আমরা আর কিছুতে অবাক হই না, এটা একটা না-অবাক, না-আশ্চর্য সময়, এটা “হ্যাঁ, এ আর এমন কী” টাইপের টাইম আছে, বাবু।  আমরা ভাল সিনেমা, ভাল সাহিত্য, ভাল প্রেম, ভাল আইসক্রিম, ভাল কন্ডোম, ভাল আকাশ, ভাল পাতাল – কোনও কিছুতেই আর অবাক হই না, কারণ আমরা সব জেনে গেছি, আমরা সব দেখে নিয়েছি, আমরা সব জানি, আমরা হোয়াটস্যাপ জানি, স্ন্যাপডিল জানি, চিকেন টেট্রাজিনি জানি, হইচই অ্যাপ জানি, আই -পিল, আই পিএল  জানি, প্রথম ডেট-এ নির্ঝঞ্ঝাট শুয়ে পড়া জানি, টাকা মেরে দেওয়া জানি, চাকরি খেয়ে নেওয়া জানি, কাঠিবাজি জানি হাড়েহাড়ে, ধর্ম জানি, ধর্ম মানে রাজনীতি জেনেও জানতে চাইনা, মালানা ক্রিম জানি, ই.ভি.এম. মেশিন জানি, জিন্সের সাইডপকেটে লুকোনও মেশিনও জানি। এটা একটা সবজান্তা, না-অবাক সময়, সেই কবে কারা হারানো সত্তর দশকে দূরদর্শীর মত লিখেছিল – ” ঘরে বসে সারা দুনিয়ার সাথে / যোগাযোগ আজ হাতের মুঠোতে/ ঘুচে গেছে দেশ  কাল সীমানার গন্ডি /…..ভেবে দেখেছো কী ? তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে,  তারো দূরে / তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে….” , আজ এই ২০১৯-এ বসে, ক্যাফে লাতে খেতে খেতে, আমরা সেই ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলানোর জন্যে  গম্ভীর মুখে বসে আছি, আমরা জাস্ট সরে গেছি।  পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, সম্পর্ক সবার থেকে আমরা সরে গেছি ক্যাজুয়ালি, বিপদে পড়ে থাকা মানুষের পাশ থেকে সরে গেছি উচ্চাশার পিচ্ছিল মই দেখে, আমরা “ব্রেক-আপ” করেছি সূর্যোদয়ের দিনে, খোলা পিঠের ট্যাটু দেখে ভুলে গেছি চোখের জল। আমাদের আর কিছু ভাল লাগে না, ভাল মানুষ ভাল লাগে না, ভাল আকাশ ভাল লাগে না, কারণ এ সব তো আমরা জানি, না ? নতুন কী আছে, ধর্মাবতার, প্লিজ আর বোর করবেন না, নয়া কুছ বাতাইয়ে, নইলে এই শনিবার সন্ধ্যায় পাবে বসে ড্রট বিয়ার খাব, আপনার বাতেলা শুনবনা হার্গিস। সময় কম, অত অবাক-আশ্চর্য হবার টাইম নেই, আমরা সব জানি, বিলিভ মি, নতুন কিছু আছে ? আমরা আর অবাক হই না।  আমি একটু অবাক হতে চাই আবার।  একটা না-অবাক সময়ে দাঁড়িয়ে একটা অবাক করে দেবার মত ভালবাসা চাই, একটা মেশিনগান চাই যা থেকে বুলেট বেরোয়না, জ্যোৎস্না বেরোয়। আমাদের অবাক হবার একটা চান্স দেওয়া হোক, স্যার।  লাস্ট চান্স, আই স্যোআর …

আবার অনেকে আছেন, যাঁদের মনে হয় কিছুই হচ্ছে না – “এই সিনেমাটা হয়নি, করতে পারেনি”; “এটা কি অভিনয় ? এর চেয়ে তো আমি বেটার”; ” এটা কবিতা হয়নি, এর কবিতা হয়না ” ; “এর গান ভাল লাগেনা, গাইতে পারেনা ” ; “এর ছবি আঁকা উচিত না, এ কেন আঁকে ?” ইত্যাদি। কিন্তু এই যে “হয়নি”, এর বিপরীতে কী করলে “হবে”, তা নিয়ে এনাদের ধোয়াঁশা কলকাতা শহরের বাড়তে থাকা পলিউশনের চেয়েও গভীর। “এই সিনেমাটা তো গুয়েতেমালার এক শর্ট ফিল্মের নকল শুনছি” – যিনি বলে উঠলেন, তিনি সিনেমাটাই দেখবেন না কখনও, তিনি কে ? বাঙালি। কোনও আর্ট-ফর্ম ভাল লাগলেও বুক ঠুকে প্রশংসা না করতে পারা লোকটি কে? বাঙালি। কলোনিয়াল পাস্ট এবং তার পর বহু বছরের অর্থনৈতিক পিছিয়ে পড়ার ইতিহাসের ফলে বাঙালি এক অসুখী জাত, সব ব্যাপারে নেগেটিভ, বিশেষত আর্ট-কালচারের ক্ষেত্র হলেই, তার মনে হয় কিচ্ছু হচ্ছে না, অনেক ভাল হতে পারত। বিশ্বায়নের হাঙরের মুখ থেকে নির্গত এক বাজার-সর্বস্ব, মধ্যমেধার হাওয়ার মধ্যে এক অলীক রেনেসাঁস-এর দিকে তাকিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে থাকা বাঙালি তাই বলে ওঠে – “হয়নি”, “দাঁড়ায়নি”, কী করলে “দাঁড়াবে” বা দাঁড়াত সে সব নিয়ে তার পাতে দেবার মত কোনও বক্তব্য থাকে না …ভুষি মালকে অযথা প্রশংসা করা যেমন সমীচীন নয়, তেমনই সবই “হয়নি” এটাও হয়না …আর তা ছাড়া এই “হয়নি” সময়ে দাঁড়িয়ে আপনি কোন জাদুবলে বুঝতে পারছেন কোনটা “হয়”? মানে কোনও রেফারেন্স পয়েন্ট, অতীতের সঙ্গে তুলনা টানছেন, তাই তো ? কিন্তু অতীত তো অতীত – অন্য সময়, অন্য সমাজ, অন্য বোধ, অন্য দেখা ও দেখানোর চোখ, তুলনা হয় ? আমি ২০১৯-এর সাউথ সিটি মলের সামনে দাঁড়িয়ে স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড থেকে নেমে ঠোঁটে সিগারেট, চোখে সানগ্লাস উত্তমকুমার ফিরপো /ফারপো -র দিকে হেঁটে যাচ্ছেন, দেখব ? নাকি কবিতায় “নাটোরের বনলতা সেন” খুঁজব প্রতিটি অক্ষরে ?

এই সময়ে যাঁরা বাংলা কবিতা লিখছেন , তাঁদের মধ্যে সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। সৌভিকের কাব্যভাষা স্বকীয় ও স্বতন্ত্র - নাগরিক বিষন্নতা , সমাজসচেতনতা , মাঝে মাঝে কালো ঠাট্টা বা শ্লেষ ও নস্টালজিয়া তাঁর কবিতায় নানাভাবে ফিরে ফিরে আসে। লিখেছেন ছোট-বড় প্রায় সমস্ত বাণিজ্যিক ও লিটল ম্যাগাজিনে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সংখ্যা তেরো, ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে 'কবিতাসমগ্র ১'। কবিতার জন্যে ভাষানগর-মল্লিকা সেনগুপ্ত পুরস্কার, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পুরস্কার সহ পেয়েছেন আরও একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। গদ্যকার হিসেবেও উজ্জ্বল, এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত গদ্যের বইয়ের সংখ্যা তিন । বড় পর্দাতে অভিনেতা হিসেবেও তাঁকে মাঝে মাঝে দেখা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *