“আচ্ছা, মহাশূন্যে তাহলে কীভাবে ভর মাপা যাবে কাকাই?” ঘুগনি খেয়ে নিয়ে পাতাটা ফেলতে ফেলতে জিজ্ঞাসা করে রুমকি।
কাকাইও ঘুগনি শেষ করে রুমাল দিয়ে মুখ মুছছিলো। রুমকির প্রশ্ন শুনে বললো, ” হ্যাঁ রে, বাড়ি ফিরে পড়তে বসতে হবে তো তোদের? দেরি হয়ে যাবে না? বকুনি খাবি না তো বাড়ি ফিরে?”
পাপাই ঘুগনিটুকু খেয়ে নিয়ে মন দিয়ে ঘুগনির পাতাটা চাটছিলো। কাকাইয়ের প্রশ্ন শুনে মুখ তুলে বললো, “না, না, আঁকার ক্লাস সাড়ে ছটা থেকে, রুমকির বাড়িতে। বাড়ি থেকে ব্যাগটা নিয়ে চলে যাব একেবারে। তুমি বলো না, ভর মাপার আর কী সিস্টেম আছে বলছিলে…”
কাকাই চট করে একবার হাতঘড়িটার দিকে দেখে নিয়ে বলে, “আচ্ছা, চ ঐ বেঞ্চটায় বসে বলার চেষ্টা করছি।”
“আবার চেষ্টা করাকরির কী আছে, কাকাই! তোমার কি তাড়া আছে নাকি?” রুমকি প্রশ্ন করে।
বেঞ্চে বসে কাকাই বলে, “আমার তাড়া নেই। তবে তোদের ফিরতে হবে তো… তাছাড়া এই ব্যাপারটা খুব ছোট করে বলতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে না যায়। যাই হোক… ধর, একটা ফুটবল তোদের দিকে গড়িয়ে আসছে, থামাতে পারবি?”
দুজনেই সমস্বরে বলে, “হ্যাঁঅ্যাঅ্যাঅ্যা…।”
“আর যদি একই বেগে একটা মালগাড়ি আসে, তখন পারবি?”
“সুপারম্যান পারবে,” রুমকি বলে।
“স্পাইডারম্যানও পারবে,” পাপাই যোগ করে।
“সে না হয় হল, তোরা পারবি কি?” কাকাইয়ের প্রশ্নে দুজনেই ঘাড় নাড়িয়ে না বলে। “কেন পারবি না সেটা বলতে পারবি?”
“মালগাড়ি অনেক বড় আর ভারী বলে?” পাপাই বলে।
কাকাই কিছু বলার আগেই রুমকি বলে ওঠে, “কারণ মালগাড়ির ভর বেশী। তাই না?”
“ঠিক বলেছিস রুমকি,” কাকাই রুমকির পিঠ চাপড়ে দেয়। “দেখ পাপাই, ধর একটা জিনিস খুব বড় অথচ তার ভর কম, যেমন ধর শোলার তৈরি একটা বেশ বড় সাইজের বল, সেটা গড়িয়ে এলে হয়তো তুই সহজেই থামিয়ে দিতে পারবি। কিন্তু তার চেয়ে অনেক ছোট সাইজের লোহার একটা বল যার ভর বেশী সেটা একই বেগে তোর দিকে এলে তোর থামাতে অসুবিধে হবে। আর এটা যে তার ভার বা ওজনের জন্য হচ্ছে তাও নয়। কারণ এমন কোন জায়গায় যদি যাস যেখানে ভার মানে ওজন শূন্য বা আমাদের এখানের থেকে আলাদা সেখানেও তাই হবে। একই ভাবে যদি থেমে থাকা জিনিসপত্র নড়ানোর চেষ্টা করিস সেক্ষেত্রেও যেগুলোর ভর কম সেগুলো সহজেই নড়াতে পারবি…”
“আর ভর বেশী হলে অসুবিধে হবে,” কাকাই শেষ করার আগেই পাপাই বলে দেয়।
“হ্যাঁ, আর ভর খুব বেশী হলে সুপারম্যান, স্পাইডারম্যানদের ডাকতে হবে। তার মানে দেখ, কোন স্থির জিনিসকে স্থির অবস্থা থেকে নড়াতে গেলে বা সোজা একই বেগে চলতে থাকা জিনিসের এই চলার পরিবর্তন করতে গেলে, সেটা সহজ হয় জিনিসটার ভর কম হলে আর কঠিন হয় ভর বেশী হলে।” কাকাই একটু থেমে ওদের প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করে।
রুমকি ভুরু কুঁচকে শুনছিল। কাকাই থামার পরে আস্তে আস্তে বলে, “জাড্যর ব্যাপারটা বলার সময় তো এরকমই অনেকটা বলেছিলে না?”
পাপাইয়ের মুখ চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। চটপট বলে ওঠে, “থেমে থাকা জিনিসের থেমে থাকতে চাওয়া বা চলতে থাকা জিনিসের একইভাবে চলতে থাকতে চাওয়াকেই তো জাড্য বলে। তাহলে কি জাড্যর সাথে ভরের কোন সম্পর্ক আছে?”
“একদম। ভরই হল জাড্যর পরিমাপ। যার ভর যত বেশী, তার জাড্যধর্মও তত বেশী,” কাকাই বলে।
“তাহলে মহাশূন্যে কি…?” রুমকি প্রশ্নের মাঝপথে থেমে যায়।
“যে বস্তুর ভর জানা তার ওজনের সাথে কোন অজানা বস্তুর ওজনের তুলনা করে যে ভর মাপা হয় তাকে বলে মহাকর্ষীয় ভর বা gravitational mass। পৃথিবী যে আমাদের টানছে বা সূর্য যে পৃথিবীকে টানছে এটা হচ্ছে মহাকর্ষ বল বা gravitational force এর জন্য। mass মানে হল ভর। আর কোন বস্তুর ওপর একটা আগে থেকে ঠিক করা জোর খাটিয়ে নাড়িয়ে-চাড়িয়ে তার যে ভর মাপা হয় তাকে বলে inertial mass বা জড়ত্বীয় ভর। কারণ এটার সঙ্গে তার জাড্যধর্ম বা inertia-র সম্পর্ক আছে। এই দ্বিতীয় পদ্ধতির সাহায্যে মহাকাশে ভর মাপা যায়,” এতটা বলে আরেকবার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে নেয় কাকাই।
“এই দু’ধরনের ভর কি একই, কাকাই?” পাপাই প্রশ্ন করে।
“খুব ভাল প্রশ্ন করেছিস। এই প্রশ্নটা বছরের পর বছর বিজ্ঞানীদের ভাবিয়েছে। আপাতত জেনে রাখ যে দুটোই সমান। এবার কিন্তু বাড়ি ফিরতে হবে, নইলে আবার তোদের আঁকার ক্লাসে দেরী হয়ে যাবে। কিছু কিছু ব্যাপার আজ ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেলাম। পরে সময় পেলে নিশ্চয়ই সেগুলো নিয়ে আবার গল্প করবো,” বলে কাকাই বেঞ্চ থেকে উঠে পড়ে। পাপাইও উঠে দাঁড়ায়।
“আচ্ছা মহাশূন্যে যে, কোন জিনিসকে নাড়িয়ে-চাড়িয়ে তার ভর মাপে বললে, সেখানে কি জিনিসটা কতটা নড়ছে সেটা দেখেই ভর মাপা হয়?” রুমকি বসে থেকেই প্রশ্নটা করে।
“কতকটা সেইরকমই। আর একটু খোলসা করে বলার আগে আরও কয়েকটা ব্যাপার নিয়ে বলতে হবে যে। বুঝতে পারছিস তো জাড্য, ভর, ওজন এইসব বিষয়গুলোর নিজেদের মধ্যে কীরকম যোগাযোগ? এখনও অবদি যা জানিস সেগুলো নিয়ে ভাববি আর দেখবি সব মিলছে কিনা। খটকা লাগলে প্রশ্ন করবি। সব প্রশ্নর উত্তর হয়তো সঙ্গে সঙ্গে পাবি না। কিন্তু প্রশ্ন করা থামাবি না। কেমন? আজ উঠে পড়, আমাদের আলোচনা চলতে থাকবে।”
রুমকি আস্তে আস্তে উঠে পড়ে। তারপর তিনজনে বাড়ির পথে এগিয়ে যায়।
জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ভাটপাড়ায়, স্নাতক স্তরের পড়াশোনা কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। বর্তমানে বোস ইন্সটিটিউটে পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণারত। সিনেমা, গান এবং ফুটবল নিয়ে সময় কাটাতে ভালোবাসেন।