সরকারি নথি অনুযায়ী মেঘালয়ের এগারোটি জেলার অন্যতম পশ্চিম জয়ন্তিয়া হিলস্ জেলার সদর শহর। ২০১২ সালের ৩১ জুলাই সাবেক জয়ন্তিয়া হিলস্ জেলা ভেঙে পূর্ব এবং পশ্চিম জয়ন্তিয়া হিলস্ তৈরি হওয়ার আগেও জেলাসদর ছিল জোয়াই। শিলং থেকে শিলচরগামী সড়কের উপর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর এই জোয়াই। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে জোয়াই স্বাভাবিকভাবেই যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অবশ্যই প্রশাসনিক কাজকর্ম চালানোর উপযোগী জায়গা। এমনকী ব্রিটিশ আমলেও জোয়াই ছিল একটি স্বনামখ্যাত জনপদ।
১৮৭০-এর দশকে জয়ন্তিয়া পাহাড়ের লাকাডং এলাকায়, সিলেট সীমান্তের গ্রাম ‘লুম মুইয়ং’-এ শুরু হয়েছিল মাটি খুঁড়ে কয়লা তোলার কাজ। তখনকার নিরিখে কোনোরকম আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া, একেবারে প্রচলিত পদ্ধতিতে ১৮৭৭-৭৮-এ মাটির গভীর থেকে তুলে আনা হয় প্রায় ২ টন কয়লা। নৌকায় করে টিসাং নদী পেরিয়ে কিছু কয়লা সিলেটে পাঠানো হয়। আর বাদবাকি কয়লা খরচ করা হয় জোয়াই-তে বসবাসকারী সরকারি আধিকারিকদের বাড়ির কাজকম্মে। বছরশেষে হিসেবনিকেশ করে দেখা যায়, প্রকল্পটি মোটেও লাভজনক হয়নি। আর বাণিজ্যে লাভ না হলে সে প্রকল্পে ব্রিটিশ কেন, কোনো শিল্পসংস্থাই পুঁজি ঢালবে না। কাজেই বন্ধ হয়ে গেল জয়ন্তিয়া পাহাড় থেকে কয়লা উত্তোলন। তখন অবিশ্যি কেউ কল্পনাও করতে পারেনি, যে প্রায় একশো বছর পর জয়ন্তিয়া পাহাড়ের কয়লা স্থানীয় সমাজে নিয়ে আসবে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন। আর সেই আলোড়নের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠবে জোয়াই।
দেশের যে কোনো জমির তলদেশে খনিজপদার্থ, তা কয়লাই হোক বা লৌহ আকরিক, অথবা পেট্রোলিয়াম বা প্রাকৃতিক গ্যাস, যা-ই হোক না কেন, আইন মেনে সেই জমি তো বটেই, আশপাশের সমস্ত জমি, সাধারণ নিয়মে সরকার অথবা সরকার-নির্ধারিত সংস্থা অধিগ্রহণ করে। জমির মালিকরা কিছু ক্ষতিপূরণ পান। কোথাও কোথাও পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত করা হয়। তারপর গড়ে ওঠে খনি বা অন্য কোনো শিল্প। তবে সব জমির গভীরে কালো হিরে বা অন্য কোনো খনিজ সম্পদ পাওয়া যায় না বলেই এ বিষয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই।
মেঘালয়ের পরিস্থিতি কিন্তু ভিন্ন। সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল অনুযায়ী, মেঘালয়ে জমির মালিক একই সঙ্গে ভূ-স্তর এবং ভূ-গর্ভে সঞ্চিত যাবতীয় সম্পদের স্বত্ত্বাধিকারী। রাষ্ট্রীয় সংস্থা কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড কোনোদিনই মেঘালয়ের কয়লা নিয়ে চিন্তিত নয়। কারণ কোল ইন্ডিয়ার মতে, এখানকার কয়লার মান যথেষ্ট উন্নত না-হওয়ায় মেঘালয়ে কয়লা উত্তোলনে বিনিয়োগ লাভজনক নয়। কাজেই মেঘালয়ের কয়লার মালিক জমির স্বত্ত্বাধিকারী। আর সেই জমিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য স্বপ্ন অথবা স্বপ্নপূরণের কাহিনি। আবার সেই জমিতেই হারিয়ে গিয়েছে কত নাম না-জানা, পরিচয়হীন মানবসন্তানের শৈশব-কৈশোর।
কয়লার সঙ্গে মেঘালয়ের সম্পর্ক কমবেশি চল্লিশ বছরের। ১৯৭৯ নাগাদ মেঘালয়ে কয়লাখনির কাজ শুরু হওয়ার সময়, বছরে প্রায় চল্লিশ হাজার টন কয়লা উৎপাদিত হত।
পূর্ব এবং পশ্চিম জোয়াই হিলস্ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা জয়ন্তিয়া পাহাড়ের প্রায় সর্বত্রই মাটি খুঁড়লেই কয়লা পাওয়া যায়। তবে বাপুং, লাকাডং, লুম্পশং, মালওয়ার, মুসিয়াং, লামারে, মুতাং, শুতঙ্গা, জারাইন, ৎকেনতালাং, লোকসি, খলিয়েহ্রিয়াট ইত্যাদি এলাকা, কয়লার জন্য সুপরিচিত। অন্যান্য এলাকার তুলনায় এসব জায়গায় অনেক বেশি পরিমাণ কয়লা আছে, এমনটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। আবার অন্যান্য জায়গার তুলনায় এসব এলাকার কয়লার মান উন্নত বলে চাহিদা বেশি, এমনটাও বলা যাবে না। তাহলে এই অধিক পরিচিতির কারণ কী? আসলে, এই দশ-বারোটি এলাকায় কয়লা খননের কাজ বেশি হয় এবং তার মূল কারণ হল, উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। কোনোরকমে মাটি খুঁড়ে কয়লা নিয়ে এলেই ট্রাকে ভরে সরাসরি জোয়াই-তে পাঠিয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে। আর কয়লাভর্তি ট্রাক জোয়াই-তে পৌঁছলেই পূর্ণ হয় জমির মালিকের স্বপ্নের সচ্ছ্বল জীবন।
কয়লার সঙ্গে মেঘালয়ের সম্পর্ক কমবেশি চল্লিশ বছরের। ১৯৭৯ নাগাদ মেঘালয়ে কয়লাখনির কাজ শুরু হওয়ার সময়, বছরে প্রায় চল্লিশ হাজার টন কয়লা উৎপাদিত হত। ২০১৪ সালে সেই পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ষাট লক্ষ টনে। তারপরের হিসেব সরকারি দলিলে নথিভুক্ত হয়নি। কারণ, জাতীয় পরিবেশ আদালত বা ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের ১৭ এপ্রিল ২০১৪-র নির্দেশনামা অনুযায়ী, মেঘালয়ে কয়লা উত্তোলন নিষিদ্ধ হয়। এই নির্দেশ জারির প্রায় একমাস পরে, ৯ মে, ২০১৪-তে মেঘালয় সরকার তা কার্যকর করে এবং জানায় যে, এর ফলে বছরে প্রায় ছ’শো কোটি টাকা রাজস্বের ক্ষতি হবে। কারণ প্রতি টন কয়লার জন্য ৬৭৫ টাকা রয়্যালটি আদায়ের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে।
সরকার না হয় হিসেবনিকেশ কষে ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান তৈরি করতে পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষ? উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমির সুবাদে যাঁদের জীবনে জড়িয়ে গেছে অনাবিল স্বাচ্ছন্দ্য তাঁদের কী হবে? কৃষিজীবী এইসব প্রাচীন জনজাতির মানুষ যাঁরা খাতায়কলমে কয়লাখনির মালিক হলেও সত্যি সত্যিই তো শিল্পপতি নন! তাঁরা তো আর খনি থেকে কয়লা খুঁড়ে বের করার জন্য অর্থ বিনিয়োগ করেননি। আবার গায়ে-গতরে খেটে তাঁদের রোজগার করতে হয় না। অর্থাৎ সমাজ বিবর্তনের স্বাভাবিক ধারাবাহিকতায় তাঁরা কৃষিজীবী থেকে শ্রমজীবীতে রূপান্তরিত হননি। অথচ গত তিন-চার দশক ধরে তাঁদের হাতে এসেছে প্রচুর অর্থ। নগদ টাকা। আয়কর দিতে হয় না। কারো কাছে জবাবদিহির প্রয়োজন নেই। যাবতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জারিয়ে যাওয়া জীবনে অভ্যস্ত মানুষের কী হবে? কাঁচা পয়সার দাপটে যাঁরা শহরে বাড়ি করেছেন, গাড়ি হাঁকিয়ে চলাফেরা করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন তাঁদের হাল-হকিকতের খবর কে রাখে! তাঁদের অনেকের সন্তান এখন দেশে-বিদেশে পড়াশোনায় ব্যস্ত। সেই খরচা কে জোগাবে?
এইসব প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে যে কেন নিষিদ্ধ হওয়ার পরেও জয়ন্তিয়া পাহাড়ের কয়লার ব্যবসা এখনও সক্রিয়? কেন বাংলাদেশ সীমান্তের ডাউকি স্থল বন্দরে হঠাৎ করে ট্রাকের পর ট্রাক লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে? কয়লার দৌলতে জনজীবনে যে স্বাচ্ছন্দ্য স্বচ্ছলতা এসেছিল তা সাময়িকভাবে নিশ্চয়ই হোঁচট খেয়েছে বলে মনে হলেও জমির মালিকদের জীবনযাত্রার মান কি বদলে গেছে? তখনই প্রশ্ন ওঠে তাহলে সত্যি সত্যিই কি মেঘালয়ে কয়লাখনির কার্যকলাপ বন্ধ হয়েছে?
ছবি সৌজন্যে: Pinterest
প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।