গুগলকে মাস্ক কথাটার বাংলা মানে জিজ্ঞাসা করলে কুড়ি বাইশটা রেজাল্ট দেখায়। মুখোশ ছাড়াও অন্য যে শব্দগুলো আছে সেগুলো হল, ছদ্মবেশ, ভান, ছলনা, নকল মুখ, ছল ইত্যাদি। মুশকিলটা হল, মাস্ক পরার ইদানীং যে আদব কায়দা, তাতে ‘মুখোশ’ ছাড়া আর সবকটা মানেই ঘোরতর সত্যি হয়ে গিয়েছে।

এই সামান্য একফালি কাপড় নিয়ে যে এত রকম ছল- পারমুটেশন ও কম্বিনেশনে নিজেদের মুখ অলংকৃত করা যেতে পারে, তা আমাদের করোনা-কাল দেখিয়েছে। দেখাচ্ছেও। হোয়্যাটস্যাপের সৌজন্যে আধুনিক ব্যবহার অনুযায়ী মাস্কের নানা নাম জানা গেল, শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনামের মতো। নাকের উপরে পরলে এর নাম নাস্ক। একটা কানে কানপাশার মতো ঝুলিয়ে রাখা হলে একে বলা যেতে পারে কানাস্ক। থুতনিতে এঁটে থাকা মাস্ককে বলা যায় থুতনাস্ক। আর অপর্ণা সেনের সানগ্লাসের মতো মাস্কটা যদি কপালের উপরে তুলে দেওয়া হয়, তাহলে একে ভালবেসে কপালাস্কও বলা যেতে পারে।

Mask
হোয়াটস্যাপের সৌজন্যে যে মিম হল ভাইরাল আর আমরা জানলাম বিবিধ মাস্কাবলি! ছবি সৌজন্য – লেখকের হোয়াটস্যাপ

করোনা থেকে বাঁচতে চিকিৎসকেরা পই পই করে বলে চলেছেন মাস্ক পরার কথা। কিন্তু কে কার কথা শোনে! যাঁরা মাস্ক পরেন না, তাঁদের থেকে নানা অসুবিধার কথা শুনতে পাওয়া যায়।

এছাড়াও যাঁরা সকালে দাঁত মাজার পর থেকেই তাঁদের মুখটা পান মশলার গর্ভগৃহ বানান, তাঁদের প্রতি মিনিটে পাপ-পিক বাইরে নিক্ষেপ করার সদিচ্ছেয় মাস্ক একটা বিরাট বাধা। মাস্ক পরলে বিড়ি সিগারেট টানার অসুবিধে। চায়ে চুমুক? ভাবাই যায় না। আর সর্বোপরি, মহামহিম অত্যুচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন শ্রীযু্ক্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন, মাস্ক পরিয়ে নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করা উচিত নয়। তিনিও তো নাগরিক। এই যু্ক্তি মেনেই সম্ভবত ট্রাম্পস্যারও মাস্ক পরেন না!

Mask
মাস্ক পরে ‘পিক-কুহ-রীতি’ মেনে চলা ভয়ানক অসুবিধে! ছবি সৌজন্য – dnaindia.com

মাস্ক বিরোধীরা বলছেন, সত্যি সত্যি ক’টা লেয়ারে ভাইরাসশুদ্ধি হয়, তা আগে সবাই বুক বাজিয়ে বলুক। অকাট্য যুক্তি বটে। প্রথম দিকে শুনেছিলাম, রঘু ডাকাতের মতো দেখতে লাগলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু যদি মাস্ক কিনতে অসুবিধে হয়, তা হলে মুখের সামনে রুমাল প্যাঁচালেও চলবে। জেনেছিলাম, গেঞ্জির কাপড় দিয়ে তৈরি পাতলা মাস্ক হলেও দোষ নেই। তার পরে শোনা গেল, মাস্কে একাধিক লেয়ার থাকা চাই। ভাবলাম, যত বেশি লেয়ার, তত মঙ্গল বুঝি। আর এক দল বিশেষজ্ঞ বলতে শুরু করলেন, প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হল এন ৯৫ মাস্ক। অন্য দল বিরোধিতা করে বললেন, এন ৯৫-ই শেষ কথা নয়। এ ডাক্তার বললেন, ডিসপোজ়েবল মাস্কের জুড়ি নেই। ও ডাক্তার মত দিলেন, দু’টো মাস্ক রাখুন। একটা রোজ ধুয়ে পরুন। এক পক্ষ বলিলেন, ভাল্ভ মাস্ক (যে মাস্কের একদিকে কয়েনের মতো ছোট জায়গা করা থাকে, বায়ু চলাচলের জন্য) অতি উত্তম। অন্য পক্ষ কহিলেন, ভাল্ভ মাস্ক পরার থেকে মাস্ক না পরা ভাল। শ্বাস ছাড়ার সময় এমন মাস্কের ফুটো দিয়ে নাকি প্রবল গতিতে হাওয়া বেরিয়ে আসে। ফলে পাশের লোককে সংক্রামিত করার সম্ভাবনা বাড়ে।

পুণের ব্যবসায়ী শঙ্কর কুরাদে ভাবলেন, ওরা যা খুশি বলে বলুক। কাপড়ের থেকে মেটালে কাজ হবে বেশি। পকেটটাও ভর্তি ছিল। তাই যাবতীয় তুচ্ছ মাস্ককে অগ্রাহ্য করে তিনি বানিয়ে নিলেন একেবারে সোনার একটা মাস্ক। খরচ বেশি পড়েনি। মাত্র ২.৮৯ লক্ষ টাকা। আর এত প্যাঁচ-পয়জারে অতিষ্ঠ হয়ে বেশ কিছু মানুষ উপলব্ধি করলেন, মাস্ক পরার মতো মূর্খামি আর দু’টি নেই। এটা পরা মানে নিজের ইমিউনিটির উপরেই ভরসা হারিয়ে ফেলা। করোনা? ছোঃ।

Mask
মাস্ক নেই? টাকা ছাড়ুন। জরিমানার নির্দেশ রয়েছে পুলিশের ওপরেও। কিন্তু তাতেও কি কিছু আটকাচ্ছে? ছবি সৌজন্য – facebook.com

আমি আপনি শুনেছি যেমন, তেমন মাস্ক বিরোধীরাও শুনেছেন, এ বারে নাকি আরও কড়া হবে লকডাউন। মাস্ক না পরলেই এবার থেকে মোটা জরিমানা করবে পুলিশ। খবরের কাগজ পড়ার অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে, জরিমানারও আবার রকমফের আছে। মাস্ক না পরলে যে জরিমানা হওয়ার কথা, তার আবার বেশ কয়েকটা শাখানদী রয়েছে।

পরিচিত এক পুলিশ আধিকারিক আজ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলছিলেন,

“এই জরিমানা করার ব্যাপারটা অনেকটা হ য ব র ল-র গেছোদাদার মতো বুঝলি। প্রথমে দেখতে হবে লোকটা মাস্ক পরেছে কি পরেনি। যদি না পরে থাকে, তা হলে দেখতে হবে লোকটার সঙ্গে মাস্ক আছে না নেই। যদি সঙ্গে থাকে, তাহলে এ বার দেখা দরকার মাস্কটা কোথায় রয়েছে- জামার বুক পকেটে না প্যান্টের পিছনের পকেটে। যদি বুক পকেটে থাকে তা হলে বুঝতে হবে, লোকটার মাস্ক পরার ইচ্ছে আছে, তাই ধারে কাছেই রেখেছে। আর যদি প্যান্টের পকেটে থাকে তা হলে ধরে নিতে হবে ওর ইচ্ছে চার আনার বেশি নয়।” জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘ওরেব্বাস। তবে কোনও রকমে মাস্ক একটা পরে নিলেই পাশ, তাই তো?’’ উনি বললেন, ‘‘এটা আরও ভয়ানক বুঝলি। বেশিরভাগ লোকেরই মাস্ক থাকে কানে, নাকে, কপালে কিংবা থুতনিতে। কোন চার্ট দেখে ফাইন করব? কোথায় রাখলে কোন ধারা? কেউ কেউ শুধু কানে সাপোর্ট দিয়ে ঠোঁটের উপরে নরম আদরের মতো মাস্কটা বুলিয়ে রাখে। আরে বাবা, নাকটাই যদি ঢাকা না থাকল, তাহলে মাস্ক পরে লাভ কি?’ জানতে চাইলাম, ‘সবচেয়ে বেশি ফাইন কার থেকে করলে?’’ উনি বললেন, “সে এক কাণ্ড বটে। এক অফিসযাত্রীর কাছে ‘মাস্ক কোথায়’ জানতে চাওয়ায় তিনি বললেন, ‘এইতো স্যার’। বলে পাসওয়ার্ড দিয়ে অ্যাটাচিটা খুললেন। ভিতরের একটা খাপ থেকে একটা ব্যাগ বের করলেন। এবারে ওই ব্যাগটা থেকে বেরোল একটা এনভেলপ। তারপরে ওই এনভেলপের থেকে বের করলেন একটা পাটপাট ইস্তিরি করা মাস্ক। বুঝলাম, উদ্বোধনই হয়নি।”

উনি ফাইন নিতে পারেননি। বিবেকে বেধেছিল।

এটিএম-এর সামনে, কাচের দরজায় পোস্টার সাঁটানো থাকে- সানগ্লাস কিংবা হেলমেট পরিয়া প্রবেশ নিষেধ। সম্ভাব্য জালিয়াতদের শ্রীমুখ যেন ভিতরে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরার সামনে স্পষ্ট ভাবে ধরা দেয়, তার জন্যই এই নির্দেশিকা, বহু বছর ধরে। অথচ, সানগ্লাস হেলমেটে লাল দাগ মেরে দেওয়া হলেও মাস্ক পরে এটিএম-এ প্রবেশে কোনও বাধা নেই। তথ্য বলছে, মাস্ক জড়ানো মাসগুলোতে এটিএম-এ জালিয়াতিও বেড়ে গিয়েছে হুহু করে। মাস্ক পরা চোর, টাকা মেরে ধাঁ। টিকিটিরও নাগাল পাচ্ছে না পুলিশ। এমনই এক এটিএম জালিয়াতির খবর পাওয়ার পর এক কাব্যরসিককে বলতে শুনলাম, ‘ক্যামেরা তুমি হার মেনেছ মুখোশ পরার কাছে, একটি মাস্ক খুললে পরে একটি চুরি বাঁচে।’

উনি যথার্থ বলেছিলেন। সোনার দোকানদাররাও আতান্তরে পড়েছেন। দোকানের বাইরে লিখতে হচ্ছে, মাস্ক ছাড়া প্রবেশ নিষেধ। আর ভিতরে ঢোকার পরেই সিকিউরিটি গার্ড বলছেন, ‘পাঁচ সেকেন্ডের জন্য মাস্কটা একটু খুলে ফেলতে হবে স্যার। সামনে তাকান। ওই যে ক্যামেরা!’

মাস্ক পরা বা না পরা নিয়ে এমন চাপান উতোর আরও বেশ কয়েক মাস চলবে হয়তো। তবে পৃথিবী জুড়ে ফ্যাশন ডিজাইনাররা বলে দিয়েছেন, আমরা চাই বা না চাই, এবার থেকে আমাদের পোশাকেরই অঙ্গ হয়ে গেল মাস্ক। মনে একটাই দুঃখী প্রশ্ন থেকে যায়। যে শিশু জন্মাল আজ রাতে, সে যদি তার গুরুজনদের আগামী কয়েক বছর এ ভাবে দেখতে দেখতেই বড় হয়, তবে তার ‘সাদা মনে কাদা নেই’ মন নাককে যে এক গোপনাঙ্গ ভাববে তাতে কি কোনও সন্দেহ থাকতে পারে??

অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *