বড় অসুখে ডাক্তার-বদ্যি। কিন্তু, ছোটখাটো ‘হিরিহিরি পিরিপিরি’তে বায়ু–পিত্ত–কফ, এই তিনের বিচারে ছিল, বাড়ির টোটকা এবং ঘরবন্দিত্ব। তবে, মোক্ষম দাওয়াই ছিল, ‘সেরে গেলে ঠিক হয়ে যাবে।’ বিশেষত ঠাকুমা দিদিমারা প্রতিদিন এত রকম টোটকা শুধু  ছোটদেরই কেন, পারলে বাড়ি শুদ্ধু সবাইকে এমনিই খাওয়াতেন, যার নাম ছিল ‘খাদ্যাভ্যাস।’ তেতো দিয়ে শুরু করে, ঝাল-টক হয়ে মিষ্টিতে শেষ এবং যা পাওয়া যায় তাই দিয়ে, আর পরিমাণে অল্প। তাই, দু’একজন ‘রোগা’ শরীর ছাড়া, বেশিরভাগ শরীরে সর্বদাই সুখ বাস করত। কারণ, অসুখের বালাই কমই ছিল। অসুখের বাড়াবাড়িকে আমল না দিয়ে রোগীকেই চোখ রাঙিয়ে বলতেন, ‘এত বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু রোগও বাড়বে’ তাই, আমার আগের আগের পূর্বপুরুষরা কালাজ্বর, গুটিবসন্ত, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা আর টাইফয়েডে সাবাড় হয়ে গেলেও, আমরা সে সবে ভুগিনি। গল্প শুনেছি, আর মাঝে মাঝে ঠাকুমা দিদিমাদের দেখেছি আঁচলে চোখ মুছতে। মামার বাড়ির পাড়ায়, কালো দাদুর মা রোগের নজর এড়াতে ব্যাপক মস্তানি দেখিয়ে তাঁর তিন ছেলের নাম রেখে ছিলেন – নিমে (নিম), গিমে, কালো (কালমেঘ)– এইসব কড়া তেতো শাকের নাম দিয়ে। আবার রোগ তাড়াতে এই বুড়িরা শুধু যে দাওয়াই দিতেন তাইই নয়, তার সঙ্গে ফাউ হিসেবে থাকত ঘুম পাড়ানি গপ্পো এবং ছড়া     

লোকসমক্ষে সরবে এবং নীরবে, পাদুর দামামা ছিল এক বড় দায়। কর্তা-গিন্নি, ছোটবড়, এমনকি দুধের খোকা খুকুগুলিও। লজ্জাহীন বড়দের পাদুর রকমফের, ঠারেঠোরে বা ইঙ্গিতে বোঝাতে, নানা ছড়া মুখে মুখে ফিরলেও, বচ্ছরভোর মেথি–মৌরি দিয়ে ভেজানো মিছরির  জল আর বাড়িতে বানানো কাঁচা বেলের মোরব্বা বা আখের গুড় দিয়ে মাখা একদলা বেল পোড়া ছিল, একেবারে বাঁধা বরাদ্দআর শব্দহীন চাপা গন্ধে, নির্ভুল উৎস লক্ষ্য করে ফুটকাটা, ‘ধুপকাঠি না জ্বেলে, বাছার একটু চুনের জল খেলেই তো হয়।’ তাই ভোরবেলা খালি পেটে ইসবগুলের ভুসি, আর না হলে রাতে ভিজিয়ে রাখা একগ্লাস জলে এক চিমটি ভেজানো চুনের সর পড়া ট্রান্সলুসেন্ট জল। পেট খোলসা না হলে সারা দিন দমসম – সে এক বড় অসৈরণ।

মুড়ি আর ভুঁড়ি ঠাণ্ডা রাখার ইজারা নিতেন গিন্নিরা। তাঁদের মতে, বদহজমিরা নাকি সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে, আর একটু নার্ভাস প্রকৃতিরও হয়। আর দুধের খোকা খুকুদের পেট ফাঁপলে পানের বোঁটায় নারকেল তেল মাখিয়ে, তুলতুলে নরম পাছুতে একটু ঠেকাতে না ঠেকাতেই পেটপচা হাপিস। আবার কী! ছেলে ঘুমলো/পাড়া জুড়োল- আরাম তখন নতুন মায়ের চোখে মুখে। আর আমাদের মতো বুনো বালক বালিকাদের কেউ পাত্তাও দিত না। সবেতেই এক দোষ – ‘আবার কী বাধিয়ে এলে!’ খুব পেট ব্যথায় যখন মায়ের দেওয়া জোয়ানের আরক মানে ‘একোয়াটাইকোটিস’-এও কমতো না, ঠাকুমা তখন হাল ধরতেন। একচিমটি খাবার সোডায় একটা গোটা পাতিলেবু চিপে সেই ফেনা ওঠা তরল ঢক করে গেলাতেন। তারপর বিছানায় পেড়ে ফেলে পেটে খুব খানিক তেল জল মালিশ– নারকেল তেলে জল মিশিয়ে। আর মাঝে মাঝেই ডান পা এবং বাঁ পা পর্যন্ত তেলজলে ভেজা হাতটা, বদলে বদলে টেনে মালিশ করতেন আর বলতেন, ‘‘ইল্বল, ইল্বল-বাতাপি বাতাপি- যাহ!, বাঁ পা দিয়ে/ডান পা দিয়ে সব ভস্ম হয়ে যা।” ইল্বল আর বাতাপি এই নামের দুটো পাজি রাক্ষসের যে কোনও একটা ছাগল সেজে এসে লোকালয়ে ঘুর ঘুর করত। লোভে পড়ে কেউ তাকে কেটে খেলেই অন্যজন তখন বাইরে থেকে ‘ইল্বল, ইল্বল-বাতাপি বাতাপি’ বলে ডাকলেই সেই ছাগলরুপী রাক্ষস পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে, লোকটাকেই মেরে ফেলে দু’জনে মিলে ভোজ জমাত। কিন্তু একদিন ছাগল হয়ে একজন এক ব্রাহ্মণের পেটে ঢোকবার পর অন্যজন বাইরে থেকে যতই ডাকে, সে আর বেরোয় না। তখন অন্যজনও ছাগল হয়ে বামুনের পেটে ঢুকলে বামুন তাদের দু’জনকেই খেয়ে হজম করে ফেলল। আর নিজের পেট থেকে পা অবধি হাত বুলিয়ে বলতে লাগল, ‘ইল্বল, ইল্বল-বাতাপি বাতাপি– আমার এই দু’টো পা দিয়ে তোরা ভস্ম হয়ে যা।’ তাদের হজম করে ফেলে, বামুন আরামের ঢেঁকুর তুলেছিল। তাই এই গল্পটা শুনতে শুনতেই আমাদের চোঁয়া ঢেঁকুর উঠে পেট ব্যাথা কমে গিয়ে ঘুম এসে যেত। 

আমার ঠাকুমা পিলু আর বাবার জেঠিমা রাঙাদিদা ছিলেন স্বশিক্ষিত ‘কবরেজ’ আমাশার অব্যর্থ ওষুধ ছিল, ভাঙা পাঁচিলের বা শানের ফাটলের ফাঁকে ফাঁকে গজিয়ে ওঠা ‘দুধিয়া পাতা বেটে এক চা চামচ দইতে মিশিয়ে, একটি বাতাসা সমেত পর পর তিনদিন সেবন।’ কৃমি ঠেকাতে ‘শিউলি পাতার রস, পূর্ববৎ এক চা চামচ দইতে একটি বাতাসা সমেত পরপর তিনদিন সেবন।’ নানা মাপের সাদা ও কালো পাথরের খল নুড়ি ছিল এইসব পাতাপুতি দই বা মধু দিয়ে মেড়ে ওষুধ বানাবার জন্য। তবে ওষুধগুলি দেওয়ার জন্য বরাদ্দ ছিল চিনা মাটির ডান্ডি ভাঙা ছোট ছোট পেয়ালা– যেগুলো হেঁসেলেরই কোনও একটা তাকে রাখা থাকত, খলনুড়ির পাশেই একটা হাত-গামছা চাপা দিয়ে ফিক ব্যথাতেও ছিল তাঁদের সেই অব্যর্থ তেলজল মালিশ। তবে সেটা কিন্তু সর্ষের তেল। মালিশের শেষ মোচড়ে এসে তোতা পাখির মতো গুনে গুনে তিনবার তাঁর সঙ্গে বলাতেন- ‘বল নেই, বল নেই, বল নেই।’ কাজকম্মো সেরে গড়ানে সন্ধেতে চল্লিশ পাওয়ার আলোর নিচে বসে দুই মহিলার সে এক নাটকীয় মালিশ। আর বাতের ব্যথায় রেড়ির তেলে নিশিন্দে পাতা ফেলে মালিশ। এমনকি কাজের মেয়েদের হাতে পায়ের হাজা সারাতেও নারকেল তেলে বডি পাউডার মিশিয়ে একটা মলম বানিয়ে বলতেন, রাতে শোবার  আগে লাগিয়ে শুতে। আর পুজোর ঠিক পর পরই, নতুন জুতোর ফোস্কা সারাতে আমাদের বলতেন, ‘খালি পায়ে  দিনকয়েক হেঁটে, আবার জুতো পরে বিবি সেজো।’

আমরা ছোটরা সে সময় খুব কাবু হয়ে যেতাম টিকের ফোস্কায়। তখনও ইস্কুলে ইস্কুলে গুটিবসন্তের দু’টি করে গোল টিকা বাঁ হাতের ভেতর দিকে, কব্জি থেকে একটু ওপরে প্রতি বছর নিয়মিত দেওয়া হত। যাদেরটা না শুকিয়ে পুঁজ রক্তে ফেঁপে পেকে উঠত, তাদের সে বিকট অবস্থা দেখে কে! ঠাকুমা তখন পুজোর চন্দনের সঙ্গেই সাদা চন্দন একটু বেশি করে বেটে, মাঝে মাঝেই টিকেতে লেপে জ্যালজেলে গজ কাপড় জড়িয়ে দিতেন। তা সত্ত্বেও নানা উৎপাতে কী জ্বালানই না জ্বালাতাম ঠাকুমাকে! গরম কাল হলেই গায়ে গরম গোটা, প্যাঁচড়া আর ঘামাচি ছাড়াও থাকত ফোঁড়া, বিষফোঁড়া, লোমফোঁড়া, ফুসকুড়ির দাপাদাপি। কিন্তু সবের দাওয়াই ছিল ফটকিরি জলে স্নান আর কর্পূর জল পান। এবং আবার সেই চন্দনের প্রলেপ আর একগুচ্ছ পাতা সমেত নিমডালের সুড়সুড়ি।

ঘামাচিতে আবার চন্দন বাটার পরিশ্রম নয়। পিঠে-গলায়-ঘাড়ে স্রেফ মাখনের মতো মসৃণ গঙ্গা মাটি লেপাআর প্রথম বৃষ্টিতে লাফালাফি করতে করতে পারলে ন্যাংটো স্নান। তবে বড় ফোড়া ফাটানো হত, বোরিক পাউডার ফেলা গরম জলে কমপ্রেসের পর পুরনো ঘিয়ে নিমপাতা গরম করে সেই প্রলেপ লাগিয়ে। আর বাচ্চাদের ন্যাড়া হওয়া খুলিতে চট পোড়ার সঙ্গে ঘুঁটে পোড়ার ছাই মাখিয়ে ঘন চুল গজানোতেও তাঁদের বিশ্বাস ছিল অগাধ

ইস্কুল যাওয়া শুরু হলে রবিবার করে ঝাঁঝালো গন্ধের মতিহারি দোক্তাপাতা ভেজানো জলে নিয়ম করে চুল ধোয়া। উকুন আর খুস্কির প্রতিষেধক। তার আগে রিঠের জলে শ্যাম্পু। মরা আঁচে একটা অ্যালুমিনিয়মের হাঁড়িতে রোজ রিঠে আর শিকাকাই-চাকতি সেদ্ধ করতে বসানো থাকত তোলা কাপড় কাচা আর চুল ধোয়ার জন্যে। তবে ইতিমধ্যেই ভাগ্যিস মায়ের স্নানঘরে মিসেস সিম্পসন-এগ শ্যাম্পু ঢুকে পড়েছে! তবে কোনওদিন যে লাইসিল মাথায় দিতে হয়নি, তা ওই দোক্তা পাতার গুণে। আমাদের দৈনিক হাত পা কাটা, মচকানো এবং মাঝে মাঝে ভাঙার শুশ্রুষা ছিল গিন্নিদের ‘নিত্যকর্ম’ পদ্ধতির অন্যতম। চুন-হলুদ এক সঙ্গে মিশিয়ে এনামেলের বাটিতে একটু তাতিয়ে, আওরানো ফোলায় দু’একদিন লাগালেই মচকা, কোঁতকা, লাথির ঝাড়, হেঁচকা টান সব হাওয়া। কিন্তু ভাঙলে ডাক্তার। তখন হাড় ভাঙার পর প্লাস্টার এবং সেই প্লাস্টার খোলার পর সর্বশক্তি দিয়ে ডাক্তারবাবুর হ্যাঁচকা টান। বেশিরভাগ সময় তা আর আগের মতো সেট হত না। বাঁকাচোরা, এবড়ো খেবড়ো থেকেই যেত।

কিন্তু থ্যাঁতলানো বা খুচরো কাটা ছেঁড়ায়, টিঞ্চার আইডিন বা ডেটলের চিড়িক এড়াতে ছিল গাঁদা পাতার প্রলেপ। বাড়িতে তাই বলতামই না। যে কোনও বাড়ি থেকে পাতা ছিঁড়ে হাতে ডলে কাটায় লাগিয়ে নিয়ে আবার খেলা। আর বনেবাদাড়ে ঘুরে বিছুটি লাগলে, জ্বলতে জ্বলতে কয়েক ফোঁটা সর্ষের তেল ডলা হাত-পায়ের আঙুলে বা পায়ের তলায় কোথাও কাঁটা ফুটলে, ছুঁচের ডগাটা দেশলাই জ্বেলে পুড়িয়ে নিয়েই মাইনর অপারেশন। গলায় মাছের কাঁটা আটকালে কয়েক দলা ভাত কোঁত কোঁত করে গেলা। এসব খুব চটজলদি ছিল। যেমন রান্না করতে গিয়ে টুকটাক পোড়ায় বা তেল ছিটকানিতে গিন্নিরা সঙ্গে সঙ্গে আলু থেঁতো করে বা মাখা ময়দা থাকলে তার পুল্টিস লাগিয়ে নিতেননা ফোস্কা, না দাগ। চামড়া মোলায়েম হয়ে যেমনকার তেমন। তবে সন্ধ্যে হলেই গিন্নিদের তখন খুব মাথা ধরত। অবেলায় খাওয়া আর বিকেলে চুল বাঁধার সময় চ্যাটচেটে করে মাথায় খানিক তেল ঢালায় সম্ভবত। তখন ঘর অন্ধকার করে কপালের দু’দিকের রগে একটু কপ্পুর তেল বা ঘৃতকুমারির ঠান্ডা শাঁস লাগিয়ে চিৎপাত পড়ে থাকতেন সেই ব্যথাময়ী   

সে সময় সবচেয়ে উৎপাত ছিল সর্দি। নাকে পোঁটা নেই এমন বাচ্চা একটাও ছিল না। বড়রাও কাবু হতেন নাক দিয়ে কাঁচা জল ঝরায়। রাত্রে হয় গরম দুধে মধু আর হলুদ গুলে, না হয়তো খেজুর ডোবানো গরম দুধ এবং সকালে এক চা চামচ মধুতে দু’তিনটে তুলসি পাতা ডলে খেতে হতো। আর সর্দি ঝরা ঠেকাতে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরত একটা পুঁটলি। কালোজিরে ঠাসা। সেই পুঁটলি হাতের তালুতে ঘসে লম্বা শ্বাস নিলেই মাথা অবধি ঝনঝন করত ঝাঁঝে। বাপ বাপ বলে সর্দি পালাত। তবে নাকের চেহারাটা দেখতে হত ঠিক মুসুরির ডালের লালচে বড়ার মত টসটসে। এই চোরা ঠান্ডা লেগে মাড়ি ফুললে বা দাঁত ব্যথা করলে ‘মাজন’ (যাকে এখন বলি পেস্ট) অথবা লবঙ্গ থেঁতো করে গালে ঠুসে কথা বন্ধ করে থম। গালে বা টাগরায়  লাল ঠোসা উঠলে সর্ষের তেলে নুন মিশিয়ে দাঁত মাজা আর তিনবেলা গলাভাত ও একবেলা দুধ। জ্বর না এলেও খুব জ্বরঠোসা হত ঠোঁটের দু’কোণে। তখন মধু দিয়ে মেড়ে সোহাগার খই লাগিয়ে সারানো হত। সোহাগার খই আনতে যেতে হত স্যাকরার দোকানে। কোথাও একটু চিড়বিড় বা খচখচ, যেমন নাক বেঁধানো বা কান ফুটোর ব্যথা, সবেরই মুস্কিল আসান ছিল চুন। পরে তার জায়গা নিল লাল আর সবুজ ওষুধ – মারকিউরোক্রম এবং আ্যন্টিব্যাকট্রিন।

জ্বর দু’রকম হত। ঘুসঘুসে আর তাড়স। ঘুসঘুসে জ্বরে কাঁথা আর তাড়সের জ্বরে কম্বল মুড়ি। সঙ্গে দফায় দফায় পাঁচন। বচ, কাবাবচিনি, আদা, তুলসিপাতা আর লবঙ্গ গরম জলে ফুটিয়ে ফুটিয়ে সেই ক্বাথ মধু মিশিয়ে ‘ভোম্বলদাদার’ মতো সুক সুক করে সেবন। গলা ব্যথার আরাম। আর চারবেলাই দুধ সাবু। তাড়সের জ্বরে পাড়ার মানিক ডাক্তারের তৈরি জ্যামিতিক আল্পনার মতো দাগানো কাচের শিশিতে গোলাপি মিক্সচার। সকাল বিকেল, দিনে দু’বার। তারই সঙ্গে উষ্ণ জলে গা স্পাঞ্জ, মাথা ধোয়ানো, আর বার বার জামা বদল। তবে আসল নিরাময় হত টসটসে জ্বর মাখা গায়ে ইস্কুল থেকে ছুটি নেওয়া মায়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে শোনা সেই জ্বর আর মাকড়সার গপ্পে। জ্বর গেল চাষির বাড়ি। আর জমিদার বাড়িতে মাকড়সা। চাষি একদিন মোটে চাপাচুপি দিয়ে শুয়ে জ্বরে কেঁপে পরদিনই উঠে পড়ল। পান্তাভাত আর তেঁতুলের টক কষে খেয়ে কাস্তে নিয়ে রোদে পুড়ে, জলে ভিজে, ধান কাটতে লাগল। আর মাকড়সার ঝুল দেখেই কাজের লোক এসে জমিদার বাড়ি থেকে তাকে তাড়াল। জ্বর আর মাকড়সা তখন বিপদ বুঝে বাড়ি বদল করল। চাষির ঘরে ভাল করে জাল বুনলেও মাকড়সাকে কেউ আর তাড়ায় না। আর ওদিকে জমিদারবাবুকে জ্বর ধরতেই আপেল, বেদানা, ডাক্তার, ওষুধ সবেরই থরে থরে ব্যবস্থা হয়ে গেল। তাই জ্বর তাড়াতে জমিদার না হয়ে, আমাদের চাষি হওয়ার সখ জাগত। খেলা বন্ধ করে কতদিন আর দুধ সাবু খেয়ে কাটানো যায়!

অসুখে যেমন ওষুধ, তেমনি রোগ নিরাময়ে ছিল পথ্যি আর সাবধানতামুখের স্বাদ ফেরাতে ঘিয়ে সাঁতলানো গেঁড়ি গুগলি, টেংরির জুস, আদা গোলমরিচ দিয়ে ঘিয়ে ভাজা পাঁঠার মেটে, আলু মরিচ, সরষের তেলে কালোজিরে ফেলে পেঁয়াজ ভাজা, আর ফোড়ন দিয়ে সাঁতলানো ভাতের ফ্যান বা মুসুর ডালের জল। নতুন করে আবার যাতে ঠান্ডা না লাগে তাই ভাল করে তেল মালিশ, আর রাতে নাকে, কানে, গলায় তেল লাগিয়ে শুতে পাঠানো। বৃষ্টিতে ভিজে এলেই আবার ভাল জলে স্নান আর ছাল চামড়া তুলে বিশেষত মাথাটা মোছানো। পেট সুস্থ করে রুচি ফেরাতে বরাদ্দ হত লেবু চিনি দিয়ে মাখা ভাত আর পাতলা ঘোল। থানকুনি পাতা বাটা দিয়ে আলুভাতে মাখা, রাঙালু ভাতে, পেঁপে ভাতে, সেদ্ধ হিঞ্চে পাতা দিয়ে মাখা আলু ভাতে আর গাঁদাল পাতা দিয়ে পেঁপে কাঁচকলার ঝোল। এক ফোঁটা তেল ফেলে শিং মাগুরের ঝোলও – নুন হলুদ জলে সিদ্ধ করে। সঙ্গে জাউ বা খুদ ভাত। জাঁতি দিয়ে কটাস কটাস করে কাটা এক হাত ডান্ডার আখ দাঁতে ছাড়িয়ে চিবিয়ে খাওয়া– যত ইচ্ছে। নুন চিনি দিয়ে জরানো বাতাপি লেবু আর চিনি মাখানো ফুটি ও কাঁকুড় পেট ঠান্ডার অব্যর্থ ওষুধ। আর থাকত বাড়িতে বানানো (আহা!) আমলকির মোরব্বা এবং বিটনুন মাখানো চালতা চুর (চূরণ), যা সদলবলে চুরি করে খেলেই হজম হত বেশি। জন্ডিস বা ন্যাবা হলে হলুদ জলে সিদ্ধ বিচে কলার কচি কচি কাঁচকলা, সৈন্ধব লবণ দিয়ে মেখে খুদ ভাত, কাঁচা অড়হর পাতার রস, ছানার জল আর চিনি দিয়ে জ্বাল দেওয়া বার্লি। হলদেটে চোখ আর মাথা ঝিম ঝিম নিয়ে রোদে বেরনো, এমনকি ঘরের মধ্যেও ঘুর ঘুর পুরো বন্ধ। জোর করে শুয়ে শুয়ে শুধু বিশ্রাম।

আর ছিল কিছু চিররুগ্ণ মানুষ। হয় পেটরোগা, না হয় গা জ্বরজ্বর, না হয়তো অ-ক্ষিদে। কল বেরনো ছোলা মুগ, ছাতু, লেবু, মুড়ি কোনও কিছুই শরীরে জুত আনে না। তাদের ওই রোগা ভোগাদের দলে রেখে, সাদা সাপটা ঝোল ভাত, জলছানা আর কচি ডাব। এরা শুশ্রূষার বাইরে, সেবা নির্ভর। এদের জন্য তাই পথ্য বা নিরাময় নয় – সিম্পল মেইনটেনেন্স ডায়েট।  

প্রসূতিদের মা হওয়ার আগে এবং পরে, খাওয়া ও বিশ্রামের নানা ধর কাট মানা হত, যাতে  হাড়, ধমনী, ত্বক, মাথার চুল সবেতেই শিশুর বাড়বৃদ্ধি যথাযথ হয় এবং মায়ের শরীরেও ক্ষয় কমে গর্ভধারণ তো আর অসুখ নয়। খুব স্বাভাবিক এক পর্যায়। তাই যত্নআত্তি দিয়ে ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা। আর ‘মেয়েলি অসুখ’ – অর্থাৎ বাধকের ব্যাথায় ছিল গরম সেঁক-সহ কবিরাজি বোতলে, ‘অশোকারিষ্ট’ সেবন। আর রক্তাল্পতায় ভুগলে, ফ্যাকাসে জিরজিরে শরীর চনমনে করা হত মূলত কুলেখাড়া বা কুল্পো শাক সেদ্ধ করে ছাঁকা জল আর থোড়ের কাঁচা রস খাইয়ে। সঙ্গে সহজলভ্য নোনা মাছ, ডিম, ছানা এবং পাঁঠার মেটে সেদ্ধ। ফলে, খুব সহজেই এবং অল্প আয়োজনেই জীবন যাপনকে বেশ তাইয়ে তুইয়ে রাখা যেত। আর অসুখগুলিও হুটহাট করে না সারিয়ে, সময় নিয়ে, নিরাময় করা হত বলেই, শরীর আবার ভেতর থেকে  মজবুত হয়ে যেত।

আর তা না হলে, ধরেই নেওয়া হত, যে ‘ধাত’ – যা সকলের এক নয়। তাই কেনা ওষুধ বলতে তখন ঘরে ঘরে থাকলেও থাকত মারকিউরোক্রম, টিঞ্চার-আইডিন, আ্যন্ট্রিব্যাক্ট্রিন, ডেটল আর একটু বোরিক পাউডার। আর বেশি কাবু হলে পাড়ার ডাক্তারের দেওয়া লাল মিক্সচার যার শিশি ফেরত দিলে আটআনা দাম কম দিতে হত। আর কী আশ্চর্য, যে সে সময় পাড়ার একমাত্র এম.বি.বি.এস ডিগ্রিধারি, ডাকসাইটে ডাক্তারের নাম ছিল ‘গরল’! আর, তিনিও সেটা ‘এপিঠ ওপিঠ’ (এফিডেভিট) করে বদলাননি। এই জন্যেই কি তাঁর দেওয়া জীবনদায়ী ট্যাবলেটকে ঠাকুমারা সবাই মিলে সমস্বরে বলতেন, ‘ওষুধ তো নয়– বিষ বড়ি!’ তখনও ডাক্তারদের নাম ছিল, ‘মানিক’, ‘হরিকালী’, ‘গরল’ যা ক্রমে বদলাতে বদলাতে ডাঃ আর. এন. চ্যাটার্জি, ডাঃ ভট্টাচার্জি, বা ডাঃ সোম হয়ে গেল। তবে পুরনো চাল মেনে খড়দায় আমৃত্যু একজন এই সেদিনও ছিলেন– যিনি, সকলেরই ‘কিষাণ ডাক্তার’, যদিও তিনি সাবেক ডাক্তারদের সেই ট্র্যাডিশন অনুযায়ী, কোনওদিনই মিক্সচার দেননি। 

আজ  আমাদের ঘরে ঘরে প্রেসক্রিপশন। মাস তিনেকের বড়ির পাতা, টনিক, ইঞ্জেকশান, নানা পরীক্ষার রিপোর্ট ও অ্যামবুলেন্স চেপে হাসপাতাল এবং তারপরেও কিন্তু রোগের ভয়ই আমাদের নিত্যসঙ্গীখাটের পাশেই তাই শোভা পায় সুবিন্যস্ত এক ‘মেডিসিন পারলার’  ডাক্তারের দেওয়া, ওষুধের দোকানদারের দেওয়া, এর ওর কাছ থেকে জানা, এবং নিজের উৎসাহে দেশ বিদেশ থেকে আনানো ওষুধের এক বিপুল আয়োজন এবং রোগ নির্ভরতার অভ্যেস। কমবেশি সকলেরই প্রায় প্রেশার, সুগার, থাইর‍য়েড, কলেস্টোরল,বাত এবং স্মৃতিবিভ্রম। তাই জীবন সামলাতে অন্তত জেনারেল, মেডিসিন এবং স্পেশালিস্ট ডাক্তারদের নাম প্রায় জপমন্ত্র। নিয়মিত চেকআপের আরামে সামজিকতার সাক্ষ্য সাধ্যের অতীত এক ব্যয়ভার গাধার মতো টেনে চলতে যাতে না হয়, তাই সঙ্গের লেজুড় আবার মেডিক্লেম। আর এই সুরক্ষায় থাকতে চেয়ে আরও আরও আয়ের খোঁজে খানা এবং খন্দ পার হওয়া। সুস্থ ভাবে মরার জন্যেই যেন এই বাঁচা।  

তাই, ঠাকুমার সেই নানা সাইজের খল নুড়িগুলোতেই এখন আমি এ ঘরে-ও ঘরে একটু কুচো ফুল সাজাই আর তাঁর সেই আত্মবিশ্বাসী গলা স্মরণ করে, মনে মনেই তিনবার বলি– ‘নেই ,নেই, নেই।’   

Mandar Mukhopadhyay

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান।
ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।

4 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *