আজ সারাদিনই ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়ছে। কখনও ঝিরঝির করেও ঝরছে। কিন্তু ঝরছে। হ্যাঁ, ঝরার কোন বিরাম নেই। আগে এই বৃষ্টির দিনগুলো খুব প্রিয় ছিল নয়নের। মানে নয়নমণির আগে মানে সেই কিশোরী বেলায় যখন এমন বৃষ্টি পড়ত। উঠোনে জল হলে নৌকা ভাসাতেন নয়নমণি। কখনও নৌকাটা ডুবে গেলে খুব কষ্ট হত। কাগজের নৌকা বানানো শিখিয়েছিল সনৎ কাকু। খুব ভালো ছিল এই সনৎ কাকু কিন্তু তারপর পাগল হয়ে গেছিল। কার সঙ্গে নাকি প্রেম ছিল শেষে ওই দুঃখে না ভুল চিকিৎসায় পাগল হয়ে গেছিল সনৎ কাকু। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কী সব বিড়বিড় করে বলত। তারপর একদিন – কোথায় জানি ব্যাঙ ডাকছে ঘোৎ ঘোৎ করে। তার মানে ঢস্ ব্যাঙ। এখানে তো ব্যাঙ ডাকে না। তবে কোত্থেকে এলো বাঙটা? আসুক। নয়নমণির মনটা হঠাৎ করে ভালো হয়ে গেল। ব্যাঙটার ডাক শুনে। আগে ছোটবেলায় নয়নমণিদের পুকুরে একঝাক ব্যাঙ কুরকুর করে ডাকত। আহারে….কি মধুর সেই ডাক। আনন্দে ভরে যেত মন। বাবা বলত ব্যাঙের কোরাস। ওদের ডাকে কারওর কথাই শোনা যেত না। তবু বড় ভালো লাগত নয়নমণির। ভরা পুকুর বৃষ্টিতে আরও ভরে যেত। কলমি, হ্যালেঞ্চা লতার উপর ফরিঙ বসত। কই মাছ গুলো পুকুর থেকে উঠে এসে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে যেত। আহারে কি সেইসব দৃশ্য। মনটা একদম আনন্দে কল কল করত। কোনও কোনও দিন স্কুল থেকে আসার সময় যখন বৃষ্টি পড়ত ঝমঝমিয়ে তখন ব্যাগে বই ঢুকিয়ে ছাতা বন্ধ করে আসতেন নয়নমণিরা। তাও কখনও হাসতে হাসতে কখনও আনন্দে চেঁচাতে চেঁচাতে। যখন বৃষ্টি সঙ্গে ঝড় বাতাসও থাকত। কখনও সবাই মিলে গানও ধরতেন- আজি শ্রাবণ আকাশে ওই মম ছলছল আঁখি মেঘে মেঘে…
তখন যেন মনের ভেতরও বৃষ্টি হত, কখনও ঝমঝমিয়ে কখনও বা ঝিরঝির রিমঝিম করে। তবে হ্যাঁ, বৃষ্টিটাকে প্রাণভরে উপভোগ করতেন নয়নমণি। আকাশ ভরা বৃষ্টি। সারা বছর শান্ত হয়ে থাকা যেন খেতে পায় না উপোসি নদীটাও ওই সময় গর্বে দুকুল ছাপিয়ে ছুটত। কি সেই অপরূপ দৃশ্য। নয়নমণি ধলেশ্বরী দেখেছেন বিরি, জিরি, মধুরা, জাটিঞ্চা, মহ, লোভা বুশিয়ারা আরও কত নদী। সব নদীকেই কেন জানি নয়নমণির সখি মনে হয়। মনে হয় বড় আপন। নৌকা বাঁধা থাকলে মনে হয় যেন ওর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। উঠলেই চলতে শুরু করবে। মাঝে মাঝে স্বপ্নও দেখেন নয়নমণি। হ্যাঁ, স্বপ্নে –
শুধু নদীরাই আসে। নৌকাও থাকে। কখনও নৌকায় চড়ে বসেন নয়নমণি। নিজেই বৈঠা চালায়। জল তখন কলকল শব্দ করে। এত জল। এত জল। আহারে। চারদিকে শুধু জল আর জল হায়রে,—সেথায় তো কেউ থাকে না। থাকেন শুধু নয়নমণি। হ্যাঁ, নয়নমণি আর থইথই জল… শুধু জল আর জল। আর কিছু নেই… কিন্তু কথা হলো এই বৃষ্টি আর ওই বৃষ্টি একই বৃষ্টি। কিন্তু মানুষের জন্য এখন এই বৃষ্টিও আতঙ্ক হয়ে গেছে আজ। তাই চলে গেছে আনন্দ। নদী, জল তার গতিপথ ঠিক করে নেয় তৈরি করে জলাশয় বিল। কিন্তু সেই বিল মানুষ যদি নিজের স্বার্থে বুজিয়ে ফেলে তাহলে কোথায় যাবে জল? ইচ্ছেমতো বন ধ্বংস করবে। গাছ কাটবে। উন্নয়নের নামে পাহাড় কাটবে ধ্বস তো পড়বেই। ওই তো কে জানি মারা গেল কাল ধ্বস পড়ে। প্রকৃতি কখনও বিরূপ হয় না। এটা বিশ্বাস করেন নয়নমণি। কিন্তু মানুষ ওকে বারবার ডিসটার্ব করলে কী করবে ও? ওরও কি ভালো লাগে বলো তাণ্ডব করতে। মানুষ শুধু নিজের ধান্দায় বিপদ ডেকে আনে। সবাই না মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মুনাফার জন্য স্বার্থের জন্য সব মানুষের এই শাস্তি । নদী চর ফেলল শ্বাস ফেলার জন্য? তাতেও শান্তি আছে? হুড়মুড় করে মানুষ দখল করে বসতি করে ফেলবে। আর রাজনীতির নেতাগুলো ফায়দা লুটবে। বিল ঝিলের ও শান্তি নেই। কতভাবে যে ওকে ব্যবহার করে নোংরা করছে মানুষ। পরিযায়ী পাখিগুলোরও শান্তি নেই আজকাল। কত হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসে আহারে কলকল করে। ওদেরকেও মেরে মেরে খাবে। ধরে ধরে বিক্রি করবে। বন বিভাগও তো নাম মাত্র। এদের কোনও কাজ নেই হরিণ মেরে খাবে। শেয়াল মেরে খাবে। হরিণের মাংস বিক্রি হয়। বন বিভাগ কি জানে না? কত তক্ষক কত হুতোম প্যাঁচা বিক্রি হয়ে গেল। হারিয়ে গেল। না, – হারিয়ে গেল না ধরে ধরে মানুষ বেচে ছিল তক্ষক, প্যাঁচা সব। ছোটবেলায় মধুরা পাখি দেখেছেন নয়নমণি। আজকাল মধুরা পাখির কেউ নামই জানে না। দেখা তো দূরের কথা। সব ধরে ধরে খেয়ে ফেলল মানুষ। খেয়ে ফেলল এদিকের সব বইরুই সজারু। খরগোস কচ্ছপ, সবকিছু। সব বৃষ্টিটা ঝুপঝুপ করে পড়ছে তো পড়ছেই। ডুবে আছে পুরো শহর। নয়নমণি কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। এই মাস খানেক আগেই একবার ডুবল শহর প্রশাসনের তরফে এক বোতল জল ও পৌঁছাল না। বয়স্ক মানুষজনদের কী যে কষ্ট হল হায়রে। এই জলের মধ্যে আবার চুরিও হলো। মনটা বড় খারাপ হয়ে যায় নয়নমণির, খুব খারাপ অবস্থা সত্যি। এই যে করোনার সময় লকডাউন হলো। চারদিকে কারফিউ আর কারফিউর মধ্যেই পাশের বাড়ির নতুন বউয়ের সব সোনার গহনা চুরি করে নিয়ে গেল চোর। এ দায় কার? প্রশাসনের নয় কি? অনেক ছুটোছুটি করল ওরা এস.পি অব্দি গেল। পুলিশ কিছুই করল না। সবাই বলল পুলিশ চোর মিলেই হয়ত করেছে। না হলে পুলিশ কিছুই করল না কেন? জানালা দিয়ে বৃষ্টি ঢুকছে ঘরে। নয়নমণি তবু জানালাটা বন্ধ করেন না। আসুক বৃষ্টি। আসুক। ভিজুক কিছু। ভিজুক। কিছু কেন সবকিছুই ভিজুক। এই যে করোনাকালে মানুষের কত যে কষ্ট হলো। আহারে রোগে না যত লকডাউনে তত। মানুষের কাজকাম নেই তখন খাবে কি? চা বাগানের মানুষ কাঁঠাল সেদ্ধ, কচু শাক সেদ্ধ খেল। পরিযায়ী শ্রমিকরা পথ হাঁটল মাইলের পর মাইল। খিদে তৃষ্ণায় কতজন মরে গেল। আহারে রোগ হলে কেউ কাছে যেত না। কতজনের আসল চেহারা এই করোনা কালে দেখলেন নয়নমণি। বাড়ির লোকে মরলে ছুঁলো না। অন্য লোকে করল দাহ।। আজ নেগেটিভ রিপোর্ট এলে কাল এলো পজিটিভ। আরও কত কিছু দেখলেন একটা ছোট্ট বীমাহ মানুষের, সমাজের, রাষ্ট্রের চেহারাটা প্রকট করেছিল। যাকগে, নয়নমণি আবার আকাশের দিকে তাকালেন। এ বৃষ্টি বোধহয় সপ্তাহ ধরে চলবে। কী হবে এই শহরের? মানুষের? এমনিতেই পুরো দেশ থেকে এ উপত্যকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। রেললাইনে। ধ্বস পড়েছে। সড়কপথে ধ্বস। প্রায় প্রতিটি রাস্তায় বুক জল। কোথাও কোথাও ঠাঁইও নেই। রাতে চোর ডাকাত ঘোরে। চারদিকে শুধু জলস্রোত। কত মানুষ ভেসে গেল। মরেও গেল। কী যে কষ্ট মানুষের। আহারে। দোকানপাট বন্ধ। যে ও একদুটো খোলা আছে। তাতে ভীষণ দাম। ভীষণ। টিভি আজকাল দেখেন না নয়নমণি। খবরের কাগজ ও কেন জানি আজকাল পড়তে ভালো লাগে না। (এখন যদিও কাগজ বের হচ্ছে না।) অথচ একসময় তিনটে খবরের কাগজ পড়তেন নয়নমণি। কিন্তু মানুষকে পড়তে ভালোবাসেন নয়নমণি। পড়তে ভালোবাসেন এই সময়টাকেও। হ্যাঁ, – ,মন দিয়ে পড়তে চেষ্টা করেন। জীবনের যোগ বিয়োগগুলোকে মেলান। কখনও মেলে। কখনও মেলে না। তাতে কি? জীবনভোর তো স্বপ্নই দেখে গেলেন। কত রকম স্বপ্ন আহারে। পৃথিবী বদলানোর স্বপ্নও। কতকিছু যে লালন করলেন। ধারণ করলেন। এ কি সেই বাগানের উপড়ে তোলা লক্ষ লক্ষ চা গাছেরা কাঁদতে কাঁদতে না আর্তনাদ করতে করতে আসছে। আসছে হাজার হাজার শিরিষ, মোহর ছায়া গাছেরাও। দুচোখ জলে ভরে এলো নয়নমণির, অনেকক্ষণ কাঁদলেন নয়নমণি । অনেকদূরে মাটিছড়া বাগানের বাসন্তী যেন গাইছে—
টুসু পরবে আইলি নাই কেনে তোর লাগি পিঠা বানায়ছিলি ….
কি পিঠা বানিয়েছিলি বাসন্তী? হ্যাঁ, – বিরুনচালের শুকনো গুড়ি দিয়ে নারকেলের পুর – ভরে পিঠা বানাত বাসন্তী। করমের সময় মাদল বাজাত সুমন্ত। বাবুর বেটি নয়নমণি তখনতো সত্যিই সকলের নয়নের মণি। বৃষ্টিটা এখন যেন আরও ঝেপে এলো। পুরো উঠোন রাস্তা জুড়ে এখন প্লাবন। নয়নমণি দেখেন স্বপ্নে দেখা নৌকাটা দাঁড়িয়ে আছে। আহারে কি সুন্দর কাঠের নৌকাটা। বৈঠাও আছে কি সুন্দর কারুকাজ করা। কিন্তু মাঝি নেই। নয়নমণি আস্তে আস্তে সেই নৌকার উপর উঠে বসলেন। চারদিকে আহারে বড় মায়াময় বৃষ্টি। সেই মায়াময় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নয়নমণি এখন সেই মায়া নৌকায় বসে ভেসে যেতে লাগলেন।
‘কারুকথা এইসময়’ পত্রিকায় পূর্বপ্রকাশিত। বানানবিধি অপরিবর্তিত।
ঝুমুর পান্ডের জন্ম অসমের হাইলাকান্দি জেলার কাঠলিছড়া চা বাগানে এক প্রগতিশীল সংস্কৃতিমনস্ক বামপন্থী পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই তাঁর সৃষ্টিশীল লেখালিখির শুরু এবং তখন থেকেই বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর আখ্যান গুলো। মূলত চা বাগান ও খেটে খাওয়া নিম্নবর্গের প্রান্তিক মানুষজনদের নিয়েই তাঁর লেখালিখি। সাহিত্যের সব ক্ষেত্রেই তার অবাধ বিচরণ। তামিল, তেলেগু, ওড়িয়া, মারাঠি, ইংরেজি, হিন্দি, অসমীয়া, মনিপুরী, সাদরি ইত্যাদি ভাষায় তাঁর লেখা অনুবাদ হয়েছে। সাহিত্যের জন্য পেয়েছেন বেশ কয়েকটি পুরস্কার এবং সম্মান।