শূন্য দশকের কবিদের মধ্যে অতি পরিচিত এক নাম- সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কাব্যভাষার অমোঘ রোমান্টিকতা আচ্ছন্ন করেছে পাঠক ও কবিবন্ধুদের। প্রাণবন্ত, বন্ধুবৎসল, দিলদরিয়া সৌভিক মাতিয়ে রাখতেন কবিতা উৎসব এবং বইমেলার জমায়েত। বাংলালাইভের জন্য নিয়মিত লিখেছেন কবিতা, গদ্য ও কলাম। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে আমরা একইসঙ্গে হতবাক এবং শোকস্তব্ধ।
……….
সেই একটা সময় ছিল যখন শীতের বোরোলিন-হাওয়ায়, হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে, লুচি তরকারি খেতে খেতে,পশ্চিমে হাওয়া বদল করতে যেত বাঙালি; গিরিডি, ঘাটশিলা, শিমুলতলা, মধুপুর, হাজারিবাগ , নেতারহাট, ডাল্টনগঞ্জ, ম্যাক্লাস্কিগঞ্জ,পালামৌ, ঘন সবুজ পাহাড়ি টিলা, ফরেস্ট বাংলো, নীল আকাশ, বন্য ফুলের উপত্যকা, পাখিদের নির্জন ঝিল, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র ব্যাডমিন্টন কোর্ট থেকে উড়ে আসা শর্মিলা ঠাকুরের কালোফ্রেম চশমা-একটা সময় ছিল এ রকম। আদিবাসী বেকারির কেকের গন্ধে পুরোনো সন্ধে নেমে আসতো, বাগানবাড়ির মাথায় উঠতো শীতকাতুরে অলস চাঁদ, ইংল্যান্ডবাসী জ্যাঠামশাই গম্ভীর গলায় বলে উঠতেন – “বেশ শীত পড়েছে এখানে, এবার এই স্কচটা নিয়ে এসেছি, গলা ভিজিয়ে দ্যাখো, অমরেন্দ্র, ভালো লাগবে….”, দূরে তখন কোনও নাম-না-জানা গ্রামে বেজে উঠেছে মাদল, হ্যাজাকের আলো পেরিয়ে জঙ্গুলে পথ বেয়ে নেমে যাচ্ছে অচেনা ছায়া। সেই একটা সময় ছিল যখন সানি গাভাস্কারের লেট কাট, হাইকোর্ট অ্যান্ড ছাড়িয়ে পৌঁছে যেত ট্রিঙ্কাসের কোণের টেবিলে, আর লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের গেট পেরিয়ে হেঁটে এসে, ধুলোমাখা পার্ক সার্কাসে রং ছড়িয়ে দিত দু-বিনুনী প্রেমিকা। সেই একটা সময়, যখন হাত ধরতে এক মাস, আর প্রথম চুমু খেতে দু মাস আঠাশ দিন, যখন বিপদ মানে ময়দানের মর্নিং ওয়াকের সরোজ দত্ত, আর গাম্ভীর্য মানে ব্যারিটোন উৎপল দত্ত, যখন আভিজাত্য মানে সাদা অ্যাম্বাসাডক, আর রবিবার মানে মটনের ঝোল-পরবর্তী নিউ এম্পায়ারের ম্যাটিনি শো। সেই একটা সময় ছিল, দূরভাষবিহীন ইনোসেন্স ঘেরা একটা ঝাপসা সময় , স্ন্যাপ-ডিল আক্রান্ত ককটেলবিলাস যাকে চেনেনা….
কলকাতার শীত এমনই যে জ্যাকেট-মাফলার-সেমিবাঁদরটুপি-র পাশাপাশি বীরদর্পে হেঁটে চলে রাউন্ড নেক টি-শার্ট আর বারমুডা , কম্বলের ওপর এসে পড়ে এ.সি.-র হাল্কা চুম্বন, লং স্কার্টের দিকে আঙুল তুলে হেসে ওঠে ব্যাকলেস পিঠের প্রজাপতি-ট্যাটু। কলকাতা আর শীতের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে, তবে সেই সম্পর্কে কোনো কমিটমেন্ট নেই, একটা ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি আছে, একটা শুলেও হয়, না শুলেও হয় আছে , একটা সোয়েটার আছে, একটা না-সোয়েটার আছে। কলকাতার শীত বা শীতের কলকাতাকে ভরসা করা মানে পামেলা বোর্দের প্রেমে পড়ে যাওয়া, মানে চার্লস শোভরাজকে টাকা ধার দেওয়া, মানে বিশ্বাস করা সরকার মানুষের জন্যে নিবেদিতপ্রাণ, মানে ধরে নেওয়া এবার পৌষমেলায় তেমন ভিড় হবেনা, মানে ভেবে নেওয়া কাশ্মীরে নেমে এসেছে চিরশান্তি। রেমন্ডসের ঘন বাদামি সুটের কাপড় আর অঙ্গ-প্রতঙ্গের মধ্যে নিঃশব্দে ঢুকে পড়ে যে বিশ্বাসঘাতক, সে ক্যালকাটা উইন্টার; নভেম্বরে আশার আলো দেখানো যে স্লাইট হিমেল হাওয়া ডিসেম্বরে পাল্টি খেয়ে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম হয়ে যায়, তাকে চিনতে চেয়ে ন্যাপথলিন খেয়ে খেয়ে মরে গেছে আমাদের স্মৃতি-সোয়েটার, গিজার আসলে এক লুকোনো বন্দুক যে উষ্ণতার আড়ালে গায়ে ঢেলে দেয় অপ্রয়োজনীয় ক্ষয়। কলকাতা আর শীতের সম্পর্ক আসলে একটা খারাপ বিবাহ, একসঙ্গে থেকে যাবে বলে থেকে যাওয়া কিছুকাল, না থাকলেও হত, এ এক ‘যত দোষ উষ্ণায়ণ ঘোষ’ বলার ছুতো, বাকি অউর কুছ নহি। সারা বছর কমলালেবু হাতে বসে থাকা শহরে কমলালেবুর মাহাত্ম বিন্দুমাত্র নাই, ইয়ে উইন্টার, উইন্টার নহি, এক ধোঁকা হ্যায়, কলকাতা আর শীতের কাছে আসা, চুমু খাওয়া – এসব আসলে একাডেমিতে মঞ্চস্থ হওয়া নাটক, যেমন সব প্রেমের সম্পর্কই আজকাল বক্সঅফিসলোভী ফিল্মের শুটিং।
ঘন বাদামি চুল ডান দিক থেকে বাঁ দিক টস করলে আপার উড স্ট্রিটে অর্কিডের মরসুম নেমে আসে, রয়্যাল স্ট্যাগ হয়ে যায় সিঙ্গল মল্ট, ইকনমি ক্লাসের টিকিট অটোম্যাটিক আপগ্রেড হয়ে বিজনেস ক্লাস হয়ে যায়, ক্লিভেজে চোখ রেখে কেঁদে ফ্যালে প্রাক্তন প্রেমিক – চুল টস করলে, যে এতকিছু ঘটে, তামান্না ভার্গব জানেনা , তাই চুল ঝাঁকিয়ে সে হেসে উঠে বলে – “হোয়াও , ইনক্রেডিবল ….”, আর ট্র্যাফিক পুলিশের মাইনে বেড়ে যায় দু-গুন। এই ডিসেম্বর , তামান্না ভার্গবের বিভাজিকা আর বহ্নিশিখা থেকে উত্তাপ জড়ো করে তাই দিয়ে বনফায়ার করে , দিল্লির আউটস্কার্টসে মেহরৌলির সুবিশাল ফার্মহাউসে আইলাইনার আর হিপফ্লাস্ক , পার্টির হৈ -হট্টগোল পেরিয়ে বাগানের এক কোণে গোপনে চুমু খায় , কলকাতায় বেজে ওঠে ” জোসেফিন আই সেন্ড ইউ অল মাই লাভ ” ; তামান্না ভার্গবের ঘন বাদামি চুল হেসে ওঠে ব্রিজেট জোন্সের পার্লারে , উঠে যাওয়া জেমিনি সার্কাসের বাতিল রিং-মাস্টার বাজেট হোটেলে বসে রুটি-তড়কা খায় , ছোটখাট ব্যবসা দাঁড় করাবার স্বপ্ন দ্যাখে। এই ডিসেম্বর , নিউ মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য রাখে কে কখন ঢুকে যাচ্ছে সন্দেহজনক খোপে , কার প্রেম পালক হয়ে উড়ে যাচ্ছে দূরে , তামান্না ভার্গব চুল টস করে – হেড হলে, ভালোবাসা, টেল হলে যৌনতা – বল , আর্বান জিপসিবালক, তুমি কোনদিকে যাবে ?
এই সময়ে যাঁরা বাংলা কবিতা লিখছেন , তাঁদের মধ্যে সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। সৌভিকের কাব্যভাষা স্বকীয় ও স্বতন্ত্র - নাগরিক বিষন্নতা , সমাজসচেতনতা , মাঝে মাঝে কালো ঠাট্টা বা শ্লেষ ও নস্টালজিয়া তাঁর কবিতায় নানাভাবে ফিরে ফিরে আসে। লিখেছেন ছোট-বড় প্রায় সমস্ত বাণিজ্যিক ও লিটল ম্যাগাজিনে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সংখ্যা তেরো, ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে 'কবিতাসমগ্র ১'। কবিতার জন্যে ভাষানগর-মল্লিকা সেনগুপ্ত পুরস্কার, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পুরস্কার সহ পেয়েছেন আরও একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। গদ্যকার হিসেবেও উজ্জ্বল, এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত গদ্যের বইয়ের সংখ্যা তিন । বড় পর্দাতে অভিনেতা হিসেবেও তাঁকে মাঝে মাঝে দেখা যায়।