কোনও কোনওদিন আয়না থেকে আমার বদলে একটি ছুঁচলো মুখের জন্তু আমার দিকে চেয়ে থাকে। যেন ভীষণ নোংরা একটা হাসি আত্মারই আশেপাশে কোথাও গোপন করে দৃশ্যত গম্ভীর হয়ে আছে। এই তো কিছুক্ষণ আগেই তুমি শেষ ঘুমে আমাকে বয়স্ক লতাপাতার মতো জড়িয়ে ধরেছিলে, এখন তারা আলগা হয়ে নেমে যাচ্ছে আমার গা থেকে। চারপাশে স্বর্ণাভ চূড়ার মতো কী ঝকঝক করছে দিন! ধুতি-চাদরে বীতকাম মানুষ এসে বসেছে বারান্দার ইজিচেয়ারে। তার পায়ের কাছে রেলিংয়ের ফাঁকে লকলক করছে একটি প্রাচীন বেড়াল। চারপাশে এমনই হাত ফসকে গড়িয়ে যাওয়া রঙের মতো ঝকঝক করছে একটি দিন, আরও একটি দিন। পিঙ্গল সব চড়াই-উৎরাই, গরম সূর্যের আগে সার সার উট। দেখব না দেখব না করেও আমি আয়নায় সেই ছুঁচলো মুখের জন্তুটাকে দেখি। তার কপট গাম্ভীর্য দেখি। লক্ষ করি বেশ কিছুটা দূরে ওর দোল-খাওয়া লেজ। আমার মনে পড়ে শেষ বাস্তবে আমাদের শীতে কুঁকড়ে-থাকা ঘরে দু’জন অতিথি এসেছিল। দু’জনেরই মাথায় উলের টুপি, মুখের মাংস মিঠে। অনেক রহস্য পার হলে তবে যোনিরেখা। গত বাস্তবে দুটো মৃতদেহ আঁকড়েই তো বেঁচে ছিলাম! ঠাণ্ডা লোহার মতো দুটো মৃতদেহ, মনে পড়ে? অতিথি দু’জনের উলের ঊষ্ণীষ, মুখের মিঠালো মাংস, রহস্যে ঘেরা যোনির স্বাস্থ্য কোথাও, কোথাও আমাদের অবচেতনে নাড়া দিয়েছিল কি? অতিথি দু’জনের পোশাকের জাফরি দিয়ে যে অলীক সুগন্ধ ভেসে আসছিল, সেই সুগন্ধ? 

চারপাশে ঝকঝক করছে আরও একটি নতুন দিন। তুমি উড়ে গিয়ে বসেছ তোমার চিরবিখ্যাত ডালে। সেখান থেকে কী অক্লেশে দেখা যায় পড়শি বাড়ির দরজা। স্তন নিয়ে যে মানুষটি বিপদে পড়েছে, তার ঝুমঝুমি-বাজানো সুখ। গলায় কাঁপন ধরিয়ে উঠে আসা গভীর নিঃশ্বাস। পুরুষের লিঙ্গ যার হেফাজতে ছিল- দড়িতে টাঙানো সেইসব ক্ষুদ্র প্রহরার আনন্দ। এখন যে জমাট সোনার মতো ঝকঝক-করা দিনটি, একসময় সে তৈলাক্ত চেহারার গিরগিটি হবে। চকিতে সরে পড়বে ঝোপঝাড়ে। তখন তো আমরা আবার মুখোমুখি এসে দাঁড়াব, দাঁড়াব না? প্রথম প্রথম নীরব চোখে দৃষ্টিবিনিময় হবে। তারপর হয়তো একটি আঙুল অন্য আঙুলকে আত্মসাৎ করার জন্য এগিয়ে যাবে। কী বলব তোমাকে তখন? অবলম্বন খুঁজতে যদি চারপাশে তাকাই, দেখব সেই ধুতি-চাদর মোড়া বীতকাম মানুষটি কখন যেন উঠে গেছে। শূন্যতায় শুধু গমগম করছে বারান্দার ইজিচেয়ার। রেলিংয়ের ফাঁকে তখনও অবশ্য লকলক-করা সেই প্রাচীন বেড়ালটা আছে। মানুষটির বদলে তখন সে তাকিয়ে আছে শূন্যতার দিকে। মাথার ওপরে গ্যাসবেলুনের মতো উঠে যাওয়া যে আকাশ- তার গায়ে কাতারে কাতারে সব দুর্লভ নক্ষত্র! গত বাস্তবের অতিথিদের মধ্যে কেউ একজন আমাদের বলছিল ‘তোমাদের কিছুতেই যেন মেলাতে পারছি না, জানো, কিছুতেই যেন মেলাতে পারছি না।’ আমরা তো জানিই সেকথা। সেকথা আমরা তো জানিই… 

সেইজন্যেই বুঝি প্রত্যহ দিনান্তে আমরা যখন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার হই, একটি শীর্ণ কুকুর আমাদের ওপরে উঠে এসে যৌন হতাশার মতো সুরে কেঁদে ওঠে  

 

ছবি সৌজন্য: Pixabay

জন্ম কোচবিহার জেলায়৷ বড় হয়ে ওঠা আলিপুরদুয়ার জেলার হ্যামিল্টনগঞ্জে৷ কলেজে পড়াকালীন লেখালেখির প্রতি আগ্রহ জন্মায় এবং লেখার হাতেখড়ি৷ স্থানীয় ছোট পত্রপত্রিকায় প্রথম লেখা প্রকাশ৷ এরপর লেখায় দীর্ঘ সময়ের ছেদ পড়ে৷ আবার গত তিনবছর ধরে লেখায় ফেরা৷ কাব্যগ্রন্থ 'কিছুক্ষণ থাকা অথবা অনন্তকাল' ২০২০ কলকাতা বইমেলায় 'শুধু বিঘে দুই' থেকে প্রকাশিত৷ মূলত কবিতা লিখতে পছন্দ করেন৷ একটু আধটু গদ্যচর্চাও হয়৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *