আমি যখন আত্রেয়ীর বাড়ি পৌঁছলাম তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। তবে দিনটা ৩১ ডিসেম্বর। বছরের শেষ দিন। জীবনেরও। এর মধ্যেই আলো মরে এসেছে। সন্ধে নামার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। আমার ছায়াটা পোয়াতি বেড়ালের কান্নার মতো দীর্ঘ এবং বিষণ্ণ। ছায়ার মাথাটা আমার থেকে এতদূরে যে আবছা হয়ে এসেছে। ছোঁয়া যায় না। ছায়াদের কখনওই ছোঁয়া যায় না। ছায়ারা কেবলই আমাদের পিছু পিছু হাঁটে। 

কে বলেছে ছায়া সব সময় আমাদের পিছু পিছু হাঁটে? কখনও আমাদের আগে আগেও হাঁটতে পারে। আলোর আকর কোথায় তার ওপর নির্ভর করেবলেছিল আত্রেয়ী আমি ওর বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে দিতে দিতে বলেছিলাম, ‘এখন, ঠিক এই মুহূর্তে, আমাদের দু’জনের এই চরম মুহূর্তে, আমাদের ছায়া আমাদের সামনে আছে না পেছনে?’

শুয়ে থাকলে মানুষের ছায়া থাকে নাআমার চুল মুঠো করে ধরে আমার ঠোঁটের গভীরে নিজের ঠোঁটটা গুঁজে দিতে দিতে বলেছিল আত্রেয়ী। 

জুতো জোড়া খুলে যত্ন করে এক পাটি অন্যটার সঙ্গে সমান্তরাল করে রাখলাম। পকেট থেকে রুমাল বের করে আমার কালো চশমাটা চোখ থেকে খুলে ভাল করে মুছে নিলাম। তাড়া নেই। ধীরেসুস্থে যাওয়াই ভাল। অনেক জোড়া জুতো রাখা সিঁড়ির নীচটায়। এলোমেলো পড়ে আছে, যেন শহরের কোনও সিগনালহীন ব্যস্ত চৌরাস্তার মোড়ে জড়ো হওয়া গাড়ি। দু’ এক মিনিটের অবকাশ। তারপর যে যার দিকে চলে যাবে। জুতোর সংখ্যা দেখে বোঝা যায় অনেকেই এসেছে। স্বাভাবিক। শেষ দিনে অনেকেই আসে। শুরু আর শেষটুকুই যা ইন্টারেস্টিং। মাঝের দিনগুলো একটা আর একটার অনুলিপিমাত্র। আলাদা করে চেনা যায় না আমার থেকে তোমাকে



দরজা দিয়ে ঢুকে শু র‍্যাক পেরিয়েই বসার ঘর। একটা চাকচিক্যহীন সোফা। সামনে সেন্টার টেবিল।  একটা পুরনো আমলের ফ্যান মাথার ওপর খুব আস্তে আস্তে ঘুরছে। হাড় হিম করা প্রাগৈতিহাসিক দৈত্যের মতো দশাসই। কিন্তু এত ক্লান্ত যেন সহস্র বছরের অভিশাপ বয়ে ফিরছে। আমি জানি ডানদিকে সিড়ি। বাঁ দিকে গেলে রান্নাঘর আর পাশাপাশি দুটো শোবার ঘর।  আমি আসিনি কখনও। আত্রেয়ীর কাছে শুনেছি ওর বাড়ির কথা। ওর মায়ের কথা। ও মায়ের কথা বলতে ভালবাসে। আমি শুনতে। সিঁড়ির পাশেই দেওয়াল ঘেঁষে একটা তেপায়া টেবিলে একটা বত্রিশ ইঞ্চি সোনি টিভি। সোনি শব্দটার ওপর ধুলোর আস্তরণ। অদ্ভুত যন্ত্র এই টিভি। চাইলেই সারা দুনিয়ার সমস্ত অস্থিরতার খবর বয়ে আনবে। না চাইলেই মুখ অন্ধকার করে ঝুম হয়ে বসে থাকবে। এখন যেমন চুপ। পানাপুকুরের মতো ঘোলাটে। টিভি-সহ টেবিলটা যে দেওয়ালে ঠেস দেওয়া, সেই দেওয়ালে একটু ওপরের দিকে মনে হয় একটা টিকটিকি। খুব সন্তর্পণে পা ফেলছে। একটা শ্যামা পোকা অন্যমনস্কভাবে বসে আছে। ওদের তো পুঞ্জাক্ষি। তাই ভাল দেখতে পায় না। মনে হয় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই টিকটিকির হাঁ-মুখ গিলে নেবে ওকে। টিকটিকির অনিঃশেষ জঠরে স্থান পাওয়ার জন্যই পতঙ্গের জন্ম। 

আজ সকালে প্যারাগ্লাইডিং করার পরে আমার কাছে একটা নতুন জগৎ খুলে গেল। ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল। 

হুম। আমিও প্রথম বার। 

আপনি বোধ হয় একটু চুপচাপ, তাই না?

আমি সামান্য লজ্জা পাই। আর সেটা লুকোতে কফিতে চুমুক দিই। মেয়েদের সামনে আমি কোনওদিনও সহজ হতে পারি না। আমার চোখে কালো চশমা। 

জানেন আমার খুব আনন্দ হলে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে

আমি কফি নামিয়ে কালো চশমা খুলে ওর চোখে চোখ রাখি। ভুল বললাম। চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করি। ওর চোখে চশমা মানায়। জানলায় পর্দা ঝোলালে যেমন জানলার রূপ খোলে, সেরকম। ফেডেড জিনস আর রিবকের নেভি ব্লু টিশার্ট পরেছে। ওর বুক দুটো উৎসুক চড়ুই পাখির মতো নোনা নীল টি শার্টের আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে। নীল রঙটা ছেলেদের। কিন্তু ওকে বেশ মানিয়েছে। ওর গায়ে আসলে সমুদ্রের গন্ধ আছে। তাই সমুদ্রের রঙ ওকে বেশ মানায়। আত্রেয়ী রোগাসোগা। বিশেষত্বহীন। টিনএজার গার্লদের মতো  শরীরের গঠন। যদিও বয়স বলল চব্বিশ। সারা শরীরের মধ্যে চোখে পড়ার মতো যদি কিছু থাকে সেটা অস্বাভাবিক উজ্জ্বল দুটো চোখ। চব্বিশ বছর ধরে সমস্ত পুষ্টি যেন চোখ দুটো অন্যায্য ভাবে শুষে নিয়েছে। 



জানি। আমি বললাম। চরম আনন্দের মুহূর্তে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে কেন জানি।  

জানেন? কেন হয় বলুন তো?

আনন্দঘন মুহূর্তের পরক্ষণেই অনিবার্যভাবে যে বিষণ্ণ প্রহর নেমে আসে, আপনি তাকে ফাঁকি দিতে চান। তার ফাঁদে পা দেওয়ার আগেই তাই চলে যেতে চান, তাই। 

ওর মুখে হাসির একটা রেখা ফুটেই মিলিয়ে যায়। বোধ হয়। 

আপনার ফোনটা দিন। আমার নাম্বারটা সেভ করে দিই। আমি কিন্তু যাকে তাকে আমার নাম্বার দিই না। বাট ইউ আর ইম্প্রেসিভ

আমি লজ্জা পাই। ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে কফিতে চুমুক দিই। 

পাখি। আমার ডাকনাম। ওই নামেই সেভ করলাম

মিষ্টি নাম। 

খুব কমন

তা ঠিক। পাখি সকলেই। যার পাখা আছে সেই পাখি। আমি বলি। 

ওর মুখে আবারও একটা হাসির রেখা ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। হাসিটা কাঠফাটা দুপুরে পোড়া আমের শরবতের মতো। ক্লান্তিহরা। 

সোফায় যে মহিলা বসে আছেন, তিনি নিশ্চয় আত্রেয়ীর মা। আমি ওঁকে দেখিনি কখনও। তবু চিনতে অসুবিধে হল না। আত্রেয়ীর গায়ে যে সমুদ্রের গন্ধ ছিল, ওঁর গায়েও সেই এক গন্ধ। চিনতে অসুবিধে হয় না। ওঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি আমায় দেখলেন। না ভুল বললাম। উনি আমার দিকে তাকালেন। কিন্তু আসলে আমায় ছাড়িয়ে, আমায় ভেদ করে দূর অতি দূর কোনো প্রবালদ্বীপের দিকে চেয়ে রইলেন।  

সমুদ্রের গভীর তলদেশে প্রবাল দ্বীপ থাকে। সেখানে বহু বছরের নৈঃশব্দ্য জমা। পরতে পরতে। আত্রেয়ী  বলেছিল। 

আর সেখানে কারুকে পিছু পিছু তার ছায়া অনুসরণ করে না। তাই ভয় লাগে না। প্রাণী মাত্রেই তার ছায়াকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়।  কচুর লতির মতো সুস্বাদু ওর কানের লতিগুলো চকাম চকাম করে খেতে খেতে আমি উত্তর দিয়েছিলাম। নেশার ঘোরে। 

প্রবাল তুমি কখনো জলস্তম্ভ দেখেছ

আমি ওকে চিত করে শুইয়ে ওর পলিমাটির মতো শরীরে মুখ গুঁজে দিই। সমুদ্রের নোনা গন্ধ ওর গায়ে। নেশার মতো হয়। উত্তর দিই না। 

আমি রোজ একটাই স্বপ্ন দেখি জানো প্রবাল। আমি শুয়ে আছি। একটা দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ। এত সবুজ, যে অন্য সব রঙেরা বিপন্ন বোধ করছে। আমার খোলা চুল আমার চারপাশে চক্রাকারে ছড়িয়ে আছে। আমি সম্পূর্ণ নগ্ন। ঠিক এখন যেমন। আর আমার মাথা থেকে একটা সিলিন্ড্রিকাল জলস্তম্ভ সেই একদম আকাশ পর্যন্ত উঠে গেছে। সন্ধে নামব নামব। অস্তমিত সূর্যের সমস্ত কমলা শুষে নিচ্ছে জলস্তম্ভটা। কাস্তের মতো এক ফালি বিষণ্ণ চাঁদ আকাশে আলগাভাবে ঝুলে আছে। প্রবাল তুমি ছবি আঁকতে পার?


আমি ওকে চিত করে শুইয়ে ওর পলিমাটির মতো শরীরে মুখ গুঁজে দিই। সমুদ্রের নোনা গন্ধ ওর গায়ে। নেশার মতো হয়। উত্তর দিই না। 

আমি থামি। ওর চোখে চোখ রাখি। আমি কি ছবি আঁকতে পারি? দৃষ্টিহীন কি ছবি আঁকতে পারে?

বোধহয় পারি। চেষ্টা করিনি কখনও। বিঠোভেন তো শেষ জীবনে বধির ছিলেন, যখন উনি ওঁর বেস্ট কম্পোজিশানগুলো সৃষ্টি করেছেন। আমিই বা পারব না কেন?

মাসিমা, আমার নাম প্রবাল। আত্রেয়ী কোন ঘরে?

শূন্যগর্ভ চোখ দুটো এক সেকেন্ডের জন্য ঝিকমিকিয়ে ওঠে। ও কি আমার কথা বলেছে? বলার প্রয়োজন তো ছিল না। আমাদের সম্পর্কটা যে টাইম বাউন্ড, সময়ের বেড়া দিয়ে বাঁধা, সে তো আত্রেয়ী প্রথমেই বলেছিল। এ বছর তেমন ঠান্ডা পড়েনি। কিন্তু ওদের বাড়ির মধ্যে ঢুকে থেকেই আমার খুব শীত করছে। আমি চাদরটা ভাল করে গায়ে মুড়ে নিই। আমার মায়ের চাদর। মাকে মনে নেই। ছোটবেলায় অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছিল। যেদিন খুব ঠান্ডা লাগতে পারে বলে মনে হয়, সেদিন মায়ের চাদরটা আলমারি থেকে বের করে গায়ে চড়িয়ে বেরই। আজকে যেমন। 

উনি নিঃশব্দে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। শোবার ঘরের দিকে। আত্রেয়ীর সঙ্গে শুয়েছি আমি। ওদের শোবার ঘরে নয়। হোটেলের সস্তা ঘরে মহার্ঘ সময় কাটিয়েছি। শুধু একবার। আলাপ হওয়ার মাত্র তিনমাসের মধ্যেই। ওরই তাড়া ছিল। আমাদের মানালিতে আলাপ হয়েছিল প্যারাগ্লাইডিং করতে গিয়ে। 

শোবার ঘরটা কিছুদিন আগেই বোধ হয় হোয়াইটওয়াশ করা হয়েছে। ফ্যাটফেটে সাদা। বসার ঘরের থেকে এ ঘরটা আরও একটু বেশি ঠান্ডা। আমি চাদরটা বেশ করে গায়ে জড়িয়ে নিই। আমার মায়ের চাদর। তাও কাঁপুনি যায় না। শোবার ঘরটায় এদিক ওদিক চাঙড় চাঙড় বরফ পড়ে আছে। হাড়ের মতো সাদা। ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপ্টায় আমার চোখ থেকে জল পড়ে রজনীগন্ধার আর ধূপের গন্ধ আমাকে অনেক ক’টা বছর পেছনে নিয়ে যায়। সেই অনেক ছোটবেলায়। মাও আত্রেয়ীর মতো শুয়েছিল। অনিশ্চল। একটু পরে ওরা মাকে নিয়ে গেল। সক্কলে আমায় মিথ্যে বলছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম যে ওরা মিথ্যে বলছে। আমার ভয় করছিল। হিউমান নেচার। কেউ যখন জানে, সক্কলে তাকে মিথ্যে বলছে, তার খুব ভয় করে। সত্যের থেকে যত দূরে যায়, তত ভয় পায় মানুষ। হিউমান নেচার। 

আত্রেয়ী ঘুমিয়ে আছে। পড়ন্ত বিকেলের কমলা ওকে লেহন করছে। ওর ঠোঁট, কানের লতি, বুক। ওর বাটারক্রিম উরুসন্ধি। কিন্তু কোনও ছায়া পড়েনি। ঘুমন্ত লোকেদের ছায়া থাকে না। ওর অস্বাভাবিক উজ্জ্বল চোখ থেকে বোজা অবস্থাতেও যেন আলো ঠিকরে বেরচ্ছে। আমি ওর চোখে চোখ রাখি। রাখতে চেষ্টা করি। বিছানায় সাদা চাদর পাতা। টান টান। একটুও কুঁচকানো নয়। যেন চারদিক থেকে পাথর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশেই ড্রেসিং টেবিল। আয়না। 

 

আমি যদি দেখতে পেতাম, আমার কেমন মনে হয়, আমি আয়নাকে খুব ভয় পেতাম। কারণ আয়নায় নিজেকে দেখা যায়! নিজেকে! নিজেকে দেখতে কে না ভয় পায়? শুধু তাই না। আয়না ব্লটিং পেপারের মতো সময় শুষে নেয়। আয়নার সামনে মানুষ শিশু থেকে শম্বুক গতিতে বৃদ্ধ হয়। সকলে হয় না যদিও। কেউ কেউ মাঝের নাম-না-জানা স্টেশানে রাতের অন্ধকারে নেমে যায়। 

আমি সময়কে হারিয়ে দেব দেখো। মৃত্যুকে হারিয়ে দেব। ঠিক যখন নখর বের করে হালুম বলে ঝাঁপ দেবে মহাকাল, আমি মোক্ষম চাল দেব। আমি ওকে হারিয়ে দেব দেখো

ওর আঙুলগুলোকে নিয়ে আমি খেলছিলাম। ওর আঙুলে আমার আঙুল আশ্রয় পেলেই আমি সমুদ্দুরের  গন্ধ পাই। মরার কথা শুনে আমি হাত গুটিয়ে নিই। না, ভুল বললাম। আমার অনুমতি ছাড়াই আমার হাতটা নিজেকে গুটিয়ে নেয়। ইনভলান্টারি মোশান

রেসকোর্স নয় কোনও। একজনকে জিততে হলে একজনকে হারতে হয় না। মরবার কথা বল কেন?

বলছি, কারণ সময় শেষমেশ সবাইকেই হারিয়ে দেয়। আর সময় আমার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে। ডক্টর পাকড়াশি তো বলেইছেন। আর তা ছাড়া আমি নিজেও ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস শুনতে পাই। সে তো তোমায় বলেছি। তাই তো আমার এত তাড়া ছিল বিছানায় তোমার সান্নিধ্যের। লাগেজ প্যাক করে বসে আছি। নেক্সট স্টেশনে নামতে হবে আমায়। তুমি আমায় পার্টিং গিফট্ কিছু দেবে তো? বিদায় উপহার? আমার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলেছিল আত্রেয়ী

আমি লজ্জা পেয়ে জানলার দিকে চোখ ফেরাই। বাইরে যত দূর চোখ যায় ঘন সবুজ। এমন সবুজ, যে অন্য সব রঙ বিপন্ন। একটা জলস্তম্ভ আকাশ ছুঁয়েছে। মাটিতে শুয়ে থাকা যে মেয়েটির মাথা থেকে জলস্তম্ভটা উঠেছে, তার মুখ দেখতে পাই না। দূরে আবছা একটা প্রবালদ্বীপ দেখতে পাই, প্রতি মুহূর্তে যা আরও দূরে সরে যাচ্ছে। আত্রেয়ীর ঘুমন্ত মুখে এখন এমন একটা প্রশান্তি, যেন সমুদ্রের স্বপ্ন দেখছে। কিংবা পাখায় ভর করে উড়ছে আকাশে। ওর অস্বাভাবিক উজ্জ্বল চোখের দিকে সবুজ দৃষ্টি মেলে বসে আছে এক বৃদ্ধ, পাথর ব্যাঙ। মাথার কাছে। আমি বললাম, আমার নাম প্রবাল। পাথর ব্যাঙ বলল, জানি। সমুদ্রের গভীর তলদেশে তুমি থাক। আত্রেয়ী তোমায় বলতে বলেছে, ও সময়কে হারিয়ে দিয়েছে। সময় হালুম বলে ঝাঁপ দেওয়ার আগেই ও ঝাঁপ দিয়েছে। অতল খাদে। জানলা দিয়ে হিমশীতল বরফ ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে আমার চোখে লাগে। আমার চোখ দিয়ে জল পড়ে। আমি কালো চশমা খুলি। চশমা খুললেই আমি নগ্ন। শুধু আত্রেয়ীর সামনেই আমি নগ্ন হয়েছি। বা হতে পারি। না আমি আর কারও সামনে নগ্ন হতে পারব না। বৃদ্ধ ব্যাঙ সবুজ দৃষ্টি মেলে আমার দিকে চেয়ে থাকে। বার্ধক্য সব জানে। সব গোপন কথা। সব রঙ মিলন্তি খেলা। সব মুছে যাওয়া রঙের ইতিকথা। অথবা সব ভ্রষ্টাচার।  

আমি রঙ দেখিনি। আমি আত্রেয়ীকে দেখিনি কখনও। তাই জন্যই কি আত্রেয়ী খাদে ঝাঁপ দেওয়ার আগে আমায় শরীর দিয়েছিল? আমি জিজ্ঞেস করি। 

কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর আয়না দিতে পারে। আয়নাকে জিজ্ঞেস কোরো। ব্যাঙ বলে। কাস্তের মতো চাঁদ আলগা ঝুলে থাকে ওর ঠোঁটের প্রান্তে

আমি কি ওকে ভালবেসেছি, না শুধুই শরীর?

এর উত্তরও তোমায় আয়না দেবে। আমি শুধু আত্রেয়ীর বিদায় উপহার নেওয়ার জন্য বসে আছি



 আমি আমার ঝোলা ব্যাগ থেকে সযত্নে রোল করা আর্ট পেপারটা বের করে মেলে ধরি। যতদূর দেখা যায়, ঘন সবুজ প্রান্তর। এমন সবুজ যে অন্য রঙেরা বিপন্ন। মাঝখানে শুয়ে আছে নগ্ন আত্রেয়ী। পাকা বেলের মতো পারফেক্ট রাউন্ড স্তনবৃন্ত দুটোতে দুটো প্রবাল। মাথা থেকে একটা জলস্তম্ভ উঠে গেছে আকাশ অবধি। কাস্তের মতো একফালি চাঁদ আকাশ থেকে আলগাভাবে ঝুলে আছে বিষণ্ণ মুখে। আমি আঁকতে পেরেছি। আমার দৃষ্টিহীন জীবনের প্রথম শিল্পকর্ম। অ্যাকচুয়ালি দ্বিতীয়। প্রথম শিল্পকর্ম ছিল সস্তা হোটেলের ঘরে আত্রেয়ীর শরীরে বীণার মতো সুর তোলা।       

আমি কালো চশমাটা যত্ন করে পরিষ্কার করি। ঠান্ডায় চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে। কাচটা ভিজে গেছে। আমার তাড়া নেই। আমায় জীবনের বাকি সফরটা জুড়ে এই ছবিটাই অযুত নিযুত কোটিবার আঁকতে হবে। এ ছাড়া আমার আর কাজ নেই। আমি চশমাটা পরে বেরিয়ে আত্রেয়ীর মায়ের সামনে এসে দাঁড়াই। উনি আমার চোখের ডানায় ভর করে দূর কোনও প্রবাল দ্বীপে হারিয়ে যান। টিভির একটু ওপরে দেওয়ালে টিকটিকিটা পোকাটাকে ধরে ফেলেছে। গিলে ফেলার চেষ্টা করছে। হঠাৎই পোকাটা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঝাঁপ দেয়। অতল খাদে। 

আমি জুতো জোড়া পায়ে গলিয়ে বাইরে আসি। আমার ছায়াটাকে আর দেখতে পাই না। আত্রেয়ীর বাড়িতে বোধহয় ফেলে এসেছি। থাক ওখানেই। সমুদ্রের গভীর তলদেশে চলে গেলে ছায়ারা আর অনুসরণ করে না। আমি হাঁটা লাগাই। সমুদ্রের খোঁজে। 

জন্ম ও বড় হওয়া কলকাতায়, বর্তমান ঠিকানা ইলিনয় শিকাগো। লেখালেখির অভ্য়েস দীর্ঘদিনের। প্রবাসের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত গল্প সংকলন 'যযাতির ঝুলি'।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *