বাবার গল্প বলতে গিয়ে অন্য কথাও এল। জীবনী লেখা অবশ্য আমার উদ্দেশ্য নয়। ওঁর শৈশব ও কর্মজীবনের কথা অনেকটা ধরা আছে ‘উজান গাঙ বাইয়া’ বইতে। প্রণব বিশ্বাস এবং আরও অনেকে নানা জায়গায় লিখেছেন। ২০১২-তে শতবর্ষ উদযাপনের সময় পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও বাংলাদেশে নতুন করে লেখালেখি হয়েছে। আমার বোন রঙিলী বাবার জীবন নিয়ে নানা কাজ করছে। আমি ভাবছিলাম, টুকরো কিছু স্মৃতি কোথাও একটা লিখে রাখব। এরপর যদি ভুলে যাই! এই পত্রিকার আমন্ত্রণে সাহস পেলাম। এলোমেলো কথাও এঁরা ছাপবেন বলেছেন।
সত্তর-একাত্তর সাল এসে পড়ল। ‘দিকে দিকে তন্দ্রা টুটে যাওয়ার’ দিন। আমার বয়সটা কম হওয়াতে সেই ঘূর্ণীর মাঝখানে গিয়ে পড়িনি। কিন্তু যাদের তখন বিপ্লবের ‘দোদুল্যমান মিত্রশ্রেণি’ বলে কটাক্ষ করা হত তার সদস্য হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলছিলাম।
একদিকে নকশাল আন্দোলন, অন্যদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, এই দু’য়ে মিলে দফায় দফায় উত্তপ্ত করে তুলল দেশ। বাংলাদেশের ব্যাপারটা আগাম টের পাওয়া গেল দাদু-দিদিমার আবির্ভাবে। ‘৭০ সালের এক রাত্তিরবেলা আমাদের আজগর মিস্ত্রী লেনের বাড়ির সামনে একটা ঘোড়ার গাড়ি এসে থামল। অবাক হয়ে দৌড়ে গেলাম দেখতে। গাড়ি থেকে নামলেন আমাদের মাতামহ এবং মাতামহী, সঙ্গে সুটকেস ও পুঁটুলি! পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রামের বাঁশখালি থানার কোকদণ্ডী গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার অবিনাশ দত্ত আর তাঁর সহধর্মিনী কিরণময়ী। ঘোড়ার গাড়িটা কোথা থেকে পাওয়া গেছিল কে জানে। আমার বহু পোস্টকার্ডের “আদরের দাদু ও দিদু”-কে চর্মচক্ষে দেখতে পেয়ে ঘোড়ার কথা আর সেদিন জানতে চাইনি। তখন পূর্ব পাকিস্তানে পোস্টকার্ডে চিঠি লেখা যেত। আমার একমাত্র চিঠি লেখার লোক ছিল ওই চাঁটগা-বাসী দুই প্রবীণ, এবং বেশ মনে আছে, ওটাই ছিল ওদের প্রতি আমার সম্বোধন। মায়ের লেখা থেকে জেনেছি, ‘৬০ সালে দিদিমা একবার কলকাতায় এসেছিলেন (‘স্মৃতির মণিকোঠায়’)। সেবারে বাবাকে তিনি প্রথম দেখেন। আর খুব আবছা হলেও মনে আছে, ‘৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে মায়ের সঙ্গে চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। সেই থেকে পোস্টকার্ড লিখে চলেছি, ক্রমশ ভুলে গিয়েছি ওদের কেমন দেখতে। তারপর দু’জনে দেশত্যাগ করে পাকাপাকি এসে হাজির! আমার চিঠি লেখা বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের মেজমামা ছাড়া ততদিনে মায়ের সব ভাইবোন এপারে চলে এসেছে। যে-দেশটা ওদিকে পড়ে রইল সেখানে বছর না ঘুরতে আগুন জ্বলে উঠল।
ততদিনে নকশাল আন্দোলন তুঙ্গে। দাদু সাংঘাতিক ঝাল খেত, থালার পাশে বাটি-ভর্তি শুকনো লংকার গুঁড়ো নিয়ে খেতে বসত, এবং আমরা রান্না নিয়ে প্রতিবাদ করলে বলত, মাও সে-তুং বলেছেন, ঝাল না খেলে বিপ্লবী হওয়া যায় না। বাবা সিলেট, মা চট্টগ্রাম, আর আমি ঝাল খেতে পারি না, সেই ঘায়ে এইভাবে লংকার ছিটে দিত দাদু। কিন্তু ঘটনা হল, দাদুর ছোট ছেলে, আমাদের সবার প্রিয় মামা ভুলু, ততদিনে সত্যি নকশাল হয়ে গেছে। ওদের সবার বড় দিদি, আমার মা, দেশভাগের আগেই এপারে এসে লেখাপড়া শিখে চাকরি বাকরি করে ভাইবোনেদের মানুষ করায় হাত লাগিয়েছিল। এদের মধ্যে ছোটমামা অনেকটা আমাদের বাড়িতেই বড় হয়েছে। লেখাপড়া করত না, ফুটবল খেলত, ডাকাবুকো গোছের ছিল। অন্য মামা-মাসিদের মত ও বাবাকে ডাকত দাদাভাই, এবং একমাত্র বাবাকেই কিছুটা মেনে চলত। মামা বীরভূমের হেতমপুর কলেজে পড়তে গিয়ে চেয়ারম্যানের ডাকে সাড়া দিয়ে অ্যাকশনে নেমে গেল। সেই অ্যাকশন বস্তুটা কী, অনেকেই জানেন নিশ্চয়ই। এইসব কাণ্ড কানাঘুষোয় শুনে আমাদের মনে ছোটমামুর প্রতি শ্রদ্ধা আরও গভীর হল। শহিদ হলে ওকে নিয়ে কী কবিতা লেখা যায় সেটাও কিছুটা ভেবে রেখেছিলাম।
ছোটমামু মারফত বীরভূম জেলার নকশাল আন্দোলনের গান আমার কাছে এসে পৌঁছেছিল। মারাত্মক সব গান! একটার বাণী ছিল, “বড় সুখবর শুনিলাম বাঘা জোতদার মরিল নাকি/ গেরিলা কিষাণের ঘায়ে জোতদার মরিল নাকি”, ইত্যাদি। মামু সুরটাও তুলিয়ে দিয়েছিল। সে সময় জীবনের প্রথম ডায়রি আমার হাতে আসে। সে এমনই রোমহর্ষক ঘটনা যে ডায়েরিটার চেহারা আমার এখনও মনে আছেঃ পকেট সাইজের কিন্তু মোটা, কারণ প্রতিদিনের জন্যে একটা করে পাতা। ছাই রঙের রেক্সিনের মলাটে ছিট ছিট নকশা। রুল টানা পাতার উপরে হিজরি শকাব্দ অমাবস্যা পূর্ণিমা, নিচে আমার হস্তাক্ষরে এইসব ‘অ্যাকশনের গান’ লিখে রেখেছিলাম। আর লিখে রেখেছিলাম জোতদার খতমের সংখ্যা। এই কাজটা কে করতে বলেছিল মনে নেই, কিন্তু ‘দেশব্রতী’ পত্রিকায় শশাঙ্ক ছদ্মনামে লেখা সরোজ দত্তের কলাম পড়তাম মাঝে মাঝে। সেই কলামে, এবং ওই পত্রিকার অন্য পাতায়, জোতদার খতমের সুখবর পরিবেশিত হত, আরও খতম হোক এই আহবানও জানানো হত। সেখান থেকেই ডেবরা, গোপীবল্লভপুর ইত্যাদি অঞ্চলের খতম-সংবাদ সংগ্রহ করে আমি লিখে রাখতাম ক’জন গেল। আমাদের বাড়িতে একজন আসত যে মাঝে মাঝে জিগ্যেস করত স্কোর কত হল। কিছুতেই তার নাম মনে করতে পারছি না। ভাগ্যিস ‘দেশব্রতীর’ থেকে ‘শুকতারা’ বেশি পড়েছি, নাহলে কী যে হত কে জানে!
বাবা তখন সদলবল নিয়মিত অনুষ্ঠানে গাইছে। নতুন গান রচনাও চলেছে। ’৭০ সালে লেনিন শতবর্ষে বাবা ল্যংস্টন হিউজের লেনিন-কে নিবেদিত কবিতায় (বিষ্ণু দের অনুবাদে) সুরারোপ করেছিল। সেই সময়কার গানগুলোর মধ্যে ওটার কথা বোধহয় বিশেষ করে বলা উচিত। বেশ কিছু গান অনুবাদ করেছিল, যার মধ্যে ‘জন ব্রাউনের দেহ শুয়ে সমাধিতলে’ আর ‘জন হেনরি’র কথা আলাদা করে বলা যায়। খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ’৭২ আর ’৭৩-এ অনুবাদ করা এই দুই গান, বিশেষ করে দ্বিতীয়টা। চিনবিপ্লবের কিছু গানও বাবা অনুবাদ করে গাইত।
[রুশ দেশের কমরেড লেনিন’ ঃ সলিল চৌধুরীর ভূমিকা]
[হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কণ্ঠে ‘রুশ দেশের কমরেড লেনিন’]
চিনের প্রতি ওঁর পক্ষপাতের কথা আগেই বলেছি। ১৯৫৭ সালে চিনযাত্রার পর থেকে ওই দেশের প্রতি বাবার গভীর আগ্রহ জন্মেছিল। মূলত স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্যে দুই দেশের পার্টির উদ্যোগে সেবারে বাবা চিনে গিয়ে আড়াই বছর কাটিয়েছিল। চিনের নানা গল্প শুনতাম, আমাদের দেওয়ালে সিল্কের জড়ানো পটে বোনা চিনা নিসর্গ ঝুলত। একটা নকশা-তোলা কভার দেওয়া অ্যালবাম-ভর্তি ছিল চিনে তোলা প্রচুর ছবি, কাচের ঢাকনা দেওয়া শেলফে সাজানো থাকত চিনামাটির পেয়ালা আর প্লেট। প্রাণে ধরে সেসবে কাউকে আপ্যায়ন করা হয়েছে বলে মনে হয় না। ওর অনেকগুলো এখনও অক্ষত আছে। বাবার একটা টিনের ট্রাঙ্ক ছিল যেটা খুললে হরেকরকম চিনের জিনিস পাওয়া যেতঃ রেশমি স্কার্ফ, রেশমে বোনা ছবি, খাম আর লেখার কাগজ যার কোণে জলরঙে আঁকা বাঁশ গাছের ডাল, ফিনফিনে লাল কাগজে-কাটা সূক্ষ্ম ড্রাগন। জেড পাথরের এক ছোট্ট বুড়ো ছিল, যার অল্প হাঁ-করা মুখে টুকটুকে লাল জিভ দুলত। অন্য একটা দেশ যেন ওই ট্রাঙ্কের ভিতর বন্দি ছিল। তখন কজনই বা অন্য দেশে যেত! বাবা ওখানে ঠান্ডায় পড়ে একটা ওভারকোট কিনেছিল। সেই গাঢ় নীল ওভারকোট আমাদের কাঠের আলমারিতে ঝুলে ছিল দশকের পর দশক। দু’য়েকবার ওটার ভিতর ঢুকে দেখেছিলাম। সাংঘাতিক ওজন!

চিনে যাওয়ার সময় বাবার চালচুলো ছিল না। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্তর কেনার জন্যে চাঁদা তোলা হয়েছিল মনে হয়। কারণ, বাবার কাগজপত্রের মধ্যে পরে একটা চিঠি পেয়েছিলাম, বোম্বে থেকে চিত্র পরিচালক মণি ভট্টাচার্যের লেখা। লিখেছেন এক হাজার টাকা তুলে পাঠানোর কথা – চাঁদা দিয়েছেন দিলীপকুমার, বিমল রায়, সলিল চৌধুরী, হৃষীকেশ মুখার্জি, বলরাজ সাহানী প্রমুখ। ফেরার সময় বাবা অনেক উপহার নিয়ে এসেছিল যার অধিকাংশ ওই টিনের ট্রাঙ্কে সংরক্ষিত ছিল। একটা পুতুল ছিল, দুই বিনুনি-বাঁধা, ঢোলা পাতলুন আর ফুলহাতা শার্ট-পরা চিনা মেয়ে, যেটা আমার বোনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। ওই পুতুলকে মানুষ করে ও জীবনের প্রথম কয়েক বছর কাটায়। বাবাকে লেখা ওঁর চিঠি থেকে জানা যায়, চিনের পুতুল উপহার পেয়েছিলেন সুচিত্রা মিত্রও! আর সারাজীবনের সঙ্গী ছিল চিনা চা। হলুদ টিনের কৌটো থেকে গরম জলে সেই চায়ের পাতা ফেলে দিলে বার কয়েক জল ঢেলে খাওয়া যেত। ছুটির দিনে বেলা গড়ালে বাবা সেই চা খেত, পেয়ালায় ভাসত জুঁইফুল। কী করে ওই চায়ের সরবরাহ অত বছর বজায় ছিল জানি না, তবে এক একটা কৌটো অনেকদিন চলত, কারণ, বাড়িতে যারা আসত তারা দুধ-চিনি ছাড়া চা খাওয়ার লোক ছিল না।
চিনা বই ছিলো তাকে। তাতে ’৭০ দশকে নতুন সংযোজন হল ‘রেড বুক’, মাও সে-তুং-এর উদ্ধৃতির সংকলন। টুকটুকে লাল ভাইনল কভারে ঢাকা সেই বই বিনি পয়সায় বিতরিত হত। চটপট বিপ্লবের মন্ত্র শেখার পকেট-সাইজ রেড বুকের চেহারা ছিল খুব চিত্তাকর্ষক। প্রথম পাতায় লেখা থাকত, ‘একটি স্ফূলিঙ্গ দাবানল সৃষ্টি করতে পারে’। আর পাঁচটা কমিউনিস্ট বাড়ির মত আমাদের বাড়িতেও বুক-শেলফে সোবিয়েত সাহিত্য শোভা পেত। ম্যাক্সিম গোর্কির বই থাকতে হত, পাশে পাশে তলস্তয় প্রমুখও ছিলেন। তাছাড়া, ঝাড়াই জবাই করে সোবিয়েত পার্টি খাঁটি সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদী সাহিত্য বেছে দিয়েছিল। তার মধ্যে ছিল নিকোলাই অস্ত্রভস্কির ‘ইস্পাত’ আর বরিস পোলেভয়ের ‘মানুষের মত মানুষ’। মায়ের ক্লাসিক বাংলা সাহিত্য ভালো পড়া ছিল, তার সঙ্গে পড়ে ফেলেছিল এইসব বই। আমরা মাসতুতো ভাইবোনেরা গোল হয়ে বসে আছি, মা একটা বিরাট থালায় আলুসেদ্ধ ভাত মেখে গ্রাস করে করে আমাদের মুখে তুলে দিচ্ছে আর ‘ইস্পাত’ থেকে পড়ে শোনাচ্ছে, এমন এক গরমের ছুটির কথা মনে পড়ে।
সত্তরের গোড়ায় এর সঙ্গে যোগ হল চিনের পার্টি দ্বারা পরিশোধিত সাহিত্য। তার একটা নিদর্শন আমি নিজে থেকেই পড়ে ফেলেছিলাম, চিন চিং-মাই-এর লেখা উপন্যাস ‘বিপ্লবের গান’। তার ধাঁচা সোবিয়েত সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের থেকে আলাদা কিছু ছিল না। আলাদা হলে বই বা লেখক কেউ একটা জবাই হয়ে যেত। এসব দেখেশুনে কিছুদিন বাদে মনে প্রশ্ন এসেছিল, চিনে আর রুশে এত ঝগড়া তবে কী নিয়ে। ‘সোবিয়েত দেশ’ আর ‘চায়না পিকটোরিয়াল’ পত্রিকা দু’টো যেমন হুবহু একরকম ছিল। দুটোতেই শ্রমিক কৃষক সর্বদা হেসে চলেছে, খামারে উপচে পড়ছে ধান, কারখানা থেকে হাসতে হাসতে বেরোচ্ছে মজদুর। কিন্তু দুই দেশের ঝগড়া তখন চরমে। সোবিয়েত ইউনিয়নকে ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী’ বলে দাগিয়ে দিয়েছে চিন, ওরাও গাল দিচ্ছে চিনের নামে। বাবার, আর বাড়িতে যারা আসত তাদের কথা শুনে তখন মনে হয়েছিল, সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হল ‘রিভিশনিস্ট’ অর্থাৎ সংশোধনবাদী হওয়া। আরও অভিসম্পাত ছিল, যেমন ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ – যা নিজগুণে টিঁকে আছে। কিন্তু শোধনবাদী অপবাদটা এখন আর তত শোনা যায় না। তখন নকশালরা শুধু যে সিপিআই এবং সিপিএম-কে শোধনবাদী বলত তা নয়, যত উপদল ছিল তারা পরস্পরকে শোধনবাদী বলত। বাড়িতে যেসব লিটল ম্যাগাজিন আসত তার পাতায় শব্দটা আকছার দেখতাম। এর সঙ্গে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল আরেকটা শব্দ, অপসংস্কৃতি। ১৯৭২ সালে অসীম চক্রবর্তী প্রতাপ মঞ্চে উপস্থিত করেন ‘বারবধূ’। তারপর থেকে বহুদিন অপসংস্কৃতির পরাকাষ্ঠা হিসেবে ‘বারবধূ’র নাম করাটা রেওয়াজ ছিল। একই সময় গ্র্যান্ড হোটেল থেকে বিশ্বরূপা থিয়েটারে এলেন মিস শেফালি। অপসংস্কৃতির প্রধান তালিকায় যুক্ত হল ক্যাবারে নৃত্য। উত্তর কলকাতা অঞ্চলটা গোলমেলে হয়ে উঠল।
সেটা ছিল লিটল ম্যাগাজিনের সমৃদ্ধির সময়, গ্রুপ থিয়েটারেরও। আমাদের বাড়িতে যে নকশালপন্থীরা নিয়মিত যাতায়াত শুরু করল, তাদের অনেকের একটা করে ম্যাগাজিন ছিল। পত্রিকার সুবাদে অনেক সময় কে কোন উপদল তা চেনা যেত। ‘দেশব্রতী’র পাশাপাশি আর একটা পত্রিকা বেরোত কানাই চট্টোপাধ্যায়ের এমসিসি দলের পক্ষে, নাম ছিল ‘দক্ষিণ দেশ’। আমাদের বাড়িতে থাকত আমাদের আর এক মামা স্বপন। শোনা গেল সে ‘দক্ষিণ দেশ’ করে! ওই দলের সৃজন সেন আসতেন আমাদের বাড়িতে। ’৬৯ সালে লেনিনের জন্মদিনে কানু সান্যাল যে সিপিআই (এম এল) প্রতিষ্ঠা করলেন এঁরা সেই দলে ছিলেন না। লিটল ম্যাগাজিনগুলো এদের মত সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দিত না, কিন্তু নকশালপন্থীরা অনেকগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিল। বহরমপুরের ‘অনীক’ পত্রিকার লোকেরা বাড়িতে আসতেন। আরও একটু সংস্কৃতির দিকে ঘেঁষা ‘অনুষ্টুপ’-এর লোকেরা আসতেন। এই দু’টো নাম আগে মনে পড়ছে কারণ, অন্যেরা বহুকাল বন্ধ হয়ে গেলেও এরা আজও প্রকাশিত হয়ে চলেছে। ‘অনুষ্টুপ’এর সম্পাদকেরা ভাগ হয়ে গেলেন। একদল ‘প্রস্তুতিপর্ব’ নামে অন্য পত্রিকা বের করলেন, আদি পত্রিকায় রয়ে গেলেন আদি অকৃত্রিম অনিল আচার্য। এইসব পত্রিকায় বাবার লেখা বেরত মাঝে মাঝে। আমাদের বাড়িতে এদের আলোচনার মূল বিষয় ছিল রাজনীতি আর সংস্কৃতি। এই দু’টো জিনিস তখন আর আলাদা করে দেখা হত না। দু’টোকে মিলিয়ে দেখার অভ্যাস এখন যে সাধারণভাবে ছড়িয়ে গেছে তা বোধহয় ওই দশকের অবদান। পুরনো কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে তাত্ত্বিক নেতা খুব বেশি ছিলেন না। বাবার লেখা এবং কথায় মার্কসবাদী তত্ত্ব-আলোচনার ঝোঁক থাকত সবসময়। ওঁর বয়সী কেউ নকশাল আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন, সেটাও ছিল বিরল ব্যাপার।
পত্রিকার মধ্যে ভাগাভাগি ছিল সাধারণ ঘটনা, কারণ, বিপ্লবীদের মধ্যে ভাগাভাগি নিত্যকার ব্যাপার। স্প্লিট না করলে কোনও দেশের র্যাডিকালরা স্বস্তিতে থাকতে পারে না। পরে ইউনিভার্সিটিতে আমাদের এক নকশাল বন্ধু হয়েছিল, সে যে কোন ফ্যাকশন আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। শেষে ধরে নিয়েছিলাম যে ফ্যাকশনই হোক, তাতে ও একাই মেম্বার। সেজন্যে ওকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল সারা গায়ে যেন লিউকোপ্লাস্ট জড়িয়ে থাকে। ভাগাভাগির পাশাপাশি ছিল সন্দেহ বাতিক। বহু লোককে কারণে-অকারণে পুলিশের চর বলে সন্দেহ করা হত। বাবাকেও মাঝেমাঝে এমন কথা কারও কারও নামে বলতে শুনেছি। আর একদল ছিল যাদের বলা হত সিআইএ-র চর। এরা একটু ভদ্র গোছের দেখতে হত, ঠিক পাড়ায় ঘুরঘুর করবার মত নয়। কিছুদিন বাদে সন্দেহ ব্যাপারটা যখন আরও বিস্তার লাভ করেছে, তখন কিছু লোককে বলা হল কেজিবির চর। এদের অনেকের কথা ভাবলে খুব অবাক লাগে। এদের সিআইএ বা কেজিবি কেন চর হিসেবে নিয়োগ করবে বুঝে পাই না। করলেও নিশ্চয়ই পয়সা দিত না। এই চারদিকে পুলিশ, সিআইএ, কেজিবির চর থাকার জন্যেই বোধহয় লিটল ম্যাগাজিনে অনেকে ছদ্মনামে লিখত। সেই সব ছদ্মনাম দেখলেই ছদ্মনাম বলে বোঝা যেত। পদবী হত গুপ্ত, মিত্র, নামও হত তেমন। কিছু লোক এমন সব ছদ্মনাম ধারণ করে এদিক ওদিক কয়েকবার দেখে নিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকত। বাবাও চাকরির ঠেলায় ছদ্মনামে লিখেছে সেই সময়। ‘সাপ্তাহিক বসুমতী’-তে বাবার নাম ছিল মুরশিদ, ‘অনীক’-এ মোহন মুর্মু, ‘অনুষ্টুপ’-এ প্রবীণ বড়ুয়া। নাটকে যে সঞ্জয় সেন নামে সুর দিয়েছিল সেই গল্প আগেই বলেছি। আমিও আমার সেই উপদ্রুত ডায়রিতে ছদ্মনামে লিখব ভেবেছিলাম। কিন্তু তার আগেই ওটা খোওয়া গিয়েছিল।
আমাদের বাড়িতে সক্রিয় নকশাল কর্মীদের একটা ছোট দল ’৬৯ সাল থেকে আসত। স্থানীয় কমিটির সদস্য ছিল এরা, নেত্রী ছিল বিশাখা রায়, খুকুদি। ওই পাড়ায় বাবার বন্ধু বলতে ছিলেন বয়েসে ছোট শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায়, আমাদের মণিকাকা। আমাদের বাড়ি থেকে একটু এগিয়ে ‘নলিয়া ভিলা’ নামের দোতলা বাড়িতে থাকতেন। খুকুদি ওঁর ভাগ্নি। সেই লোকাল কমিটির আর দুই সদস্য ছিল দেবু বণিক আর প্রশান্ত ব্যানার্জি। এরা সবাই তখন অল্পবয়সি। আমাদের বাড়িতে ওরা মিটিং করত। মাঝেমাঝে বাবার অনুপস্থিতিতেও চলত সেইসব সভা। বাবা উপস্থিত থাকলে ওদের সঙ্গে আলোচনা হত, কখনও তর্ক হত, কিন্তু ওরা মা-বাবার স্নেহের পাত্র ছিল তা বুঝতাম। বাবা ব্যক্তিহত্যার লাইনের সমালোচক ছিল, সেসব নিয়ে তর্ক বাধত। ‘অতিবাম বিচ্যুতি’ কথাটা শোনা যেত বাবার মুখে। আর ওদের প্রতি বাবার নালিশ ছিল “যথেষ্ট পড়াশুনা কর না”। এই বকুনি শুনে আমার কোনও উপকার হয়নি, তরুণ বিপ্লবীদের হয়েছিল কিনা জানি না। কিন্তু ক্রমশ ওদের ঘিরে সবার দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকল। উল্টোদিকে কয়েকঘর গরিব বাসিন্দার ছেলেমেয়েদের ওরা পড়াত। হুমকি দিয়ে সেটা বন্ধ করে দেওয়া হল। তারপর ’৭১ সালে একদিন তিনজন পালিয়ে যায়। খুকুদির খোঁজে মণিকাকাদের বাড়িতে পুলিশ রেড করে। সেদিন ও বাড়িতে না থাকায় বেঁচে যায়। তারপর আর ফেরেনি বেশ কয়েক বছর। পুলিশের কালো ভ্যান আর সিআরপি, স্টেনসিলে ছাপা চেয়ারম্যানের মতোই রাজপথের শরীরে জড়িয়ে গেল। আমাদের বাড়িতে একটা সাইডব্যাগে কে যেন বেশ কিছু ‘দেশব্রতী’ আর একটা টিপ-ছুরি রেখে গিয়েছিল। ৭০ সালে ‘দেশব্রতী’ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। মনে হয় সেই সময়ে আমার ছোটমামার কীর্তি !
*
এরই মধ্যে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল। সীমানা পেরিয়ে আসা নতুন মানুষ আমাদের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করল। তাদের কথা পরের পর্বে বলব। (চলবে)
বাবার গল্প (পর্ব ১)
বাবার গল্প (পর্ব ২)
মৈনাক বিশ্বাস যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগে অধ্যাপনা করেন এবং মিডিয়া ল্যাব পরিচালনা করেন। চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতি বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ওঁর নানা প্রকাশনা রয়েছে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বই 'উজান গাঙ বাইয়া' (১৯৮৯, ২০১৮) ও 'গানের বাহিরানা' (১৯৯৮) সম্পাদনা করেছেন।
ধন্যবাদ মৈপাক।আগ্রহ নিয়ে তোমার লেখা পড়ছি ।সময়টা নতুন করে ভাবাচ্ছে আজ। ব্যক্তিগত ভাবে কিছু কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে ।পরের পর্ব অবশ্যই পাঠিও ।
Mainak…party gathon korbar sidhdhanta hoy 27 April 1969. Thik hoy Lenin er janmodin 22 April ke dhora habe party-r janmodin. 1 May 1969 Monument maiden theke Kanu Sanyal janosabhay ta prokashye ghoshona koren. Lekha khub bhalo hochhe. Likhe chalo bhai.
Ashoke Mukhopadhyay
Sorry sidhdhanta AICCCR er meeting e ja cholechhilo 19 theke 22 April 1969 (Souren Bose 27 April likhechhen..ota vul)..Announcement hoy 1 May 1969..announce koren Kanu Sanyal..sei meeting er sabhapati chhilen Asit Sen. Meeting hoyechhilo Monument Maidan e.
সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে…..
প্রতিবারেই পরেরটার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। দারুণ লাগছে !! পুরনো স্মৃতি জেগে উঠছে…