আগের পর্ব পড়তে: [] []

 উট জলপান করতে বাধ্য নয় 

গঙ্গারাঢ়ী কলিঙ্গরাজ দণ্ডপাণির বোন .
যেন তখন ফিরে আসছে হাসতে হাসতে পিয়াল ও রঙ্গন
তখন আমার বুকের মাঝে
কী অপরূপ পদ্ম রাজে
ঘণ্টা বাজে, অন্ধস্কুলে ঘণ্টা বাজে। 

–অরুণ বসু 

সহস্রাব্দের শুরুর দিকে, যখন আমরা সবে কলেজে উঠেছি আর তবুও কচি গোঁফে লেগে শিশিরের সর, ছোট পাড়া থেকে বেরিয়ে রাজপথে থতমত পা ফেলা যখন আপন বাপন চৌকি চাপন করে রাস্তা কেটে নিচ্ছে নিজেদের। মনে রাখতে হবে প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের রমরমা হলেও একটা বড় সংখ্যায় ছেলেমেয়ে কলকাতার কলেজগুলোতেই যেত তখন, হয়তো এখনও, সে সময়ে ভ্যাবাচ্যকা তারুণ্যকে শক্ত মুঠিতে মোষের শিং ধরাতে শিখিয়েছিল যে প্রকরণগুলো, সেগুলো নানাবিধ, তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটো উপাদান ছিল ছাত্র রাজনীতি ও লিটল ম্যাগ, এবং তারাও অনেক সময়েই লগ্নতায় ভরপুর থাকত। ছাত্র রাজনীতি বলতে এক্ষেত্রে নানা রঙের বাম রাজনীতির কথাই বলা উচিত, কারণ তখনও কলকাতায় পোস্ট-আইডিয়ার যুগ শুরু হয়নি, তাই শিবিরভেদে সংস্কৃতির বিভাজনও জাজ্জ্বল্যমান ছিল। ব্যতিক্রম ছিল না তা নয়, কিন্তু মোটামুটিভাবে দেখতে গেলে নানা ধারার বাম ছাত্র রাজনীতির সমর্থক ছেলেপুলেরাই মূলত পত্রিকা বার করত, তাদের পাতায় পাতায় সময়বিশেষে উৎকট প্রতিজ্ঞাগুলো দেখে চিনেও নেওয়া যেত কে কোন খাতে বইছে। এখন ব্যাপারটা অনেক অন্যরকম, অবাম অথবা অরাজনৈতিক ছেলেমেয়েরাও ভালো কাগজ বার করে, লেখালেখিতে চমকে দেয়। কিন্তু আজ থেকে কুড়ি বাইশ বছর আগে ক্লাসিফিকেশন কিছুটা সরল ও নিখুঁত ছিল। তখনও খানিক সংস্কৃতির চর্চা পাড়ায় পাড়ায় হয়েছে, যতই প্রথামাফিক হোক না কেন, এবং বাম পরিবৃত্তের ছায়ায় বাঁচা মানুষজনের ভেতর একপ্রকার কৃষ্টির উত্তরাধিকার এতটাই অনুগত ও একমুখী স্রোত বজায় রেখেছিল, তাকে ছুঁতে পারা অনায়াস ছিল না অন্য ধারার কাছে। নানা কারণে এই ভেদরেখা পরে আবছা হয়েছে, সে অন্য প্রসঙ্গ।

সেই সময়ে বহু কলেজপত্রিকা বেরত যেগুলোতে, এমনকী কলেজের দেওয়ালে ঝুলত যে হাতেলেখা পত্রিকাগুলো, ক্কচিৎ ভালো লেখা ঝলসে ওঠার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক স্থানাংক নির্ণয়ও সহজ ছিল। ম্যাগাজিনগুলো অনেক সময়েই বেরত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে, এবং গুণগত মানের হেরফের থেকেও বুঝে নেওয়া যেতে পারত কোন দল ইউনিয়নে। ইনকিলাব ও বন্দেমাতরম তখনও স্থান পালটাপালটি করেনি, হাঁটেওনি হাত ধরে। কিন্তু শুধু সেটা নয়। কলেজের যে ছেলেমেয়েরা কাগজ করতে আসত, তাদের রোল-মডেল থাকতেন এক একজন সাহিত্যিক, যাঁদের সিংহভাগ তথাকথিত অর্থে অবাণিজ্যিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক কিছুটা। সুবিমল মিশ্র পর্বতপ্রতিম, তাঁকে পছন্দ অপছন্দের সমীকরণ এড়িয়েও অগ্রাহ্য করা সম্ভব ছিল না। বইমেলাতে তাঁর বইয়ের পসরা সাজিয়ে সামনে লেখা ‘মূল্য একশো টাকা অথবা সুবিমলের পাঠক হবার জন্য যতটা দিতে আপনি রাজি থাকেন’, এসবে চমকিত হয়েছে অনেকেই। তাঁকে বাদ দিলেও, বাসুদেব দাশগুপ্ত হোক বা অরুণেশ ঘোষ, কাল্ট হয়ে উঠলেন যাঁরা, সকলেই দ্বিধাহীনভাবে নিজেদের বাম রাজনীতির উত্তরবাহক বলতে আপত্তি করেননি। ‘এবং বিসম্বাদ’ জাতীয় সরাসরি রাজনৈতিক পত্রিকা যদি বাদও দিই, সাহিত্যে নিবেদিত কাগজগুলোতেও ট্রেন্ড ছিল সেটা। 

subimal-misra
সুবিমল মিশ্র পর্বতপ্রতিম, তাঁকে পছন্দ অপছন্দের সমীকরণ এড়িয়েও অগ্রাহ্য করা সম্ভব ছিল না

মনে পড়ছে ১৯৯৮ বা ’৯৯ সালে সুবিমল মিশ্রকে নিয়ে চমকে দেবার মতো সংখ্যা করেছিল অধুনালুপ্ত ‘অ-য়ে অজগর’ পত্রিকা, যার সম্পাদকমণ্ডলীর প্রায় সকলেই প্রত্যক্ষভাবে গাঢ় লাল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পোস্ট-মডার্ন জাতীয় চিন্তাধারা, পরিচিতির রাজনীতি তখন এলেও শীর্ণস্রোতা, আমাদের হৃদয় নক্ষত্রের মতো জ্বলন্ত আনুগত্য গচ্ছিত রাখতে শিখেছিল শ্রেণির কাছেই মূলত। সেখানেও প্রাতিষ্ঠানিকদের বিপ্রতীপে দাঁড়ানো অন্য বামেরা সাহিত্যের ক্ষেত্রে কিছু বা উজ্জ্বলতর ছিলেন, বলতে দ্বিধা নেই। তাঁদের কাগজগুলোতে পরীক্ষানিরীক্ষা হত বেশি, প্রথা ভাঙার, গদ্যের ফর্ম নিয়ে অভিনবত্ব, যেগুলোর বেশিরভাগ স্বাভাবিকভাবেই অসফল। কিন্তু এখানে বিষয়টা অর্জনের নয়। আমরা সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুল, কলেজবেলায় লাজুক আমরা, আমরা লিখতে চাইতাম, তবু প্রকাশের পথ জানতাম না, আর দেখতাম বাণিজ্যিক জায়গাগুলো সাফল্যে টইটুম্বুর, অমেধাবি আমাদের দিকে উদাসীন পিঠ ফিরিয়ে রাখে, তাহলে আমরা কোথায় যাব? আমরা তো কেউই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা করব বলে বা তত্ত্বরচনার অভিপ্রায়ে লিটল ম্যাগে আসিনি! এসেছি, কারণ লিখতে চাই। তখন এই ওপেন স্পেসগুলো আমাদের জড়িয়ে নিল, বিশ্বাস করাতে শেখাল দ্রোহে ও নাস্তিক্যে, গর্ভে সঞ্চিত বিদ্যুৎ চমকানো মেঘের মতো আমাদের অভিমান, পুঞ্জিত প্রত্যাখ্যানের ক্ষোভ আমাদের, সেসবের আধার হল অবাণিজ্যিক জায়গাগুলো। আর নিশ্চিত নিয়তির মতো সেই অবাণিজ্যিকতা, যা নাকি আসলে বৃহৎ পুঁজিকে অস্বীকার করে, নির্জন চোখ ফিরিয়ে নেয় পণ্যায়নের থেকে, অন্তত এসব তখন ভেবেছিলাম, একে তত্ত্বায়িত করতে হলে রাজনীতি ছিল অমোঘ, যা বিশ্বায়ন-বিরোধী, মানুষকে মানুষের অসীমতায় পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে একতানমনা। এভাবেই আমাদের রাজনীতির পাঠ, দশকদেহ যাকে ধারণ করে। 

Kobitar-Andhakar-Jatra-Arunesh-Ghosh
প্রাতিষ্ঠানিকদের বিপ্রতীপে দাঁড়ানো অন্য বামেরা সাহিত্যের ক্ষেত্রে কিছু বা উজ্জ্বলতর ছিলেন

আজ স্বীকার করতে বাধা নেই, সে পাঠ কাঁচা ও আতুর, যার উদ্গ্রীব লাবডুবের মধ্যে আবেগ যতটা ছিল, যুক্তি ছিল না। তার থেকেও বেশি ছিল ব্যক্তিগত হিসেব– আমরাও খ্যাতি চাই, চাই যশ, আবার চাই দ্রোহের মর্যাদা, আমরা চাই বামের প্রেস্টিজ ও ডানের অর্জন– তবু সেসব অপরিণত উচ্চাকাঙ্ক্ষা অথবা বোকামির মতো একপ্রকার স্পর্ধাবোধ আমাদের অক্ষরনির্মাণ শিখিয়েছে, অস্বীকার করব কী করে! আমাদের কলেজের ইউনিয়নগুলো যে কাগজ বার করত, অকৃপণ ঔদার্যে সেখানে আমরা ফর্ম ভেঙেছি, ঢুকিয়েছি দুঃসাহসী শব্দবন্ধ। দাদারা হয়তো বুঝত না, অথবা মনোযোগ দিয়ে পড়ত না, কিংবা ‘যা পারে লিখুক’ জাতীয় স্নেহমিশ্রিত অবহেলায় মুখ ফিরিয়ে থাকার ফলে আমাদের কবিতায় ঢুকেছিল বুকাওস্কির কথামালা, কাফকা বা বর্হেস মেঘের মতো ঝুঁকেছিলেন আমাদের লেখা গল্পে, মুক্তগদ্যে সন্দীপন অনুসারী যৌনতার অক্ষম ব্যবহার নিজেদেরকে নাশকতার দেবদূত ভাবতে শিখিয়েছিল। সেসব ভাষানির্মাণ পরবর্তীকালে অপ্রাসঙ্গিক হয়েছে, আমরা নিজেরাই করুণ হেসেছি ব্যর্থ সন্তানের দিকে তাকিয়ে, তবু সেগুলোই পরিণত করেছে আমাদের। সুবিমল মিশ্র একবার লিখেছিলেন, কোনও এক অগম্য স্পর্ধায়, যা একমাত্র লিটল ম্যাগাজিনই নিজের মুঠিতে বাঁধতে পারে– ’উট শুকনো কুয়ো থেকেও জলপান করে, কিন্তু উট জলপান করতে বাধ্য নয়।’ প্রথাজল আঙুল গড়িয়ে চুঁইয়ে দেবার অবাধ্যতায় আমাদের পিঠ উঁচু হয়েছিল সত্য, সে গলার ভেতর যতই তৃষ্ণার্ত আকুলি থাকুক, নিঃসঙ্গ গ্রীবা অথবা দুর্বিনয় আমাদের কল্পারম্ভ, বোধন সমবেত লেখাজন্মে ।

তখনও পর্যন্ত আমাদের লেখালেখি, আমরা যারা সিরিয়াস লিখতে চেয়েছি, সেগুলো বাইরের পত্রিকাগুলোর ছোঁয়া খুব একটা পায়নি। কলেজের দেওয়াল পত্রিকা ও ম্যাগাজিন, বিশেষত হাতে লেখা যেগুলো বেরত, সেসবের মধ্যেই দিন গুজরান। তারই মধ্যে কোনও বন্ধুর লেখা ‘পরিকথা’ বা ‘দিবারাত্রির কাব্য’-র মতো কুলীন কাগজে স্থান পেলে ঈর্ষাকাতর চোখে তাকানো– আমাদেরও নাকি হবে! আবার লেখা অমনোনীত হয়ে ফেরত এলে সেসব কাগজকে সুবিধেবাদী, বুর্জোয়ার দালাল বলে দাগিয়ে দেওয়া, সেসবও ছিল। কেউ কেউ আবার কোথাও লেখাই পাঠাত না। লিখছে হয়ত দারুণ, সান্ধ্য আড্ডায় কবিতা বলে ফাটিয়ে দিচ্ছে ও অবধারিত জুটে যাচ্ছে সমবেত আঘ্রাণ-কামনার শ্যামলা মেয়েটির মুগ্ধতা, তবু লেখা দেবে না, আলস্য অথবা একপ্রকার ঘাউড়ামি, যা-ই বলা যাক একে। তার ওপর আদর্শবাদের গোলমরিচ ছড়ালে মুচমুচে হয়, সমস্ত প্রকার প্রাতিষ্ঠানিকতার গালে থাপ্পড় মেরে সে স্বাদ লেগে থাকে আমাদের ঠোঁটে, এবম্বিধ নানা রোমান্টিকতা সম্বলে দিন কেটেছে অপ্রকাশনার আখ্যানদের।

Little Mag
আমরা তো কেউই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা করব বলে বা তত্ত্বরচনার অভিপ্রায়ে লিটল ম্যাগে আসিনি

বেশিরভাগই পরে লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছে, চাকরিবাকরি সংসার আর নানা ফিকির গিলে খেয়েছে, কেউ কেউ চালিয়ে গেলে সত্যিই ভাল লিখত হয়তো, এবং তবু যা হয়, জীবনের জটিলতা যেভাবে গিলে নেয় পবিত্র অর্ধকুসুম, সেসব থাকেই। আশুতোষ, যাদবপুর, মৌলানা আজাদ, সিটি অথবা নেতাজিনগর জুড়ে যে লেখারা ডানা মেলেছিল, তবু, স্কুলের দেওয়াল ম্যাগাজিনের দিনগুলোর কাঁচা দেশাত্মবোধ পেরিয়ে এসে যৌবনকালের ঔদাসিন্য, স্মার্ট প্রেমের ভঙ্গি অথবা তীব্র স্যাটায়ারিক, তাদের বিবেক বামমার্গী ছিল নির্দ্বিধায়, তাই মরে গিয়েও দ্বন্দ্বে হতাশায় বৈরিতায় ও উৎসাহে তারা বেঁচে থাকে, সতীর্থ কেউ যদি লেখা চালিয়ে যায়, অতর্কিতে সে লেখার ঘাড়ে চাপে ভুলে যাওয়া কলেজপত্রিকায় বিস্মৃত বন্ধুর উদাস মুখ।

এতদিন পেরিয়ে এ প্রকার ক্লাসিফিকেশন অচল হয়ে গেছে, কারণ আমরা জানি মড়ার খাটের নীচে বোমার বস্তা যে রেখে আসে, তার রাজনীতি ধরা সহজ হয় না। যে পার্টির পরিবৃত্ত আমাদের প্রারম্ভিক পাঠ দিয়েছিল, আজ সে স্রোতও স্তিমিত, কিছু বা স্থান বদলে, কিছু বা হতাশ মৃত্যুতে, নিস্পৃহতায় কিছুটা। সাদা লাল মলাটে দুনিয়া কাঁপানো দশ দিনের ওপর ধুলো পড়ে, ফুটপাত থেকে কেনা স্পার্টাকাসের স্পাইন ভেঙে যায়, অবহেলায় পড়ে থাকে আলমারির কোণে। বিশ্বাসের হাতবদল হয়, আমরা বিস্ময়ে দেখি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে চমৎকার বিশ্লেষণী প্রবন্ধ জায়গা করে নিচ্ছে ডানপন্থী পার্টির কোল ঘেঁষা কাগজে, দেখি কীভাবে এক যুগের অবাক দ্রোহের সুতীব্র উচ্চারণ ফেটে বিচূর্ণ হয়ে পরের যুগে নির্বিষ লব্জে পরিণত হয়, যাকে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট করতে ডান বা বাম কোনও শিবিরের সমস্যা থাকে না। এসবই দেখি, তবু মায়া রহিয়া যায়। প্রকৃত সাবোতাজ এক খাঁটি বন্ধুত্ব, ছানাকাটা কুয়াশায় প্রিয়তমের মুখ খুঁজে নেবার শুদ্ধতা যেমন, সে অপেক্ষায় ভাসানপ্রতিমার স্থির মুখের মতো অনিমেষ থাকে অনুজদের লেখালেখি, আমরাও ভাবি এদের হাতেই আছে সেই নিষ্পাপ নাশকবোমা। ভাবি, এরা এখনও জলপান করতে বাধ্য নয়!  

 

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৯ সেপ্টেম্বর ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Shapefeature, Boighar, Facebook

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *