ঝকঝকে নীল আকাশ, মাঝে মধ্যে মেঘের সঙ্গে কথালাপ, বিশ্বকর্মার ঘুড়ি উড়তে উড়তে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ভোরবেলার ঐতিহাসিক ব্যারিটোনের দিকে ভেসে চলেছে ; এ সময়, অফিস-কাজকর্ম-মিটিং সব চুলোয় যাক – আপামর বাঙালির মনে এ রকম উড়ু উড়ু ভাব, অফিসের কিউবিকলে হরিণীর নীল ওড়না ক্রমেই বালিগঞ্জ কালচার হয়ে যাচ্ছে, ভিনশহর থেকে উড়ে আসছে পুরনো বন্ধুর “পঞ্চমী রাতে পৌঁছচ্ছি..” , শোভাবাজার রাজবাড়ির দালানে, সোনালি রোদ এঁকে ফেলছে -“এই শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু…” ; নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে, টালিগঞ্জের ছেলে আনমনে হাডসন নদী পেরিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে গঙ্গার বুকে ভেসে চলা স্মৃতিনৌকায়, যে নৌকা অষ্টমীর অঞ্জলি দিয়ে ছইয়ের নীচে প্রেম বেয়ে বয়ে গিয়েছিল দূরে ….শপার্স স্টপের লাল কুর্তি টুক করে ঢুকে পড়ছে ব্রিজেট জোনসের ফেসিয়ালে, পুরুষালি লিভাইস জিন্স জাভেদ হাবিবের আয়নায় নিজেকে দেখে নিচ্ছে শেষ মুহূর্তে, “গুমনামিবাবা”-র হাত ধরে হাসিমুখে প্যান্ডেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সৃজিত মুখার্জি, এক নিঃশব্দ আলোড়ন শহরে , অদৃশ্য ত্রিনয়ন সব দেখে হেসে উঠছে মৃদু …

এখন, সন্ধেগুলো একটু তাড়াতাড়ি নেমে আসে, যেন ল্যাম্পপোস্টের চোখের ওপর নেমে আসছে হাল্কা ধুলোরং সানগ্লাস। হাওয়ায় মৃদু  হিম, আর সকলেই কোথাও ফিরতে চায় তাড়াতাড়ি।  রাস্তায় রঙচঙে পোস্টার-প্ল্যাকার্ড চারিদিকে, দিনভর রোদের অলস মেখে এলিয়ে থাকে অফিসপাড়া, কোথাও শহর-যাত্রার জন্যে তৈরি হয় সনাতন ঢাকি ও তার কাঁসর-বাদক ছেলে। মেঘ আর কাশের চুম্বন-পয়েন্টে চরাচর জুড়ে ফুটে ওঠে দেবীর মুখ, কুমোরটুলির অলি-গলিতে বিদেশিনীকে আরতি বোঝায় নিকন ডি.এস.এল.আর. লেন্সের সাহসী  যুবক। এখন, সন্ধেগুলো পাড়ায় পাড়ায় চেয়ার বিছিয়ে অর্ধনর্মিত প্যান্ডেলের পাশে জটলা, ঝাপসা আলো পেরিয়ে জেগে ওঠে দুঃখী বাইলেন।  শপিং মল  থেকে বেরিয়ে আসে আইফোন-যুবতি, প্রতিটা উবার ড্রাইভারকে হৃতিক রোশন মনে হয়। এক অদৃশ্য স্যাক্সোফোন বেজে চলে কোথাও, কোথাও বাজে পুরোনো  মাউথ-অর্গ্যান। যে প্যান্ডেলে দেখা হয়েছিল এক যুগ আগে, আজ সেখানে হেসে ওঠে নতুন মুখেরা। দিনগুলো ভেঙেচুরে হাওয়ার লিরিক হয়ে উড়ে যায় কে জানে কোথায়, অজানা সুড়ঙ্গপথে দাঁড়িয়ে থাকে বাগবাজার সার্বজনীন, সল্ট লেক এফ.ডি. ব্লক, যোধপুর পার্ক; একটা সবুজ দোপাট্টা, চিঠি হয়ে ভেসে থাকে  যেন মহাকাশে অতীতের ধুলো। যে ঠাকুর দেখা হয়নি, আর রাতজেগে যে ঠাকুর একসঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল – পুজোর মানে তাদের কাছে ফেরা, অনন্ত জলে ভেসে যাওয়া প্রতিমার মুখ তুমি বিসর্জন দিতে পারোনি কখনও, তবু অঞ্জলি দিতে দিতে আড়চোখে চোখাচোখির ওই নব্য-কুশীলবদের দেখে তুমি খুশি হয়ে ওঠো , শূন্য ডায়াল করে হেসে উঠে বলো – “দেখা হোক , সপ্তমীর বিকেলবেলায় ….”

আর কয়েক দিন পরেই কতশত উড়ন্ত, রঙিন যুবতী-সানগ্লাস দুর্গাবাড়ির অষ্টমী-সকালে আলগা ছুঁয়ে যাবে রুখু-দাড়ি প্রেম-অভিলাষী নতুন বাইকের চোখ, কত কত ফুচকা উড়বে আকাশে , হৃদয়ে কাঠি পড়বে নতুন ঋতুর আশায়।  পরবাস থেকে এসে পড়া পরিজন ক্যামেরায় বন্দী করবে ত্রিনয়ন, “কলকাতা পাল্টে গেছে”, কথা হবে দালানে-উঠোনে।  রেস্তোরাঁর বাইরে  ভদকার গেলাসে ফেলে রাখা চেরা লঙ্কার চাইতেও লম্বা, কিয়ুট, কিউ; আড্ডায় কালো সিফনের ভাঁজে ঘুরে চলা বাজপাখি-চোখ, সন্ধিপুজোয় ছুঁড়ে দেওয়া সন্ধিপ্রস্তাবে এ বারেও সাড়া মিলল না।  ফানুস ছুঁতে গিয়ে যে নাবিক ঘর হারিয়েছে , যাকে ছেড়ে চলে গেছে কমনীয় রং-পেন্সিল, বালিগঞ্জ কালচারে, বাগবাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে সে অসুরের দুঃখ বোঝে, সিগারেট ধরায়। অন্ধকার মুছে দেবেন আলোবাঁশি রুদ্র পাল, কথা দিয়েছেন।  হোয়াইট লিনেন শার্টে আমার যে নীল দাগ লেগে আছে , তা দেখে দুর্গাদেবী মৃদু হাসলেন, আশা রাখি, এক দিন পেয়ে যাব স্বর্গীয় সার্ফ এক্সেল।  আপাততঃ, ওয়েস্ট সাইড, প্যান্টালুন, চাঁদা-প্রত্যাশী কিছু হাত, ‘পুজোয় কী প্ল্যান ?’ – শহর ভরিয়ে রাখ এই সব দুর্গা-লিরিক।

বিসর্জন হয়ে গেলেও, লক্ষ্মী ফিরে যায় না, ভাসানের হইচইয়ের মধ্যে মা-ভাই-বোনদের চোখ এড়িয়ে স্যাট করে কেটে যায়, কলকাতা-কৈলাশ ফ্লাইট ডিপারচারের ঠিক আগে দুর্গার নজরে পড়ে লক্ষ্মী নেই , তিনি প্রশ্ন করলে বাকিরা সবাই চুপ করে থাকে। একমাত্র সরস্বতী জানে, লক্ষ্মী কোথায়, দশমীর পরে কৈলাশ ফিরে গিয়ে দুদিনের মাথায় আবার ফ্লাই ব্যাক করার ধকল এড়াতে লক্ষ্মী যে পুজোয় হওয়া নতুন বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে থেকে গেছে – এই গোপন কথা আর কেউ জানে না। পঞ্চমীর দিন আহিরিটোলা সাৰ্বজনীনের প্যান্ডেলে যে কালো টি-শার্ট পরা ছেলেটির সঙ্গে লক্ষ্মীর “চোখে চোখে কথা বল, মুখে কিছু বলনা” হয়েছিল, অষ্টমীর সন্ধ্যায় তারই সঙ্গে দুর্গাবাড়িতে লক্ষ্মী মণ্ডপে নিজের মায়া-মূর্তি বসিয়ে রেখে  ঘন্টা খানেক ঘুরেছিল , কফি খেয়েছিল, প্রক্সিটা সরস্বতী ছাড়া কেউ বুঝতে পারেনি। সেই বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গেই লক্ষ্মী পুজোর ভিড়-ভাট্টা শেষে নদীর ধারে এক নিরিবিলি গেস্ট হাউসে দু-তিন দিন কাটিয়ে আগামিকাল ফুলমুন রাতে আবার প্যান্ডেলে ফিরবে। মা-কে “সরি মা, আর করব না ” – এই হোয়াটস্যাপ পাঠিয়ে কোনও উত্তর মেলেনি , মেসেজ ডেলিভার্ড , ডবল নীল দাগ, দুর্গা পড়েছেন তবু জবাব দেননি, সুতরাং বাড়ি ফিরে চাপ আছে  লক্ষ্মী জানে , তবু এই মাঝের দু-তিনদিন সে ব্লু জিন্স, পিঙ্ক টপ পরে চুল খুলে গেয়ে ওঠে – “পরী হুঁ ম্যায় “….দশমী আর লক্ষ্মী পুজোর মাঝখানের  এই লুকোনো গল্প কোথাও লেখা নেই, তবে মর্ত্যের উদ্দেশে রওনা দেবার আগে, এ রকমটা যে ঘটতে পারে, তা লক্ষ্মী বাবাকে জানিয়ে রাখে প্রতি বার, এই লুকনো রোম্যান্সে মহাদেব হাসিমুখে সায় দিয়ে থাকেন , শুধু তাঁর একটাই শর্ত থাকে – পুজোয় হওয়া বয়ফ্রেন্ডের কাছ থেকে” একটু মালানা ক্রিম আর একটা  রুপোর ছিলিম জোগাড় করে আনিস …”

এই সময়ে যাঁরা বাংলা কবিতা লিখছেন , তাঁদের মধ্যে সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। সৌভিকের কাব্যভাষা স্বকীয় ও স্বতন্ত্র - নাগরিক বিষন্নতা , সমাজসচেতনতা , মাঝে মাঝে কালো ঠাট্টা বা শ্লেষ ও নস্টালজিয়া তাঁর কবিতায় নানাভাবে ফিরে ফিরে আসে। লিখেছেন ছোট-বড় প্রায় সমস্ত বাণিজ্যিক ও লিটল ম্যাগাজিনে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সংখ্যা তেরো, ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে 'কবিতাসমগ্র ১'। কবিতার জন্যে ভাষানগর-মল্লিকা সেনগুপ্ত পুরস্কার, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পুরস্কার সহ পেয়েছেন আরও একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। গদ্যকার হিসেবেও উজ্জ্বল, এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত গদ্যের বইয়ের সংখ্যা তিন । বড় পর্দাতে অভিনেতা হিসেবেও তাঁকে মাঝে মাঝে দেখা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *