লন্ডনের হাইগেট কবরস্থানে সন্ধে নেমেছে সবে। দরজা বন্ধ হয়েছে এ দিনের মতো। হালকা হাওয়ায় জীবিত মানুষের ভারী ও তাজা ঘ্রাণ,মৃতদের কাছে যা উপভোগ্য। সোয়েইন্স লেনের এই গোরস্থানের বয়স ১৮২ বছর। ৩৭ একর জমিতে ছড়ানো,হাজারও গাছের ভূমি। পূর্ব ও পশ্চিম– দু‘-ভাগ। ১ লক্ষ ৭০ হাজার জন রেস্ট ইন পিস। এঁদের বেশির ভাগই নামীদামি। নিজের গাড়িতে এলে পার্কিংয়ের সমস্যা,তাই গণপরিবহণে আসার অনুরোধ সেমেটারি-কর্তৃপক্ষের। আসতে পারেন সাইকেলে বা হেঁটে। ঢোকার জন্য টিকিট কাটতে হয় ইন্টারনেটে।

পূর্ব হাইগেটের কবরে এই সায়ংকালে ঘুরে শুলেন কার্ল মার্ক্স। না,মার্ক্স এখন আর চোখ খুলতে পারেন না। খুললেও তো কফিনের অন্ধকার দর্শন! পাশের কফিনে শুয়ে জেনি। প্রিয়তমা স্ত্রী। যাঁকে এতটুকুও সুখ দিতে পারেননি সারা জীবন, সেই হাহুতাশ এখনও। বিয়ের পর থেকে জেনির দুঃখ-যন্ত্রণার শুরু। অভিমানের বড় বড় গাছ জন্ম নেয় ক্রমে। এই কবরস্থানের গাছেদের ভিড় তারই প্রতীক যেন!

Karl Marx and his wife Jenny
স্ত্রী জেনির সঙ্গে কার্ল মার্ক্স

প্রেম কিন্তু কার্ল মার্ক্সের জীবনে একটা সময়ে পৌঁছে ত্রিকোণ হয়ে উঠল। এক বিন্দুতে স্ত্রী,আর একটিতে বাড়ির পরিচারিকা হেলেন ডেমুথ। ডেমুথও এই কার্ল মার্ক্স স্মৃতিসৌধ কবরে শুয়ে। মার্বেলের গ্রেভস্টোনের উপর ব্রোঞ্জের দৈত্যাকার মার্ক্সের মস্তক। মার্ক্স-জেনি-ডেমুথ ছাড়াও এখানে চিরনিদ্রায় কার্লের ছোট মেয়ে ৪৩ বছর বয়সে বিষ খেয়ে আত্মঘাতী এলিয়ানোর। বড় মেয়ে জেনিচেন লঙ্গুয়েটের শিশুপুত্র হ্যারি। হ্যারির মৃত্যু হয় চার বছর আট মাসে,ক্যানসারে। গোড়ায় অবশ্য মার্ক্স সপরিবার কবরস্থানের এইখানে কবরস্থ ছিলেন না। ১৯৫৪ সালে গ্রেট ব্রিটেন কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে পুরনো কবর থেকে কফিনগুলি তুলে কিছুটা সরিয়ে এনে এই নতুন ব্যবস্থা। মেমোরিয়ালটির নক্সা করেন ভাস্কর ও ব্রিটেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য লরেন্স ব্র্যাডশ। 

আসুন,মার্ক্সের বিবাহ বাসর থেকে কাহিনিটা শুরু করি। 

দিনটা ১৮৪৩ সালের ১৯ জুন। সকাল ১০টা নাগাদ একটি দাপুটে প্রেম তীরবর্তী। সাতপাকে বাঁধা পড়ছেন কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স এবং ফ্রাউলিন জোহানা বার্থা জুলিয়া জেনি ভন ভেস্টফালেন। মার্ক্স, বেকার, বয়স ২৫। সবুজ সিল্কের গাউন, ওড়না, গোলাপি টুপিতে জেনি–  বয়স ২৯।  যে শহরে তাঁদের স্থায়ী ঠিকানা, সেই ট্রিয়ের থেকে ৫০ মাইল দূরের ক্রোয়েটসনাখের রিসর্টে বিয়েটা হচ্ছে। বাড়িতে হাওয়াবদলের কথা বলে জেনিকে এখানে নিয়ে এসেছেন তাঁর মা ক্যারোলিনা হুবেল। 

বুড়ো নিক (মার্ক্সের ডাকনাম), সেই দিন তোমার মুখটা…। উফঃ, কী টেনশনে ছিলে! আদৌ বিয়েটা হচ্ছে তো, শেষ পর্যন্ত ধন্দটা তোমার কাটেনি! বলে উঠলেন কফিনের জেনি ভন ভেস্টফালেন। 

কী সুন্দর দেখাচ্ছিল তোমায়, মনে হচ্ছিল যেন একটা ট্রফি জিতে নিলাম। বার বার গায়ে চিমটি কেটে দেখছিলামও– সত্যি সত্যি বিয়েটা হচ্ছে তো!

হা হা হা… জেনির হাসিতে মনে হল কবরটা ফেটে যাবে… এনগেজমেন্টের প্রায় সাত বছর পর– অনেক বাধা অনেক বিপত্তি পেরিয়ে, তোমার চিন্তা হওয়াটা তো স্বাভাবিকই ছিল বুড়ো নিক–  

তোমার সৎ দাদার কথাটা মনে আছে, যার হাত থেকে বাঁচতে তোমার মা ক্রোয়েটসনাখে নিয়ে এলেন তোমাকে!

ফার্দিনান্দ… ফার্দিনান্দ… মনে থাকবে না আবার… নাজেহাল করে তুলেছিল জীবন… সব সময় স্পাইং… তুমি ছিলে ওর দু’চক্ষের বিষ। তোমার সব খুঁটিনাটি খবর ও রাখত। বাবাকে তোমার বিরুদ্ধে কম লাগিয়েছে। কিন্তু বাবা তোমাকে সত্যি সত্যিই ভালবাসতেন কার্ল, তাই ওই লাগানো-ভাঙানোয় কাজ হয়নি। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর ফার্দিনান্দ যে বাড়ির কর্তা হয়ে গেল। আমাদের এনগেজমেন্টটা ভাঙার জন্য একেবারে আদাজল খেয়ে নামল… উফ সে এক কাহিনি বটে!

আপত্তি করাটাই স্বাভাবিক ছিল জেনি। কোথায় তুমি, আর কোথায় আমি… তুমি ছিলে ট্রিয়েরের সবচেয়ে সুন্দরী। আর আমার চেহারা ভাল্লুকের মতো। পকেট ফাঁকা। হ্যাঁ, ডক্টরেট ডিগ্রি একটা ছিল পকেটে, রাইনল্যান্ড গেজেটে চাকরিও পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই পত্রিকা তো বন্ধ… কে আর মেনে নেবে বলো আমার সঙ্গে তোমার বিয়েটা

রাইনল্যান্ড গেজেট… তোমার প্রথম প্রবন্ধ…

হ্যাঁ, জেনি, রাইনল্যান্ড গেজেট নিয়ে সত্যিকারের একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা। প্রধান সম্পাদকও হলাম। ভাবলাম একটা হিল্লে হল বুঝি, আমাদের সম্পর্কটা এবার পরিণতি পাবে! আর প্রবন্ধ? এখনও মনে আছে, ১৮৪২ সালের ৫ মে, আমার ২৪ বছরের জন্মদিনে প্রথম প্রবন্ধটা ছাপা হয়েছিল ওই পত্রিকায়। আমার নাম ছিল না লেখক হিসেবে। কিন্তু বন্ধুমহলের সকলে জানত লেখক আমিই। তোমার নিশ্চয় মনে আছে কী ভাবে প্রশংসার জোয়ার এসেছিল, এখনও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়! 

Karl Marx Fredrich Engels and Marx's daughters
পারিবারিক বন্ধু ফ্রেডরিক এঙ্গেলস এবং তিন কন্যার সঙ্গে মার্ক্স

তুমি যে দিন কাগজের সম্পাদক হলে, তারিখটা মনে আছে এখনও, ১৩ অক্টোবর, তার পর দিন তোমার ভাই হার্মান মারা গেল, মাত্র  ২৩ বছর বয়সে! তুমি তখন ব্যস্ততায় ভেসে যাচ্ছিলে স্টিম ইঞ্জিন (এই নামেও মার্ক্সকে ডাকা হত), হার্মানের অন্ত্যেষ্টিতে যাওনি… নিজের ভাইকে শেষ দেখাটা তোমার হয়নি।   

না, সে জন্য কোনও অপরাধ বোধ আমার নেই। গিয়ে কি করতাম বলো? চোখের জলের শরিক হওয়ার চেয়ে দরকারি মনে হয়েছিল পত্রিকার কাজকর্ম।  

তুমি তো তোমার বাবার মৃত্যুর সময়ও ছিলে না! 

হ্যাঁ, ছিলাম না। ছিলাম না। ছিলাম না।… (মুহূর্তের নিস্তব্ধতা) কিন্তু আমি তো ১৮৩৮-এর মে মাসের সাত তারিখ পর্যন্ত ট্রিয়েরেই ছিলাম। ২০ বছরের জন্মদিনটা কাটল সেখানে ভালই। তবে বাবা খুব অসুস্থ ছিলেন, যক্ষ্মাটা চারিয়ে গিয়েছিল… মনে হচ্ছিল জানো বেঁচে যাবেন। বার্লিনে ফিরে এলাম যখন, ফিরে আসাটাই হয়তো হটকারিতা ছিল, বাবার মৃত্যুসংবাদ পেলাম। টাকাপয়সার খুবই অভাব সেই সময়টায়, তা ছাড়া বাড়ি যেতে তো পাঁচ দিন সময় লাগবে, তাই…। এই তো, এই কবরে আমার বুকের উপর তোমার আর মেয়ের ছবি যেমন, তেমনই রাখা আছে বাবার সেই ছবিটাও। মৃত্যুর সময়ে বুকপকেটে ছিল এটা। এঙ্গেলস বার করেছিল।  

ছাড়ো ও সব, মৃত্যু আর ভাল লাগে না, এত দিন তো মৃত্যুতেই আছি… চলো আমরা কবিতার কথা বলি স্টিম ইঞ্জিন– তুমি ভাল কবিতা লিখতে, আমার জন্য লিখতে, প্রেম আর বিচ্ছেদে ভরা সে সব কবিতা, সেই কথা বলো…

আহ কবিতা… আমার ব্যর্থ প্রয়াস… কবিতা তো নয়, তোমায় পাওয়া, দূরের তুমি কবিতায় কাছে এসে যেতে জেনি, মিলিত হতে আমার সঙ্গে।… কত কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে। বার্লিনে পড়তে যাওয়ার আগে দারুণ ঝুঁকি নিলাম আমরা দুজন। এনগেজমেন্টটা করে ফেললাম। আমার ফ্যামিলিতে জানত, কিন্তু তোমার পরিবার…  তোমার বাবা  ব্যারন লুডভিগ ভেস্টফালেন। প্রিয় লুডভিগ… ট্রিয়েরের সরকারি কাউন্সিলর, বাবার বন্ধুও, আমার পরম সুহৃদ। আমাকে খুব ভালবাসতেন । নিজের সন্তানের চেয়ে যা কিছুমাত্র কম ছিল না… মার্ক্স থামলেন, অনেক দূর… অতীতে চলে গিয়েছেন তিনি। দেখতে পাচ্ছিলেন ব্যারনের বাড়িতে সবাই মিলে সেই হইচই-হুল্লোড়। জেনির ভাই এডগার আর তিনি এক স্কুলে পড়তেন, স্কুলের নাম– ফ্রেডরিক উইলহেম জিমনাশিয়াম। কত দিন স্কুল থেকে সোজা  এডগারের সঙ্গে চলে গিয়েছেন জেনিদের বাড়ি। ওখানে ছিল বিশাল লাইব্রেরি। ব্যারনই ছিলেন তাঁর সাহিত্যের দীক্ষাগুরু। চলত হোমার, শেক্সপিয়র, ভলতেয়ার, রুশো পড়া। তাঁরা দুজনে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেন কখনও, সাহিত্য-দর্শন চর্চায় বিভোর হয়ে। কিন্তু সেই মানুষটাকেও এনগেজমেন্টের খবরটা জানাতে দ্বিধার থরথর চূড়ায় উঠতে হল। যদি ওই খবরে মনোরম সম্পর্কটা চুরমার হয়ে যায়! তা ছাড়া ছিল এক ধর্মসঙ্কট! মার্ক্সরা তো আগে ইহুদি ছিলেন, তাঁর জন্মের আগের বছর, ১৮১৭ সালে, তাঁর বাবা হেশেল মার্ক্স ধর্ম বদল করে খ্রিস্টান হলেন, নাম নিলেন হাইনরিশ। আসলে, নেপোলিয়নের ঐতিহাসিক পরাজয়ের পর প্রুশিয়ার সরকার আইন-ব্যবসায় ইহুদিদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ইহুদি আইনজীবী হেশেল অথৈ আর্থিক সাগরে পড়েছিলেন তাতে, পেট বাঁচাতে তখন তাঁকে ধর্ম বদল করতে হল! ধর্মান্তরণে খ্রিস্টান হওয়া কোনও পরিবারের সঙ্গে প্রুশিয়ার কোনও রাজ-আমাত্য বন্ধুত্ব করতে পারেন, কিন্তু বৈবাহিক সম্পর্ক, এক কথায় অসম্ভবের পরের কথা, তাই ওই আকাশছোঁয়া দ্বিধা হাজির হয়েছিল এসে। যদিও পরে যখন এনগেজমেন্টের খবরটা জেনেছিলেন ব্যারন, মেনে নিয়েছিলেন সস্নেহে। কিন্তু তিনি বিয়েটা দেখে যেতে পারেননি। লুডভিগের মৃত্যুর পরের বছর জেনি-মার্ক্সের বিয়ে হয়। 

কী ভাবছ মার্ক্স? কবিতা বলবে না?

হ্যাঁ, কবিতা… কবিতা… এখনও মনে আছে এনগেজমেন্টের পর উত্তেজনায় ভাসতে ভাসতে ১৮৩৬-এর অক্টোবরের এক দিন পৌঁছলাম বার্লিন। পথ পাঁচ দিনের। উথালপাথাল মন। জীবনটাই যেন ঝটকায় পাল্টে গিয়েছিল। একদিকে তোমার পাগল-পাগল টান, অন্য দিকে কিছু একটা করে দেখানোর অপ্রতিরোধ্য বাসনা। দুকূলপ্লাবী সাহিত্যও এসে হাজির। বাবার ইচ্ছায় আইন নিয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম বটে, কিন্তু গোগ্রাসে গিলছিলাম কবিতা, উপন্যাস, গল্প। কবিতা লিখছিলামও। আমার কবিতা দেখে বাবা তো ভয় পেয়ে গেলেন। টিপিকাল মধ্যবিত্ত আরকি! বললেন, কী যে লিখছ কার্ল, কিচ্ছু বুঝতে পারি না… সে এক মজার ব্যাপার, হা হা হা… 

তোমার হাসি… সেই হাসি– মাস্টার, উফঃ… বুক কেঁপে ওঠে… কিন্তু কবিতা, কবিতা বলবে না…

এনগেজমেন্টের পর-পরই বার্লিন চলে যাওয়া… জানি না কতটা ঠিক হয়েছিল, প্রেমটা তখন ভিতর থেকে পাগলের মতো বেরতে চাইছিল। আমার তখন ১৮ বছর, আর তোমার বাইশ, ফলে বয়সের ধর্মেই সব হচ্ছিল। হু-হু করে কবিতার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল।   

রাইনল্যান্ড গেজেট নিয়ে সত্যিকারের একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা। প্রধান সম্পাদকও হলাম। ভাবলাম একটা হিল্লে হল বুঝি, আমাদের সম্পর্কটা এবার পরিণতি পাবে! আর প্রবন্ধ? এখনও মনে আছে, ১৮৪২ সালের ৫ মে, আমার ২৪ বছরের জন্মদিনে প্রথম প্রবন্ধটা ছাপা হয়েছিল ওই পত্রিকায়। আমার নাম ছিল না লেখক হিসেবে। কিন্তু বন্ধুমহলের সকলে জানত লেখক আমিই। তোমার নিশ্চয় মনে আছে কী ভাবে প্রশংসার জোয়ার এসেছিল, এখনও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়! 

নাহ, জেনি কবিতাগুলো কিন্তু কিস্যু হয়নি, শুধু আমাদের প্রেমের স্মারক হিসেবে সেগুলির যা মূল্য! সারা জীবন আমি কবিতা প্রকাশ করিনি। মৃত্যুর পর শুনেছি সেগুলি বই হয়ে বেরিয়েছে। একান্ত ব্যক্তিগত পবিত্র ব্যাপার, হাটের মাঝে তা আনা হয়েছে, আমি খুশি হইনি জেনি, খুশি হইনি… 

তিনটি কাব্যগ্রন্থ কার্ল মার্ক্সের। প্রেমের বই, পর্ব-এক ও পর্ব-দুই এবং তৃতীয়টি– গানের বই। প্রতিটাই উৎসর্গ করা জেনিকে। আমার প্রিয়তমা, চির ভালবাসার জেনি ভন ভেস্টফালেনকে… উৎসর্গপত্রে লেখা। তবে মার্ক্সের বাবাকে উৎসর্গ কবিতাও আছে বইতে। প্রেমের বই‘-এর ১২টির মধ্যে চারটি কবিতা বাবাকে উৎসর্গ করা, যা  যোগ করা হয়েছিল পরে। গানের বইতে ৫৩টি কবিতার মধ্যে বাবার জন্য চারটি। 

না, আর কোনও কথা শুনব না, কবিতা এবার বলতেই হবে স্টিম ইঞ্জিন, বলতেই হবে–

হা হা হা হা… অক্ষম প্রচেষ্টা আমার… হা হা হা… (হঠাৎ চুপ করে গিয়ে)… দেখো, আমি লিখতে পারি সহস্র বই কাব্যের,/ প্রত্যেক পংক্তিই তার হয়েছে রচিত জেনি শব্দে–, / বলবে গোপন কথা–  এ মহাপৃথিবীর,/ বদল নেই, সে অসীম… সে মুক্তির / মধুর কবিতা– আলতো– আকুলতা তার/ প্রভাময় আকাশে ফুটে ওঠা আলোর বাহার,/ ব্যথা-ঝরানো সে দুঃখ, পবিত্র বড় সুখ/ আমার সমস্ত জীবন, জ্ঞানের ঝিনুক,’…  

বাহ, মন্দ লাগল না কিন্তু!

হাস্যকর জেনি, হাস্যকর…

আচ্ছা, স্টিম ইঞ্জিন, তোমার লেফটেন্যান্ট কার্ল ভন পেনেউইজের কথা মনে আছে

থাকবে না আবার? তোমার অসংখ্য প্রেমিকের মধ্যে সে ছিল একজন। হাজারও পুরুষের প্রেমপ্রস্তাব, বিবাহপ্রস্তাব তুমি নস্যাৎ করেছিলে, কিন্তু এপ্রিলের এক সন্ধ্যায় তুমি যেন নিজেকে হারিয়ে ফেললে। এক পার্টিতে তুমি পেনেউইজের সঙ্গে বলড্যান্সে মত্ত হলে। তার পর তাঁর বিয়ের প্রস্তাবে সম্মতি জানালে। অনেকেই অবাক হয়ে গিয়েছিল সেই হঠাৎ-সম্মতিতে। কয়েক মাসের মধ্যেই কিন্তু তুমি উল্টো সুরে। এনগেজমেন্ট চুরমার করে দিলে। সবাই ছ্যা-ছ্যা করেছিল মনে আছে।  

আমার জন্য তো একটাও কবিতা লেখোনি মার্ক্স? বাড়ির কাজের লোক আমি, কেনই বা লিখবে তাই না? একটা অভিমান-মেশা গলা। এই গলা কার? এ কণ্ঠস্বর হেলেন ডেমুথের। হ্যাঁ, তিনি কাজের লোকই বটে! গৃহপরিচারিকা। পাশের কফিনেই শুয়ে। মার্ক্স এই কণ্ঠস্বরে, এই শ্লেষে কী বলবেন…

আসুন, হেলেন ডেমুথকে একটু চিনে নিই।

হেলেন ডেমুথ। ডাকনাম লেনচেন। হিসেব মতো মার্ক্সদের পরিচারিকা। কিন্তু লেনচেন তার চেয়ে অনেক বেশি, অনেক বেশি কিছু। জেনির থেকে ছবছরের ছোট। লেনচেন ট্রিয়েরের একটি গ্রামের মেয়ে। বাবা কেক-রুটি বানাতেন। সাত সন্তানের একজন ডেমুথ। বয়স যখন এগারো, ভেস্টফালেনদের পরিবারে গৃহপরিচারিকার কাজে এলেন হেলেন। পরিবারের একজন হওয়ার ক্ষমতা তাঁর ছিল। জেনি-এডগারদের সঙ্গেই বড় হয়ে গেলেন। জেনি ও ডেমুথ যেন দুবোন। ১৮৪৩-এর জুনে জেনির বিয়ে হল। পরের বছর ১ জুন তাঁদের প্রথম সন্তানের জন্ম। মায়ের নামে নাম জেনি, আলাদা করার জন্য বলা হত জেনিচেন। সে সময়ে মার্ক্সরা প্যারিসে। তার পর, ১৮৪৫ সাল, মার্ক্স-জেনি ব্রাসেলসে, জেনি আবার অন্তঃসত্ত্বা, এমনিতে জেনিচেনকে নিয়ে তখন হিমসিম খাচ্ছিলেন জেনি-মার্ক্স, তার উপর আর একটি বাচ্চা আসছে, চরম চিন্তায় এপ্রিল মাসে জেনির মা ২৫ বছরের লেনচেনকে পাঠিয়ে দিলেন মেয়ের কাছে। লেনচেন শব্দের অর্থ উজ্জ্বল, সুন্দরী। নামকরণটা ছিল সার্থক। সোনালি চুল তাঁর, নীল চোখ।

helen demuth
মার্ক্স পরিবারের পরিচারিকা হেলেন ডেমুথ

বড়লোকের বাড়ির পরিচারিকা, ফলে আভিজাত্য-চোঁয়ানো শরীর। মার্ক্স পরিবারের ঝঞ্ঝাট অনেকটাই লেনচেন-ম্যাজিকে উধাও হয়ে গেল তার পর। পরিবারটিকে ছাড়লেনও না হেলেন সারা জীবন, এমনকি বহু বিয়ের সম্বন্ধ এলেও, তিনি নাকি গ্রিন সিগনাল দেননি। মার্ক্সকেই তিনি স্বামীর আসনে বসিয়ে ছিলেন নাকি? প্রশ্নের উত্তর নেই। কিন্তু লেনচেন এর পর একটি সন্তানের জন্ম দিলেন, সেই সন্তানের পিতা কে? কার্ল মার্ক্স কি?

মার্ক্স তোমার মনে আছে সেই দিনের কথাটা… জেনি তখন হল্যান্ডে…

নাহ, ও সব আর মনে করতে চাই না লেনচেন…

কেন স্টিম ইঞ্জিন, তোমার সঙ্গে লেনচেনের সম্পর্কটা তো জগৎ জেনে গিয়েছে, লুকোনোর কিছু নেই… আমি কষ্ট পাই না আর… জেনি বলে উঠলেন।

থাক ও কথা, আমরা তো অনেক দিন আগেই ঠিক করেছিলাম ওই প্রসঙ্গ আর তুলব না, তা হলে?

লেনচেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আচ্ছা থাক তা হলে… থাক…

মার্ক্স বলতে না চাইলেও, আমাদের বলতে হবে সেই কথাটা। জানা-অজানা গলিতে হাঁটতে হবে আজ। একটু পিছন থেকে শুরু করা যাক তা হলে। ১৮৪৯ সালের জুন। কোলন থেকে ঘাড় ধাক্কা খেয়ে লন্ডনে চলে এসেছেন সপরিবার কার্ল মার্ক্স। জেনি আবারও অন্তঃসত্ত্বা তখন। বয়স তাঁর ৩১। মার্ক্স তখন কার্যত কুখ্যাত। লেনচেন পরিবারের ভরসা। পারিবারিক অর্থনীতির হাল চোখে দেখার মতো নয়। থাকার জায়গা পেতে নাকানিচোবানি খেলেন লন্ডনে। জেনির মা এসে অর্থ জোগালেন, এবং সোহোর ৬৪ নম্বর ডিন স্ট্রিটে দুই কামরার বাসা মিলল। অনেক সাধ্যসাধনার পর ব্রিটিশ মিউজিয়ামের রিডিং রুমে পড়াশোনার ছাড়পত্রও পেলেন। কিন্তু ধারকর্যে তখন জর্জরিত কার্ল, তাগাদা আসছে লাগাতার। সুন্দর আগামীর স্বপ্নে তখনও বিভোর হয়ে থাকা জেনি মাঠে নামলেন। হল্যান্ডের জাল্টবোমেলে কার্ল মার্ক্সের কাকা লায়ন ফিলিপসের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলেন জাহাজে চেপে। আশা ছিল কাকা কিছু অর্থ জোগাবেন। ১৫ ঘণ্টার কষ্টকর জার্নির পর পৌঁছলেন ফিলিপসের বাড়ি। অর্থলাভের চেষ্টায় জেনি নাছোড়বান্দা। কিন্তু ফিলিপসের আলো জ্বলছে না তার ঘরে। তার উপর জেনির সম্মান নিয়ে হতে থাকল গেন্ডুয়া খেলা। আর ও দিকে, ডিন স্ট্রিটের বাড়িতে তখন মার্ক্স-লেনচেনের রসায়ন মাহাকাশে উড্ডিন।

দুটো শরীর মিলে গিয়েছিল তখনই, দাবি করেন অনেকে। এর ফলে জেনি এবং হেলেনা ডেমুথ দুজনেই ১৮৫১ সালে তিন মাসের ব্যবধানে সন্তানের জন্ম দিলেন। জেনির-টি মেয়ে, নাম আবারও তাঁরই নামে, জেনি ইভলিন। হেলেনার ছেলে– হেনরি ফ্রেডরিক। ডাকনাম ফ্রেডি। যাঁর জন্মের ছসপ্তাহ পর, অগস্টের এক তারিখ, নাম রেজিস্ট্রেশন করালেন লেনচেন। তবে ফ্রেডির বাবার নামের জায়গাটা রয়ে গেল ফাঁকা। 

frederick demuth

এর পর কী হল? মার্ক্সের মুখ বাঁচাতে পূর্ব লন্ডনে অতি দরিদ্র এবং দুর্বিত্তবহুল এলাকায়  লেভি নামে একজনের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সদ্যোজাত ফ্রেডিকে। সেখানেই তিনি বড় হতে থাকেন। সে জন্য প্রয়োজনীয় টাকাপয়সা নাকি জুগিয়েছিলেন এঙ্গেলস। লেনচেন ডিন স্ট্রিটেই থেকে যান। জেনির সঙ্গে এক আশ্চর্য বোঝাপড়ায় এগিয়ে চলতে থাকে জীবন। শোনা যায়, পরিবারের মধ্যে ফ্রেডিকে বলা হত এঙ্গেলসের ছেলে। তবে এ ব্যাপারে মার্ক্সসের দ্বিতীয় কন্যা জেনি লরা মার্ক্স (যাঁর স্বামী লেখক-সাংবাদিক-সমাজতন্ত্রী পল লাফার্গ, এবং যে দম্পতি একসঙ্গে বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হন, তখন লাফার্গের বয়স ৬৯, লরা ৬৬) এবং চতুর্থ কন্যা তথা ছোট মেয়ে এলিয়ানোর ওরফে টুসির (বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হন ৪৩ বছর বয়সে) মতপার্থক্য ছিল বলেও জানা যায়। টুসির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে ফ্রেডি এঙ্গেলসেরই ছেলে, লরা নাকি ভাবতেন না তেমনটা। কিন্তু ফ্রেডির চেহারাটা যে অবিকল কার্ল মার্ক্স! সেই চওড়া কপাল, সেই ভ্রুভঙ্গি, সেই নাক এমনকি চাউনিতেও মার্ক্সের সঙ্গে আশ্চর্য মিল তাঁর। ফ্রেডি থাকতেন লন্ডনেই, ছিল স্ত্রী এবং একটি ছেলে, শ্রমিকের জীবন ছিল তাঁর, পেশায় মেশিনম্যান। মার্ক্সবাদী, সমাজতান্ত্রিকও।

মৃত্যুর তিন দিন পর, ১৮৮৩-র ১৭ মার্চ কার্ল মার্ক্সের দেহ হাইগেট কবরস্থানে জেনির পাশে কবরস্থ করা হয়। সে দিন হাজির ছিলেন ১১ জন। মৃত্যুর সময় মার্ক্সের বুকপকেটে তাঁর বাবা এবং স্ত্রী ও কন্যা জেনিচেনের ফোটোগ্রাফ ছিল, যেগুলি পেয়েছিলেন এঙ্গেলস। ছবি তিনটি কফিনে দিয়ে দেওয়া হয়। এঙ্গেলস লেনচেনকে নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়িতে। তার আগে অবশ্য হেলেন সেই ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলেন, যে কাজে সঙ্গী ছিলেন লরাও। তাঁরা কার্ল মার্ক্সের লেখাপত্তর ঘেঁটে বার করেন ৫০০ পাতার একটি ম্যানুস্ক্রিপ্ট, ক্যাপিটাল-এর দ্বিতীয় খণ্ড। এঙ্গেলসের বাড়িতে লেনচেন আসার পর দুজনে একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠেন। এঙ্গেলসের জীবনসঙ্গিনী লিজি বার্নস তখন (বিয়ে করেননি তাঁরা) সাড়ে চার বছর হল প্রয়াত। দুজনের শূন্যতা নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছিল। এঙ্গেলসের বাড়িতে মা হেলেনের সঙ্গে দেখা করতে ফ্রেডি প্রতি সপ্তাহে যেতেন। সন্ধ্যায় ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের সঙ্গে ফ্রেডরিক ডেমুথের কথাবার্তা চলত, মূলত যা মার্ক্স সম্পর্কিত। এর পর ক্রমে লেনচেন অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৮৯০-এর অক্টোবর থেকে তা চরমে পৌঁছল। সম্ভবত সেপ্টিসেমিয়ায় ভুগছিলেন। ১৮৯০ সালের ৪ নভেম্বর হেলেন ডেমুথের মৃত্যু হল। হাইগেট কবরস্থানে ৭ নভেম্বর তাঁকে মার্ক্সযুগলের পাশেই কবরস্থ করা হয়। এমনটাই নাকি চেয়েছিলেন স্বয়ং জেনি! 

লেনচেন মারা যাওয়ার পরেও এঙ্গেলসের বাড়িতে আসতেন ফ্রেডি, মাঝেমধ্যেই। কিন্তু তাতে বিরক্ত হতে শুরু করেছিলেন মার্ক্সের বন্ধু। টুসি এই বিরক্তি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশও করেছেন। ফ্রেডির মুখোমুখি হলে এঙ্গেলস অপরাধ বোধে ভুগতেন, তা থেকেই বিরক্তির এই বাড়াবাড়ি। লরাকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন এ কথা। তাঁর ভাষায়, আমরা মোটেই জীবন্ত অতীতের মুখোমুখি হতে চাই না! নাহ…  

শোনো মার্ক্স, আমি হয়তো তোমাদের কাজের লোক হিসেবেই থেকে গিয়েছি। এমনকি মৃত্যুর পর তোমার পাশে শুয়েও! ফ্রেডি তাঁর বাবাকে পায়নি। কে ওর বাবা, তুমি না এঙ্গেলস, তা নিয়ে একটা ধন্দ ওকে ঘিরে তর্পে গিয়েছে। আর্থিক ভাবেও ও বঞ্চিত। তোমাদের সব সাম্যবাদ আমাদের দরজায় এসে থেমে গিয়েছিল মার্ক্স। তোমাকে আমি ভালবেসেছিলাম, এঙ্গেলসকে আমি বন্ধু করেছিলাম। কিন্তু প্রতিদানে তোমরা দিয়েছিলে উদাসীনতা, উদাসীনতা আর উদাসীনতা…। আমার মৃত্যুর পর এঙ্গেলস বলেছিল অনেক কিছু। বলেছিল– বিশ্বাসভাজন লেনচেন। আচ্ছা বন্ধুকে কেউ এই ভাবে বলে নাকি! বিশ্বাসভাজন শব্দটা তো চাকরের সম্পর্কে বলা হয়, তাই না!

হেলেন ডেমুথের আগুন-কথায় কথা সরল না কার্ল মার্ক্সের। স্টিম ইঞ্জিনযেন সুইচ টিপে হঠাৎ থামিয়ে দিয়েছেন মেশিনম্যান ফ্রেডি। 

ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons

Nilarnab Chakraborty Author

পেশায় সাংবাদিক নীলার্ণব বিভিন্ন বাংলা সংবাদপত্র ও পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। গল্প কবিতা ও ফিচার লেখায় সমান আগ্রহ ও দক্ষতা রয়েছে। প্রকাশিত বই রাতের কাহিনী, অসংলগ্ন রিপোর্টাজ, হাওয়ার আওয়াজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *