আসলে, ‘উত্তর কলকাতা’ কোনও জায়গা নয়, এক বোধের নাম। এই যে মায়াবী, মেঘলা দিনে আপনি নেমে পড়লেন শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনে, আর তারপর জয়পুরিয়া কলেজ পেরিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে গেলেন শোভাবাজার  সিংহদুয়ারের দিকে, এটা একটা কবিতা – ধুলোপড়া ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসে যেন হেঁটে গেল হারানো সময়।

শ্যামপুকুর স্ট্রিটের আলস্যঘেরা পার্ক পেরিয়ে এক একটা দিন যে কোথায় ভেসে যায়, কেউ জানে না; এক অন্য কলকাতা যখন ছুটে চলেছে কার্ল লুইসের মতো, তখন শোভাবাজার রাজবাড়ি, শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ের পাশে ‘বিপজ্জনক বাড়ি’ তকমাধারী দুঃখী এক প্রাচীন হাওয়ামহল, বাগবাজার ঘাটের কাছে রংচটা, হলুদ দেয়াল তখন স্মৃতি-বিস্মৃতির মধ্যে ভেসে আছে আবহমান। বৌবাজারের ভীমনাগের মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একটা আলোছায়া সময়, ঝাপসা ট্রামে চড়ে ঢিমেতালে এগিয়ে চলে সামনের দিকে। উঠে যাওয়া সিনেমাহল, বন্ধ হয়ে যাওয়া বাংলা মদের ঠেক পেরিয়ে একটা ট্রাম ঢুকে পড়ে সত্তর দশকের কলেজ স্ট্রিটে। কফিহাউসের টেবিলে টেবিলে তখন নতুন দিনের স্বপ্ন। বিনয় লিখে চলেছেন, “গায়ত্রী, ফিরে এসো, চাকার মত ফেরো…।” কমলকুমার মজুমদার ট্রাম থেকে নেমে পড়ে তড়িঘড়ি হেঁটে চলেছেন খালাসিটোলার দিকে। আর প্রেসিডেন্সির সামনের গেটে দাঁড়িয়ে ঘনঘন হাতঘড়ি দেখছে কাব্য-প্রিয় প্রেমিক।

উত্তর কলকাতার অলি-গলি-পাকস্থলীর ভেতরেই তো রয়েছে এ শহরের গোপন রোম্যান্স, গুলু ওস্তাগর লেনের দোতলার বারান্দা থেকে ভেসে আছে বেথুন কলেজের দু’বিনুনী মেয়েটির চোখ, মনে হয়, কথা কিছু বাকি রয়ে গেছে। এই গলিতেই তো গুলি লেগেছিল সত্তর দশকের পিঠে। আর তৃণাদিকে জোর করে চুমু খেয়েছিল বে-পাড়ার ছেলে। 

যে কলকাতা শপিং মল, বারিস্তা আর রংচঙে বহুতলের কলকাতা, যে কলকাতায় সকালের ভালোবাসা সন্ধের মিথ্যে নিয়ন হয়ে যায়, যে কলকাতায় কেউ বলেছিল “দেখা হবে,” কিন্তু আর দেখা হয়ে ওঠেনি কোনও দিন, সেই কলকাতা, উত্তর কলকাতা নয়। উত্তর মানে এক স্মৃতির শহর। বিশ্বায়নের হাঙরের হাঁ-মুখের সামনে দাঁড়ানো শেষ প্রতিবাদ। হানি সিংয়ের বিপরীতে গিরিশ ঘোষ। ফাঁকা ফ্ল্যাটের যৌনতার বিরুদ্ধে ভেসে থাকা অপাপবিদ্ধ প্রেমিক-চিলেকোঠা। গ্লাস ক্যাপসুল লিফটের উড়ালের বিপরীতে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আহিরীটোলার গুলতানি-চাতাল। হিপহপ গানের ডিস্কোপ্রিয়তার অপোজিটে বরানগরে ভাস্কর চক্রবর্তীর দেড়তলার ঘর। আইফোন এক্সের উল্টোদিকে শান্ত দাঁড়িয়ে থাকা লিটল ম্যাগাজিন।

আসলে, যা বলেছি আগে, উত্তর কলকাতা কোনো জায়গা বা ভৌগোলিক অবস্থান নয়। উত্তর কলকাতা একটা বোধ। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে চলা এক স্মৃতিপথ। সমস্ত ভাঙনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা দুঃখিত প্রতিবাদ। বিশ্বায়নের বিপরীতে কলার তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বলিভিয়া। বহুতল হয়ে যাওয়া শহরের পেটের নিচে চাপা পড়া সম্পর্কের দলিল। 

দক্ষিণ কলকাতার কিছু কিছু জায়গার মধ্যেও তাই রয়ে যায় উত্তর কলকাতার চিঠি- দক্ষিণের কালীঘাট, ভবানীপুর অঞ্চলের অলি-গলির মধ্যে, শ্যাওলা-পাঁচিলের আঁকিবুঁকির মধ্যে, লোকাল কমিটির বন্ধ অফিস ঘরের দেয়ালে, প্রাচীন শরিকি বাড়ির কার্নিশে, স্ট্যাচু হয়ে যাওয়া পোষা হুলোবেড়ালের চোখে, সরস্বতী পুজোর চাঁদায়, সদানন্দ রোডের ছাদ থেকে উড়িয়ে দেওয়া পেটকাটি ঘুড়িতে, চিলেকোঠার ঘরের দেয়ালে গ্যাব্রিয়েলা সাবাতিনির পোস্টার-হাসিতে, ‘মা লক্ষ্মী জুয়েলার্স’-এর ঘুপচি ঘরে, ‘গ্র্যান্ড সেলুন’-এর ধুলোপড়া আয়নায়, বাবার যুবক মোটরসাইকেল আর মায়ের যুবতী ধনেখালি শাড়ির আঁচলে- তাই চিরকাল রয়ে যায় উত্তর কলকাতার পদছাপ। যা কিছু পুরোনো, যা কিছু হারাতে চায়নি কিন্তু হারিয়ে গিয়েছে, যা কিছু চোখের কোণে মুক্তো আর মনের কোণে নীল রং, সবই আমাদের উত্তর কলকাতা, আমাদের দক্ষিণ কলকাতা, আমাদের কালীঘাট, আমাদের ভবানীপুর, আমাদের প্রতাপাদিত্য রোড, আমাদের গিরিশ পার্ক, আমাদের গুলু ওস্তাগর লেন। 

গুলু ওস্তাগর লেন, মোহনবাগান লেন, হাতিবাগান, আহিরীটোলায় ঘুরপাক খেয়ে মরছি। হাতড়ে বেড়াচ্ছি স্মৃতিমুখ, খুঁজে বেড়াচ্ছি বসন্তে হারিয়ে ফেলা প্রেমের গন্ধ। আর সন্ধে নেমে আসছে শহরের মাথার ওপর। ধীরে ধীরে জ্বলে উঠছে ল্যাম্পপোস্ট। উত্তর কলকাতাবিহীন একটা কলকাতা আঙুল তুলে বলে উঠছে- “এই কে তুমি… কোথা থেকে এসেছ, কোথায় যাবে? এখানে তোমার কোনও জায়গা নেই। এ শহরে কোনো পুরোন মোটিফ নেই। নতুন মোটিভ আছে। খাপ খাওয়াতে পারলে থাকো। নইলে চলে যাও যেখানে যাবার…”

মনে হয়, কেউ ছিল পাশে একদিন, হেঁটেছিল পাশাপাশি কয়েকটা বছর, তারপর চলে গেছে কালের নিয়মে, ম্যাজিশিয়ানের আশ্চর্য ইশারায়। চলে গেছে বহুদূরে। আর দেখা হবে না কখনও। ছেড়েছে শহর, দেশ, সমস্ত সীমানা। অথচ একদিন ছিল, কাছে ছিল এতটাই, তার নিঃশ্বাস এখনও চোখের ওপর এসে পড়ে। আর চমকে উঠি হাজার মানুষের ভিড়ে। খুব শীত করে ওঠে। এই বাতাসে ভেসে আসা শীতলতা, এই কেঁপে উঠে সিগারেট ধরানো, শহরের ক্যানভাসে এই ছবি খুঁজে চলা- এই অমোঘ, অনিবার্য দূরত্ব অন্তরীণ করে নেবার নামই ‘উত্তর কলকাতা’…

পুরোন দালান, গাড়িবারান্দা, তেতলার গাছ-ঘেঁষা ঘর, জানলায় ভেসে থাকা হারানো মানুষের মুখ- সবকিছু ভেঙে ভেঙে আমাদের শরীর ও মন স্কোয়্যারফুটে মাপা হবে একদিন। একদিন রংচটা লেটারবক্স থেকে সময়ের রাস্তায় উপচে পড়বে ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্কের চিঠি। সেদিন আর কোনো উত্তর কলকাতা থাকবে না। কোনো কান্না থাকবে না। সবকিছু চকচকে, রঙিন হয়ে যাবে। শপিং মলের হাঁ-মুখের ভেতরে ঢুকে পড়বে হাসিখুশি জোকার। নিমতলা ঘাটের গাঁজার ধোঁয়ায় ভেসে উঠবে পূর্বজন্ম। জোড়াসাঁকো থেকে ছুটতে শুরু করবে মেহের আলি। ‘সব ঝুট হ্যায়’ বলতে বলতে মিলিয়ে যাবে হাওয়ায়। ভিন গ্রহ থেকে নেমে এসে শহরের দখল নেবে এলিয়েনের দল…।  

এই সময়ে যাঁরা বাংলা কবিতা লিখছেন , তাঁদের মধ্যে সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। সৌভিকের কাব্যভাষা স্বকীয় ও স্বতন্ত্র - নাগরিক বিষন্নতা , সমাজসচেতনতা , মাঝে মাঝে কালো ঠাট্টা বা শ্লেষ ও নস্টালজিয়া তাঁর কবিতায় নানাভাবে ফিরে ফিরে আসে। লিখেছেন ছোট-বড় প্রায় সমস্ত বাণিজ্যিক ও লিটল ম্যাগাজিনে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সংখ্যা তেরো, ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে 'কবিতাসমগ্র ১'। কবিতার জন্যে ভাষানগর-মল্লিকা সেনগুপ্ত পুরস্কার, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পুরস্কার সহ পেয়েছেন আরও একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। গদ্যকার হিসেবেও উজ্জ্বল, এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত গদ্যের বইয়ের সংখ্যা তিন । বড় পর্দাতে অভিনেতা হিসেবেও তাঁকে মাঝে মাঝে দেখা যায়।

3 Responses

  1. খুব ভাল লাগল। তবে শেষের প্যারাগ্রাফটা না দিয়ে শেষ করলে মনে হয় আরও বেশি ভাল হত।

    বি.দ্র. উত্তর কলকাতা কিভাবে যেন আমার জীবন থেকেও একেবারে হারিয়ে গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *