ম্যাক্সমুলার ভবনে পর্তুগিজ শিখতে যেতুম এককালে। তেমনই এক দিনে আমার জন্য এক চমক অপেক্ষা করছিল। আমাদের অধ্যাপিকা মাদাম মারিয়া নাতালিয়া বিয়েক এসে জানালেন যে ম্যাকাওয়ের তাইপা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রীষ্মকালীন শিক্ষাক্রমে যোগ দেওয়ার জন্য কলকাতা থেকে যে তিনজন নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আমি একজন আর অন্যজন সুব্রত। তৃতীয়জন পূর্ণা চৌধুরী, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্তুগিজ ক্লাসের ছাত্রী। উপরন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপকও বটে।
১৯৯২ সাল। তার প্রায় বছরখানেক আগে এক বন্ধুর কাছে খবর পেয়ে যখন ম্যাক্সমুলার ভবনে পর্তুগিজ ভাষা শিক্ষার ক্লাসে যোগ দিয়েছিলাম, তখন এরকম সম্ভাবনার কথা কল্পনাতেও ছিল না। সাউথ পয়েন্ট স্কুলে দিদিমণি থাকার পাশাপাশি সেই নব্বুয়ের দশকে আমাকে বিদেশি ভাষা শেখায় প্রথম উৎসাহিত করেছিলেন আমার সাংবাদিক স্বামী শংকর ঘোষ, যিনি নিজে ফরাসি ভাষায় স্বচ্ছন্দ ছিলেন। রাশিয়ানও জানতেন অল্পবিস্তর। আমি তখন গোলপার্কে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচারে দু’বছরের স্প্যানিশ পাঠ শেষ করেছি। ফাইনাল পরীক্ষাতে সেকেন্ডও হয়েছি। এরই মধ্যে পর্তুগিজ শেখার সুযোগ। ভাষার দিক থেকে স্প্যানিশ-পর্তুগিজকে ‘তুতোভাই’ বলা যেতে পারে। দুইয়ের মধ্যে অজস্র মিল। তাই আমার পক্ষে একটু সহজ হয়েছিল এই ভাষাটা শেখা।
যাই হোক, ওই মধ্য চল্লিশে এসে এক বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী হয়ে ক্লাস করব, পর্তুগিজ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হব, নতুন দেশ দেখব- এসব ভেবে রোমাঞ্চিত হলাম। নাতালিয়া জানালেন, জুলাই মাস থেকে ক্লাস শুরু হবে। ১০০ হংকং ডলারের একটি ড্রাফট পাঠিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম নিবন্ধীকরণ ছাড়া আমাদের আর কোনও খরচ নেই। প্লেনের টিকিট থেকে শুরু করে ম্যাকাও থাকাকালীন আমাদের যাবতীয় খরচপত্র বহন করবেন পর্তুগিজ কালাচারাল ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ ও তাইপা বিশ্ববিদ্যালয়।

নির্দিষ্ট দিনে যে যার মতো বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণা চৌধুরীর সঙ্গে আলাপও হয়ে গেল ওখানেই। কলকাতা থেকে বিকেলের ফ্লাইটে দিল্লি। সেখান থেকে শেষ রাতে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ়ের ফ্লাইটে হংকং। দিল্লিতে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্তুগিজ ভাষার চার ছাত্র। ওদের মধ্যে একটি মেয়ে, বন্দিতা কুমার ছিল এক্কেবারে ছেলেমানুষ। সে তার দিল্লির সহপাঠীদের সঙ্গ ছেড়ে সেই যে আমাদের হাত ধরল, ম্যাকাও বাসের শেষদিন পর্যন্ত সে হাত ছাড়েনি।
ম্যাকাও আদতে চিনদেশের অংশ। কোনও এক প্রাচীনকালে জর্জ অ্যালভাদর নামে এক পর্তুগিজ নাবিক সমুদ্রে ঘেরা ম্যাকাও ভূখণ্ডে পা রেখেছিলেন। বিদেশিদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে সেই সময়ে চিন খুব আগ্রহী না হলেও নানা সমস্যায় জর্জরিত চিন পরে প্রায় বাধ্য হয়েই ১৫৫৭ সালে পর্তুগালের সঙ্গে একটি বাণিজ্যিক চুক্তি করে এবং অচিরেই ম্যাকাও এক অতি সমৃদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়। ইউরোপের বেশকিছু দেশেরই এই ভূখণ্ডটির ওপরে নজর থাকলেও কীভাবে শেষ পর্যন্ত ম্যাকাওতে পর্তুগিজ উপনিবেশ গড়ে ওঠে, সে অবশ্য এক দীর্ঘ ইতিহাস। তবে মাঝখানে ষাটটি বছর বাদ দিলে, সেই সময় থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত পর্তুগিজরা নিরবচ্ছিন্নভাবে ম্যাকাওতে তাদের শাসন জারি রেখেছিলেন।

১৯৯২ সালে আমরা যখন ম্যাকাওতে গিয়েছি, তখনও দেখেছি পাহাড়চূড়ায় পর্তুগালের পতাকা সগর্বে উড়ছে। হংকং থেকে সামান্য দূরত্বে দক্ষিণ চিন সমুদ্র পেরিয়ে ম্যাকাও ভূখণ্ড। এর সঙ্গে তাইপা আর কোলোয়ান নামের আরও দুটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত বিশ্বের অন্যতম ক্ষুদ্র উপনিবেশ ম্যাকাও। ১৯৮৭ সালে চিন ও পর্তুগালের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে ১৯৯৯ সালের ২০ ডিসেম্বরের মধ্যরাত থেকে ম্যাকাও যুক্ত হয়ে গেছে তার মাতৃভূমি চিনের সঙ্গে।
এ তো গেল ইতিহাস। এবার যাত্রাপথে ফিরি। হংকং বিমানবন্দরে নেমে, বেরিয়ে বাসে করে ফেরি টার্মিনাল স্টেশন। এখান থেকে স্পিডবোট, জেট ফয়েল, হাইড্রো ফয়েল প্রভৃতি নানা ধরনের নৌকো সারাদিন হংকং-ম্যাকাও যাত্রী পারাপার করে। স্পিডবোটের ভাড়া অপেক্ষাকৃত কম। তাই বেলা তিনটে নাগাদ একটা আমরা একখানি স্পিডবোটে উঠে বসলাম। দু-আড়াই ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম ম্যাকাও। ওখানে আবার ভিসার জন্য লাইন। মাত্র কুড়ি দিনের ভিসা মিলল একটা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে। আমাদের কোর্স চার সপ্তাহের। বুঝলাম কুড়ি দিন বাদে আবার অর্থদণ্ড দিতে হবে বাকি সময়ের ভিসার জন্য। এসব কথাবার্তায় অনেক দেরি হয়ে গেল।
অবশেষে ট্যাক্সি ধরে তাইপার পথে। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে চলেছি আমরা। গোধূলির পড়ন্ত আলোয় পাহাড়ের গায়ে তাইপা দ্বীপের সে এক ভারি মায়াময় রূপ। খানিকটা গিয়ে পট পরিবর্তন হল। সমুদ্রের বুকে বিশাল দীর্ঘ তাইপা সেতু। সেতু পেরিয়ে তাইপা বিশ্ববিদ্যালয়। ট্যাক্সি থেকে নেমে চোখে পড়ল মস্ত বিশ্ববিদ্যালয় ভবন আর তার পাশেই দশতলা ছাত্রাবাস। সামনের চত্বর জুড়ে নাম-না-জানা বাহারি ফুলের মেলা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব দফতর অবশ্য ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও ছাত্রবাসের চিনে প্রহরী কিছুতেই আমাদের ঢুকতে দিতে চাইলেন না। ভাঙা ইংরেজিতে তাঁর সেই একই বক্তব্য, পরদিন সকালের আগে কিছু করা সম্ভব নয়। এদিকে আমরা সারাদিন প্রায় অভুক্ত। শারীরিক ও মানসিকভাবে আমরা তখন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। হতাশ হয়ে চত্বরের বাঁধানো চাতালে মালপত্র নিয়ে আমরা চার মূর্তি বসে পড়লাম। কাছেপিঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও কর্মচারীও চোখে পড়ল না, যিনি আমাদের সাহায্য করতে পারেন। বিদেশবিভুঁইয়ে রাতটা কী পথে কাটবে নাকি!

অবশেষে টোনি গ্রিফ নামের এক পাক্কা ইংরেজ ও তাঁর সঙ্গী কেরলের বিশ্বনাথের নজরে পড়ে গেলাম আমরা। আমাদের ওইভাবে রাস্তায় বসে থাকতে দেখে ওঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, যে বিপদে পড়েছি। আমরা তিনজনে কলকাতার লোক শুনে টোনি বেজায় খুশি। বাবার কর্মসূত্রে গ্রিফের শৈশব ও কৈশোরের সিংহভাগ সময় কেটেছে কলকাতায়। আমাদের দেখে তিনি বোধহয় একটু স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েছিলেন সেদিন। সজোরে সুব্রতর পিঠ চাপড়ে অভয় দিলেন। বললেন, এটা কোনও সমস্যাই নয়। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই প্রহরীরও দেখি গ্রিফকে দেখে মুখে হাসি ফুটেছে। ওর টেবিলের ইন্টারকম থেকেই গ্রিফ দু’চারটি ফোন লাগালেন। আলিবাবার চিচিংফাঁক মন্ত্রের মতো স্টুডেন্ট কাউন্সিলের দফতরের দরজা খুলে গেল। সংশ্লিষ্ট কর্মচারীও হাজির হলেন। তিনি আমাদের প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র দেখলেন, কিছু সইসাবুদ করালেন। আর তারপরই পেয়ে গেলাম যে যার ঘরের চাবি। সবটাই ঘটল এক অপরিচিত মানুষের দাক্ষিণ্যে। গ্রিফ বলে দিলেন, ওঁরা নীচে অপেক্ষা করবেন। মালপত্র ঘরে জমা করে একটু ফ্রেশ হয়ে আমরা যেন তাড়াতাড়ি চলে আসি। পাশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন। ওখানে রাতের খাবারটা মিলতে পারে।
আমরা তিনজন মেয়ে চলে এলাম ন’তলায়, সুব্রত গেল ছ’তলায়। আমি আর পূর্ণা একঘরে থাকব। পাশের ঘরটিতে থাকবে বন্দিতা। দ্বিশয্যা বিশিষ্ট ছিমছাম সুন্দর সাজানো ঘর। দেয়ালে দু’টি বই রাখার ঝুলন্ত তাক। তাকের নীচে দু’জনের দু’টি পড়ার টেবিল ও চেয়ার। এক পাশে জামাকাপড় রাখার আলমারি। একমাস থাকার পক্ষে চমৎকার ব্যবস্থা। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে উলটো দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ভবন। আরও ডানদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় রাতের অন্ধকারে অস্পষ্ট হলেও ঠাহর করতে পারলাম, অনন্ত সমুদ্র। ঘর এক ঝলক দেখে নিয়ে, মুখেচোখে জল দিয়ে তড়িঘড়ি নেমে এলাম নীচে।
আরও পড়ুন: আলপনা ঘোষের কলমে: সংবাদজগতের উত্তমকুমার
ঘড়ির কাঁটা রাত আটটা পেরিয়ে গেছে। ক্যান্টিন ধুয়েমুছে সাফ। কিছুই মিলল না সেখানে। গ্রিফ আমাদের কোনও ওজর আপত্তি শুনলেন না। ট্যাক্সি করে কাছে ‘তন্দুর’ নামে ভারতীয় রেস্তরাঁয় নিয়ে গেলেন। নাম থেকেই বোঝা যায় এখানে প্রধানত উত্তর ভারতীয় খাবার মেলে। আমাদের সুব্রত আবার ডিম ছাড়া আর কোনও আমিষ মুখে তোলে না। মধ্যপ্রদেশের মেয়ে বন্দিতা তো কট্টর নিরামিষাশী। সাহেব দু’রকম খাবারেরই অর্ডার দিলেন।
এদিকে মেনুতে খাবারের দাম দেখে আমাদের তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া! কিন্তু তখন তো সব কিছু আমাদের হাতের বাইরে। চারজনেরই খিদেতে পেটে ছুঁচোয় ডনবৈঠক মারছে। কাজেই দুশ্চিন্তা ভুলে আমরা চটপট টেবিলে আসা খাবারের সদ্ব্যবহারে মনঃসংযোগ করলাম। গ্রিফ গোপ্পে মানুষ। খেতে খেতে তাঁর ছেলেবেলায় দেখা কলকাতার নানা গল্প করলেন। অনেককাল পরে কীভাবে একবার ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় বিশ্বনাথ ও টনি প্রাণে বেঁচে ম্যাকাও পৌঁছেছিলেন তার রোমহর্ষক কাহিনিও শোনালেন। খাওয়ার শেষে আমরা টাকার ব্যাগে হাত দিতেই হুঙ্কার ছাড়লেন তিনি। আমরা মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম। আমাদের আশ্বস্ত করে পুরো বিলটা গ্রিফই মেটালেন।
পরের দিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠে জানলা দিয়ে দেখি সামনে বিশাল সমুদ্র। ঘর থেকে বেরিয়ে আবার অন্য দৃশ্য। ঘন সবুজ পাহাড় আর তার মাঝখান দিয়ে প্রায় আবছা দেখা যাচ্ছে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট গ্রাম। মনে হয় যেন পটে আঁকা ছবি। ওইদিন অর্থাৎ মঙ্গলবার থেকেই ক্লাস শুরু। আমি আর পূর্ণা একই ক্লাসে, সুব্রত আর বন্দিতা অন্য ক্লাসে। বিভাগীয় প্রধান জর্জ কাভালিরো আমাদের স্বাগত জানিয়ে পাঠ্যক্রমের বইপত্র, খাতাকলম হাতে তুলে দিলেন।
জানা গেল, সপ্তাহে পাঁচদিন ক্লাস। সকাল ন’টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত। প্রতি শুক্রবার রাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর তার সঙ্গে বিশাল খাওয়াদাওয়া। শনিবার করে অধ্যাপকদের তত্ত্বাবধানে আমরা যাব ম্যাকাও দর্শনে। সপ্তাহের পাঁচদিন ভাষা শিক্ষা চলবে দ্রুত গতিতে। এর মাঝে মাঝে মৌখিক ও লিখিত পরীক্ষায় বসতে হবে। সামনের রোববার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাঙ্কোয়েট হলে আমাদের গ্রীষ্মকালীন কোর্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে আর শেষে ডিনার। অধ্যাপক ও ছাত্রদের পরিচয়ের প্রথম ধাপ হবে এই অনুষ্ঠান।

রোববারের অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হল। স্থানীয় সরকারের শিক্ষা দফতর, পর্তুগিজ সংস্কৃতি বিভাগের সঙ্গে যৌথভাবে নবাগত বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের স্বাগত জানালেন। আমাদের অধ্যাপকদের নির্দেশ মতো আমরা যে যার দেশের জাতীয় পোশাক পরে এসেছিলাম। আমি আর পূর্ণা সাউথ ইন্ডিয়ান সিল্কের শাড়ি, বন্দিতা পরেছিল কাশ্মিরী কাজ করা সালোয়ার কামিজ। সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা আর টুপি মাথায় সুব্রতকেও চমৎকার দেখাচ্ছিল সেদিন। পরিচয় হল চিন, জাপান, কোরিয়া থেকে আসা ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও। গোয়া থেকে এসেছিল দুই বোন, তাদের সঙ্গেও আলাপ হল সেদিন।

পর্তুগিজ অধ্যাপকেরাও এগিয়ে এসে আলাপ করলেন। ছাত্র থেকে অধ্যাপক সকলেরই নজর কেড়েছিল সেদিন আমার আর পূর্ণার শাড়ি। অধ্যাপকদের মধ্যে জর্জ কাভালিরো, ইসাবেলা আর কার্লসের সঙ্গে একটা চমৎকার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। কার্লস ওঁদের মধ্যে বয়সে অনেকটাই ছোট। ওঁকে দেখলে মনে হত অধ্যাপক নয়, কলেজ-পড়ুয়া। ইসাবেলা আর জর্জ মধ্যবয়সী। ভারতীয় দর্শন, সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগের কথা প্রকাশ পেত ওঁদের কথাবার্তায়। এসব নিয়ে পড়াশুনো করতে ভারতবর্ষে এসে বেশ কয়েক মাস কাটিয়েও গিয়েছিলেন ওঁরা দুজন। জাতি হিসেবে প্রায় বাঙালিদের মতোই ভোজনরসিক পর্তুগিজরা। জর্জ ভারতীয় খাবারের ভক্ত। জানালেন, এখনও সময় পেলেই তিনি চলে যান ম্যাকাওয়ের ভারতীয় রেস্তোরাঁয় তাঁর পছন্দের খাবারের সন্ধানে।
ক্লাস শুরু হবার পরে পড়াশুনোর চাপ কাকে বলে, তা এত বছর বাদে নতুন করে টের পেলাম। আমাদের অধ্যাপিকা ইসমেনিয়া ডিসুজ়া বেশ কড়া ধাতের। পড়া করে না গেলে যে ভাবে ছাত্রছাত্রীদের বকুনি দিতেন, তাতে ফাঁকি মারার কথা কল্পনাও করতে পারতাম না। সত্যি কথা বলতে কী, এই বয়সে নতুন করে পড়াশুনো বেশ উপভোগ করছিলাম আমি।

বেলা একটায় ক্লাস শেষ হলে আমরা সোজা ক্যান্টিনমুখো হতাম। খাবার মোটামুটি সস্তা। পর্তুগিজ-চিনে দু’ধরনের খাবারই মিলত, তবে সবই আমিষ পদ। লক্ষ্য করলাম বাঙালিদের মতো চিনেরাও ভাত খেতে ভালোবাসে। প্রতিটি পদের সঙ্গে এক প্লেট চমৎকার সরু সাদা চালের ভাত। পূর্ণা আর আমি প্রায় সর্বভূক। কিন্তু বন্দিতা আর সুব্রতকে নিয়ে বড়ই সমস্যা। শেষ পর্যন্ত ম্যাকাওয়ের অ্যানা, ক্যান্টিনের চিনা মালকিনকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সুব্রত আর বন্দিতার জন্য আলুসেদ্ধ মাখনভাতের ব্যবস্থা করল। বন্দিতা দেশ থেকে ওর মায়ের হাতে বানানো হরেক রকম আচার এনেছিল। তাই দিয়ে ছেলেমেয়ে দুটো সোনামুখ করে খেয়ে নিত। পরে সুব্রতর জন্য এক চিনা পরিবেশিকা একটা দুটো ডিম সেদ্ধ করে দিত।
ক্যান্টিনে আমাদের দিনের অনেকটা সময় কেটে যেত। বিকেলে কফি খেতে খেতে আমরা চেষ্টা করতাম নিজেদের মধ্যে পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলতে। সুব্রত আমাদের মধ্যে পড়ায় এগিয়ে থাকা ছাত্র। ক্লাসে পরীক্ষা থাকলে ও-ই আমাদের পড়া দেখিয়ে দিত। ও বলত এতে ওর নিজের পড়াও নাকি তৈরি হয়ে যায়। বিশেষ করে পর্তুগিজ ব্যাকরণ নিয়ে আমার বেশ সমস্যা ছিল। সত্যি কথা বলতে কী, ইসমেনিয়া মাদামের চেয়ে সুব্রত আমাকে অনেক সহজ করে ব্যাকরণের কঠিন ব্যাপারগুলি বুঝিয়ে দিত। সুব্রত তখনই একাধিক ভাষা জানত। ম্যাক্সমুলার ভবনের জার্মান শিক্ষক হিসেবে শুধু নয়, অনুবাদক হিসেবেও তার খ্যাতি আজ কিছু কম নয়।
কোনও কোনওদিন সন্ধ্যেতে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছন দিকের চত্বরে। ওখান থেকে দেখা যেত আলোর মালায় সাজানো তাইপা সেতু, হোটেল লিসবোয়ার ক্যাসিনোর মাথায় আলোর মুকুট, দূরে আরও দূরে গিয়া পাহাড়ের চূড়ায় লাইটহাউসের বাতি, চীনের ওয়াংঝোউ শহরের অস্পষ্ট আলোর রেখা। সব মিলিয়ে ম্যাকাওয়ের সে এক মোহিনী রূপ। নির্জন নিস্তব্ধ দ্বীপের এক প্রান্ত থেকে এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যেত, খেয়াল থাকত না। এরপরে অবশ্য ঘরে ফিরে বসতে হত হোমওয়র্ক নিয়ে। বাড়ির জন্য যেদিন বেশি মন খারাপ হত, সেদিন টেলিফোনের লাইন ঠিক থাকলে ছাত্রাবাসের ‘বুথ’ থেকে কলকাতায় ফোন করতাম। আর আমার মন খারাপ থাকলে তার দাওয়াই ছিল ঘর-সঙ্গী পূর্ণার গলায় আমার পছন্দের রবীন্দ্রসঙ্গীত। রাতের পরে রাত কত গান যে শুনেছি ওর!

পড়ার চাপ কম থাকলে কোনও কোনওদিন বাসে করে সেতু পার হয়ে আমরা চলে যেতাম ম্যাকাও শহরে। ‘লিয়াও সিনাডো’ অর্থাৎ সেনেট হলের উলটো দিকে ছিল পাথর দিয়ে বাঁধানো পায়ে চলার রাস্তা। এই রাস্তার দু’পাশের প্রতিটি বাড়িই শুধু যে বয়সে প্রাচীন তাই নয়, পর্তুগিজ স্থাপত্যের অসাধারণ নিদর্শনও বটে। রয়েছে বড় বড় সোনার দোকান, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আর বইয়ের দোকান। আমাদের কলকাতার শিক্ষয়িত্রী নাতালিয়া ম্যাকাও আসার আগে আমাদের হাতে একটি করে পর্তুগিজ বইয়ের লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা ঢুকেওছিলাম একদিন বই কিনতে। কিন্তু দাম এত বেশি, যে কিনে উঠতে পারিনি। তবে সস্তায় কিছু পিকচার পোস্টকার্ড কিনেছিলাম কলকাতায় পাঠাবার জন্য। দোকানে দাঁড়িয়ে তাতে দু’লাইন লিখে সঙ্গে সঙ্গে ডাকবাক্সে ফেলে দিলাম আমি।

‘লিয়াও সিনাডো’র উলটো দিকে ভারি সুন্দর একটি চারচৌকো চাতাল, যার নাম সিনাডো স্কোয়্যার। চাতাল ঘিরে নানা বাহারি ফুলের গাছ। সবুজ রঙা কাঠের বেঞ্চি পাতা সারি সারি। মাঝে মাঝে ক্লান্ত পথিকেরা একটু জিরোতে ওখানে এসে বসেন। দুপাশে ঠেলাগাড়ি নিয়ে ফেরিওয়ালারা কেনাবেচায় ব্যস্ত। স্কোয়্যারের এক পাশে বসে থাকতেন এক বৃদ্ধ চিনা গণৎকার। চোখে চশমা লাগিয়ে তিনি খদ্দেরদের ভাগ্য গণনা করে চলতেন দিনভর। (চলবে)
*ছবি সৌজন্য: লেখক ও Wikipedia
পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি বই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।
তথ্যমূলক সুখপাঠ্য
ঝরঝরে স্বচ্ছ গদ্যে চমৎকার স্মৃতিচারণ।
সূচনা পর্বটি সত্যিই অসাধারণ।
সত্যজিতের বায়েস্কোপের মতো প্রথম দৃশ্যেই যাবতীয় চরিত্র এবং ইনফরমেশন জানিয়ে দিয়ে পাঠককে লেখার সঙ্গে জড়িয়ে ফেললেন। তিনিও টানটান করে চেয়ারের হাতল ধরে বসে রইলেন,পরবর্তী ঘটনার অপেক্ষায়।
সবমিলে দারুণ !
🙏🌻
তোমার সাথে পৌঁছে গেলাম ম্যাকাও। তোমার স্মৃতিচারণা আমাকে মুগ্ধ করল — মনে হল আমিও তোমার পাশে পাশে ঘুরছি আর উপভোগ করছি ম্যাকাও এর প্রকৃতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশরুম আর হস্টেল। পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় রইলাম। — গৌরী।
Golper moto porlam..etotai sabolil aapnar Lekha. Porer angsho ta kobe porbo..opekkhai roilam.
Asadharon laglo,harie giechilam tomar lekhar moddhye.
Alpana mashi, khub bhalo laglo. Aami Hong Kong gechhi kintu Macao jaoa hoye ni. Ei lekhata porey tokhon kaley bidesh jatra je koto complicated chhilo bujhtey parlam.