সকালে ঘুম থেকে উঠে আজ বেশ ফুরফুরে লাগছে। অনেকটা সালভাদোর দালির মতো। ওঁর নাকি প্রত্যেকদিন ঘুম ভাঙলেই খুব আনন্দ হত এই ভেবে, যে উনিই সালভাদোর দালি! আমার প্রতিদিন এই সৌভাগ্য না হলেও আজ ভালই লাগছে। এই যে চোখ খুলেই বুঝতে পারা, আমার মতো আর কেউ নেই ধারেকাছে, স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি এই বিছানাতেই শুয়ে আছে যদিও, কিন্তু আমি বলছি মননের কথা, আর কন্ট্রোল। 

আমার মতো সম্মান আর কতজন পেয়েছে এ অঞ্চলে? অবিশ্যি ভয়ও পায়। ভয় না পেলে চলবে কেন? সমাজটাকে গুছিয়ে রাখতে গেলে হাতের মুঠি শক্ত করতে হবে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার দুটো সত্ত্বা। ব্রাশ হাতে (মানে টুথব্রাশ) আয়নায় আমি দালি! আর মাথায় রাগ চড়লেই মহম্মদ আলি! তখন সামনে যেই আসুক, পাঞ্চ খেতে হবে। জ্যাব, আপার কাট ইত্যাদি। প্রতিপক্ষ শুয়ে পড়লে ‘ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান’ ভাঁজতে ভাঁজতে আমি রাস্তার মোড়ে, পঞ্চার চায়ের দোকানে। নিজের মধ্যে নিহিত এই বৈচিত্রের কথা ভেবে শিহরণ জাগে।

কই আমার মা-বাবা, চোদ্দগুষ্টির কারও জিনে তো এই প্যাঁচ ছিল না! আয়নার সামনে দাঁড়ালে আমার মনে বারবার এই প্রশ্নই জেগে ওঠে। মাঝে মাঝে মনে হয় দুটো কেন, আরও কয়েকটা সত্ত্বা ঘাপটি মেরে আছে শরীরের আনাচে কানাচে। চায়ের ঠেকে এই বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণ করতে হবে আজ। 

সোশ্যাল মিডিয়া আর প্যানডেমিকের উৎপাতে বাঙালির চায়ের দোকানের আড্ডা খাটে উঠেছে প্রায়। পঞ্চা তা-ও যে চালাতে পারছে তার একমাত্র কারণ আমি। আমার কথা শোনার জন্যই সকাল সকাল যা ভিড় হয়। দু-চার পয়সার ব্যবসা হয় ওর। যদিও আমার কাছ থেকে কিছু নেয় না। মায় লেড়ো বিস্কুট পর্যন্ত ফোকটে। আমার সহধর্মিণী কিন্ত ট্যারাব্যাঁকা মন্তব্য করেন। বলেন, ওরা নাকি আড়ালে হাসাহাসি করে। আমি বলি, তুমি মহারানি ভিক্টোরিয়া হলে একথা বলতে না। উনি বলেছিলেন, পাবলিক আমাকে নিয়ে কী ভাবল, তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। আমি পাবলিককে কী চোখে দেখছি সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। ওফ… কী জীবনদর্শন! এইরকম বাণী ছুড়ে ছুড়েই আমি আজ পঞ্চার দোকানের একমাত্র কাঠের বেঞ্চির মধ্যমণি। আমাকে দেখলেই সবাই উঠে দাঁড়ায়। ত্রেতাযুগ হলে স্যালুট করত। 

Megalomaniac
অভিধানে যা রয়েছে…

আজ গান-বাজনা দিয়ে শুরু হল আড্ডা। গান মানে আমার গলায় টপ্পা। এক উঠতি ছোঁড়া চায়ের ডেকচি আর ছাঁকনি সহযোগে পারকাশন করছিল। মন্দ নয়। লেগে থাকলে উন্নতি হবে। তারপর তাত্ত্বিক আলোচনায় প্রবেশ। এই যে টিভিতে এতগুলো গানের কম্পিটিশন, তার এতগুলো চ্যাম্পিয়ন ফি বছর, তারা যায় কোথায়? আমি বোঝালাম। গান গাইতে পারাই তো শেষ কথা নয়, সেটা আসলে শুরু। মূল ব্যাপার হল মার্কেটটা বোঝা এবং ইন্ডাস্ট্রিকে হাতের মুঠোয় রাখা। অন্যরা কেমন গাইছে সে দিকে খেয়াল রাখা এবং তোমার সমকক্ষ কেউ মাথা চাড়া দিলে, তার গলা টিপে ধরা। 

আমি যদি ছোটবেলায় বুঝতে পারতাম আমার এই ট্যালেন্ট, তাহলে কি আর এখানে বসে চা খাওয়ার সময় পেতাম? তখন মুম্বইয়ে সমুদ্রের ধারে বাংলো আমার। সকালে ফাইন দার্জিলিং, সন্ধ্যেবেলা দু’পেগ স্কচ, রাতে এক চামচ ইসবগুল। দশ বছর বয়স থেকে প্লে ব্যাক করতাম, আশি বছরেও কেউ নড়াতে পারত না। অভিনেতা অভিনেত্রী চুল পেকে, দাঁত পড়ে বুড়ো-হাবড়া হয়ে যায়, আমার গলা তবু কোকিলসম। মাঝে মাঝে নিজের পুরনো গান শুনে নিজেই চমকে ওঠা। এই খ্যানখ্যানে গলা আমার? পরক্ষণেই ভুল ভাঙে। আরে এটা তো মামদো ভূতের ছবি। চিত্রনাট্য বুঝে মড্যুলেশন এনেছিলাম গলায়।

ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত আর ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকালের মেলবন্ধনের ব্যাপারে দু’চার কথা বলব ভেবেছিলাম, বাবলু এসে হাজির। ওর সম্প্রতি পিতৃবিয়োগ হয়েছে, কোভিডে। বেচারা একটু মুষড়ে পড়েছে। আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝালাম যে এতে ভেঙে পড়ার কিছু নেই। কোভিডে অনেকেই মারা যাচ্ছেন। প্রথম দিকে একটু ভুগলেও কয়েকদিন পর কোমরবিডিটি সংক্রান্ত জটিলতা একবার শুরু হলে পেশেন্ট অজ্ঞান। কষ্ট বোঝার আগেই নির্বাণ। 

কষ্ট পেয়েছিলেন বটে আমার বাবা। চার ধাম থুড়ি হাসপাতাল ঘুরেও বোঝা গেল না কী হয়েছে। প্রত্যেকদিনই যায় যায় অবস্থা। এইভাবে এক বছর টেনে দিল। চোখ কপালে ঠেকে গেছে, মুখ হাঁ, হাত-পা বেঁকে গেছে। কথা বলতে পারে না, শুধু গোঙানি।  আমার নিজেরই শরীর খারাপ হয়ে গেল ওই কষ্ট দেখতে দেখতে। শেষের দিকে আর হাসপাতালেও নিয়ে যেতে পারলাম না, বিছানা থেকে নড়াতে গেলেই কেলেঙ্কারি। ওই বিছানাতেই গেলেন। সবাইকেই তো যেতে হয়, না রে? তোর বাবা যে কষ্ট পাননি, সেই কথা ভেবে মনটা হালকা কর আর শ্রাদ্ধটা ভাল করে কর। যদিও আমি ওইদিন থাকছি না। তবে নিয়মভঙ্গের দিন অবশ্যই যাব। বাবলু ঘাড় নেড়ে বিদায় নিল। একটু আশ্বস্ত হয়েছে মনে হল। পঞ্চা এই রাউন্ডে আদা-চা বানিয়েছে। 

Megalomaniac 1
আমি যদি ছোটবেলায় বুঝতে পারতাম আমার এই ট্যালেন্ট…

চিনটু একটু দুঃখী দুঃখী গলায় বলল, ‘সত্যি, পৃথিবীটা কত বদলে গেল। আগের বছর কোভিড শুরু হল, এ বছর তালিবান।’ আমি একটু বিরক্ত হই। তোরা এই পৃথিবীর কিই বা দেখেছিস? না দেখে থাকলে অন্ততঃ পড়াশোনা কর। মূল সমস্যা হল, কোনও লিডার নেই ওই অঞ্চলে। আজ যদি থাকত নেপোলিয়ন কিম্বা আলেকজান্ডারের মতো কোন ধুরন্ধর, তাহলে তো এই অবস্থা হত না। ধরো-মারো-কাটো। তারপর নিজের পিঠ চাপড়াও। কেউ জ্ঞান দিতে এলে হয় গর্দান নাও, নাহলে দেশছাড়া কর। খুব সহজ সমীকরণ। নিদেনপক্ষে চার্চিল বা মাও জে দং হয়ে দেখাও। তা নয়, যত ঢং! 

এই একই কারণে আমাদের দেশেও কিছু হল না। ব্রিটিশরা যাওয়ার পর থেকে একেবারে অধঃপাতে। আমি যদি ক্ষমতায় থাকতাম, তাহলে আমাদের সবেধন নীলমণি ইমারজেন্সি টেনেহিঁচড়ে দশ বছর চালিয়ে দিতাম। যে ‘বার্নিং ট্রেন’ ছবি দেখে পাবলিক উত্তেজিত হল, দুনিয়া ছ্যা ছ্যা করল, আমি হলে সেই সিনেমা আরও সাতাশ রাজ্যে বাইশ ভাষায় রিমেক করতাম। ওয়াল্ট ডিজনি পিকচার্স,  আহা… সেই আমেরিকা। কী বুদ্ধি করে কাবুল থেকে চম্পট দিল! ওই একটিমাত্র দেশ, যেখানে আমার কদর করবে জনগণ। ভায়রা বলেছে, যে কোনও দিন চলে এসো। এই কথা শুনে দোকানে একটু শোরগোল শুরু হল, যেও না, যাবেন না … ইত্যাদি। আমি একটা লাল চা অর্ডার করলাম।

আসলে সত্যি বলতে কি, আমেরিকাই একমাত্র দেশ যাদের সব উদ্দেশ্যই মহৎ। কোনও হামবড়া ভাব নেই, কলার তুলে হাঁটা নেই, শুধু প্রকৃত ট্যালেন্টের খোঁজে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছে। ট্যালেন্ট থাকলে ডাক পড়বেই। সেদিন ভিডিও কলে ভায়রা তো স্পষ্ট বলল (যদিও ওয়াই-ফাই একটু বেগড়বাঁই করছিল), যে আমি না গেলে সেটা হবে আমেরিকার লস। আর আমেরিকার লস মানে যে আমাদের দেশ তথা সারা বিশ্বের লস, সে তো স্বতঃসিদ্ধ। 

তাই ভাবছি আর ভাবছি। পুজো কেটে গেলে একটা সিদ্ধান্ত নেব। ওই প্রজেক্টটা ভালভাবে উৎরোতে হবে। আমি প্রেসিডেন্ট কিনা। গতবছর খাওয়ার সময় সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মেইনটেইন করা হয়নি বলে আমি-ই বাজার গরম করে দিয়েছিলাম। তার ফলশ্রুতি নন্তুদার পদত্যাগ এবং এ অধমের সিংহাসন লাভ। এবারে হোম ডেলিভারি করব। ভেন্ডর ঠিক হয়ে গ্যাছে। ছোট শালা অনেকদিন স্ট্রাগল করছে। একটা সুযোগ দিয়েছি। এবার কিছু করে দেখাক। 

Megalomaniac 3
আমাকে ভয় না পেলে চলবে কেন?

একাগ্রচিত্তে পুজো নিয়ে ভাবছিলাম। পঞ্চার ডাকে ঘোর কাটল। ডিম-পাঁউরুটি এনেছে। বাকিরা কেটে পড়েছে। যতদিন ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ কানুন বলবৎ ছিল, সবাই এই দোকান থেকেই কাজ করত। এখন আবার কাছা ধরে দৌড়চ্ছে। সবে পাঁউরুটিতে একটা কামড় দিয়েছি, হাঁফাতে হাঁফাতে টিকলু এসে হাজির। বেকার। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ফুলটাইম পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট করেছি। মাঝে মাঝে সামান্য হাতখরচ দিই। তাতেই খুশি। জুতোসেলাই থেকে সহজপাঠ ওই করে। হয়তো ভেবেছে অদূর ভবিষ্যতে আমি পলিটিক্সে নামব। মন্ত্রী হব। তখন ও টু-পাইস কামাবে। আমেরিকার মতো এই ব্যাপারটাও ভাবনায় রেখেছি। 

টিকলুকে বললাম, মাস্ক নামিয়ে কথা বল হতচ্ছাড়া, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। এক দাবড়ানিতে ওর মাস্ক থুতনিতে। যা বুঝলাম, পুজোর মাঠে কোনও একটা টিভি চ্যানেল এসেছে, খুঁটিপুজো কভার করতে। প্রেসিডেন্টের বাইট চায়। সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে যেন ঝাঁ চকচকে ড্রয়িং রুম। কালো গগলস, খুঁটিতে হেলান দিয়ে জীবন মাহাত্ম্য বোঝাচ্ছি। সন্ধ্যেবেলা টিভির সামনে বসে পাড়াপড়শি চা ও চানাচুর সহযোগে দেখছে। যেন উত্তমকুমার…আই ওয়ান্ট টু গো টু দ্য টপ, টু দ্য টপ… টপটপিয়ে দুফোঁটা ঘাম পড়ল মনে হল। 

দাড়িতে হাত বুলিয়ে বুঝলাম বেশ বড় হয়েছে, তার ওপর পাকও তো ধরেছে। কামিয়ে নেব? টিক্লু আর পঞ্চা হাঁ হাঁ করে উঠল। বলল হেব্বি লাগছে। চল তাহলে… বেঞ্চি থেকে নামলাম। কিন্তু এক পাটি হাওয়াই কোথায় গেল? ধারেকাছে কোত্থাও নেই। আমি নিশ্চিত, এটা কোনও বেয়াদপ ছোকরার কাজ। অশিক্ষিত, অসভ্য। কোনও রেসপেক্ট দিতে শেখেনি। টিকলু বরং ভাল আইডিয়া দিল। বলল, মায়ের থানে যাচ্ছেন, খালি পায়ে গেলে ভক্তিভাব টিভি স্ক্রিন ফুঁড়ে উথলে উঠবে। কথাটা মনে ধরল। গলার গামছাটাকে মাস্ক বানিয়ে হাঁটা দিলাম।

 

*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Washingtonpost, Pixels

অনুব্রত নামী বহুজাতিক সংস্থায় অতি উচ্চপদে আসীন ছিলেন। কিন্তু মনে মনে এখনও স্কটিশের সেই লেখা-পাগল ছাত্রটি। লেখালিখি তাঁর হাড়ে-মজ্জায়। নিয়মিত লেখেন পত্রপত্রিকায়। শখ, সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো আর ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *