নিকষ কালো জন্তুটা পা-গুলো কেমন ঠুকছে দেখো! এখনই যেন ঝাঁপিয়ে পড়বে পাশের ষাঁড়টাও আসছে তেড়ে অ্যালুমিনিয়ামের কাটআউট যে এত জীবন্ত, বলিষ্ঠ হয়, কখনও ভাবিনি কিংবদন্তি শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের মৃত্যুর এগারো বছর পর, তাঁর তৈরি এমনই কিছু কাটআউট নিয়ে ইমামি আর্টের উদ্যোগে ‘এসেনশিয়াল ফর্মস’ শীর্ষক প্রদর্শনী সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটিতে  (১২-২৮ ফেব্রুয়ারি) 

হুসেনের শিল্পকর্মের অপেক্ষাকৃত অচেনা দিক শহরের শিল্পপ্রেমীদের কাছে প্রকাশ করতে পেরে অসম্ভব খুশি ইমামি আর্টের সিইও রিচা আগরওয়াল এবং প্রদর্শনীর কিউরেটর ইনা পুরি দু’জনেই একমত, এই কঠিন সময়েও শহরের সৃষ্টিশীল মানুষজন হুসেনের কাজ দেখার সুযোগ হারাতে চাননি ইনা বললেন, ‘আমি ভীষণ খুশি। কারণ এই ধরনের প্রদর্শনী প্রথম হল, তাও আবার কলকাতায়, যে শহর ছিল হুসেন সাহবের বড় আদরের।’

Ahmedabad series by M F Husain
কালো আর ঘিয়ে রঙের পাশে হঠাৎ এল চোখ-ধাঁধানো লাল।

অ্যালুমিনিয়ামের ওই দুটি কাটআউট ছাড়া বাকি কাজগুলি সবই করা ন্যু-উড বা ফাইবার বোর্ডের উপর একটি ছাড়া সব-ক’টি ছিল একরঙা বা মোনোক্রোমাটিক জানা গেল, বিষয় নির্বাচন করার পর কাটআউট কেটে নিয়ে তার উপর রঙ করাই ছিল হুসেনের পছন্দ কিউরেটর্স নোটে ইনা বলেন, ‘কোনও এক প্রাচীন আত্মা এসে যেন মানুষ, জীবজন্তু ও দেবতাকে এক জায়গায় জড়ো করে দিয়েছিল

সত্যিই, প্রদর্শনী কক্ষের প্রতিটি কাটআউটই যেন এক একটা জলজ্যান্ত গল্প তবে তাদের পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ ছিল না প্রথমেই নজর কাড়ে ষাঁড়ের উপর বসা বংশীধারীর ছবি গোটা প্রদর্শনীতে এটিই একমাত্র বহুরঙা কাটআউট নীল, কমলা, খয়েরি-সবুজের সমাহারে স্পষ্ট লেখা বৃন্দাবনের ঠিকানা প্রদর্শনীতে এটিই ছিল সব থেকে পুরনো কাজ, ১৯৯২ সালের। কালো আর ঘিয়ে রঙের পাশে হঠাৎ এল চোখ-ধাঁধানো লাল সেই কাটআউট চরিত্রটি আবার হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ এই প্রসঙ্গে ইনা বললেন, ‘এই মানুষটি হয়তো দুনিয়াকে উল্টো করে দেখে অনেক সময় হুসেন সার্কাসের নানা চরিত্রকেও নিজের কাজে এনে ফেলতেন তাই কখনও এই সামারসল্ট, আবার কখনও জাগলিং

কৃষ্ণবর্ণ কাটআউটগুলির বেশির ভাগই ২০০৮-এর আহমেদাবাদ সিরিজের এর মধ্যে দৃষ্টি আকর্ষণ করল এক দেহে-দুই নারী অন্য দুটি যেন ‘ওরা কাজ করে’র চিত্রকল্প আর একটি দেখে মনে পড়ে গেল হুসেন-বালকৃষ্ণ দোশি গুফার (এখন আহমেদাবাদ নি গুফা) মধ্যস্থলের কাটআউটের কথা কেন জানি না, ভেসে এল নজরুলের দু’কলিও, ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে, বিরাট শিশু আনমনে’ প্রদর্শনী-ফেরত তার সার্থকতা নিয়ে কথা হল কিউরেটর ইনা পুরির সঙ্গে এক ফোনালাপে তিনি বললেন, ‘এই কাজগুলি হুসেনের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ের যখন তিনি বাধ্য হয়েছিলেন স্বদেশ ছেড়ে চলে যেতে’ মনে করিয়ে দিলেন, চারের দশকে হুসেনের শিল্পীজীবনের গোড়ার কথা, যখন তিনি সংসার চালাতে কাজ নেন এক আসবাব বিপণিতে সেখানে তিনি কাঠের বহু খেলনা বানিয়েছিলেন কাটআউট নিয়ে কাজ তারই সংযোজন এই ভাবনা তিনি লালন করেন সারাজীবন ইনার কথায়, ‘ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শিল্পকর্ম থেকে বিরাট মাপের ক্যানভাস, সব কিছু ওই মানুষটার আঙুলের ডগায় খেলা করে বেড়াত’   

হুসেনের এই কাটআউট, ক্যানভাস ও ভাস্কর্যের মাঝামাঝি অবস্থান করলেও, ইনা এদের পুরোদস্তুর শিল্পকর্ম বলেই মনে করেন। এই প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই চলে এল ফরাসি শিল্পী অঁরি মাতিসের তৈরি কাটআউটের কথা। প্যারিসের পঁপিদ্যু সেন্টারে সেগুলি দেখার সৌভাগ্যও হয়েছিল ইনার। তাঁর প্রশ্ন, ‘মাতিসের তৈরি এই কাটআউটগুলি কি তাঁর সারাজীবনের কাজ থেকে আলাদা করা যায়? হুসেনের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই।’ হুসেনের একাধিক সৃজনশীল মুহূর্তের সাক্ষী থেকেছেন ইনা।  কাটআউটও তার ব্যতিক্রম নয়। তিনি বললেন, ‘নারী হোক, বা জীবজন্তুই হোক, তার দেহরেখা বা অবয়ব, হুসেন সাবের হাতে একেবারে নিখুঁত হয়ে উঠত। এর পর সেটি যখন রঙে সেজে উঠত, তাকে নিজের কল্পনার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে কোনও অসুবিধা হত না।’

দ্য সত্যজিৎ রায় সেন্টিনারি শো, ভলিউম ১

ছবি বিশ্বাসের নাগরা, তুলসী চক্রবর্তীর পাৎলুন এবং অনুভা গুপ্তার ওভারকোট। ‘দ্য সত্যজিৎ রায় সেন্টিনারি শো, ভলিউম ১’ প্রদর্শনীতে জলসাঘর, পরশপাথর ও কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবির এই তিনটি উল্লেখযোগ্য প্রপ এখন দেখা গেল। 

দিল্লির গ্যালারি রাসার উদ্যোগে কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটিতে আয়োজিত এই প্রদর্শনীতে ছিল সত্যজিৎ রায়ের অধিকাংশ ছবির পোস্টার, লবি কার্ড, প্রেসবুক, বিশিষ্ট আলোকচিত্রী নিমাই ঘোষের তোলা সত্যজিৎ রায়ের নানা মেজাজের ছবি। এ ছাড়াও রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের করা অসংখ্য বাংলা ও ইংরেজি বইয়ের প্রচ্ছদ। বিপুল এই কর্মকাণ্ডের পিছনে রয়েছেন কিউরেটর সিদ্ধার্থ শিবকুমার ও তাঁর দল ।

Nagra shoes used in the movie Jalsaghar
জলসাঘর ছবিতে ব্যবহৃত ছবি বিশ্বাসের নাগরা

লবি কার্ডের মাধ্যমে জানা গেল, ছ’য়ের দশকে সত্যজিতের ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ ছবিটি পরে হিন্দিতে ডাব হয়ে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। 

ছবির ক্যাচলাইন অবশ্য ছিল ‘রে’জ ফার্স্ট হিন্দি পিকচার’। ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবির প্রেসবুকে পাওয়া গেল ছবির বারোটা গানের কথা। হঠাৎ আবিষ্কার হল ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’এর প্রেসবুকের পিছনে ছিল মৃণাল সেনের ‘আকাশকুসুম’ ছবির আসন্ন মুক্তির খোঁজখবর। 

প্রায় ২৫ বছর সত্যজিৎ রায়ের ছায়াসঙ্গী ছিলেন আলোকচিত্রী নিমাই ঘোষ। তিনি বলেছিলেন, কখনও মনমরা হলে, তিনি মানিকদার (সত্যজিৎ রায়) শরণাপন্ন হন। কারণ তিনিই তাঁর অক্সিজেন। 

গত বছর অতিমারির কারণে সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন ভাল ভাবে করা যায়নি। কিন্তু এই প্রদর্শনী তার বিশালতা ও বিস্তৃতি দিয়ে সেই খেদ অনেকটা ভুলিয়ে দিল।

ছবি সৌজন্য: কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি

দু’দশক ইংরেজি সংবাদপত্রের কর্তার টেবিলে কাটিয়ে কলমচির শখ হল বাংলায় লেখালেখি করার। তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন কয়েকজন ডাকসাইটে সাংবাদিক। লেখার বাইরে সময় কাটে বই পড়ে, গান শুনে, সিনেমা দেখে। রবীন্দ্রসঙ্গীতটাও নেহাত মন্দ গান না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *