চল রে চল সবে ভারতসন্তান
মাতৃভূমি করে আহ্বান।।

কাছারিবাড়ি থেকে অন্দরমহলে ঢুকেই পূর্তমন্ত্রী টের পেলেন, বহুদিন বাদে মিষ্টিমাসি বাড়িতে এসেছেন। ঘরদোর গোপালের তিনশো জর্দার গন্ধে ভরপুর, দম নিলেই মহার্ঘ বাতাস মাথায় ঢুকে কেমন মদালস করে তুলছে, চোখে ঘোর ঘনিয়ে আসছে, অন্ধকার আকাশে একটি একটি করে তারা জেগে ওঠার মত ছেলেবেলার সব কথা মনে পড়ছে। হিট কোম্পানির মশা তাড়ানোর স্প্রের মধ্যে অনেকটা এরকম ঝাঁঝ মেশানো থাকে.

একথা সেকথা বলতে বলতে মিষ্টিমাসি দুম করে জিজ্ঞেস করলেন— হ্যাঁরে বিনু, তোরা নাকি রামগড় শ্রীকলোনির মোড়ের নেতাজিকে সরিয়ে ফেলছিস? পূর্তমন্ত্রীর ভেতরে সঙ্গে সঙ্গে রাডার সিস্টেম চালু হয়ে গেল। বিড়বিড় করে তিনি বললেন— যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধে হয়।

বয়শ আশির কোঠা পেরিয়ে গেলেও মিষ্টিমাসির কান এখনও বাঘের মাসির সঙ্গে পাল্লা দেয়। ঝাঁজিয়ে উঠে বললেন— হ্যাঁ, কলির সন্ধে হয়। তা না হলে মহাপুরুষদের স্ট্যাচু নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলা খেলতে পারতিস? বলি, ওনাকে সরিয়ে তোরা কী করবি? এলাকার উন্নয়ন হবে? মোড়ের রাস্তা চওড়া হবে? বুকের ছাতিও তাহলে ছাপান্ন ইঞ্চি চওড়া হবে। আরে গোমুখ্যু, এটাও জানিস না, যাঁহা বাহান্ন তাহাই ছাপান্ন?

ভুরভুরে জর্দার সুগন্ধ আরেকবার বুক ভরে টানলেন দুঁদে মন্ত্রীমশাই—আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, বিশ্বব্যাঙ্কের টাকা আমি গুছিয়ে নিয়েছি, রাস্তা সম্প্রসারণ বা মন্ত্রের সাধন, সব পেলে নষ্ট জীবন।

—কথার ছিরি দেখ! কলি, ঘোর কলি। শবাজারে রাজা কালীকেষ্ট দেবের লাল মন্দিরের কথা মনে নেই? মন্দির সরাতে গিয়ে কত কুলিকামিন মুখে রক্ত উঠে মরল, জানিস না? সেই দশা হবে আবার। রসাতলে যাবে সব। শেষবারের মত বলছি, নেতাজিকে সরানো চলবে না, চলবে না।

—জেনেশুনে বিষ করেছি পান…

ঠেলার নাম বাবাজি

অ্যাসিস্ট্যানট ইঞ্জিনিয়ার নন্দীসাহেব দরদর করে ঘামছিলেন। আগস্ট প্রায় শেষ, তবু গুমোট গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। রাত একটা বাজল, কোত্থাও একফোঁটা হাওয়া নেই। রামগড় শ্রীকলোনির মোড় সুনশান। ছিটেফোঁটা গাড়িঘোড়া একটু আগেও ফাঁকা রাস্তায় হুশহাস করে বেরিয়ে যাচ্ছিল বটে, এইমাত্র পুলিশ গার্ডরেল টেনে টেনে এনে সবকিছু আটকে দিল। ধোঁয়াধুলো কোলাহলহীন এই এক টুকরো জায়গাতে বাতাসও যেন থমকে দাঁড়িয়ে। ধুস। ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস, নেতাজির চোখে জ্বলে আমাদের সর্বনাশ। আকাশ থেকে টুপটুপ করে লাইনদুটো যেন মাথার ওপর খসে পড়ল।

নন্দীসাহেব এবার একটু চনমনে হয়ে উঠলেন। স্বভাব কবি বলে ঘরে বাইরে তো আর এমনি এমনি নামডাক হয়নি, সমঝদারো কে লিয়ে ইশারা হি কাফি হ্যায়। প্রতিবছর দপ্তরের সাংস্কৃতিক সম্মেলনের স্যুভেনিরে তাঁর ছড়া প্রথম পাতায় ছাপা হবেই হবে। এখন সৃষ্টিসুখের উল্লাসে ঘামতে ঘামতেও বেশ টের পাচ্ছিলেন, ছড়াটা টাটকা টাটকা কাউকে শোনাতে না পারলে আত্মার খিদে মিটবে না।

তালবাগান থানার ওসি অমিতাভ পাল দুলকিচালে সামনে এসে দাঁড়ালেন— আপনার ট্রাক মাউন্টেড ক্রেন তো রেডি। চমৎকার। ধরা যাক নেতাজিকে এবার। আরে, এত ঘামছেন কেন মশাই?

— ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস…ইয়ে…

—আপনারা সুখিপুরুষ, গরম তো লাগবেই। আর আমরা তো শান্তিরক্ষক, তাই অন্ধ। জানেনই তো অন্ধের কি বা দিন, কি বা রাত্রি। শান্তিরক্ষার জন্য সবকিছুর ঊর্ধে উঠে স্ট্যাচু হয়ে থাকতে হয়। সরি, কিছু মনে করবেন না। জ্ঞান দিয়ে ফেললাম।

—ভ্যাপসা চোখে সর্বনাশ। এই যাঃ, সব গুবলেট হয়ে গেল। আসলে হ্যান্ডমাইকের ব্যাটারিটা ডাউন হয়ে গেছে হঠাৎ। গলা ফাটিয়ে চেঁচালেও ক্রেনের ড্রাইভারের কানে কথা গিয়ে পৌঁছবে না। কীভাবে কাজ শুরু করি, বলুন তো?

কুছ কুছ হোতা হ্যায়

আমরা এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি দক্ষিণ কলকাতার রামগড় শ্রীকলোনির মোড়ে। জানেন তো, এখানকার নেতাজির মূর্তিটি কম করে পঞ্চাশ বছরের পুরোন। দশকের পর দশক ধরে মূর্তিটি স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনের সুখদুঃখের সাক্ষী। বহু ঝড়ঝাপটা সয়েও এটি এখনও অক্ষতভাবে মাথা উঁচু করে নিজের জায়গায় বহাল। সম্প্রতি বিশ্বব্যাঙ্কের টাকায় রাস্তা সম্প্রসারণ ও এলাকার উন্নতির জন্য মূর্তিটিকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশু প্রয়োজন। হেরিটেজ কমিশন, পূর্ত ও নগরোন্নয়ন দপ্তরের সমবেত উদ্যোগে এখন এটিকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগানে বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন থেকে এর চারদিকে শোভা পাবে সবুজ বনবীথি ও গম্ভীর চেহারার সব ব্রিটিশ রাজপুরুষ। mahanishkramanবিদেশি রাজশক্তির বিরুদ্ধে নেতাজির সংগ্রামকে স্মরণীয় করে রাখবার জন্য এই সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে। আমাদের নিউজ চ্যানেলের ক্যামেরাম্যানকে এবার অনুরোধ করছি, ক্রেন বসানো ট্রাকটির গায়ের লেখাটিতে একবার ফোকাস করতে। হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে, আপনারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, বড় বড় হরফে লেখা, বুঢ়ি নজরবালে তেরা মুহ কালা। আশা করছি, লেখাটির অর্ন্তনিহিত তাৎপর্য আপনারা ঠিকঠাক বুঝতে পেরেছেন। আপনারা একই সঙ্গে দেখতে পাচ্ছেন, রাত গভীর হলেও এই ঐতিহাসিক ঘটনা দেখবার জন্য কিছু দর্শক এখানে হাজির। স্বদেশি নিউজ চ্যানেলের নিজস্ব সংবাদদাতা হিসেবে আমি এঁদের মধ্যে থেকে একজনকে এই মুহূর্তে ডেকে নেব। তবে আগাম জানিয়ে রাখি, এঁর নাম খুব সম্ভবত, আমি কিছু জানি না।

— আপনার নাম কী?
— আমি কিছু জানি না স্যার।
— গলায় ঝোলানো বাঁশি, হাতের লাঠি দেখে মনে হচ্ছে, আপনি এই এলাকার নাইটগার্ড।
— তা তো জানি না স্যার।
— এই মূর্তিটিকে আপনি কবে থেকে দেখছেন?
— আমি কিছু জানি না স্যার।
— উদ্বোধন কে করেছিলেন, বলতে পারবেন?
— না। পারব না।
— এই ফলকে তো স্পষ্ট লেখা আছে, কত সালে এটি বসানো হয়েছিল, কে উদ্বোধন করেছিলেন, ভাস্করের নাম, সবকিছু। এসব কখনো পড়েননি?
—আমি কিছু জানি না স্যার।
— এতদিনের পুরোন মূর্তি নিয়ে এলাকার মানুষদের নিশ্চয় আবেগ, ভালোবাসা যথেষ্ট পরিমাণে আছে। আচমকা মূর্তি সরিয়ে নিয়ে গেলে সেই আবেগ, বিশ্বাসে কিছুটা ধাক্কা পড়তেই পারে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জন্মাতে পারে। আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় না, এই বিষয় নিয়ে এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে প্রতিটি স্তরে দফায় দফায় সরকারি বৈঠক করার দরকার ছিল?
— আমি কিছু জানি না স্যার।

স্বদেশি চ্যানেলের দর্শকবন্ধুরা এতক্ষণ ধরে মূর্তি অপসারণ ও পুনঃস্থাপনের কর্মকাণ্ড দেখলেন। এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রতিনিধি আমি কিছু জানি না মহাশয়ের প্রতিক্রিয়াও আপনারা মনোযোগ দিয়ে দেখেছেন। দেশ ও জাতির স্বার্থে এই ধরনের উন্নয়নমূলক কাজের পেছনে সবসময় জনগণের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতার প্রয়োজন, এটাই আমাদের বক্তব্য। এখন থেকে নিজের নিজের এলাকার মনীষীদের মূর্তির অস্তিত্ব নিয়ে যথাযথ পর্যালোচনা শুরু করবেন এবং আমি কিছু জানি না ধরনের মানুষের সংখ্যা কমিয়ে আনবেন, এই আশা রেখে প্রতিবেদন শেষ করছি। ভাষ্যে ছিলাম অর্কপ্রভ রায়, ক্যামেরায় শক্তি সামন্ত।

যেতে নাহি দিব

গুমোট গরমের ভেতর কোন মহাসিন্ধুর ওপার হতে এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া। টুপটুপ করে ফুলের পাপড়ির মত বৃষ্টি নামছিল। গভীর রাতে পার্কে, পাড়ার মোড়ে, দোকানের সামনে নেতাজির ছোট বড়, আবক্ষ পূর্ণাঙ্গ মূর্তিগুলি জেগে উঠে নড়াচড়া করছিল, বিস্ফারিত চোখে আগুন জ্বালাচ্ছিল, গলার শিরা ফুলিয়ে মুঠো হাত শূন্যে ছুঁড়ে শ্লোগান দিচ্ছিল, ‘পুনর্বাসনের নামে গণআন্দোলনের নেতাকে গ্রেপ্তার করা যায় না যাবে না। নেতাজি ফিরে এসো, জলদি এসো।’ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ওপর কালো পরি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নিজের মনে চক্কর কাটছিল। পরির ট্রাম্পেটে করুণসুরে বাজছিল, গড সেভ দি কিং।

‘কারুকথা এইসময়’ পত্রিকায় পূর্বপ্রকাশিত। বানানবিধি অপরিবর্তিত।

ছবি সৌজন্য: Flickr

জন্ম ১৯৫৬, কলকাতা। মধ্যবিত্ত জীবন চর্যায় লালিত। প্রচলিত ধ্যানধারণায় সদাসংশয়ী। আশির দশকের গোড়ায় নতুন নিয়ম গল্প আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা। বিগ ও লিটল ম্যাগাজিনে মৌলিক ও অনূদিত গল্প নিয়মিত লিখে চলেছেন। দুটি গল্পের বই -- কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার ও অন্যান্য এবং দৈনিক রাশিফল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *