দু’দিন আগে বাড়ির বাইরে পোর্চ-এ আমাজন থেকে বাক্স ডেলিভার করে দিয়ে গেছে — সে বাক্সের ভেতরে এসেছে নতুন আইপ্যাড। অন্য সময় হলে আমাজন-এর বাহক গাড়িতে ওঠার আগেই ছোঁ মেরে তার হাত থেকে তুলে আনতাম বাক্স, কিন্তু এখন সেটা সচেতনভাবেই ফেলে রাখা আছে পোর্চ-এ। কার্ডবোর্ড, অ্যালুমিনিয়াম, গ্লাস, ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমে করোনা ভাইরাস-এর হাফ লাইফ নিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ গবেষণাপত্র পড়ে ফেলেছি এই ক’দিনে। দিনক্ষণ ঠিক করে আজ সন্ধ্যেবেলা আমাজন-এর বাক্স ঘরে আনা হবে, আইপ্যাড আদ্যন্ত মোছা হবে ক্লোরোক্স ওয়াইপ দিয়ে, তারপর তার বরণ। হাতে গ্লাভস পরে দাগী আসামির মতো ঘষে ঘষে মুছব আইপ্যাড, রক্তের দাগ তোলার মতো, যাতে আমাজনকর্মীর স্পর্শবাহিত সম্ভাব্য করোনা নামক বীজাণুর বিন্দুমাত্র ছিঁটেফোঁটা না থাকে আইপ্যাড-এর গায়ে।

গত দু’সপ্তাহ ধরে আমরা এক অদ্ভুত সময়ের মধ্যে বাস করছি। এক এক দিন ঘুম ভেঙে মনে হচ্ছে যেন সায়েন্স ফিক্শন-এর মধ্যে বেঁচে আছি। স্পর্শ থেকে দূরে, একে অপরের স্পর্শ বাঁচিয়ে বেঁচে থাকা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব বন্ধ; এখন পড়াশোনা, গবেষণা, মিটিং সবকিছুর মাধ্যম ভার্চুয়াল। অর্থাৎ কম্পিউটার বা ফোন। শিক্ষার্থীদের দেখাশোনা হচ্ছে zoom, blue jeans, webex, ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মে। হাত বাড়িয়ে প্রিয় বন্ধুকে ছোঁয়ার উপায় নেই। বড় জোর একটা দু’টো উড়ন্ত চুম্বন স্ক্রিন তাক করে পাঠানো যেতে পারে।

লকডাউনের দিনগুলো চলছে একটা অমোঘ নিয়মে। সকালে ঘুম ভেঙে চায়ের জল চাপিয়েই ল্যাপটপে খুলছি মাইক্রোসফট বিং করোনাভাইরাস ট্র্যাকার। আমি পেশায় রাশিবিজ্ঞানী, জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণায় নিযুক্ত। আজকালকার দিনে আমাদের পোশাকি নাম health data scientist। গত দু’সপ্তাহ প্রতিদিন সকাল দুপুর বিকেল করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত ডাটা ঘেঁটে বুঝতে পারছিলাম বিশ্বব্যাপী সুনামি আসন্ন। শুরুটা হয়েছিল আগেই। চিনের হুবেই-তে আক্রান্তের সংখ্যা এবং সর্বস্তরে লকডাউন, ইতালির ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর হার, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রশংসনীয় প্রয়াস জনসাধারণের জন্যে অবারিত COVID-19 পরীক্ষার সুযোগ, এসব খবর পেরিয়ে যেদিন COVID-19 আছড়ে পড়লো অতলান্তিকের এপারে, মিশিগানের চৌকাঠে, সেদিন থেকে রাশিবিজ্ঞানের বিদ্যাবুদ্ধি গলায় দলা পাকিয়ে রাত জাগিয়ে রাখছে। লিনিয়ার ফেজ (Linear phase) থেকে এক্সপোনেনশিয়াল ফেজ-এ (exponential phase)-এ চলে যাওয়া মানে যে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের সূচনা হয়ে গেছে, এটা বলে দিতে হয় না কোনও জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীকে। “Flatten the curve” এখন আমাদের মূলমন্ত্র। আর উপযুক্ত ব্যবস্থা (অর্থাৎ social distancing, travel bans) না নিলে যে একই সুনামির দিকে আমরাও এগোব, এটাও নিশ্চিত। এইসব ভাবনাচিন্তা আলোচনার শেষে দমকা হাওয়ার মতো ভেসে আসে আট হাজার মাইল দূরে বৈষ্ণবঘাটা বাই লেনের পাড়ার ছবিটা। গ্রিল দেওয়া বারান্দায় দাঁড়ানো মায়ের মুখ, টিংটং কলিং বেল বাজিয়ে বাজার ফেরত বলাইদা। বিশ্বব্যাপী এই অনিশ্চয়তার শেষ কবে, তার আগে কত মাশুল দিতে হবে আমাদের, কবে ছুঁতে পারব বারান্দাটা, মায়ের মুখ, এইসব ভাবতে ভাবতে রাতভোর হয়। বুকে খামচে ধরে ভয়, তবু তো রাতের শেষে আরেকটা দিনের শুরু! 

Cookery book of grandma
দিদুর রান্নার বই, আর ইউটিউবের রেসিপি দেখে রান্না চলছে পাশাপাশি। ছবি – লেখক

লকডাউনের সকালগুলো একটু অন্যরকম। দুধ, সিরিয়াল, বয়েল্ড এগ, ফলের বদলে মুখরোচক জলখাবার তৈরি হয়। সামনে খোলা মলিন মলাটের দিদুর রান্নার বই। অল্প সবজি দিয়ে দালিয়া বা সুজির উপমা। সঙ্গে ঠান্ডা দুধ ছোট এক কাপ। এই আমাদের মোটামুটি ব্রেকফাস্ট মেনু। দুপুরে দিদুর বইয়ের পাতা ঘেঁটেই তৈরি হয় খোসা চচ্চড়ি। সামগ্রি কম, কিন্তু সময় তো অঢেল। দৌড়ে বেরোতে বেরোতে একটা ইয়োগার্ট কিংবা গাড়িতে স্যান্ডউইচ চিবনোর বদলে এখন একসঙ্গে টেবিলে বসে খাওয়া হয় ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার। খাদ্যদ্রব্য সাশ্রয়ের সঙ্গে সঙ্গে জল, সাবান, সবকিছুর সাশ্রয় শিখছি আমরা। লন্ড্রি সপ্তাহে দু’বারের বেশি নয়। দিনে একবার ডিশওয়াশার চলছে। ভাই বোন মিলে ইন্টারনেট থেকে রেসিপি ডাউনলোড করে লাঞ্চে বানাচ্ছে ইজি ডাম্পলিং স্যুপ। লকডাউনের কালে বাড়ির লোকজনদের মধ্যে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং কমেছে। 

cycling in Ann Arbour
সারাদিন বাড়িতে। তাই মাথা ছাড়াতে একফাঁকে সাইক্লিং। ছবি- লেখক

ভার্চুয়াল পড়াশোনা, মিটিং, ক্লাস পড়ানো ইত্যাদির পরে কোনও কোনওদিন মাথাটা ছাড়াতে হুশ করে সাইকেল নিয়ে একটা চক্কর কেটে আসা হচ্ছে শুনশান পাড়ায়। কিম্বা বাড়ির সামনে একটু হাঁটাচলা। সবই অন্য মানুষজনদের থেকে দূরত্ব রেখে। পড়ন্ত বিকেলে হোয়াট্স্যাপ ভিডিও কলে প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে গল্প হচ্ছে। কিম্বা বাঙালি বন্ধুরা মিলে ফেসবুক মেসেঞ্জারে অন্তাক্ষরি খেলা। কেউ এক কাপ কফি নিয়ে বসেছে পাশে, তার ভার্চুয়াল ঘ্রাণ নিচ্ছে বাকিরা। আর বাড়িতে বোর্ড গেমস খেলা হচ্ছে বিস্তর– ক্লু, মিলস বোর্ন, লুডো, দাবা। মাঝে মাঝে ছেলে উজান আর তার দিদি বাস্কেটবল পিটিয়ে আসছে ড্রাইভওয়েতে। পাশের বাড়ির ম্যাথু কাচের জানালায় নাক ঠেকিয়ে ওদের দেখছে, জানে এখন দৌড়ে বেরিয়ে এসে খেলায় যোগ দেওয়া যাবে না। মঙ্গল আর বৃহস্পতি বাড়ির বেসমেন্টে zoom-এ তাইকনডো ক্লাস করছে উজান। ওকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে কনুইয়ের গুঁতো খেলাম। সোম বুধ ফেসটাইমে মা আর মেয়ের যোগা মেডিটেশন ক্লাস। শনিবার উর্জা-র ভয়েস লেসন– জ়ুমের পর্দায় ভেসে আসছে মিস স্ক্যানলনের গলা, “Just you wait Henry Higgins!” স্কুলের মিউজিকাল থিয়েটারের মহড়া চলছিল। এখন তো আর কেউ জানে না স্কুল কবে খুলবে আবার!

এই দুঃসময়ে মানুষ একে অপরের পাশে দাঁড়াচ্ছে, একে অপরকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছে নানা ভাবে। ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের সহকর্মী ডাক্তার বন্ধুরা যখন লড়ছে সামনাসামনি হাসপাতালে আইসিইউ-তে, তখন ফেসবুক লাইভ-এ WHO-র নির্দেশ মেনে অ্যান আরবর পাবলিক স্কুলের রোবোটিক্স টিমের ছেলেমেয়েরা মাস্ক বানাচ্ছে তাদের জন্যে। একই ইউনিভার্সিটির ভারতীয় ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, গবেষকরা bluejeans-এ একজোট হয়ে দিনরাত তোলপাড় করে কোভিড-১৯-এর তথ্য বিশ্লেষণ করছে, মডেলিং করে বার করার চেষ্টা করছে ভারত সরকার এবং জনসাধারণের জন্যে নিৰ্দেশপত্র। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও, এদেশের বহু ছেলেমেয়ে স্কুলের ফ্রি ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চ প্রোগ্রামের ওপর ভরসা করে দিন চালায়। তারা যেন এই স্কুল বন্ধের সময়ে ক্ষুধার্ত না থাকে, সেদিকে খেয়াল রেখে স্কুল ডিস্ট্রিক্ট তাদের জন্যে ফুড পিক আপ স্টেশনের ব্যবস্থা করেছে। সপ্তাহে দু’দিন তারা পালা করে গিয়ে সারা সপ্তাহের খাবার তুলে আনতে পারে। লোকজনের মানসিক সুস্থতার কথা ভেবে ইউনিভার্সিটি মিউজিকাল সোসাইটির কর্মীরা তাদের প্রিয় গানবাজনার অডিও ভিডিও লিংক পাঠাচ্ছে প্রতিদিন। ২৪ মার্চ থেকে এই শহরে পাঁচদিনের ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হওয়ার কথা ছিল। কর্মকর্তারা সেটাও অনলাইন করে দিয়েছেন। আজকেই লাইভ স্ট্রিমিংয়ে সন্ধ্যেবেলা নিউ ইয়র্কের ডিরেক্টর লিন স্যাক্সের ছবি দেখব। সঙ্গে আলোচনা “the fraught and bewildering challenge of looking at the human form from behind the lens.”

এরই মাঝে বসন্ত আসছে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি বাড়ির সামনে ব্র্যাডফোর্ড পিয়ার গাছটায় নতুন পাতার ইঙ্গিত। পাশের বাড়ির রিটায়ার্ড নার্স মহিলা পোর্চ -এ দুটো বেলুন লাগিয়েছেন “I turned 70 today!” উল্টোদিকের বাড়ির বাচ্চাটা গ্যারাজের দরজা খুলে ড্রাইভওয়েতে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বেহালায় বাজাচ্ছে  “Happy birthday to you!” যুদ্ধ তো সবে শুরু হয়েছে! শেষমেশ একটা ক্ষুদ্র বীজাণু এসে আমাদের সমগ্র মানবজাতিকে হয়তো অন্যরকম কিছু শেখাবার চেষ্টা করছে। আমরা বেঁচে আছি দূরে দূরে, একদিন কাছাকাছি বাঁচবার প্রত্যাশায়!

আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের বায়োস্ট্যাটিসটিক্স-এর অধ্যাপক ড: মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়ের গবেষণার বিষয়বস্তু ক্যান্সার ডেটা মডেলিং। জন্ম এবং লেখাপড়া কলকাতায়। কর্মসূত্রে বিশ্বনাগরিক। লেখালেখির শুরু কলেজজীবন থেকেই। কবিতার পাশাপাশি ছোটগল্প, মুক্তগদ্য এবং প্রবন্ধ লেখেন। বাতায়ন, পরবাস, বাংলালাইভ, সুইনহো স্ট্রিট, কেয়াপাতা, গল্পপাঠ, সাহিত্য কাফে, TechTouchটক, Antonym ইত্যাদি বহু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: একলাঘর (যাপনচিত্র প্রকাশনী)।

10 Responses

  1. খুব ভালো লাগলো তোর লেখা। আমরাও এখানে এক দমবন্ধ পরিবেশের মধ্যে রয়েছি।কি হবে কি হবে এই চিন্তায় রাত কাটছে। বিশেষ করে আমাদের উপর কড়াকড়িটা বেশি।কারণ বয়স ও শারিরীক নানান ব্যাধির প্রভুত্ব।
    তোর লেখা পড়ে মনটা মিসিগান ঘুরে এলাম।
    ভালো থাকিস, সাবধানে থাকিস সবাই।

  2. এতদিনে একটা ভালো লেখা পেলাম। করোনার দিনগুলোতে যেভাবে দিন কাটছে, একসময় তোর মতনই মনে হয় কবে আবার আদর করতে পারব প্রত্যুষের ছানাপোনাদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *