সিজন চেঞ্জ মানেই ঘরের একরত্তি সদস্যটির হাঁচি–কাশি–সর্দি আর মায়ের নাভিশ্বাস! কী করে সামলাবেন সিজন চেঞ্জের এই সব ভাইরাসদের? বাচ্চাদের মায়েদের নিশ্চিন্ত করলেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ড আশা মুখোপাধ্যায়। শুনলেন কস্তুরী ভারভাদা।
করোনাভাইরাস এসে পর্যন্ত আমাদের মুখে করোনা ছাড়া গীত নেই। কিন্তু মুশকিল হল, করোনা এসেছে বলে বাকি সব ভাইরাসেরা যে ভয়ে পাড়াছাড়া হয়ে গিয়েছে তা তো নয়! তারাও বহাল তবিয়তে বিদ্যমান! আর কে না জানে, আজকাল লাগামছাড়া দূষণের জেরে আলাদা আলাদা করে সব ঋতুর পরিবর্তন বোঝা না-গেলেও এই গরমের শুরু আর শীতের শুরুতে নানা রকম রোগবালাই এসে থানা গেড়ে বসে। ফলে ঋতুর আসা-যাওয়া বুঝি আর না-বুঝি, সিজন চেঞ্জ কথাটার সঙ্গে আমরা কমবেশি সকলেই পরিচিত। বিশেষত যাঁদের বাড়িতে খুদে সদস্য রয়েছেন, তাঁরা তো বটেই। কারণ বাচ্চারা এই সময় অসুস্থ হয় সবচেয়ে বেশি। আর এ বার ভয় আরও খানিকটা বেশি কারণ করোনার লক্ষণে আর সাধারণ ফ্লুয়ের লক্ষণে খুব একটা তফাত বোঝা যাচ্ছে না, যতক্ষণ না সোয়্যাব টেস্ট করা হচ্ছে! কাজেই প্রবল উদ্বেগে সব বাবা-মায়েরাই।
বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ড আশা মুখোপাধ্যায় জানালেন, এই সিজন চেঞ্জের সময়টায় বাচ্চাদের সর্দিকাশি, জ্বর আর পেটের গন্ডগোল– এই উপসর্গগুলি সাধারণত বেশি দেখা যায়। তবে এগুলো অধিকাংশই কিন্তু হয় পরিবেশ দূষণজাত কারণে। শীত থেকে গরম পড়ার সময় বা উল্টোটা… দুই ক্ষেত্রেই বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ বাড়ে। ফলে শ্বাসকষ্ট, সর্দিকাশি, অ্যালার্জির প্রকোপ বাড়ে।
যাঁদের ঘরে বাচ্চা আছে সে সব মায়েরা সিজন চেঞ্জের জ্বর-সর্দিকাশির সঙ্গে পরিচিত হলেও এ সময়টায় খুবই আতান্তরে পড়ে যান। আর আগেই বলা হয়েছে, করোনার আক্রমণে এ বার সকলেই কী রকম বিপর্যস্ত। তবে সাধারণত এই সিজন চেঞ্জের সময় চার রকম ভাইরাসই বাচ্চাদের বেশি আক্রমণ করে- ফ্লু ভাইরাস, রাইনো ভাইরাস, অ্যাডিনো ভাইরাস, এবং আরএসভি (রেসপিরেটরি সিনসিটিয়াল ভাইরাস)। ফলে ইনফ্লুয়েঞ্জা, ঠান্ডা লেগে গলা ব্যথা, সর্দিজ্বরে কাবু হয়ে পড়ে বাচ্চারা। এছাড়া হাঁপানির প্রকোপও এই সময়টায় বাড়ে। যদিও হাঁপানির বিষয়টা অনেকটাই বংশগত, তৎসত্ত্বেও অতিরিক্ত দূষণ, দীর্ঘদিন কফ জমে সর্দিকাশি, সব মিলিয়ে বাচ্চাকে হাঁপানির দিকে নিয়ে যায়।
সতর্কতা
- চার-পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এতটাই কম থাকে যে, সর্দিকাশিতে ভুগছেন এমন কারও সংস্পর্শে এলেই তাদের রোগ ধরে যায়। তাই সর্দিকাশি বা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন এমন কারও কাছে বাচ্চাকে দেবেন না। বাবা-মায়ের যদি সর্দিকাশি হয়, তাহলে মাস্ক পরে বাচ্চাকে কোলে নেবেন বা বাচ্চার কাজ করবেন। যে কোনও অবস্থাতেই বাচ্চার মুখে মুখ লাগিয়ে আদর করা ও চুমু খাওয়া একদম উচিত নয়।
- ঘরে ভারী পর্দা, কার্পেট একদম রাখা চলবে না। যতটা সম্ভব ঘর ধুলোবালি মুক্ত রাখতে হবে। বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় নিয়মিত বদলে গরমজলে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
- ঘরের জানলা-দরজা বন্ধ করবেন না। ঘরের মধ্যে অনেকে একসঙ্গে থাকেন, শ্বাস নেন. সেই দূষিত হাওয়াটা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া দরকার। তাই জানলা খুলে রাখুন। বাইরের তাজা হাওয়াবাতাস ঘরের মধ্যে ঢুকতে দিন, বাচ্চার শরীর ভালো থাকবে। ঘরের বদ্ধ পরিবেশে অধিকাংশ সময়ে এসি চলে, রোদ্দুর ঢোকে না। ফলে ঘরের মধ্যে নানারকমের অদৃশ্য ফাঙ্গাস জন্মানোর সুযোগ থাকে। এর থেকেও বাচ্চাদের ইনফেকশন হতে পারে। তবে বাইরে থেকে অতিরিক্ত ধোঁয়া বা ঠান্ডা হাওয়া এলে অবশ্য জানলা বন্ধ করতেই হবে।
- বাচ্চাদের ভ্যাকসিন দিতে দেরি করবেন না। এমএমআর, ফ্লু ভ্যাক্সিন, নিউমোকক্কাল ভ্যাক্সিন, রোটা ভ্যাক্সিন যথাসময়ে দিতে হবে। এগুলো সাধারণত বাচ্চাদের প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। রোগমুক্ত রাখে।
- ফ্লু ভাইরাস কিন্তু বাচ্চাদের স্কুল থেকেও খুব সংক্রামিত হয়। এখন দু’বছর বা তার আগে থেকেই বাচ্চারা স্কুলে যায়। ব্যস্ত মা-বাবারা অল্প সর্দিকাশি থাকলেও অনেক সময়েই বাচ্চাকে স্কুলে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু এটা উচিত নয়। সম্পূর্ণ সুস্থ না-হওয়া পর্যন্ত স্কুলে গেলে বাচ্চার নিজের তো বটেই অন্য বাচ্চাদেরও সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এ সময়ে শরীর দুর্বল থাকে, ফলে অন্য কোনও বাচ্চার শরীরে যদি আরও কোনও ভাইরাসের সংক্রমণ হয়ে থাকে, সেটাও সহজেই আপনার শিশুর শরীরে সংক্রামিত হতে পারে।
- বাচ্চাদের বেসিক হাইজিনের শিক্ষা দিতে হবে। সবসময় হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুয়ে তারপর খেতে বসা বা খাবারে হাত দিতে বলুন। স্যানিটাইজারও দিতে পারেন রাস্তাঘাটে চলার সময়। হাঁচি বা কাশি পেলে হাতের মুঠোর মধ্যে নয়, কনুইয়ের কাছে মুখ নিয়ে কাশতে হবে। নাহলে ভাইরাস হাতের পাতায় লেগে অন্য জায়গায় সহজেই সংক্রামিত হবে।
- সিজন চেঞ্জে বাচ্চাদের পেটের গোলমাল একটি অতি সাধারণ সমস্যা। মূলত জল থেকেই এই সমস্যার সূত্রপাত। তাই বাচ্চাকে জল ফুটিয়ে ঠান্ডা করে খাওয়ান। গরম জলে বাচ্চার জিনিসপত্র, চাদর ও জামাকাপড় বারবার ধুয়ে নিন। বাচ্চাকে কোলে নেওয়ার আগে হাত সাবান দিয়ে ধুতে হবে। বাড়ির এবং বাইরের লোক উভয়ের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম প্রযোজ্য। মায়েরা এখন অধিকাংশক্ষেত্রে চাকরি করেন। ফলে বাড়িতে বাচ্চার দেখাশুনো করার জন্য যে আয়া থাকেন, তাঁকেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। তিনি যে পরিবেশ থেকে আসছেন সেটিও পরিচ্ছন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এছাড়া এই সময়টায় এই তিনটি রোগের প্রকোপ দেখা দেওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। সেগুলি হল –
হ্যান্ড–ফুট–মাউথ ডিজ়িজ় – এটা এক ধরনের ভাইরাল ইনফেকশন এবং বেশ ছোঁয়াচে। প্রাথমিক উপসর্গ জ্বর, গা ম্যাজ ম্যাজ। পরে ধীরে ধীরে হাতের পাতা থেকে কনুই পর্যন্ত অংশে, পায়ের পাতা থেকে হাঁটু পর্যন্ত অংশে এবং মুখের বাইরে-ভেতরে বড় বড় ফোসকার মতো দেখা যায়। কারও কারও আবার ছোট ছোট লাল গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে দেখা দেয়। তবে দুই ক্ষেত্রেই চুলকুনি, জ্বালা ভাব থাকে। সাধারণত ক্যালামাইন জাতীয় সুদিং লোশন এবং প্যারাসিটামলেই এটা সেরে যায়। অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন পড়ে না। তবে রোগীভেদে চিকিৎসাপদ্ধতি আলাদাও হতে পারে।
রেস্পিরেটরি সিন্সিটিয়াল ভাইরাস – এই ভাইরাস মূলত থাবা বসায় ফুসফুস এবং শ্বাসনালীতে। প্রাথমিক ভাবে সর্দি, নাক দিয়ে সারাক্ষণ জল পড়া, গলা ব্যথা, মাথা ব্যথা, নাক চুলকোনো, শুকনো কাশি এই জাতীয় উপসর্গ থেকেই রোগটি শুরু হয়। পরে শ্বাসকষ্টের দিকে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেক্ষেত্রে দ্রুত ডাক্টারের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।
অ্যাডিনো ভাইরাস – এই ভাইরাস থেকে মূলত যে ধরনের ইনফেকশন হয়, সেগুলি নানাবিধ। সাধারণ জ্বর-সর্দি-কাশি-গলাব্যথাও হতে পারে। আবার কখনও কখনও এর থেকে অ্যাকিউট নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, কনজাংকটিভাইটিস এবং পেটের নানারকম ইনফেকশনও দেখা দিতে পারে। তবে কোনও শিশুর যদি হৃৎপিণ্ডের সমস্যা থাকে, সেক্ষেত্রে এর প্রভাব মারাত্মক হতে পারে। কখনও কখনও এই ভাইরাল ইনফেকশন মস্তিষ্কেও প্রভাব ফেলে যাকে আমরা এনকেফেলাইটিস বলি। সেক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হতে পারে। প্রয়েজনে আই-সি-ইউতেও রাখতে হতে পারে।
কস্তুরী ইতিহাসে এমএ পাশ দিয়েছেন। চাকরিও করেছেন বেশ কিছু কাল। এখন ফ্রিলান্স লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রিকায়। বেশ কিছু বছর আনন্দবাজার পত্রিকার "উৎসব" পত্রিকায় নিয়মিত লিখেছেন। গান শুনতে আর সিনেমা দেখতে ভারী ভালবাসেন।