কবিতা ও বিষাদ
একজোড়া পায়রার মতো
বুকের ওপর বসে আছে
আমার বুক, এক ঢালু জমি
ভেতরে হাড়গোড়, একদা যেসব আনন্দ ছিল জীবনে, তার
সেসবের ওপরে কাঁচামাটির গোর
মৃত্যুভয়ের গোর
বিষাদ এসে বুকের ওপর বসে
কান্না এসে খুঁটে খায় মাটির ভেতরের পোকাদের
কবিতা এসে ডানা ঝাপটায়
বলে, জেগে আছ?
ভেতরে আনন্দের হাড় খটখট করে নড়ে।
আমি সাড় ফিরে পাইনা
আগে পেতাম।

ইলাস্টিক ঢিলে হয়ে গেল
বেদনাবহন করা দীর্ঘদিন হল, তাই হয়ত।
আর ফিরে আসা যায়না, এক লাফে
পুরনো চরিত্রে, আনন্দে,
একটা প্রজন্ম মরে গেল মন থেকে
কেউ জানল না
একটা যুগের সব মানুষের ভেতরের আনন্দসূত্রটি
ভাললাগা ভালবাসা হৃদয়ের সূক্ষ্ম  পৈতেটি
কবে খসে পড়ে গেল, কেউ জানল না
গোটা একটা বয়স্ক নাগরিকের দল
আনন্দের অধিকার হারিয়ে, ব্রাহ্মণত্ব খুইয়ে, পৈতে ছিঁড়ে ফেলে
দিগম্বর, মাথার ওপরে আকাশ ও ঈশ্বরহীন
শুধু দুঃখের পালক গালে ঘষতে ঘষতে মরে যাবে…
কেউ কারুর কাছে আসতে পারবে না

কেউ কারুর কাছে আসতে পারছি না
চেনা লোকেরা পুরনো চেনা ভুলে গেছে
যেন যাদুকর বিষবড়ি ডলে দিয়েছে মাথায়
এক গাদা লোক
কেবল নতুন চেনা চাইছে,
অপরিচিতদের চাইছে
তাদের ভালবাসা চাইছে, লাইক চাইছে, গালে গাল ঘষা চাইছে
ঠোঁট ছুঁচলো করা সেলফিছবি চাইছে
মধ্যরাতের ইনবক্স চাইছে
চেনা লোকেরা পুরনো চেনাদের কাছে যেতে পারছে না
কাছে আসতে দিতে পারছে না
সবাই সবাইকে ঘেন্না করছে
সবাই সবাইকে ভয় করছে বিদ্বেষ করছে,
নীরবতার দেওয়াল তুলে দিচ্ছে।
চেনা লোকদের রোঁয়াওঠা ঘেয়ো কুকুরের মতো লাগছে
সারাগায়ে চেনা চেনা গন্ধ
দৈনন্দিনের গন্ধ
দিনগত পাপক্ষয়ের গন্ধ
কেউ আর কারুর চৌকিতে পা তুলে বসতে পারছে না
কেউ আর কারুর জামায় হাত গলাতে পারছে না
কেউ আর কারুর ঠোঁট থেকে বিড়ি টেনে ফুঁকতে পারছে না
কেউ আর কারুর বাটি থেকে হাত বাড়িয়ে এক মুঠো মুড়িমাখা তুলে নিতে পারছে না
ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যাবে যে, তাই
সবাই সবাইকে অচ্ছুৎ ভেবে, পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে
আর অপরিচিত দেবদূতের মাথার আলোকবৃত্ত খুঁজছে
দামি দোকানের ইন্টিরিয়র খুঁজছে
হাইহ্যালো কেয়াবাত চুম্মা ওয়াও খুঁজছে
একটা প্রজন্মের মাথায় যাদুকর বিষবড়ি ডলে দিয়েছে
সবাই দূরত্বে থেকে সবাইকে দেখতে, ভাবতে, ছুঁতে চাইছে…
খুব খুব অচেনা আর নতুন হতে চাইছে

সদা উদ্ভাবনে ছিলে তুমি
মনখানি নিচু হলে ফের তাকে উঁচু করে ধরার আকুতি ছিল খুব
বাসনার হাওয়াকল ভারি হয়ে নেমে এলে
ফের তাকে হাওয়া ভরে ওপরে পাঠাতে
সদা উল্লম্ফনে ছিলে তুমি
নতুন প্রেমে পড়ার মতো
এখন কেবল সুর, গান দেয় সামান্য প্রলেপ
বাকিটা, ক্ষতের মুখে কোনও আর বেদনাহারক বস্তু নেই বলে, ফাঁকা
ন্যাড়া, উন্মুক্ত ক্ষতে বয়ে যাচ্ছে শীতের বাতাস।
ভারি ভারি পাথর বেঁধেছ বুকে,
হাওয়াকল দুমড়ে পড়ে আছে।
এরপর যা হবে তা আবার ঢেউয়ের সঙ্গে ওপরের দিকেই
কেননা একেবারে তলদেশ ছুঁয়েছি আমি
হারাবার কিছু নেই
শিকল ছাড়া

ছবি সৌজন্য: Pixabay

কলকাতার বাসিন্দা | নব্বই দশকের কবি | কৃতি ছাত্রী | সরকারি আধিকারিক | একাধিক পুরস্কারপ্রাপ্ত | উল্লেখ্যোগ্য গ্রন্থের নাম পিশাচিনী কাব্য (১৯৯৮)‚ আবার প্রথম থেকে পড়ো (২০০১)‚ মেয়েদের প্রজাতন্ত্র (২০০৫) | কবিতাগদ্যে মননশীল্‚ গল্পেও স্বচ্ছন্দ |

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *