নাটককার, অভিনেতা মনোজ মিত্রের জন্ম ২২ ডিসেম্বর ১৯৩৮, অবিভক্ত বাংলার (অধুনা বাংলাদেশ) খুলনা-সাতক্ষীরার ধূলিহর গ্রামে। সেখান থেকে কলকাতা। ক্রমশ, তাঁর নাট্যকার হয়ে ওঠা, নাট্যদল গড়া, মঞ্চ এবং চলচ্চিত্র উভয় মাধ্যমেই নিজের অভিনয় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা…। এই দীর্ঘ ঘটনাবহুল যাত্রা পথের কয়েক ঝলক উদ্ধার করবার চেষ্টা এই সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলা লাইভের প্রতিনিধি অন্যমন রায়চৌধুরী।
অন্যমন: আপনার ছোটবেলায় বাড়িতে বা আশপাশে নাটকের পরিবেশ ছিল?
মনোজ মিত্র: আমার জন্ম যে গ্রামে, ছোটবেলা যেখানে কেটেছে, সাতক্ষীরার সেই ধূলিহর গ্রামে, এখন ভাবলে আশ্চর্য লাগে, বেশ একটা নাটকের আবহাওয়া ছিল। গ্রামের মানুষ অভিনয় দেখতে এবং অনেকেই আবার করতেও, বেশ ভালোবাসতেন। আমার ঠাকুরদা অন্নদাচরণ মিত্র থিয়েটার-বিরোধী হলেও যেহেতু উনি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, গ্রামের অধিকাংশের কথা ভেবে আমাদের বাড়িতেই থিয়েটারের সেট-সেটিং তারপর নানান সুন্দর-সুন্দর দৃশ্যপট রাখা থাকত। বাড়ির মুখেই যে পুজোর দালান, সেইখানেই থিয়েটার হত। ঠাকুরদা থিয়েটার-বিরোধী হলেও এইসব মেনে নিতেই হত…
অন্যমন: সেইসব থিয়েটার দেখার কোনও স্মৃতি?…
মনোজ মিত্র: হ্যাঁ…একবার বড়রা থিয়েটার করেছিল, ওই ঠাকুর দালানেই, রামের সুমতি, তখন আমি ছোট। কিন্তু এইটা বুঝেছিলাম ভাল হচ্ছে না, কেউই ভাল করছে না, সব মিলিয়ে বেশ খারাপ, দর্শক ঝিমোচ্ছে। হঠা-ৎ গান ধরল একজন, কার্তিক গণেশ থাকেন জলে, তার মাথায় মাছভরা বেতের ঝুড়ি। তাল সামলাতে না-পেরে অভিনেতার হাত ফস্কে ঝুড়ি পড়ল মঞ্চের ওপর। দেখা গেল দু’টি জ্যান্ত মাছ স্টেজে পড়ে লাফাচ্ছে! ওরাই কার্তিক-গণেশ!
দর্শক অবাক, শিহরিত, ছুটে এসেছে, একজন অন্যকে বলছে, দ্যাখ দ্যাখ জ্যান্ত মাছ…। এমন নয় যে, তারা কোনওদিন জ্যান্ত মাছ দেখেনি। গ্রামে প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতে পুকুর, তাদের ঘরে-ঘরে মাছ। অতএব ওইটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু স্টেজে নাটকের অঙ্গ হিসেবে জ্যান্ত মাছ, এটা দেখেনি। এখন বালকবেলার ওই ঘটনার কথা ভাবলে এইটা মনে হয়, মানুষ থিয়েটারে জীবন দেখতে চায়, সত্যি দেখতে চায়, জীবনের অনুকৃতি খোঁজে…
অন্যমন: আপনি ওই বয়সে কখনও অভিনয় করেছেন?…
মনোজ মিত্র: হুম। সে এক কাণ্ড। বলেইছি তো, আমাদের গ্রামের লোকের থিয়েটারের শখ ছিল…। হ্যাঁ আমার ছোটবেলাতেই ধরেছিল সেই খেলা-খেলা নেশা; একবার হল রবীন্দ্রনাথের হাস্যকৌতুক, রোগের চিকিৎসা, যার একটি চরিত্র হারাধন। মানে সেই ছেলেটা, যে ডাক্তারের আস্তাবল থেকে হাঁসের ডিম চুরি করে, মারধোর খায়। একবার ভাবল গোটা হাঁসটাই চুরি করে নেবে, তাহলে হাঁস বাড়িতে থাকবে আর ডিম পাড়বে।
তা যে ছেলেটি সেই হারাধনের ভূমিকা করছিল, বোধহয় স্টেজে ওই জ্যান্ত মাছ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে, সবাইকে মুগ্ধ করে দেবার জন্য জামার মধ্যে সত্যিকারের হাঁস নিয়ে মঞ্চে ঢুকেছে। পেট ফোলা কেন? না, তালের বড়া খেয়ে পেট ফুলেছে। এইসব তো নাটকেই ছিল… হচ্ছে… যখন ডাক্তারের জেরার মুখে ওর জামা খোলা হল, ভেতরে জ্যান্ত হাঁস। বালকটির বুক পেট সব হাঁসের নখে রক্তাক্ত। এতক্ষণ সে নাটকের স্বার্থে সব সহ্য করেছে। এইবার আর পারল না, কাঁদতে আরম্ভ করল, অভিনয় মাথায় উঠেছে তখন…

অন্যমন: মনোজদা এই ছেলেটা কে? আপনি?…
মনোজ মিত্র: হা-হা-হা (হাসি)…হ্যাঁ-হ্যাঁ আমি…
অন্যমন: আগে একদিন সকালে হাঁটতে-হাঁটতে বলেছিলেন, আপনারা কলকাতায় আসেন দেশভাগের পরে ১৯৫০ সালে?
মনোজ মিত্র: হ্যাঁ ওই সময়েই। ডাক্তার ছোটকাকা রইলেন দেশের বাড়িতে, আমরা কলকাতায় চলে এলাম। আমরা মানে মা, মেজকাকা আমার পরের ভাই, আর বোন। অমর (লেখক অমর মিত্র) তখনও জন্মায়নি। বাবা অশোককুমার মিত্র ঢাকায়, উনি ভারতীয় হাই কমিশনে চাকরি করতেন, লিয়াজঁ অফিসার। কলকাতায় এসে ওঠা হল বেলেঘাটার ভাড়াবাড়িতে। পুজোর পরে ট্যাংরার একটি স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হলাম। বোধহয় তিনমাস মতো ছিলাম, বাবা আসা-যাওয়া করতেন, কখনও মাকে নিয়ে যেতেন।
ওঁরই ব্যবস্থাপনায় বসিরহাটে বাড়ি করা হলে চলে গেলাম ওইখানে। আবার নতুন স্কুল। ইতিমধ্যে বাবার বদলির অর্ডার বেরুল, যেতে হবে পশ্চিম পাকিস্তানে। ঠাকুর্দা রেগে গেলেন, ‘গেলে তুমি আমার মরা মুখ দেখবে…।’ অতএব বাবা অপশন দিলেন বেঙ্গল গভর্নমেন্টে আসবার। বদলি হলেন কলকাতায়, কর্মস্থল রাইটার্স বিল্ডিং। বাবা এসে উঠলেন বউবাজারের তরুণ হোটেলে।.ক্রমশ বেলগাছিয়ায় বাড়ি হল, সেই বাড়িতেই এখন অমর থাকে। এ বাড়িতেই ১৯৫৫ সাল নাগাদ ঠাকুর্দাকে আনা হল, উনি পরে বসিরহাটে চলে যান, ওইখানেই থাকতেন।
অন্যমন: এই পর্বে তো নাটক বা অভিনয়ের কোনও চিহ্ন নেই দেখছি…তবে কি কলেজে এসে নাটকে পেল? কোন কলেজ?
মনোজ মিত্র: হ্যাঁ-হ্যাঁ, কলেজেই, মানে স্কটিশ চার্চ কলেজে ঢোকবার পরেই একটা নতুন জগৎ খুলে গেল আমার সামনে। ছাত্রদের মধ্যে ছিল পার্থ, পার্থপ্রতিম চৌধুরী। ওর বাবার সঙ্গে আবার আমার বাবার পরিচয় ছিল। ওই পার্থ একদিন পড়ে শোনাল ‘সংঘাত’, ওর লেখা নাটক। আমি অবাক! আর ছিল অতনু, অতনু সর্বাধিকারী। আমি, পার্থ আর অতনু, এই তিনজনের মধ্যে অতনুই সবথেকে ভাল লিখত। স্টার থিয়েটারের মালিক সলিল মিত্র ওর মামা। অতনু আর আমি মাঝে-মধ্যেই স্টারে গিয়ে নাটক দেখে আসতাম। কী যে সুন্দর সব দৃশ্যপট! মনে আছে অনুপকুমার নতুনদা’র রোল করছেন, মজা লেগেছিল।
আর ছিল দীপা, যে পরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী হবে। দীপা আর আমরা কয়েকজন বন্ধু অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটাতাম, হয়তো কখনও একসঙ্গে চিড়িয়াখানা ঘুরে এলাম, কোথাও গেলাম, এইরকম একটা ব্যাপার ছিল। সৌমিত্রদা জানতেন বা পরে জেনেছিলেন নিশ্চয়ই, কারণ ‘চাকভাঙা মধু’ লেখার পর উনি ওঁর দল থেকে করতে চেয়েছিলেন। আমি বললাম ‘বিভাসরা থিয়েটার ওয়ার্কশপ থেকে করবে বলেছে।’ তো উনি বললেন, ‘না-না আমার দাবি সবচেয়ে বেশি, তুমি দীপার বন্ধু…’ যাইহোক, যা বলছিলাম, থিয়েটার নিয়ে সেই সময়েই সিরিয়াসলি ভাবতে আরম্ভ করি।
অন্যমন: তখনই নাটকের দল?
মনোজ মিত্র: হ্যাঁ, সেই সময়েই, পার্থর উৎসাহে, আমরা জনাকয়েক কলেজের বন্ধু মিলে ১৯৫৬-৫৭ সালে নাটকের দল গড়ি, ‘সুন্দরম’। দলের প্রথম নাটক বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি।’ পার্থ নাট্যরূপ দিয়েছিল। পথের পাঁচালিতে আমার আপত্তি ছিল। ছোটবড় সব নাট্যদলই তখন সমকালকে প্রাধান্য দিচ্ছেন, এর মধ্যে আমরা কেন পথের পাঁচালি করব? পার্থর উত্তর, যেহেতু সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি বিশ্বজয়ী, অতএব ওইটিই আমাদের স্টেজে করা দরকার। পার্থর নেতৃত্বে ‘সুন্দরম’ তখন পদে পদে সিনেমাকে অনুসরণ করেছে…

অন্যমন: এরই পাশাপাশি কলেজ পেরিয়ে ইউনিভার্সিটির গণ্ডি পেরলেন
মনোজ মিত্র: ওইটা তো করতেই হবে, দর্শন নিয়ে পড়েছি। ইতিমধ্যে ১৯৫৯ সালে লিখে ফেললাম একটি নাটক, ‘মৃত্যুর চোখে জল।’ তার বৃদ্ধের চরিত্রটিতে আমার ঠাকুরদার ছাপ স্পষ্ট, ওই ভূমিকায় আমি অভিনয়ও করলাম।…
অন্যমন: আপনার তো সেরকম ট্রেনিং যাকে বলে, এই গলা তৈরি কি শরীর সঞ্চালন করবার শিক্ষণ, এইসব ছিল না, তাহলে কীভাবে করলেন?
মনোজ মিত্র: আমার ঠাকুরদাকে তো ভাল করে দেখা ছিল। ওই গলার আওয়াজ, কষ্ট করে ঘষটে-ঘষটে হাঁটা, সব তো দেখা ছিল। উনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে পঁচিশ বছর শয্যাশায়ী, যে কোনও মুহূর্তে তাঁর হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে যাবে, সব সময় এই ভয় পেতেন, উৎকণ্ঠায় থাকতেন সর্বক্ষণ। এমনই বাঁচার আকাঙ্ক্ষা! তবে বুড়ো কত কষ্ট পেয়েছে তার পৌত্রের অকালমৃত্যুতে, সে কতটা স্বার্থপর, কতটা আত্মসুখসর্বস্ব এ সবের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে অভিনয় করবার ক্ষমতা আমার সেই একুশ বছরে ছিল না, পরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরীরও না। আমি ছোটবেলায় ঠাকুরদাকে যেমন দেখেছিলাম, তেমনভাবেই করেছি অভিনয়, অনেকখানি না বুঝেই।
আর তাছাড়া অনন্ত দাস (রূপসজ্জাশিল্পী), আমার ওই একুশ বছরে, যখন ভাল করে দাড়িগোঁফ গজায়নি, কপালে এতটুকু ভাঁজ নেই, রোঁয়া ওঠা চটচটে দশ বারোটা প্লাস্টারের টুকরো মুখের ওপর আঠা দিয়ে বসিয়ে এমন বুড়ো সাজিয়ে দিলে যে, আমাকে আর রুগ্ন বৃদ্ধ ভাবা ছাড়া কোনও উপায় রইল না। তাতেই বোধহয় অনেকটা কাজ হয়ে গিয়েছিল। তবে বড় পাওনা হল অহীন্দ্র চৌধুরীর প্রশংসা। উনি থিয়েটার সেন্টার মঞ্চে ‘মৃত্যুর চোখে জল’ দেখে গ্রিন রুমে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার প্রশংসা করেছিলেন। (চলবে)
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২ মার্চ সংখ্যায়
*ছবি সৌজন্য: mubi.com, youtube, wikimedia commons
অন্যমন দীর্ঘদিন সরকারি চাকরি করে আপাতত অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। ভালবাসেন বাংলা নাটক, কবিতাও। সময় কাটাতে নানা লিটল ম্যাগাজিনে টুকটাক লেখালিখি তাঁর শখ। বই পড়া আর বন্ধুদের সঙ্গে রবিবারের আড্ডাটি ছাড়া তাঁর এক মুহূর্ত চলে না।
খুব উপভোগ্য। বর্ণময় জীবনের গল্প রসিয়ে শোনাচ্ছেন মনোজ মিত্র। সাক্ষাৎকারের মধ্যে দিয়ে তাঁকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে ঘটনাটা চোখের সামনে ঘটছে। শুধু অন্যমন রায়চৌধুরীকে চিনি না বলে তিনি একটু ঝাপসা। মুখ দেখতে পাচ্ছি না, তবে সহজ কথায় এত গভীর প্রশ্ন করে চলেছেন তিনি, অচেনা মানুষটাকে ক্রমশ ভালো লাগছে।