বন্ধ হয়ে যাওয়া এসি আর হাল্কা চলতে থাকা ফ্যানের মধ্যে ডেঙ্গি-তাড়িত ও মশারি-জড়িত হয়ে ঝুলে আছে কলকাতার হেমন্তকাল। বাতাসে হিম, সন্ধেগুলো কুয়াশা-জ্যাকেট পরে বাতিল গণিকার ইশারা অগ্রাহ্য করে নিঃশব্দে হেঁটে যায় জাদুঘরের সামনের ফুটপাথে। নয়নে স্মৃতি আর নিয়নে বিষাদ লেগে থাকে। আসন্ন শীতের দিনে, মনে হয় রোদের উপত্যকায়, বন্য ফুলের দেশে বেড়াতে যাওয়া হবে আগেকার মতো, মনে হয়, ডিসেম্বর শ্রাবন্তী মজুমদারের মতো আবার গেয়ে উঠবে – “মধুপুরে, পাশের বাড়িতে তুমি থাকতে …” ; কে যে কোথায় থাকত, আর কোথায় ভেসে গেছে, হেমন্তের অরণ্যে হলদে পাতার সাম্রাজ্যে দাঁড়িয়ে, পোস্টম্যান তা আর বুঝতে পারে না। ছায়ারা হেসে ওঠে বোরোলীন তরঙ্গে – “জীবনের নানা ওঠাপড়া যেন সহজে …” ; গায়ে তো লেগেই যায়, ক্রিস্টোফার, লেগে যায় মনেও। বো-ব্যারাকসের প্রাচীন, ভূতুড়ে বাড়িতে প্রাগৈতিহাসিক আর্মেনিয়ান ঠাকুমা আজও যত্নে সাজিয়ে রাখে হোম-মেড ওয়াইন, আগামী বড়দিনে অস্ট্রেলিয়া থেকে কলকাতা আসবে বড় ছেলে, যার ব্রিসবেন থেকে উড়ে যাওয়া ফ্লাইট অচেনা সমুদ্রে ভেঙ্গে পড়ে গিয়েছিল, এক যুগে আগে …

শীতকাল এলেই মনে হয়, বহুদূর থেকে যেন ভেসে আসছে রোদের স্যাক্সোফোন, উড়ে আসছে জঙ্গল-পাহাড়-উপত্যকা-অজানা ফুলের মন্তাজ, বারান্দায় বসে শোনা যাচ্ছে দূর থেকে ভেসে আসা অচেনা গ্রামীন গান, কোথাও যেন কাঠ কাটা হচ্ছে, কোথাও রেললাইন বসানোর কাজে ব্যস্ত মদেশিয়া যুবক-যুবতী, ব্রিটিশ অফিসারের নির্দেশে বাঙালিবাবু সেই কাজ তদারক করছেন, যে পাহাড়ি বাংলোয় দ্রুত নেমে আসছে ঘন, নির্জন, সাংকেতিক গোধূলির  ছায়া, তার নাম ‘আরণ্যক’, ছাদে শাল মুড়ি দিয়ে বসে আছেন বিভূতিভূষণ, কেয়ারটেকারের বউ আজ রাতে ঝাল ঝাল দেশি মুরগি রাঁধবে, একটু পরেই উপত্যকার বুকে উঠবে আদিম চাঁদ, সেই জ্যোৎস্নায় একশো বছর পেছিয়ে যাওয়া যায়, অনন্ত গ্যালাক্সি-মানুষ হয়ে ওঠা যায় …

একটু শীত পড়েছে কি পড়েনি, সঙ্গে সঙ্গে পুজোর পরেই বাঁদরটুপি বের করে ফেলা বাঙালির ‘গেল গেল’ রব ; কেন ভাই, ক্ষণস্থায়ী প্রেমের মত এই শীতকে একটু এনজয় করা যায় না কি ?! নিজেদের ন্যাপথালিন-খাওয়া স্মৃতিময় উলের সোয়েটার কিংবা কালো লেদার জ্যাকেট-টি বের করে ব্ল্যাক কফি কিংবা রেড ওয়াইনে আয়েশি চুমুক দিন না একটু, ‘উফফ কি শীত…” ইত্যাদি নিমকি ছেনালি না করে। বার-বি-কিউ, ক্যাম্পফায়ার, রোস্টেড পর্ক – এ সব স্বর্গ আপনার হোক, ক্যামাক স্ট্রিটে আগুন জ্বালিয়ে যে গৃহহীন মানুষ খুঁজে নিতে চাইছে বাঁচার মতো একটু উষ্ণতা, তার পাশে গিয়ে বসুন, তাকে একটা সিগারেট দিন, তার বাংলা মদের সাম্যবাদকে স্বাগত জানান; একটা সেক্সি গ্রে মাফলার গলায় জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ুন ন্যাশনাল হাইওয়ে বেয়ে, সঙ্গে থাকুক শীতের রোদের ফ্লাইং কিস। এত শীত শীত করবেন না, কিছুই থাকে না, কেউই থাকে না, দুদিন পরেই মার্চের মাঝামাঝি কপাল থেকে গড়িয়ে নামবে ঘাম, আর সেই ঘাম গিলতে গিলতে আপনি আবার “শীতকাল কবে আসবে, সুপর্ণা…” হয়ে যাবেন, সুতরাং এনজয়। তা ছাড়া, এ আর এমন কী শীত, সে রকম শীতকালে হৃদয়-ও জমে যায়, মাস-কাল-ঋতু কোনও ফ্যাক্টর নয়। আগস্ট মাসে হৃদয় জমে গেছে – এ আমার নিজের জীবন দিয়ে দেখা।

বেশ ছোটবেলায়, রেডিওতে, অজয় বসু – “….হাইকোর্ট প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন ম্যালকম মার্শাল, ওভার দ্যা উইকেট, অফ স্টাম্পের বাইরে বল, কিন্তু না, ব্যাটে-বলে হলনা, গাভাস্কার আজ যেন ঠিক টাচে নেই, ভারত দু উইকেট হারিয়ে ১০৯, ওভার শেষ …” ; হাইকোর্ট এন্ড থেকে বয়ে আসা হিমেল হাওয়ায় ফাটা ঠোঁট, কমলালেবুময় পাড়া-ক্রিকেট, পার্ক সার্কাস ময়দানে ‘রেমন্ড সার্কাস”-এর বাধ্য বাঘ আর মরণকুয়োয় ঝাঁপ দেওয়া মোটরবাইক, ঝুপ করে নেমে আসা সন্ধের চোখে এঁকে রাখা একাডেমি-মঞ্চের বহুরূপী-নান্দীকার-চেতনা-থিয়েটার ওয়ার্কশপ, নতুন ফুলকপির ঝোলে ভেসে যাওয়া তরুণ-তরুনীর মোবাইল ফোন-বিহীন প্রেম, ক্রিসমাসে সেজে ওঠা স্বর্গীয় নিউ মার্কেট  – এই সব অবিশ্বাস্য চিত্র প্রদর্শনীর  বিপরীতে একটা কোয়েস্ট, কয়েকশো হন্ডা সিভিক আর রেঁনো ডাস্টার, কয়েক হাজার আইফোন ১০, প্রমোটিং হয়ে যাওয়া বাড়ি, এক্সপোর্ট-সারপ্লাস জামাকাপড় হয়ে যাওয়া গ্লোব আর নিউ এম্পায়ার, অগুন্তি আইপিএল ম্যাচ, না-আসা শীতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ওঠা কম্বল – এদের সাজিয়ে দেখলাম। হাসলাম। নীল রঙের হাসি।

এই সময়ে যাঁরা বাংলা কবিতা লিখছেন , তাঁদের মধ্যে সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। সৌভিকের কাব্যভাষা স্বকীয় ও স্বতন্ত্র - নাগরিক বিষন্নতা , সমাজসচেতনতা , মাঝে মাঝে কালো ঠাট্টা বা শ্লেষ ও নস্টালজিয়া তাঁর কবিতায় নানাভাবে ফিরে ফিরে আসে। লিখেছেন ছোট-বড় প্রায় সমস্ত বাণিজ্যিক ও লিটল ম্যাগাজিনে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সংখ্যা তেরো, ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে 'কবিতাসমগ্র ১'। কবিতার জন্যে ভাষানগর-মল্লিকা সেনগুপ্ত পুরস্কার, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পুরস্কার সহ পেয়েছেন আরও একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। গদ্যকার হিসেবেও উজ্জ্বল, এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত গদ্যের বইয়ের সংখ্যা তিন । বড় পর্দাতে অভিনেতা হিসেবেও তাঁকে মাঝে মাঝে দেখা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *