হারিয়ে গেল! চিরতরে অদৃশ্য হয়ে গেল সেই রহস্যময়ী! আর কি কোনও দিন পাওয়া যাবে না তাকে! সুতীব্র হাহাকার উঠে এল টনির বুক চিরে! রোমাঞ্চ আর উন্মাদনার শেষ সীমায় গিয়ে এই ব্যর্থতা!  

অথচ একটু আগেই তো এখানে ছিল! এই স্বচ্ছতোয়া নদীতীরেই ছুটিয়েছিল হাসির বন্যা। হরিণীর মতো চঞ্চল পায়ে নরম ঘাসের ওপর দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে চপল দুটি পায়ে নূপুরে নিক্কণ তুলে ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছিল। অপরূপ অলঙ্করণের মুখোশে ছিল মুখ ঢাকা! তবুও দুটি কাজলকালো চোখের বিদ্যুৎ কটাক্ষ সম্মোহিত করে দিয়েছিল নিমেষে!

দৌড়! দৌড়! দৌড়! কী যেন এক নেশায় মদির হয়ে পিছু পিছু দৌড়েই চলেছিলেন টনি! স্থান কাল পাত্রের কোনও চিন্তাই ছিল না মনে! সেও একটু যায় আর পিছু ফেরে! চোখে উপচে পড়ে মায়াবি হাসি! টনিও হাল ছাড়েন না! কিন্তু একটানা ছুটে পেলব রঙিন সালঙ্কারা হাতটা প্রায় ধরে ফেলার মুহূর্তেই …বিপ বিপ বিপ!

টাইমস আপ! সময় শেষের নির্দেশ জানিয়ে দিল যন্ত্র লাল আলো জ্বালিয়ে! টাইম ট্র্যাভেলের সময়সীমা শেষ!

সমস্ত সেটিংস একই রেখে আবার অতীতে ছুটলেন টনি! একবার! দু’বার! তিনবার! না! সে নেই! আছে সেই কুলুকুলু নদী, শ্যামল ঘাসের গালিচা, আছে মুখোশপরা অগণিত নরনারীর উচ্ছ্বাস আর উল্লাস! উদগ্র বাসনা বুকে চেপে পাগলের মতো খুঁজেছেন টনি, লাভ হয়নি! 

ভুলটা টনিরই, সময়ের পরিমাপ দিয়েছিলেন প্রাচীন ভারতের গোটা এক শতাব্দী জুড়ে! তাই বিশেষ একটি বছরের সেই নির্দিষ্ট মুহূর্তে ফিরে যাওয়া মোটামুটি অসম্ভব! এত উত্তেজনা প্রফেসর টনি, মানে তন্ময় শেষ কবে অনুভব করেছিলেন মনে নেই। এমনিতেই তাঁর স্বভাব নিস্তরঙ্গ! খুব ছোটবেলা হয়তো বা কিছু উচ্ছ্বাস ছিল জীবনে– কিন্তু বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে তা কমেছে ব্যস্তানুপাতে। কাঙ্ক্ষিত যা কিছু চেয়েছেন তা সহজেই করায়ত্ত হয়েছে, তাই উত্তেজিত হবার মতো ঘটনা মনে পড়ে না।

সময়ভ্রমণের এই যন্ত্রটা নিয়ে ভাবনা যে একেবারে ছিল না তা নয়– তবে মোটামুটি জানাই ছিল কাজটা সফল হবে। মর্যাদা, সম্মান জীবনে কিছুই আর নতুন করে সাড়া জাগায় না মনে। তবে যন্ত্রটার ভবিষ্যৎ নিয়ে  চিন্তা আর পরিকল্পনা মনে আছে যথেষ্টই। অত্যন্ত সহজ এই যন্ত্রের ব্যবহারবিধি, তাই বাণিজ্যিক সাফল্যের সম্ভাবনা প্রচুর। কিন্তু আরও কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তারপরই বাজারে ছাড়ার ইচ্ছে টনির। ওয়েলসের কল্পনার বাস্তব রূপ হাতের মুঠোয়।  তবে এ যন্ত্রে শুধুই অতীতের পথে হাঁটা যায়। যন্ত্রের কার্যকারিতা পরখ করতে টনি নিজেই মাঝে মাঝে ঘুরে এসেছেন সময় পেরিয়ে। প্রাচীন মিশর, আজটেক সভ্যতা, ইউরোপে গোলাপের যুদ্ধ সব দেখা হয়ে গেছে।  

তবে এই মেশিনের একটাই অসুবিধা। সময় একদম সীমিত। ১৫ মিনিটের এক সেকেন্ডও বেশি পাওয়া যাবে না এক এক বারের সফরে, তাও দিনে তিনবারের বেশি নয়। রাত বাড়ছে। বাড়ছে রাগ আর হতাশাও! যত দোষ ওই চাঁদটার। এই ২২২৫ সালে সব রহস্য হারিয়েও মুচকি হাসছে যেন টনির ব্যর্থতায়! ওর জন্যেই তো এই সব হল! সন্ধেবেলা জানলা দিয়ে আসা জ্যোৎস্না দেখেই চোখ পড়ছিল পূর্ণবৃত্ত চাঁদের দিকে। ‘প্রাচীন পৃথিবী’– এই মোডে সেট করা ছিল সময়যান। পর্দায় ফুটে উঠছিল এমন দিনে অতীতে কী কী ঘটত! তাতেই তো জানা গেল তিথিটা, বাসন্তী পূর্ণিমা! নয়তো তিথি নক্ষত্রের ধার আর কে ধারে এই বিজ্ঞানের যুগে!

প্রাচীন ভারতের মদনোৎসবের কথা জেনে একটু কৌতূহল হয়েছিল। একটু খুঁজতেই হুড়হুড় করে বেরিয়ে এল তথ্য। এই উৎসবে মুখে মুখোশ পরে নাকি প্রেমিক প্রেমিকারা অবাধে ঘুরে বেড়াত! ওই একটি দিনই ছিল নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার সুযোগ, ফ্রি সেক্স! হাসিই পেয়েছিল পড়ে, আজকের দুনিয়ায় হাস্যকরই তো! সামান্য যৌনতা নিয়ে যে এককালে মানুষ এতটা মাথা ঘামাত, এটা টনির সত্যিই আশ্চর্য লাগে। তাই একটু লোভই হয়েছিল সে যুগের ব্যাপারস্যাপার দেখতে! আর তাতেই ওই সুন্দরীকে দেখা! কিন্তু সে হারিয়ে গেল যে চিরতরে! মনটা খারাপ হয়ে গেল। শরীরে এখনও একটু আগে দেখা উন্মাদনার ঢেউ। না পাওয়ার বেদনা।

প্রাচীন ভারতের মদনোৎসবের কথা জেনে একটু কৌতূহল হয়েছিল। একটু খুঁজতেই হুড়হুড় করে বেরিয়ে এল তথ্য। এই উৎসবে মুখে মুখোশ পরে নাকি প্রেমিক প্রেমিকারা অবাধে ঘুরে বেড়াত! ওই একটি দিনই ছিল নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার সুযোগ, ফ্রি সেক্স!

কিন্তু এমন মর্মভেদী না-পাওয়ার হাহাকার কি আগে এসেছে কখনও টনির জীবনে? শরীরের জৈবিক খিদে ইচ্ছামতো মেটাবার জন্যে তো সুঠাম যন্ত্রনারীর তো অভাব নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যাদুকাঠি কাম চরিতার্থ করার প্রতিটি রতিক্রীড়ার উপাদান নিপুণভাবে ভরে দিয়েছে তাদের মধ্যে! কিন্তু এমন তীব্র আকাঙ্খা জুড়োয় কি তাতে? আর এই তাড়না শুধু কি শরীরের? ভাবতে গিয়ে অবাক হলেন টনি। মন নামক অচল বস্তু টনির জীবনের অভিধানে ছিল নাকি কোনও দিন? 

কিচ্ছু ভাল লাগছে না! মেশিনের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই জানলা দিয়ে নজরে পড়ল জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া চরাচর। এমন মায়াবী আলো ঢালতে জানে পৃথিবীর আদিম উপগ্রহ! জানা ছিল না তো! বাড়ির বাইরের দিকে আসতেই কানে এল গানের সুর। গান শুনছে তাহলে সোফি! 

সোফি জার্মান মেয়ে। অসম্ভব মেধা। টনির কাজের সঙ্গী। সময়ে অসময়ে আগে শয্যাও ভাগ করে নিয়েছেন দুজনে। সেসব বহু আগের কথা! সংসারের কোনও বাঁধনই পছন্দ নয় টনির– তাই সোফির সঙ্গে কাজের সম্পর্কটাই স্থায়ী হয়েছে। যৌথ সাফল্যের কথা তামাম দুনিয়া জানলেও এটা টনি একবাক্যে মানেন, যে বেশিরভাগ আবিষ্কারের মূল ভাবনাটা সোফিরই। এই সময়যানেরও। কিন্তু সোফি কখনওই যশের প্রত্যাশী নন।  নিজের জীবনের ন্যূনতম চাহিদা মিটিয়ে তিনি বিজ্ঞানের সেবায় নিয়োজিত। আর আগ্রহ প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিতে। সোফি নাকি ম্যাক্সমুলার বলে এক সাহেবের উত্তরসূরি। তাই সোফি শোনে বাংলা কবিতা, গান।  বাঙালি বলেই টনির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল নিজে থেকেই। তারপর কাজ কাজ করে কেটে গেল অনেকগুলো বছর! অভ্যাস হয়ে গেছে একসঙ্গে জীবনযাপনের। 

সময়যানের সাফল্যের পর থেকেই টনির মনে একটা টানাপোড়েন চলছে। মাঝে মাঝেই মনে হয় সোফির এই প্রচারবিমুখতা, নিজেকে আড়াল করে রাখা, এ যেন একপ্রকার করুণা! টনিকে কি দয়া দেখায় সোফি? 

old temples history
তবে এ যন্ত্রে শুধুই অতীতের পথে হাঁটা যায়।

তর্কবিতর্ক করেছেন টনি অনেক। সোফি উত্তর দিয়েছেন সামান্যই- তবে স্পষ্ট জানিয়েছেন, সময়যানের ব্যবসায়িক সাফল্যের পর একসঙ্গে কাজ আর করবেন না। কিন্তু পরবর্তী পরিকল্পনা কী তা জানাননি। টনিও জানতে চাননি। এসব নিয়ে বেশি ভাবনার সময় কই টনির জীবনে? 

বাইরে বেরিয়ে টনি দেখলেন বাগানে নামার সিঁড়ির ধাপে বসে গান গাইছেন সোফি নিজে। দাঁড়িয়ে পড়লেন টনি। চেনা, বড় চেনা এই সুর! মনে পড়েছে! ঠাকুমা গাইতেন। কোনও এক বুড়ো কবির গান… সুর ভাসছে যেন চাঁদের আলোর সাগরে! এক স্বপ্নময় মায়াজাল যেন চরাচরজুড়ে! সোফিকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে বাগানে নেমে এলেন টনি! চোখ বুঁজে সোফি গেয়ে চলেছে গান। দু’একটা শব্দ টনিও  বুঝছেন, বসন্ত, জ্যোৎস্না রাত, মাতাল! গানের সুর আর কথা এলোমেলো করে দিচ্ছে টনির চিন্তার সুতোগুলো! 

গান শুনতে শুনতে চাঁদের আলোয় কোলের ওপর রাখা সোফির হাতদুটোর দিকে হঠাৎ নজর পড়ল টনির। একী ? কী দেখছেন তিনি! এমনি লাল-হলুদ-সবুজ-নীলরঙ মাখা কাঁকন পরা হাতটিকেই তো প্রায় ধরে ফেলতে যাচ্ছিলেন! আঙুলের বড় আংটিটিও তো চেনা! খানিক আগেই দেখা! পাশে বসে টনি আলতো করে তুলে নিলেন সোফির হাত। তাকালেন সোফি। পূর্ণদৃষ্টিতে। চোখে চোখ রাখলেন! আকাশের রূপোলি থালা দেখিয়ে সোফি ধীরে ধীরে বললেন, “আজ বাসন্তী পূর্ণিমা। প্রাচীন ভারতে এই দিনে মদনোৎসব হত! তুমি জানো?” 

অতীত বর্তমান একাকার হয়ে গেল জ্যোৎস্না আর আবিরে! 

ছবি সৌজন্য: Pixabay 

Aditi Ghosh Dastidar

অদিতি ঘোষ দস্তিদার পেশায় গণিতের অধ্যাপিকা। নেশা লেখালিখি। নিউজার্সিতে থাকেন। সারা পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। আমেরিকা থেকে প্রকাশিত 'অভিব্যক্তি' পত্রিকার সম্পাদক। মিশিগান থেকে প্রকাশিত 'উদ্ভাস' এবং কলকাতার 'কাফে টেবিল' প্রকাশনার 'অবসর' পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীতেও রয়েছেন। ছোটগল্প ও অণুগল্প লেখা বিশেষ পছন্দের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *