), বাবা অতুলচন্দ্র দাশগুপ্ত তা বদলে করেন ‘সুমিত্রা’। বাবা বিদ্যাসাগর কলেজে দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর উৎসাহেই সুমিত্রা ছোটবেলায় ছবি আঁকা, বাটিকের কাজ শিখেছিলেন ফণীভূষণ দেবের কাছে। মা অমিয়া দাশগুপ্ত গানবাজনা জানতেন, বাড়িতে অর্গান বাজিয়ে গান করতেন। মার কাছেই সুমিত্রার গানে হাতেখড়ি। প্রথম শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘কূল থেকে মোর গানের তরী’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতা ছেড়ে বহরমপুর চলে যান তাঁরা। সেখানে বাবার ইচ্ছানুযায়ী সেতার শেখেন রাজা রায় নামে একজনের কাছে। দু-বছর পর কলকাতা ফিরে ভর্তি হন বালিগঞ্জ গার্লস স্কুলে। সেখানে বেঙ্গল মিউজিক কলেজের ক্লাস হত। একবার মিউজিক কলেজে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁর আসা উপলক্ষ্যে এক অনুষ্ঠানে শুরুর রবীন্দ্রসংগীতটি পরিবেশন করেন সুমিত্রা। শুনে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ বলেছিলেন, ‘তোমার গান হবে। ভালো করে শেখো। তোমার গলাটা খুব মিঠা।’ তারপরই উচ্চাঙ্গসংগীতের তালিম নিতে শুরু করেন সুমিত্রা। স্কুল পেরিয়ে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে পড়ার সময় ইন্টার কলেজ কম্পিটিশনে বিভিন্ন ধরনের গানে নাম দেওয়ার সূত্রে সুরেন চক্রবর্তী, সমরেশ রায়, সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়, রাধারাণী দেবী প্রমুখের কাছে পল্লীগীতি, কীর্তন, রবীন্দ্রসংগীত— নানা গোত্রের গান শিখলেন এবং প্রথম হয়ে গোল্ড মেডেল পেলেন। গীত, ভজন আগেই শিখেছিলেন প্রদ্যোতনারায়ণের কাছে। ‘বৈতানিক’-এ শিখতে গিয়ে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমিয়া ঠাকুর, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর সান্নিধ্য লাভ করেন। তারপর ‘গীতবিতান’ শিক্ষায়তনেও শিখে ‘গীতভারতী’ ডিগ্রি পান। ইতিমধ্যে ১৯৫০-এ বেতারে নানা বিষয়ে অডিশন দিয়ে উত্তীর্ণ হন এবং আমৃত্যুই বলা যায় বেতারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল।

বেতারে নিয়মিত অনুষ্ঠানে প্রধানত রবীন্দ্রসংগীত শুনিয়েছেন। রেডিওর নিজস্ব রেকর্ডের অনুষ্ঠানে অলোকনাথ দে-র সুরে শঙ্করলাল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গাওয়া একটি দ্বৈতকণ্ঠের গান ‘গান গেয়ে বেলা যদি যায়’ বেশ আদৃত হয়েছিল। তবে রেডিওতে তাঁর স্মরণীয় গানটি ছিল রেডিওর জনপ্রিয়তম অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-তে, পঙ্কজকুমার মল্লিকের সুরে ‘মাগো তব বীণে সংগীত’। বেতারে আরও কিছু আলেখ্য ধরনের বিশেষ অনুষ্ঠানে সুমিত্রা অংশগ্রহণ করেছিলেন।
https://youtu.be/yB2JkWGEEmA১৯৫০ নাগাদই এইচ এম ভি-তে অডিশন দিয়ে উত্তীর্ণ হলেন বটে কিন্তু রবীন্দ্রসংগীত বাদ দিয়ে অন্য গান রেকর্ড করতে বলা হল। তখন ১৯৫১-তে প্রথম রেকর্ডে গাইলেন কাজি নজরুলের লেখা দুটি গান, যা সুর করলেন দুর্গা সেন: ‘গোঠের রাখাল বলে দে রে’ ও ‘বেদনার বেদীতলে’ (জি ই ২৪৭২০)। বেরিয়েছিল ‘কলম্বিয়া’ লেবেলে। তার পর ১৯৫৭ থেকে তাঁর নিয়মিত রেকর্ড বেরতে থাকে। প্রথম দিকে মূলত পল্লিগীতি আর আধুনিক। সুরেন চক্রবর্তীর কথায়-সুরে ‘বাঁশি কী গুণ জানে গো’, ‘তোরা বলিস না আর’ (১৯৫৭), প্রচলিত কথায়-সুরে নৌকাবিলাসের গান— ‘গুন গুনাইয়া গাও’ (১৯৫৮), মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সাথে জিপসি গান— ‘ও দ্যাশে আইল’ (১৯৬১) ইত্যাদির সঙ্গে আধুনিক শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘যদিও ক্লান্ত নয়নে ঘুম’ (কথা: সরল গুহ, ১৯৫৯) বা অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়-সুরে ‘সারাদিন তোমাকে খুঁজেছি আকাশে’ (১৯৬১) গাইলেও এ যেন তাঁর সঠিক জায়গা নয়। এরই মধ্যে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনায় তাঁর যথার্থ জায়গাটি পেয়ে গেলেন, তাঁর জীবনের মোড়ও ঘুরে গেল। ১৯৬০-র প্রথম দিকেই খুব সম্ভব, হঠাৎ এক অবিশ্বাস্য ফোন। উত্তমকুমার ফোন করে একটি ছবির জন্য রবীন্দ্রসংগীত গাইতে বললেন সুমিত্রাকে। এর নেপথ্য কাহিনীটি এ রকম— রেডিওতে সুমিত্রার রবীন্দ্রসংগীত শুনেছিলেন উত্তমকুমার, সে-সময় পাশে ছিলেন গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। ‘বেশ গাইছে তো মেয়েটা’— উত্তমকুমার এ-কথা বলায় গৌরীপ্রসন্ন জানান, মেয়েটি তাঁর এক বন্ধুর স্ত্রী। এইভাবে অজয় করের পরিচালনায় উত্তম-সুপ্রিয়া অভিনীত ‘শুন বরনারী’ (১৯৬০) ছবিতে রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সংগীত পরিচালনায় প্রথম নেপথ্যে গাইলেন রবীন্দ্রসংগীত, ‘ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে’ সুপ্রিয়ার লিপে। খুবই সমাদৃত হল গানটি। আর এই গানের সূত্রেই সুমিত্রা বুঝতে পারলেন তাঁর প্রকৃত ক্ষেত্র রবীন্দ্রসংগীত। সামনেই রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী। ১৯৬১তেই বেরলো এককভাবে প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড: ‘ওগো সাঁওতালি ছেলে’ ও ‘দিনের পরে দিন যে গেল’ (জি ই ২৫০৮০)। অতঃপর রবীন্দ্রনাথের গানেই নিবেদিত হলেন। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন পর্যায়ের গানে তাঁর মধুর কণ্ঠ বিছিয়ে দিলেন। গায়নভঙ্গিও ভারি সাবলীল। অভিব্যক্তি আতিশয্যহীন। অতএব তাঁর পরিবেশনায় স্মৃতিধার্য হয়ে রইল— ‘তরীতে পা দিইনি’, ‘মেঘছায়ে সজল বায়ে’, ‘তুমি একলা ঘরে বসে বসে’, ‘দিনের বেলায় বাঁশি তোমার’, ‘জীবন আমার চলছে যেমন’, ‘আর নাই রে বেলা’, ‘মোর সন্ধ্যায় তুমি’ ইত্যাকার কত না গান। আর নিজের গলা, মেজাজ বুঝে তাঁর গান-নির্বাচনও তারিফ করার মতো। একটা সময় রেকর্ড গিয়ে এল ক্যাসেট, তার পর সিডি। তিনিও এইচ এম ভি ছাড়া পরে সাউন্ড উইং, সিম্ফনি, ই বি আই, আটলান্টিস কোম্পানিতে রেকর্ড করেছেন বহু রবীন্দ্রসংগীত। এইচ এম ভি থেকে প্রকাশিত লং-প্লে রেকর্ডে বিভিন্ন গীতিনাট্য, রবীন্দ্র গীতিআলেখ্যে অংশ নিয়েছেন। যেমন, ‘শ্যামা’-য় সখীর গান— ‘বুক যে ফেটে যায়’, ‘শাপমোচন’-এ ‘ভরা থাক স্মৃতিসুধায়’, ‘বর্ষামঙ্গল’-এ ‘স্বপ্নে আমার মনে হল’ ইত্যাদি। https://youtu.be/Ul9mQZX8aLE’শুন বরনারী’ ছবির নেপথ্যে রবীন্দ্রসংগীত সুমিত্রা সেনকে ঠিক পথের সন্ধান দিয়েছিল। তার পর প্রায় ১৪-১৫টি ছবিতে তিনি প্লে-ব্যাক করেছেন। একটি ছাড়া সবই রবীন্দ্রনাথের গান। সেই ব্যতিক্রমী অন্য গানটি হল ‘গৃহদাহ'(১৯৬৭) ছবিতে রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে প্রণব রায়ের লেখা ‘তুলসী তুলসী’। লিপ ছিল সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের। ঋত্বিক ঘটক ‘কোমলগান্ধার’-এ (১৯৬১) এক চমৎকার দৃশ্য রচনা করেছিলেন, যেখানে সুপ্রিয়া চৌধুরীর ঠোঁটে ছিল সুমিত্রার ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’। একইভাবে মন ছুঁয়ে যায় জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের সংগীত পরিচালনায় ‘কাঁচের স্বর্গ'(১৯৬২)-তে ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’, ভি. বালসারার সংগীত পরিচালনায় ‘ছায়াসূর্য'(১৯৬৩)-তে ‘মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে’ (সহশিল্পী: চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়), আলি আকবর খাঁর সংগীত পরিচালনায় ‘একই অঙ্গে এত রূপ’ (১৯৬৫)-এ ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’, রবিশঙ্করের সংগীত পরিচালনায় ‘স্বপ্ন নিয়ে'(১৯৬৬)-তে ‘সখী, ওই বুঝি বাঁশি বাজে’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সংগীত পরিচালনায় ‘নবরাগ'(১৯৭১)-এ ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে’ —এইভাবে উদাহরণ বেড়েই চলবে। তাঁর কণ্ঠ ও গায়ন চলচ্চিত্রের বিশেষ পরিস্থিতিতে তার মেজাজের সঙ্গে চমৎকারভাবে মিলে গেছিল। ‘ত্রিবেণী’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি করেছিলেন ১৯৫৯-তে। নানা জায়গায় এই সংস্থা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে। গানের পাশাপাশি অধ্যাপনা করেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রসংগীত বিভাগে। নানাবিধ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন: পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরস্কার (১৯৯৮), এইচ এম ভি লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট (২০০০), সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার (২০১২)। ১৯৫৩ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন অনিল সেনের সঙ্গে। তিনি স্ত্রীকে সর্বতোভাবে সহযোগ দিয়েছিলেন। দুই কন্যা, ইন্দ্রাণী ও শ্রাবণী, শিল্পীর যথার্থ উত্তরাধিকারী। মানুষকে চলে যেতে হয় অনিবার্য, কিন্তু থেকে যায় তার সুকৃতি। সুমিত্রা সেন রেখে গেলেন তাঁর মধুমাখা কণ্ঠের গান। মানুষের হৃদয়ে রইল সে-গান।
স্বপন সোম এ কালের বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ও সংগীত গবেষক। গান শিখেছেন মোহন সোম, মায়া সেন ও সুভাষ চৌধুরীর মতো কিংবদন্তীদের কাছে। দীর্ঘদিন ধরে 'দেশ' পত্রিকায় সংগীত সমালোচনা করেছেনl গান নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন 'আনন্দবাজার পত্রিকা', 'দেশ', 'আনন্দলোক', 'সানন্দা', 'আজকাল', 'এই সময়', 'প্রতিদিন' প্রভৃতি পত্রপত্রিকায়l