অন্ধকার প্রায় নিশ্ছিদ্র। শুধু পথপ্রদর্শকের হাতের টর্চের আলো মাঝে মাঝে রাস্তা করে নিচ্ছে। আবছা অবয়ব জানিয়ে দিচ্ছে গভীর জঙ্গলের উপস্থিতি, অদূরে, ঘাসজমির ওপাশে। কারা যেন চরে বেড়ায় ঘাসের মাঠে। টর্চ ফেলতে অবাক হয়ে তাকায় মৃগ মৃগী, নিষ্পাপ চোখে। গায়ে তাদের ছোপ ছোপ দাগ।

উড়ে আসে ছোপ ছোপ দাগ, কুটুরে পেঁচা, স্পটেড আউলেট। গোল চোখ, আলোতে হরিদ্রাভ। স্কোপস আউলের ডাক নেই কোনও। তাকে খুঁজতেই এই অন্ধকার জঙ্গলে ঢোকা। কিন্তু ও কীসের আওয়াজ! বিশালদেহী কিছু যেন মাটির উপর ঘষটে এগোচ্ছে। টর্চের আলো পেঁচা থেকে সরে, ঘাস জমিতে পড়ে। দেখে শিউরে ওঠে শরীর৷

এক সুবিশাল কুমির। ফুট দশেক দূরে। এগিয়ে চলেছে এক ডোবার দিকে। তার ক্রূর চোখ মেপে নেয় আলোর উৎস। ‘এখন ওদের মিলনের ঋতু। চলাচল তাই বেড়ে গেছে। জোয়ারের সময় খাঁড়ির জল ঢুকে পড়ে জঙ্গলে। উঠে আসে তারই সঙ্গে। সাবধানে এগোনো ভালো’– পথপ্রদর্শক জানান।

এই গরমেও যেন শিরদাঁড়া বেয়ে হিমেল অনুভূতি। ভিতরকণিকা, চিনিয়ে দিলে তোমার রূপ।

***

আশঙ্কা তো ছিলই। ভারতবর্ষের আমাজ়ন। শুনেছিলাম কুমির নাকি এখানে পায়ে পায়ে ঘোরে। গাছের ডালে জড়িয়ে থাকে বিষাক্ত সাপ। কিন্তু ওই লোভ! এখানেই তো ঘুরে বেড়ায় দুষ্প্রাপ্য ম্যানগ্রোভ পিট্টা। শুনেছি এখানেই আছে সবুজ ঠোঁট মালকোহা। পাহাড় ছেড়ে এই তটভুমিতে সে কেন? আর সাত রকমের মাছরাঙা। তাও তো দেখতে হবে। সেই লোভ তাড়া করে এনেছিল দু’জনকে। তবু আশঙ্কা ছিল। আশঙ্কা ছিল শেষ বসন্তের গরমের। আশঙ্কা ছিল আসন্ন নির্বাচনী উপদ্রবের। আশঙ্কা ছিল কুমিরের, মশার, সাপের।

শেষ বিকেলে যখন বিজয় দাসের বাড়ির উঠোনে বসে চা খাচ্ছিলাম, তখন কিন্তু মন বেশ ফুরফুরে। দুপুরের তীব্র দাহ কখন মিলিয়ে গেছে স্নিগ্ধ বাতাসে। ব্রাহ্মণী আর বৈতরণী হাওয়া বিলিয়ে চলেছে অকাতরে। একটা গুড়িয়াল মাছরাঙা উড়ে গেল তারস্বরে ডাকতে ডাকতে। তাই সন্ধে নামতে বিজয়বাবু যখন জঙ্গলে ঢোকার আমন্ত্রণ জানালেন, উপেক্ষা করতে পারিনি। টর্চ হাতে উনি হলেন পথপ্রদর্শক।

Leopard Cat
এই এলাকাতেই লেপার্ড ক্যাট দেখা যায়

স্নায়ুমণ্ডলী শান্ত হল। এলাম এক আচ্ছাদিত আশ্রয়ে৷ কাছেই নদী। জলের গন্ধ উঠে আসছে ম্যানগ্রোভ ভেদ করে। এই এলাকাতেই লেপার্ড ক্যাট দেখা যায়। গত কয়েক সপ্তায় দেখা মেলেনি যদিও। লেপার্ড ক্যাট! পাব নাকি দেখা? অন্ধকারে অপেক্ষা আরো কিছুক্ষণ। জঙ্গল আজ বড়ই স্তব্ধ। এমনকি হাওয়াও হঠাৎ উধাও। কপাল বেয়ে ঘামের আনাগোনা। ফিরলাম। অপরিসীম আয়োজন রাতভোজনের৷ সীমিত সাধ্যে তাতে সামান্যই সাড়া দিতে পারলাম দু’জনে। শয়নের তোড়জোড় চলছে। এমন সময় দরজায় জোরালো ধাক্কা। বিজয়বাবু দাঁড়িয়ে৷ 
– শিগগিরি চলুন। লেপার্ড ক্যাট দেখা গেছে- উত্তেজিত ঘোষণা।
ছুট ছুট। পথপ্রদর্শক কখন হয়ে গেলেন সারথি। মোটরসাইকেল এসে দাঁড়াল এক মাঠের কাছে। টর্চের আলোতে স্পষ্ট সে। বসে আছে গর্তের মধ্যে। একটু পরে বিরক্ত। নেমে গেল মাঠের গভীরে। একটু সময় দিয়ে নেমে এলাম মাঠে। বিজয়বাবুর টর্চের আলো খুঁজে নিল তাকে। বসে আছে একটা গাছের উপর। এক্কেবারে চিতাবাঘ। শুধু চেহারাটা ছোট। মুখখানা ভারিক্কি। হুলো বুঝি। বাকি রাতটা ছেঁড়া ঘুম। সাফল্যের উত্তেজনা।

***

ভেসে আসে সকালের নরম আলো নদীর উপর, জলে ঝিকিমিকি৷ জেটির উপর আমরা দু’জন, কেউ কোত্থাও নেই। নীচে কেবল গোটা কয়েক ভুটভুটি মোটর লাগানো নৌকা বিশেষ৷ জায়গাটার নাম অদ্ভুত- ‘খোলা’। নদীপথে জাতীয় উদ্যানে ঢোকার দরজা৷ বিজয়বাবু আমাদের রেখে বনদফতরের অনুমতি আদায়ে ব্যস্ত। বিজয়বাবু ফিরে এলেন৷ সঙ্গে দুই মূর্তি- যেন নন্দী আর ভৃঙ্গি। আমাদের নৌকোর নাবিকযুগল। আমরা ছাদে বসলাম জাঁকিয়ে, ক্যামেরা বাইনোকুলার বাগিয়ে। প্রবল আন্দোলন সহকারে যাত্রা শুরু হল। মোটরের আওয়াজে সন্দেহ হয় পাখির দেখা মিলবে কিনা।

Collared Kingfisher
দেখলাম কলার্ড কিংফিশারের চকিত উড়ান

ভুল। সম্পূর্ণ ভুল সন্দেহ। বিজয়বাবুর অসাধারণ পর্যবেক্ষণ শক্তি, নির্ভুল নির্দেশ, আর আমাদের ভাগ্য এনে হাজির করল একের পর এক পাখি। দেখলাম কলার্ড কিংফিশারের চকিত উড়ান। গায়ের রং নীল স্নিগ্ধ, গলায় সাদা কলার। ব্রাউন উইংড কিংফিশার বসে আছে ম্যানগ্রোভের ডালে। স্থানু, যেন ধ্যানমগ্ন। গায়ে তার দু’রকম বাদামি রং, লেজের গোড়ায় আকাশি নীল ফোঁটা, টকটকে লাল ঠোঁট। রোদে মৃদু স্বচ্ছতা পেয়েছে। হেতালের ঝোপের কাছাকাছি ব্ল্যাকক্যাপড কিংফিশারের অবস্থান। কালো মাথা, কিন্তু গায়ের রং উজ্জ্বল নীল। আমাদের আনাগোনা আদৌ পছন্দ নয় তার।

নদী এখানে বাঁক নেয় কথায় কথায়। এঁটেল মাটির ঢালে পড়ে আছে পোড়া কাঠ হেথায় হোথায়। কাছে গেলে কাঠগুলি জ্যান্ত হয়ে কুমিরের চেহারা নেয়। অবাস্তব ক্ষিপ্রতায় নেমে পড়ে জলে। নৌকো লাগলো ডাংমালের ঘাটে। পায়ে পায়ে উঠে আসি। দেখি পৌঁছে গেছি কাল রাতের বিচরণক্ষেত্রে, যেখানে বসেছিলাম পেঁচার অপেক্ষায়। এক খোকা বসে আছে প্রাতরাশ নিয়ে, আমাদের জন্যে। খাওয়া শেষে ঢুকে পড়লাম সুন্দরী গাছের জঙ্গলে। ঢুকতে না ঢুকতেই ভেসে এলো চেস্টনাট ক্যাপড ব্যাবলারের ডাক। মাথার উপরেই বসে। অকুতোভয়৷ আরো গভীরে অবগাহন। মাটি ভিজে। ম্যানগ্রোভের শ্বাসমূল উঠে বাতাসে হাঁফ ছাড়ছে। তার নিঃশ্বাসে বাতাস ভারী, ভিজে। পা ফেলতে হয় মেপে, শ্বাসমূলের অবসরে। ঝরে পড়া পাতা পচে আছে পায়ের তলায়। ছোট্ট কাঁকড়ার আনাগোনা, তার উপরে নীচে।

Brown winged kingfisher
ব্রাউন উইংড কিংফিশার বসে আছে ম্যানগ্রোভের ডালে স্থানু

এই কাঁকড়ার লোভেই তো সে থাকে এখানে। চার ডাক কোথায়? উপরে কীসের ঝটপট? আঃ। একটা সবুজ ঠোঁট মালকোহা (গ্রিন বিলড মালকোহা)। কিন্তু ছবি হবে না। দূরে ধূসর মাথা কাঠঠোকরার (গ্রে হেডেড উডপেকার) ঠোকাঠুকির শব্দ। কিন্তু সে নেই। অবশেষে ভেসে এল তার ডাক। দুটি নোটের মিষ্টি গান। নির্ভুল ম্যানগ্রোভ পিট্টা। আরো গভীরে ঢুকলাম। পাশ দিয়ে চলে যায় ওয়াটার মনিটর লিজার্ড তার নধর শরীর নিয়ে। তার চেরা জিভ বাতাসের গা চেটে চেটে খুঁজে নেয় গন্ধ। কিন্তু কোথায় সে? ওই তো! বসে আছে সুন্দরী গাছের গোড়ায়। গায়ে তার রঙের বাহার। ডেকে চলেচে। রূপবান হয়েও লাভ হয়নি। সঙ্গিনী জোটেনি এ বছর।

***

নিষ্ঠুর রোদ। বেলা চারটেতেও তার চোখ রাঙানি কমে না! বোধকরি তার ভয়েই কুমির প্রজননের পুকুরগুলো নির্জন। শুধু সাদা কুমিরটা আজ উঠে এসেছে কেন কে জানে। গত দুসপ্তা সে ওঠেনি কিন্তু জল থেকে। এক গাছের কোটরে দেখে নিই গুড়িয়ালের (স্টর্ক বিলড কিংফিশার) বাসা। এখন নেই তারা। মাঠের মাঝে সবুজ বাঁশপাতির (গ্রিন বি-ইটার) ওড়াউড়ি। ওরা বাসা করে মাঠের মধ্যে, গর্ত করে। উঠে আসি নৌকোর উপর। ছুঁয়ে যাই মাছরাঙাদের বিচরণক্ষেত্র, আবার। একটা হুইমব্রেল উড়ে যায় পাখা মেলে।

bhitarkanika_national_park
কুমিরগুলো মেপে নেয় আমাদের দূরত্ব। ছবি সৌজন্য: Bhitarkanika.in

কুমিরগুলো মেপে নেয় আমাদের দূরত্ব আধবোজা চোখ নিয়ে। হঠাৎ দেখি গাছের মাথায় সাদা পেট সিন্ধু ঈগল (হোয়াইট বেলিড সি ঈগল)। উড়ে যায় শক্তিশালী পাখার ঝাপটায় অনায়াসে৷ নন্দীভৃঙ্গি নৌকা চালায় তাই পিছু পিছু। ওই গিয়ে বসে সে আর এক গাছের মাথায়। আরে, আরো একজন বসে আছে যে! ভিড় পছন্দ নয় তার, তাই সে ওড়ে। পায়ে তার শিকার, এক কুমিরছানা। মৃত্যুর বিস্ময়ে মুখ তখনও তার হাঁ হয়ে আছে।

Black capped kingfisher
হেতালের ঝোপের কাছাকাছি ব্ল্যাকক্যাপড কিংফিশারের অবস্থান

সন্ধ্যেবেলা আমরা নেমে আসি আমাদের আস্তানার কাছে এক মাঠে। বিজয়বাবুর জোরালো টর্চ খুঁজে নেয় এক বনবিড়াল (জাঙ্গল ক্যাট)। দ্রুত পলায়ন তার আলোর বৃত্ত থেকে। ঠেলে তোলা আইএসও, তবু ধরতে পারে না তার স্থিরচিত্র। শুধু এক পলায়ন রেখা তার ডোরাকাটা পায়ে। কিছু দূরে মন্দিরটি নির্মীয়মান। পাশে চাঁদোয়ার তলায় চলছে নামসংকীর্তন৷ কিন্তু কীর্তনের আওয়াজ ছাপিয়ে আসে এক তীক্ষ্ণ ডাক। টর্চের আলোতে দেখি এক বার্ন আউল। বৈতরণী-ব্রাহ্মণীর হাওয়ায় তার পালক উড়ছে অন্ধকারে।

***

আলো ফুটতেই আমরা বেরিয়ে পড়ি। ম্যানগ্রোভের জঙ্গলের কাছে চরে বেড়ায় রাডি ব্রেস্টেড ক্রেক। হাঁচোড় পাঁচোড় করে পথ থেকে সরে যায় এক মস্ত মনিটর লিজার্ড। উড়ে আসে এক জোড়া মালকোহা। মলিন আলোতে তার জটিল ধূসর রং খোলে না। জঙ্গল নিশ্চুপ। আমরা অন্য দিকে ঢুকি। মালকোহা জোড়া আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে এগোয়। দূরে তিন মৃগশিশু আমাদের দেখে অবাক।

Mangrove Pitta
এখানেই তো ঘুরে বেড়ায় দুষ্প্রাপ্য ম্যানগ্রোভ পিট্টা

উড়ে আসে তিন পিট্টা অপ্রত্যাশিতভাবে, পথের ধারে ঝোপের মধ্যে। দু’জনের দ্বন্দ্বযুদ্ধ লেগে যায়। তৃতীয়জন অবশ্যই স্ত্রী, দুই পুরুষের লড়াইয়ে নির্বিকার। আমরা তাদের অনুসরণ করি জঙ্গলের মধ্যে। তারা এখন ছড়িয়ে পড়েছে। একজনের ডাক ভেসে আসে। গাছের ডালে বসে আকাশের দিকে মুখ করে, ডেকে যায়, ডেকে যায়। শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্যে কঠিন পরিশ্রম সামনে। একফালি রোদ এসে পড়ে তার মুখে। ভবিষ্যৎ বিজয়ের আগাম শুভেচ্ছা। খুঁজে নিই আরো কয়েকজনকে জঙ্গলের আনাচে কানাচে। কী অপূর্ব তাদের রং। সুন্দরীগাছের মোম-তেলতেলে পাতা আর মাটির কাছাকাছি তারা আরো উজ্জ্বল। ফেরার পথে এক মালকোহা অপূর্ব ভঙ্গিমায়। একজোড়া ব্ল্যাক নেপড মোনার্ক ঘাড় বেঁকিয়ে মাথার টুপি দেখাল। পিন স্ট্রাইপড টিট ব্যাবলারগুলো খুব উত্তেজিত হয়ে ঘুরে বেড়ায় আশপাশে।

***

বিকেলবেলা গ্রামে ঘুরে বেড়াই আমরা দুজন এপাশ সেপাশ৷ কিসের যেন একটা গম্ভীর সভা বসেছে দুর্গামণ্ডপে। আমাদের অনাহূত আগমনেও সকলের প্রশ্রয় দৃষ্টি। পুকুরের ওপাশে মন্দিরের চূড়া রঙিন, উজ্জ্বল, ম্যানগ্রোভ পিট্টার মতন। একটা ডোবার কাছে একজোড়া পেইন্টেড স্নাইপ। মেয়েটি রঙিনতর- পাখির রাজ্যে ব্যতিক্রম। কিন্তু সে লাজুক উড়ে যায় সহজে। অকুতোভয় পুরুষটি বাচ্চা নিয়ে জলের কাছাকাছি। বাবলা গাছের মাথায় বসে থাকে একটা স্টর্ক বিলড কিংফিশার। পাশেই তার ছোটভাই কমন কিংফিশার। আমাদের পাঁচরকম মাছরাঙা দেখা হয়ে গেল যে!

সকালবেলা, বৈতরণীর ধারে একলা নৌকো ফিসফিস করে জানতে চায়- কেমন হল? জবাব দিইনি। এত সহজ প্রশ্নের কোনও উত্তর হয়!

বেড়ে ওঠা ছোটো শহরে, প্রকৃতি যেখানে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যেত। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে কলকাতায় আসা। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে আড়াই দশকের বসত। বহুজাতিক সংস্থায় পদস্থ কর্মী। কাজের ফাঁকে যন্ত্রকে বাংলা শেখানোর গবেষণা। সে পথেই ডক্টরেট প্রাপ্তি। বাংলা আর রবি ঠাকুরের ভালোবাসায় tagoreweb.in সহসৃষ্টি। প্রকৃতির নেশায় টালমাটাল। ফাঁক পেলেই পালিয়ে যাওয়া জঙ্গল-পাহাড়-নদীর কাছে। গবেষণা, প্রযুক্তি এবং ব্যবসা নিয়ে ইংরেজিতে প্রবন্ধ লেখেন দীর্ঘদিন ধরে। ইদানীং বাংলাতেও লিখছেন।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *