সেপ্টেম্বরে রোজ বৃষ্টি মানে আকাশের চরিত্র খারাপ , আর মেঘলা শার্টে গোপন ঠিকানা লেখা আছে – ঝিল রোড , ডান দিকের গলি পেরিয়ে একটা মোমোর দোকান, তার পর বাঁ দিক, একটু গিয়েই , বিল্ডিং-এর নাম ‘নষ্ট ভ্রমণ ‘, চার তলা , দরজায় ‘বৃষ্টিরেখা বাসু’ লেখা , গোপন ডোরবেল বাজায় মেঘদূত মেহরা, দরজা খুলে যায়, প্রবল বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায় মুখ-চোখ। একটা গাড়ি বৃষ্টিভেজা রাস্তায় ক্রমশ অস্পষ্ট, ঝাপসা হয়ে যেতে যেতে , গেয়ে ওঠে ” রিমঝিম গিরে ….”, অচেনা রেনকোট দূর থেকে দেখতে পায় সব, সিগারেট ধরায়।  সেপ্টেম্বরের বৃষ্টি মানে, বিনীত দুঃখ এসে দাঁড়িয়েছে দরজার বাইরে, আর কোভালামে ভেঙ্গে যাচ্ছে প্রেম।  শ্রীপ্রিয়া রঙ্গনাথন, তোমার ক্লাউডি স্ট্র্যাপে এখনও কি বর্ষা-ব্যালাড লেখা আছে? ফিল্টার কফির গন্ধের মধ্যে অন্ধকার ঘরে মিশে যাচ্ছে দুটো ছায়া, মঞ্চে চুম্বনের শব্দ, শাওয়ারের তলায় হেসে ওঠে লিরিল-প্রণালী, দূরে দূরে আলো জ্বলে স্কাই-স্ক্র্যাপারের অনিশ্চিত ঘরে, ঘর থেকে ঘরে কোনও ঘর নেই, শুধু টিভি চালিয়ে রেখে চলে গেছে কেউ। মেঘদূত মেহরার সানগ্লাস উড়ছে অকালবর্ষণে , বৃষ্টিরেখা বাসুর কাজল মুছে যাচ্ছে অতিবর্ষণে। “সেপ্টেম্বরের বৃষ্টি মানে প্রেম নয় , প্রেমের মতো” – এই বলে মিলিয়ে যাচ্ছে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা ফটোফ্রেম, টেলিফোন ডেড,  তবু একলা বেজে চলেছে একটানা।  

এই মেঘরং দিনের নাম “লাম্পট্যবিষাদ”, এমন ঝরোঝরো ভায়োলিন দিবসে মনখারাপ হতে হতে খারাপ মনের দিকে চলে যায়, এক কাপ চাঁদভেজা জলে চুমুক দিতে দিতে কী যে হয় তার পর, কিচ্ছু  খেয়াল থাকে না।  ছাতা উড়ে যায়, উবার পুলের ব্যাকসিট হয়ে ওঠে “ওশ্যানিক টিউলিপ” রিসর্টের সি-ফেসিং বারান্দা, সোনালি বালির বুকে পড়ে থাকে গোলাপি চটি আর বৃষ্টিতে অপ্রয়োজনীয় এস.পি.এফ. ৫ – সানস্ক্রিন লোশন। আজ বিমানসেবিকাকে ৩৮০০০ হাজার ফুট ওপরে মেঘেদের অঞ্চলে চিঠি ছুঁড়ে দেবার দিন, যাবতীয় হোয়াটস্যাপ বিপর্যয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বৃষ্টিরেখা দাশগুপ্তের ফ্ল্যাটে গিয়ে বেল বাজিয়ে ফেলা যায, ম্যাসাজ পার্লারের মেয়ের কাছে  আজ খারাপ মন নিয়ে গিয়ে উজ্জ্বল মনখারাপ হাতে  ফিরে আসা যায়। গুলমোহরের পথে আজ শ্রাবণের গান, যে “চলে গেল, বলে গেলনা” তার জন্যে আরও এক বার আজ টার্কিশ কফির মাগ তুলে ধরা যায়, দিগন্তে শুরু হয় ছায়াছবি, রিপিট টেলিকাস্ট।  দিগন্ত এক মায়াঘাতক, যার কিনারায় আমরা এক দিন রেখে এসেছিলাম ভালোবাসার পোস্টকার্ড। অনেক দিন দেখা হয়না, তার পর এক দিন মেসেজ আসে – “কেমন আছো ?” মেসেজের উত্তর আশা করেনা কেউ – আজ সে রকম দিন। পুরনো হাসির মতো এক জানলায় আজ দেখা হবে ঠিক, লাদাখের এম.পি. কী বলছেন আজ আমাদের শুনতে ইচ্ছে করছে না ….

বৃষ্টি পড়ছিল, নিয়নফোঁটায় ঝাপসা শহর। সিগনালে আটকে ছিল গাড়ি , ছাতা মাথায় মেয়েটি এগিয়ে এসে বললো – “ইয়েলো ট্যাক্সি, উবের, ওলা কিচ্ছু পাচ্ছিনা, একটা লিফ্ট দেবেন প্লিজ ?” রাত বেশি নয় , জিন্স – টিশার্ট পরা মেয়েটির মুখ কাঁচুমাচু, বিপদে পড়েছে, দেখে ভদ্রই মনে হল। এই চুরি-রাহাজানি-মিটু অধ্যুষিত জমানায, অজানা-অচেনা কাউকে লিফ্ট দেওয়াটাও আজকাল বেশ রিস্কি, তাও বলে ফেললাম – “চলে আসুন …” ; মেয়েটি চটপট উঠে এসে মৃদু হেসে বললো – “থ্যাংকস আ লট , দেড় ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, চিন্তায় পড়ে গেছিলাম …” , আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে আড়চোখে দেখলাম, মেয়েটি বেশ সুশ্রী, তবে চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ, নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম – ” আপনার নামটা জানতে পারি ? কোথায় যাবেন ?” মেয়েটি একটু সময় নিয়ে বললো – ” নাম ইন্ডিয়া। সত্তর বছর ধরে বুঝতে পারছি না কোথায় যাব। আপনিই কোথাও একটা নিয়ে চলুন …”

ঠিকানা বদলে যাওয়ায় ফিরে আসে চিঠি – “বারোর-বি তে আর কেউ থাকেনা, আপনি অন্য ঠিকানা খুঁজুন …” , মনে হয় , তুমি চলে গেছ কোস্তা ব্রাভায় , লালনীল আলোর মধ্যে হারিয়ে ফেলেছ তোমার লাজুক মাস্কারা। আদিবাসী গ্রামের পথে উন্নয়ন এসে দাঁড়িয়েছে এখন, ভোটের আগে জ্বলে উঠেছে আলো, যে ছোট্ট চার্চে আমরা ক্রিসমাস ইভে এসে দাঁড়িয়েছিলাম বহু কাল আগে, সেই চার্চের দরজায় বিষণ্ণ বাদুড়ের ওড়াউড়ি। ‘স্মৃতি’ নামে এক বারান্দায় অসম্ভব সব মুখোশ পড়ে আছে, মুখোশের আড়াল থেকে হেসে ওঠে আততায়ী মুখ- ” কী, বুঝতে পারোনি তো ?!” আসলে , চাঁদনি রাতে দেওয়া কথা এক দিন তারাদের গসিপ হয়ে যায়, টুপি নামিয়ে রেখে বসে থাকে নৈঃশব্দ …ছোটনাগপুর থেকে যে ট্রেন এসেছিল, রাত্রির নির্জন স্টেশনে আলো ফেলে চলে যায়, হাওয়ায় ভেসে যায় লোনলি ওয়েটিং রুম। ঠিকানা বদলে যাওয়ায় ফিরে আসে চিঠি – “বারোর-বি তে আর কেউ থাকে না, আপনি অন্য ঠিকানা খুঁজুন…”, সময় এক পোস্টম্যান – নিস্তব্ধ মাইক্রোফোন হাতে, দিনবদলের খবর ছড়িয়ে দেয় গথিক শহরের আনাচে-কানাচে। শ্রীপ্রিয়া রঙ্গনাথন , তোমাদের বাড়ি প্রোমোটিং হয়ে যাচ্ছে এখন, দোতলার গাছঘেঁষা ঘরে তবু জ্বলে মায়াবী টেবিল-ল্যাম্প। দূর থেকে ভেসে আসে – “ওয়ান্ডারফুল টুনাইট …”, বিক্ষোভে নিভে যায় এ পাড়ার সমস্ত পুরোনো ল্যাম্প-পোস্ট। মেঘেদের স্তরে স্তরে মিশে থাকে বারোর-বি, “আপনি অন্য ঠিকানা খুঁজুন, অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় , আমরা দুঃখিত, কমরেড…”


এই সময়ে যাঁরা বাংলা কবিতা লিখছেন , তাঁদের মধ্যে সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। সৌভিকের কাব্যভাষা স্বকীয় ও স্বতন্ত্র - নাগরিক বিষন্নতা , সমাজসচেতনতা , মাঝে মাঝে কালো ঠাট্টা বা শ্লেষ ও নস্টালজিয়া তাঁর কবিতায় নানাভাবে ফিরে ফিরে আসে। লিখেছেন ছোট-বড় প্রায় সমস্ত বাণিজ্যিক ও লিটল ম্যাগাজিনে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সংখ্যা তেরো, ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে 'কবিতাসমগ্র ১'। কবিতার জন্যে ভাষানগর-মল্লিকা সেনগুপ্ত পুরস্কার, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পুরস্কার সহ পেয়েছেন আরও একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। গদ্যকার হিসেবেও উজ্জ্বল, এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত গদ্যের বইয়ের সংখ্যা তিন । বড় পর্দাতে অভিনেতা হিসেবেও তাঁকে মাঝে মাঝে দেখা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *