আমাদের ছোটবেলায় বন্ধুদের মধ্যে বিনিময়ের প্রধান মুদ্রা ছিল দুটি। খুচরো বিনিময়ে বাবলগাম, আর বড়সড় লেনদেনে চাচা চৌধুরীর কমিকস। যাদের কাছে ইন্দ্রজাল কমিকসের অরণ্যদেব বা ম্যানড্রেক থাকত, তারা সবসময়ই প্রথমে ব্যাট করত এবং তাদের ফিল্ডিং দিতে হত না। তাই, প্রথম এক প্রচওওন্ড বড়লোক বন্ধুর বাড়িতে (মানে তাদের গাড়ি, জেনারেটর, কালার টিভি আর কুকুর, চারটেই ছিল) যখন প্রথম সুপারম্যানের ইংরিজি কমিকস দেখি, তখন আধমিনিট হ্যাংলার মতো দাঁড়িয়েই ছিলাম। বইগুলো ছিলো কাচ দিয়ে ঢাকা একটা তাকে। হাতে ধরতে চাওয়ারও সাহস হয়নি।
তখন আমার বয়স সাড়ে নয়।
এমনই কপাল, যে এর ক’দিন বাদেই কাগজে দেখি আনন্দমেলার আগামী প্রচ্ছদকাহিনি সুপারম্যানকে নিয়ে। যেভাবে মাকে জপিয়ে তখন আনন্দমেলার গ্রাহক হয়েছিলাম, গান্ধীজির লবণ সত্যাগ্রহের পর সেরকম আন্দোলনের তুলনা ভূ-ভারতে আছে বলে মনে তো হয় না। প্রথম সেই আনন্দমেলা হাতে পাওয়ার পর গোগ্রাসে গিলেছিলাম সেই প্রচ্ছদকাহিনি।
এই কথাগুলো আজকের ডিসি-মার্ভেল নিয়ে আলোচনায় টেনে আনার একটাই কারণ। উপরের কারণেই হয়তো, সেই কিশোরবেলায় সুপারম্যানের যে ছবি আমার মনে গড়ে উঠেছিল, সেটা প্রায় ঐশ্বরিক। এবং অদ্ভুত ব্যাপার, যে পরবর্তীকালে, এক ব্যাটম্যান ছাড়া সেইরকম বিশালতার অনুভূতি আর কোনও সুপারহিরোর ক্ষেত্রে হয়নি। আমার ধারণা ছিল, ব্যাপারটা নেহাতই কাকতালীয়। কিন্তু, বহুদিন বাদে যখন ডিসি, মার্ভেল, তাদের মিল, অমিল, আড়ি, ভাব- ইত্যাদি সম্বন্ধে টুকটাক পড়াশোনা করি, তখন একটা তথ্য জানতে পেরে বেশ অবাক লাগে। ডিসি এবং মারভেল সুপারহিরোদের মধ্যে একটা প্রধান পার্থক্যই হল, আদত ডিসি সুপারহিরোদের (সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, ওয়ান্ডার উওম্যান, গ্রিন ল্যান্টার্ন, মারশিয়ান ম্যানহান্টার, ইত্যাদি) মধ্যে এই ঐশ্বরিকতার প্রভাব মারভেল সুপারহিরোদের (স্পাইডারম্যান, হাল্ক, আয়রনম্যান) চেয়ে বেশ কিছুটা বেশি।

ব্যাপারটা বিশদ করব। কিন্তু, তার আগে ডিসি আর মার্ভেল খায় ব্যাপারটা কী, সহজ কথায় বোঝানোর চেষ্টা করছি। এককথায়, ডিসি ও মার্ভেল এগুলি আদতে হল মার্কিন কমিক বুকের দুই প্রকাশক। মানে ধরুন, আমাদের ডায়মন্ড বা ইন্দ্রজাল কমিকসের বড়দা। কিন্তু, এটুকু বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না। বর্তমানে, কমিকস ছাড়াও, খেলনা, পুতুল, চলচ্চিত্র প্রযোজনা, ওয়েব সিরিজ় ইত্যাদি আরও বহুবিধ ব্যবসা মিলিয়ে এদের দুয়েরই বাজারদর হবে অর্বুদের কোঠায়। বলা যেতে পারে সারা বিশ্বের কমিকসের ক্ষেত্রে বাজারদর হিসাব করলে এরাই ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান। বলা বাহুল্য, এদের লক্ষ লক্ষ কট্টর সমর্থক ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের সমর্থকদের মতোই পরস্পরকে চরম অপাংক্তেয় জ্ঞান করেন।
এবার আসি ডিসি আর মারভেলের সুপারহিরোদের ঐশ্বরিকতার কথায়। এই বিষয়ে অনেক প্রমাণ পণ্ডিতেরা দাখিল করেন, তবে এখানে আমরা তার দু‘একটা নিয়েই আলোচনা করব। সুপারম্যানের ক্ষেত্রে বুকে লেখা ‘S’ ছাড়াও দুটো জিনিস আমায় প্রথমেই খুব অবাক করেছিল। এক, পোশাকের উপর অন্তর্বাস। আর দুই, ঘাড় থেকে ঝুলন্ত ওই অত্তবড় চাদর বা কেপ। দ্বিতীয়টা লড়াই ঝগড়ায় যথেষ্ট অসুবিধাজনক, আর প্রথমটা দৃশ্যতই অত্যন্ত হাস্যকর। কিন্তু কথা হচ্ছে, জেরি সিগাল এবং জো শাস্টারই বা এমনভাবে কল্পনা করলেন কেন তাঁদের সুপারহিরোকে? মানলুম তাঁরা তখন সবে তরুণ, কিন্তু, মার্কিন তরুণরা তখন প্যান্টের উপর জাঙিয়া পরে নিশ্চয় ঘুরতেন না।

আসলে এর উৎস নিহিত, পশ্চিমের চেতনার আরও অনেক গভীরে। প্রতীচ্যের সভ্যতায় সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বা দেবদূতের দৃশ্যকল্পটা এসেছে প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা থেকে। পুরুষতান্ত্রিক গ্রিক সমাজে নিখুঁত মানুষ এবং বকলমে ঈশ্বরের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়ান প্রাচীন গ্রিসের যোদ্ধাদের জন্য অনুষ্ঠিত অলিম্পিক বিজয়ীরা। তখন সেখানে খেলোয়াড়দের পোশাক ছিল শুধু অন্তর্বাস। এবং জয়ীর কাঁধে পরিয়ে দেওয়া হত সাদা বা লাল উত্তরীয়। সেই পোশাকে, কোমরে হাত দিয়ে পা ফাঁক করে দাঁড়ানো, পিছনে চাদর ওড়া- উদীয়মান সূর্যের সামনে এই পোশাকে এক পেশিবহুল পুরুষের যে সিল্যুয়েট, সেটাই পশ্চিমের অবচেতনে রয়ে গেছে ঈশ্বরের দৃশ্যকল্প হিসেবে। সেটাই ফোটাতে চেয়েছিলেন সিগাল ও শাস্টার।

কিন্তু ১৯৩৮ সালের আমেরিকায় ঈশ্বরপ্রতিম ‘সুপার’ পুরুষকে শুধু অন্তর্বাস পরানোর সাহস হয়নি তাঁদের। তাই ওই গাঢ় নীল রঙের চামড়া-আঁটা জামার উপর স্পষ্ট বৈপরীত্যে টকটকে লাল অন্তর্বাস ও চাদর। আসলে সুপারম্যানকে আশা, আলো এবং উজ্জ্বলতার প্রতীক করতে চেয়েছিলেন সিগালরা। সেই জন্যেই এত উজ্জ্বল রঙ। আবার, সুপারম্যানের জনপ্রিয়তার সঙ্গে পাল্লা দিতে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী সুপারহিরো হিসেবে যখন ১৯৩৯ সালে ব্যাটম্যানের সৃষ্টি করলেন আর এক কিংবদন্তী বব কেন, তখন তাকে বানালেন অন্ধকারের অংশ, দিলেন বাদুড়ের মতো পোশাক। পোশাকের রংও হল মানানসই- ধূসর, গাঢ় নীল আর কালো মেশানো। কেপ জড়ানো সিল্যুয়েটটা কিন্তু দাঁড়াল অনেকটা আনুবিসের মতো, যিনি কিনা প্রাচীন মিশরের মৃত্যুর দেবতা, অপরাধীদের কাছে কৃতান্ত, বা নেমেসিস-এর মতো। এমনকী, সেই চামড়া-আঁটা পোশাকের উপর জাঙিয়ার আপাতহাস্যকর বৈশিষ্ট্যটাও রয়ে গেল অত ‘ডার্ক’ এক সুপারহিরোর মধ্যে। এঁরা ছাড়াও মঙ্গলগ্রহের অধিবাসী মার্শিয়ান ম্যানহান্টার যখন পৃথিবীর উপযোগী সুপারহিরোর পোশাক পরেন, সেটাও ওই সিল্যুয়েটের অনুকরণে।
শুধু পোশাকই নয়, ডিসি সুপারহিরোদের আদিতেও পাওয়া যায় মহাজাগতিক বা পৌরাণিক অনুষঙ্গ। যেমন ওয়ান্ডার উওম্যান প্রাচীন আমাজনদের শেষ বংশধর। গ্রিন ল্যান্টার্ন সমগ্র মহাবিশ্বের শান্তিরক্ষক গ্রিন ল্যান্টার্ন কর্পের সদস্য। অ্যাকোয়াম্যান হলেন সমুদ্রের তলায় লুপ্ত শহর আটলান্টিসের সম্রাট, ইত্যাদি। এককথায়, এঁরা অধিকাংশই আগে যা-ই থেকে থাকুন, এখন যেন মানুষের থেকে আলাদা। এবং মানবসমাজের কল্যাণে নিয়োজিত হলেও কোথায় যেন মানবসমাজের থেকে আলাদা স্তরে বিরাজমান।
উল্টোদিকে মারভেলের কথা ধরা যাক। মারভেলের প্রথম বিখ্যাত সুপারহিরোদের অন্যতম ফ্যান্টাস্টিক ফোর। সেখানে এক পরিবারের তিনজন এবং তাঁদের এক বন্ধু মহাকাশে এক উল্কাঝড়ের ফলে হঠাৎ পান তাঁদের অতিমানবিক ক্ষমতা। কিন্তু, তাঁদের প্রত্যেকে এই শক্তির সঙ্গে মানিয়ে নেন আলাদা আলাদাভাবে। যেমন একজন অমিতশক্তি পেলেও, তাঁকে দেখতে হয়ে যায় এক পাথুরে দানবের মতো। তাঁর স্ত্রী ছেড়ে যান তাঁকে। এরকম দ্বন্দগুলো কমিকসের একটা প্রধান কাহিনিসূত্র।

আবার, হাল্কের পোশাক হল একটি ছেঁড়া স্ট্রেচ প্যান্ট, কারণ ব্রুস ব্যানার কখন ক্রুদ্ধ হয়ে হাল্ক হবেন, সবসময়ে নিজেও জানেন না। আর এই প্যান্ট স্ট্রেচ না করলে তখন তাঁর লজ্জা নিবারণের কোনও উপায় থাকবে না। তিনি অমিতবলশালী, কিন্তু সেটা যেহেতু তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নয়, তাই সে শক্তি ব্যবহার করার সময়ে তিনি অনেক সময়েই দ্বিধাগ্রস্ত। আবার ধরা যাক স্পাইডারম্যানের কথা। এক কলেজ পড়ুয়া অসম্ভব মেধাবী ছাত্র পিটার পার্কার এক তেজস্ক্রিয় মাকড়সার কামড়ে হঠাৎ পেয়ে যায় অতিমানবিক কিছু ক্ষমতা। অথচ, এই শক্তির সম্পূর্ণ দায়িত্ব বুঝতে যে পরিণত চিন্তা দরকার, একজন টিনএজারের স্বভাবতই সেটা অর্জন করতে বহু অন্তর্দ্বন্দের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, অনেক অভিভাবকের দিশাও লাগে। আবার এক্স-মেন, যাঁরা তাঁদের ক্ষমতা পেয়েছেন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় জেনেটিক রূপান্তরের ফলে, তাঁরা তাঁদের ক্ষমতার কারণেই সমাজে অন্ত্যঃজ ও ব্রাত্য।
সুতরাং বলা যায়, মারভেলের প্রায় প্রতিটি অরিজিনাল সুপারহিরোই অতিমানবিক ক্ষমতা পেয়েছেন তেজস্ক্রিয়তা, বৈজ্ঞানিক দুর্ঘটনা বা কোনও প্রাচীন জাদুর মাধ্যমে। আর ক্ষমতা সত্ত্বেও, আসলে তাঁরা এক একজন মানুষ, এবং তাঁদের অসহায়তা, সীমাবদ্ধতা এবং মানবিক সমস্যাগুলোও মারভেল কমিকসের গল্পগুলোর অনেকখানি জুড়ে থাকে। উলটোদিকে, ডিসির অধিকাংশ সুপারহিরোই হয় জন্মসূত্রে, নয় অনুশীলনের মাধ্যমে পেয়েছেন তাঁদের ক্ষমতা। অবশ্য জাদুর ফলেও শক্তির বিকাশ ঘটেছে কারও কারও মধ্যে। সে বিষয়ে তাঁদের মনে দ্বন্দ হয়তো আছে, কিন্তু সেটা কাহিনির মূল উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায়নি সাধারণতঃ।
এখন এর ব্যতিক্রম কী নেই? ডিসি কমিকসের ফ্ল্যাশ বা গ্রিন অ্যারো যেমন অনেক মানবিক। উল্টোদিকে সিলভার সার্ফার বা থরের মতো মারভেলের হিরোদের মধ্যে ঐশ্বরিক প্রভাব সুস্পষ্ট। আর এই ব্যতিক্রমগুলো ছাড়াও, মারভেল ও ডিসি- দুয়েরই সাত দশকের বেশি বিবর্তনের ফলে আজ পর্যন্ত তাদের চরিত্রদের নিয়ে বিভিন্ন রকম গল্প লেখা হয়েছে। এক দল আর একদলের অনুকরণে চরিত্র বানিয়েছে। মূল সুরের উল্টোদিকে, যেমন সুপারম্যান-ব্যাটম্যানের মানবিক সত্তা নিয়ে ওয়ার্ল্ডস ফাইনেস্ট বা অন্যদিকে হাল্কের ঐশ্বরিক প্রতিষ্ঠা নিয়ে কাজ করেছেন বহু শিল্পী ও কাহিনিকার। সত্যি বলতে কী, ব্যাটমানের মানবিক সত্তা ও অন্তর্দ্বন্দ নিয়ে অনেক উঁচুদরের কাজ হয়েছে। শুধু তাই নয়, এক সময়ে দুই সংস্থার যৌথ প্রয়াসে এই সুপারহিরোরা একত্রে দল বেঁধে মানবতাকে রক্ষাও করেছেন।

তবে, হয়তো কিছুটা ওই আদি সত্তার ফলে, আরও একটা জিনিস দেখা যায়। মারভেলের অনেক হিরোই আসলে কোনও সুপারহিরো গোষ্ঠীর সদস্য। মানে অ্যাভেঞ্জার্স ধরনের দল ছাড়াও এক্স মেন, ফ্যান্টাস্টিক ফোর ইত্যাদিরা দল বেঁধেই কাজ করেন। কিন্তু, ডিসি-তে বেশিরভাগ সুপারহিরোই কাজ করেন একা। খুব বেশি হলে হয়তো তাঁদের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকেন, যেমন, ব্যাটম্যানের রবিন। কিন্তু তাছাড়া, হয়তো এই ঐশ্বরিক ভাবমূর্তির জন্যই, তাঁরা অধিকাংশ একাই কাজ করতে পছন্দ করেন এবং ভক্তরাও তাঁদের এভাবেই দেখতে চান বেশি।
বোধহয় সেই কারণেই, তুল্যমূল্য বিচার করলে, মারভেলের এই দলগুলির, যেমন অ্যাভেঞ্জার্স, এক্স মেন ইত্যাদির জনপ্রিয়তাও ডিসির দলগুলো, যেমন জাস্টিস লিগ বা জাস্টিস সোসাইটির থেকে বরাবরই কিছুটা বেশি। অবশ্য এই পার্থক্যটা এখন সহস্রগুণ বেড়ে গেছে মারভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স (MCU)-এর কল্যাণে। বহু পাঠক, যাঁরা আগে হয়তো স্পাইডারম্যান বা হাল্কের দু’ একটি কমিকস ছাড়া মারভেলের অস্তিত্ব সম্বন্ধেও বিশেষ অবগত ছিলেন না, আজ এমসিইউ অ্যাভেঞ্জারদের প্রতিটি খুঁটিনাটি তাঁদের নখদর্পনে।
এ তো গেল নায়কদের কথা। এবার আসি খলনায়কদের কথায়। এমনিতে, দু‘জায়গাতেই সত্তর শতাংশ খলনায়কের লক্ষ্যগুলো মোটামুটি গড়পড়তা। হয় সম্পদ, নয় ক্ষমতা, নয় সাম্রাজ্যবিস্তার বা পৃথিবীর অধীশ্বর হওয়া। কিন্তু, কিছু কিছু জায়গায় এঁদের স্বাতন্ত্র্য চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এবং, এই জায়গায় অন্ততঃ আমি আজও মনে করি ডিসি, মারভেলের থেকে বহুগুণ এগিয়ে। তার কারণটাও অনেকখানি সেই অতিমানবিকতার মধ্যে লুকিয়ে।
ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি। মারভেলের হিরোদের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হল অধিকাংশক্ষেত্রেই তাঁদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী, প্রায় ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন ভিলেনদের সঙ্গে মোকাবিলা করা। যেমন থানোস, ডোরমামু, ক্যাং, গ্যালাকটাস, ইত্যাদি। সেখানে নায়করা ক্ষমতায় কিছুটা বা অনেকটা কম হলেও বুদ্ধি বা আত্মত্যাগের জোরে, কিংবা মানবজাতিকে বাঁচানোর প্রবল তাগিদে কীভাবে এই ভয়ানক খলনায়কদের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করেন, সেটাই কাহিনির মূল উপজীব্য। যেহেতু, এখানে মানুষের নিজের চেয়ে বড় কোনও শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কাহিনি বর্ণিত হয়, তাই এর বৃহত্তর আবেদনও অনেক বেশি।

ডিসিতে এমন ভিলেন নেই তা নয়। ডার্কসাইড, ব্রেনিয়্যাক এবং আরও বহু উদাহরণ আছে এরকম ভিলেনের। কিন্তু, ডিসির কিছু কিছু ভিলেনের ক্ষেত্রে সমীকরণটাই পালটে যায়। এবং এ ধরনের চরিত্রের ক্ষেত্রে ডিসি কিন্তু পথপ্রদর্শক। ধরা যাক ব্যাটম্যানের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রতিদ্বন্দী জোকারের কথা। তাঁর কিন্তু কোনও অতিমানবিক ক্ষমতা নেই। এমনকী, শারীরিক ক্ষমতার দিক দিয়েও ব্যাটম্যানের ধারেকাছে যান না তিনি। তাঁর ভয়াবহতার উৎস সম্পূর্ণভাবেই মনস্তাত্ত্বিক। এমন একজন ভিলেন, যার কোনও নীতিবোধ নেই তা-ই নয়, তার কোনও উচ্চাশাও নেই। সে শুধু মানবসমাজের ক্ষতি করতে চায়, শুধু ক্ষতি করার আনন্দে। টাকাপয়সা, ক্ষমতা কিছুই তার কাম্য নয়। সেদিক দিয়ে সে প্রায় উন্মাদ। কিন্তু উলটোদিকে চরম ধূর্ত, অসাধারণ স্ট্র্যাটেজিস্ট এবং ব্যাটম্যানের সঙ্গে পাল্লা দেবার মতো বুদ্ধি রাখেন।
আবার ধরা যাক, লেক্স লুথারের কথা। সে বেড়ে ওঠে মেট্রোপোলিসের এক বস্তিতে, যেখানে তার মদ্যপ বাবা তার এবং তার মায়ের উপর অকথ্য অত্যাচার করত প্রতিদিন, এবং পদে পদে ছোট করত তার বড় হবার স্বপ্নকে। সেই জায়গা থেকে, নিজের বুদ্ধি, সাহস ও প্রতিভার জোরে আজ অভাবনীয় বৈভব তার। ঐশ্বর্য বা ক্ষমতায় পৃথিবীর যে কোনও রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে সে পাল্লা দিতে পারে। লেক্স লুথার নিজের মা ও নিজের কাছে শপথ করেছিল, মেট্রোপোলিসের আকাশে ও সেখানকার মানুষের হৃদয়ে তার নিজের নামের উপরে আর কোনও নাম থাকবে না। বহু জনহিতৈষী প্রকল্পের মাধ্যমে সক্ষমও হয়েছিল সেই জায়গায় পৌঁছতে। কিন্তু, হঠাৎই এই সময়ে মেট্রোপোলিসে আগমন ঘটে সুপারম্যানের, যিনি গ্রহান্তরের মানুষ, জন্মসূত্রে অমিতশক্তিধর।

সুপারম্যান তাঁর সহজ সরল উজ্জ্বল ভঙ্গিতে, অতি অবলীলায় মানুষের হৃদয়ের সিংহাসন থেকে বিচ্যুত করেন লুথারকে। নিজের অজান্তেই তৈরি করেন তার সবচেয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শত্রু। এতখানি সেই ঘৃণা, যে লুথার ক্যান্সারের ভয় অগ্রাহ্য করে নিজে দিনের পর দিন চালিয়ে গেছেন ক্রিপ্টোনাইট নিয়ে গবেষণা, কেবলমাত্র সুপারম্যানকে নিশ্চিহ্ন করার পন্থা খুঁজতে। তবে একটা কথা, এগুলো কিন্তু অধিকাংশই চরিত্রগুলোর মূলগত বৈশিষ্ট্য। আধুনিক যুগে ডিসি ও মারভেলের বহু চরিত্র পুনরাবিষ্কার করেছেন শিল্পীরা। ফলে এই নৈতিক ধূসরতা বা উন্মাদনার মতো বৈশিষ্ট্যগুলো এখন মারভেলেও দেখা যায় কিলমঙ্গারের মতো ভিলেনের মাধ্যমে।

তবে ভিলেনদের এই স্বাতন্ত্র্যের ব্যাপারে নিঃসন্দেহে ডিসি পথপ্রদর্শক। উপরের বহুপরিচিত চরিত্রগুলির কথা যদি বাদও দিই, আর একটি উদাহরণ এখানে যথেষ্ট। কমিকসের গ্রাফিক নভেলের পথে বিবর্তনের সবচেয়ে বড় উদাহরণগুলির অন্যতম, ‘ওয়াচমেন‘। এটি একটি স্বাধীন বই। ডিসির তরফে এক কিংবদন্তী শিল্পী অ্যালান মুরের অধীনে একটি ব্রিটিশ টিম এর স্রষ্টা। এতে সর্বসাধারণের পরিচিত কোনও হিরো বা ভিলেন নেই। কমিক্স যে শুধু কিশোরদের মনোরঞ্জনের জন্য নয়, তার যে ধ্রুপদী সাহিত্যের মতোই বহু সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক আঙ্গিক থাকতে পারে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ ওয়াচমেন। ওয়াচমেন ও তার প্রভাব নিয়ে লিখতে হলে সেটা আর একটা লেখা হয়ে যাবে। সেটা এই লেখার বিষয়ও নয়। কিন্তু এই প্রসঙ্গে এর কথা টানার কারণ, এর মূল ভিলেন, ওজ়িমেন্ডিয়াস। এই চরিত্রটা শুধু ধূসর নয়, গল্পের শেষ পর্যন্ত পাঠকেরা এটাই বুঝতে পারেন না যে আদৌ তাকে ভিলেন বলা সমীচীন কিনা। এখন অবশ্য এরকম গল্প অনেক লেখা হচ্ছে, কিন্তু এই স্তরে আমি আর কোনও গ্রাফিক নভেলকে যেতে দেখিনি।
ডিসি মারভেলের বৈষম্যের কথা তো খানিক হল। একটা লজ্জাজনক সাদৃশ্যের কথা দিয়ে বরং লেখাটা শেষ করি। অন্য বিষয়ে যতই বিবর্তন হোক, যতই পরিণত হোক গ্রাফিক নভেল, এই সহস্রাব্দের প্রথম দশক পর্যন্তও এ জগত ছিল পুরুষতন্ত্রের জলজ্যান্ত উদাহরণ। শুধু তাই নয়, এমন নির্লজ্জভাবে মহিলাদের পণ্যায়নের উদাহরণও আর কোনও এমন সার্বজনীন ক্ষেত্রে বিরল। ডিসির ওয়ান্ডার উওম্যান, হক গার্ল, জাটানা বা মারভেলের ব্ল্যাক উইডো, স্কারলেট উইচ- প্রায় সমস্ত জায়গাতেই মহিলা সুপারহিরো বা হিরোইনদের বর্ননা প্রায় এক। অসামান্য দেহসৌষ্ঠব, যা কিনা লাফঝাঁপ বা মারপিটের ক্ষেত্রে অত্যন্ত অসুবিধাজনক। লম্বা, খোলা চুল এসে পড়ছে চোখে নাকে সবসময়ে। এবং সবচেয়ে বড় কথা, পরণে হয় স্কিন টাইট লেটেক্স নয় ওয়ান পিস বা টু-পিস সুইমস্যুট।

যাঁদের বিশ্বের ভয়ঙ্করতম দুশমন এবং সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে প্রত্যহ, তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে দেহের সত্তর-আশিভাগ উন্মুক্ত করে বা সামান্য লেটেক্সের পোশাক পরে কেন নিজেদের বিপদ বাড়াবেন, এটা আমার বোধগম্য হয় না। শরীর ঢাকা কেভলার বা সেরকম বর্ম কি উপযুক্ত হত না? আসলে, এঁদের যখন আবির্ভাব, তখন সুপাহিরো কমিকসের প্রধান পাঠক ছিল বয়ঃসন্ধিপ্রাপ্ত কিশোরেরা (কিশোরীরা নয় হয়তো)। তাদের মেল ফ্যান্টাসি চরিতার্থ করার জন্যই হয়তো এই পোশাকের অবতারণা। কিন্তু, তা যদি মেনেও নিই, আশি বা নব্বইয়ের দশকের পর থেকে পাঠককুল যখন দাবি করেন যে কমিক্স বা গ্রাফিক নভেল অনেক সাবালক হতে আরম্ভ করেছে, তখনও এই পাঠককে যৌন সুড়সুড়ি দেবার প্রবণতাটা কেন যায়নি, তা বোঝা দায়। তাও বলব, গত দশকে অন্ততঃ মারভেল সিনেমায় মহিলা সুপারহিরোদের পোশাকআশাক, দেহসৌষ্ঠব, সবই কিছুটা হলেও বাস্তবসম্মত ও ইতিবাচক দিকে মোড় নিয়েছে।

সব শেষে, আরও একটা অপরিণতির ক্ষেত্রে একটা সাদৃশ্য থেকেই যায়। সেটা হল জাতিগত বৈষম্য। আসলে বৈষম্যের ব্যাপারটা বর্ণ, লিঙ্গ, জাত, ধর্ম নির্বিশেষে আমাদের এত গভীরে প্রোথিত, যে খুব সহজভাবে এই বৈষম্যগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া এখনও বহুদূরের পথ। অথচ রাজনৈতিক শুদ্ধতার খাতিরে কিছু মুখরক্ষা তো করতেই হবে। তাই সান্ত্বনা পুরস্কার হিসাবে ব্ল্যাক লাইটনিং বা ব্ল্যাক প্যান্থারের মতো কৃষ্ণাঙ্গ, বা শাং-চির মতো এশীয় সুপারহিরো সৃষ্টি হয়েছে এবং কিছু জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। সমস্যা হল, শুধু গায়ের রং আর অ্যাকসেন্ট পালটে দিলেই তো হল না, একজন প্রকৃত কৃষ্ণাঙ্গ বা এশীয় সুপারহিরো নিয়ে গ্রাফিক নভেল বানাতে গেলে সেই সভ্যতা বা সংস্কৃতি সম্বন্ধেও একটা গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রয়োজন। তা না হলে, জিনিসটা সেই পাশ্চাত্য সমাজের একটা অক্ষম অনুকরণ হয়েই থেকে যায়। তবে ডিসি আর মারভেল আদতে মার্কিন কোম্পানি- সেটা তো মাথায় রাখতে হবে। তাই এই প্রত্যাশাটা পূরণ হতে হয়তো আরও কিছুটা সময় লাগবে।
আপাতত সেইদিকেই তাকিয়ে থাকি। যেদিন একজন মহিলা সুপারম্যান, কৃষ্ণাঙ্গ ক্যাপ্টেন আমেরিকা বা ভারতীয় স্পাইডারম্যানকে নিয়ে কমিকস বেরোলে তাঁদের জাতিগত পরিচিতির দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে আমরা তাঁদের দুষ্টদমনের কাহিনির দিকে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে মনোযোগ দেব।
*তথ্য ও ছবি সৌজন্য: The ringer, Geekfeed, Firstpost, Polygon, Artstation, Denofgeek, Rolling Stone, Wired.com
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তিতিবিরক্ত হতে হতেও আইটি শিল্পতালুকে মজদুরি করতে বাধ্য হন। কিন্তু সবচেয়ে পছন্দের কাজ হাতে মোবাইলটি নিয়ে আলসেমি করে শুয়ে থাকা। চেহারাছবি নিরীহ হলেও হেব্বি ভালোবাসেন অ্যাকশন ফিলিম, সুপারহিরো আর সাই ফাই। সঙ্গে চাই সুরেশের রাবড়ি, চিত্তরঞ্জনের রসগোল্লা-পান্তুয়া, কেষ্টনগরের সরভাজা ইত্যাদি নানাবিধ মিষ্টান্ন।