আশির শেষভাগ কিংবা নব্বইয়ের শুরু-র পাড়া , ওই তো আমি, নবাব , পাপু , জয় , পাপাই …সামার ভ্যাকেশনের কিংবা মাধ্যমিক-পরবর্তী সন্ধেতে বসে রকে আড্ডা দিচ্ছি , বিশ্বায়নের ঢেউ ইন্ডিয়ান ওশ্যানের তীরে এসে ধাক্কা দেব দেব করছে , আমরা বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মারাদোনার দ্বিতীয় গোলটা দেখে ফেলেছি , “কেয়ামত সে কেয়ামত তক “-এ দেখেছি ‘আমির খান’ নামক এক রাজপুত্রকে , পাশের পাড়ার কেয়াদি-কে দেখে তারপর থেকে মনে হয় জুহি চাওলা ; “ম্যায়নে পেয়ার কিয়া”-তে ‘সলমন খান’ নামের এক স্বপ্নালু চোখের হিরোকে দেখে তার মত চুল করার চেষ্টায় আয়নার সামনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে, “আশিকি” নামক এক সিনেমার গান কুমার শানুর মুখে রাতদিন শুনতে শুনতে, রাহুল রয়ের পর্দা-চুল নিজেদের কপালের ওপর থেকেই সরিয়ে নিয়েছি বার বার। প্রথম সিগারেট খেয়ে পেয়ারাপাতা চিবিয়েছি জোরে জোরে, সরস্বতী পুজোর দিন প্রথম ‘জিন’ নামের কোনও অত্যাশ্চর্য পানীয় চেখে বাড়ি ফিরে ক্যালানি খেয়েছি , অষ্টমীর প্যান্ডেলে প্রেমে পড়ব পড়ব করতে করতেও পিছিয়ে গিয়েছি এই জেনে যে মেয়েটি বম্বেতে থাকে, পুজোয় মামার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। ইনকাম নেই, পকেট মানি কিঞ্চিৎ আছে যা দিয়ে আর চলছে না , গলি ক্রিকেটে ইমরান খানের রান-আপ নকল করে ছুটে আসা আছে, ‘শচীন তেন্ডুলকার ‘ নামের এক বিস্ময়-বালকের আবির্ভাব ঘটেছে ময়দানে যে ষোলো বছর বয়সেই আব্দুল কাদিরকে তুলোধনা করতে পারে। সাউথ সিটি নেই , গ্লোব আছে , গ্লোবে শ্যারন স্টোনের সোনালী চুলে খেলে বেড়ানো ‘বেসিক ইনস্টিংক্ট’ আছে , সিনেমা দেখতে গিয়ে হলে ছবি শুরুর আগে , স্ক্রিনজুড়ে ওঠানামা করতে করতে স্লো-মোশনে “সঙ্গম বিউটি পাৰ্লার” থেকে ছুটে আসা সমুদ্রযুবতী আছে ; ও.এ.টি.-তে ‘এল.আর. বি.’ আর ‘শিভা ‘ আছে , হঠাৎ চায়ের কাপে ‘তোমাকে চাই’ আছে, বিবেকানন্দ পার্কের আড্ডা আছে ; কথা দিয়ে কথা রাখা আছে, মোবাইল ফোন নেই ; ব্যালকনি থেকে ছুঁড়ে দেওয়া চিঠি ও ফ্লাইং কিস আছে, ই-মেইল নেই। পাড়া আছে , অ্যাপার্টমেন্ট নেই। রোম্যান্স আছে চিরভাসমান হাল্কা মেঘের মতো।

একটা কলকাতা ছিল, এখন নেই …

বন্ধ ঘরে টেলিফোন বেজে চলেছে একটানা , কেউ তুলছেনা , কেঁপে উঠছে দেয়াল , নড়ে উঠছে জানলা , আচমকা রিসিভার তুলে নেয় হাওয়া – “হ্যালো, কে বলছেন ? না, ওই নামে এখানে কেউ থাকে না , রং নাম্বার ….” ; অপর দিক থেকে বলে ওঠে কেউ – “এটা ২৪৬৬….তো ? এখানেই তো …এখানেই তো রোদছায়া থাকে , এখানেই তো ছিল মেঘমন …, বাড়ি ভেঙে নতুন নতুন অ্যাপার্টমেন্ট এ পাড়ায় , ব্যালকনি থেকে ঝুঁকে থাকে উৎসুক লং স্কার্ট আর আদুরে ল্যাব্রাডর , এ সময় অশ্বত্থ গাছ, ভাঙা স্কুটারের হেডলাইট আর বন্ধ কিচেন নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় ? বন্ধ ঘরে ছায়াজন্ম , কার্নিশে খেয়ালি প্রত্ন-বেড়াল ফোনের শব্দে লেজ নাড়িয়ে চমকে ওঠে , ফোন বেজে চলেছে একটানা , ভাঙা আয়নায় তরঙ্গ ওঠে , আচমকা রিসিভার তুলে নেয় হাওয়া – ” হ্যালো , কে বলছেন ? ওই নামে এখন আর এখানে কেউ থাকেনা , একদিন ছিল , আর ফোন করবেননা দয়া করে …” ; অপর দিক থেকে বলে ওঠে কেউ – ” সেই সে দিন খুব কালবৈশাখী, মনে পড়ে? বিদ্যুতে বিদ্যুৎ , গুলমোহর গাছেদের আন্দোলন , ছাদের উপকথা ….মনে পড়ে ?” ; বাড়ি ভেঙে নতুন ক্যাপসুল লিফট , টেরেস গার্ডেন এ পাড়ায় এখন , এ সময় গুম হওয়া সম্পর্কের দলিল নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় ? টেলিফোন বাজে একটানা , দেয়ালের পোস্টারে হেসে ওঠে ধুলোপড়া গ্যাব্রিয়েলা সাবাতিনি। সেই কবে কারা এসেছিল মার্চ মাসে, সেই কবে কারা চলে গিয়েছিল কোনও অক্টোবরে, চকচকে ব্যালকনি থেকে ঝুঁকে পড়া লং স্কার্ট সে সব জানে না, হাওয়ার রেকর্ডেড ভয়েস বলে ওঠে – ” ওই নামে এখানে কেউ থাকে না …” , ন্যাপথলিন খেয়ে মরে যায় ভুতুড়ে আলমারি ..

সব চোখ নিয়নতাড়িত , সব চোখ নির্বিকার , ঢেউবিহীন জলাশয় , কোনও চোখে “সে দিন চৈত্রমাস” নেই , সর্বনাশ নেই। চেনা রাস্তায় হেঁটে যাওয়া অচেনা লোকের মত , বাড়ি-ঘর – গাছ -বারান্দা – ইস্ত্রিওয়ালা- গাড়ি মেকানিক- এইচ.ডি.এফ. সি. ব্যাংকের নিরিবিলি ব্রাঞ্চ -চাইনিজ রেস্টুরেন্টের নেপালি কুক – কেউ আর চিনতে পারেনা, আমিও আর চিনতে পারিনা কাউকে। বহ্নিশিখা ভার্গবের বাড়ির একতলায় ছোটখাটো আর্ট গ্যালারি এখন , গাড়িবারান্দা উবে গেছে , চোরকাঁটা বিঁধে গেছে পিয়ানোআঙুলে। স্মার্টফোনে ভেসে আসে স্মার্ট এস.এম.এস. – ” মনের মত বন্ধু /বান্ধবী পান , যোগাযোগ এই নম্বরে , বোল্ড রিলেশন …” , এ ভাবেই ক্লিন বোল্ড হয়ে গেছে প্রেম, স্লিভলেস চৈত্র-সেলের দিনে সব চোখ পাথরের , সব চোখ স্মৃতিহীন হিপহপ গান , কোনও চোখে শালবন নেই, দূরের উইন্ডমিল নেই। হৃদয় নেই, হার্ট রয়ে গেছে এখনও।

‘মিউজিকওয়ার্ল্ড’ নেই, তবু ‘মিউজিকওয়ার্ল্ড’-এর সামনে দেখা হল কেন ?

এই সময়ে যাঁরা বাংলা কবিতা লিখছেন , তাঁদের মধ্যে সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। সৌভিকের কাব্যভাষা স্বকীয় ও স্বতন্ত্র - নাগরিক বিষন্নতা , সমাজসচেতনতা , মাঝে মাঝে কালো ঠাট্টা বা শ্লেষ ও নস্টালজিয়া তাঁর কবিতায় নানাভাবে ফিরে ফিরে আসে। লিখেছেন ছোট-বড় প্রায় সমস্ত বাণিজ্যিক ও লিটল ম্যাগাজিনে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সংখ্যা তেরো, ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে 'কবিতাসমগ্র ১'। কবিতার জন্যে ভাষানগর-মল্লিকা সেনগুপ্ত পুরস্কার, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পুরস্কার সহ পেয়েছেন আরও একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। গদ্যকার হিসেবেও উজ্জ্বল, এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত গদ্যের বইয়ের সংখ্যা তিন । বড় পর্দাতে অভিনেতা হিসেবেও তাঁকে মাঝে মাঝে দেখা যায়।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *