গর্জন করতে করতে বেতার অফিসে ঢুকলেন ছোটখাটো গড়নের, গোলগাল চেহারার এক প্রৌঢ়া। “এসব কী শুনছি সাহেব, তোমরা নাকি এখন থেকে খালি ভদ্দরঘরের ছেলেমেয়েদের গাওয়াবে? আর আমরা বাদ পড়ব?” অবাক হয়ে তাকালেন নতুন স্টেশন ডিরেক্টর। ততক্ষণে কার্পেট-মোড়া মেঝেতে বসে পানের বাটা বের করে পান সাজা শুরু করেছেন প্রৌঢ়া। আবারও সেই গর্জন, “সে হবে না। এ রেডিও স্টেশন আমাদের। আমরা সেই প্রথম থেকে আছি।”
সময়টা গত শতকের চারের দশকের মধ্যভাগ। আলো-আঁধারিতে ঘেরা ব্যক্তিজীবনের গণ্ডি পেরিয়ে বিগতকালের তওয়ায়েফ সংস্কৃতির শেষ যে প্রতিভূরা শিল্পীর সম্মানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তাঁরা তখনও দেশের নানা বেতারকেন্দ্রে মাঝেমধ্যেই সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এমনই সময়ে, বেতারে সঙ্গীত পরিবেশন নিষিদ্ধ করা হয় সেই সুরবিদুষীদের। এই খবর পেয়েই সেদিন কলকাতা বেতারকেন্দ্রে এসেছিলেন প্রৌঢ়া। স্টেশন ডিরেক্টর অদূরে বসা একজনকে প্রশ্ন করলেন, “হোয়াটস্ অল দিস? হু ইজ দিস উয়োম্যান?” প্রশ্ন শেষ না হতেই আবারও সেই গর্জন, “ও সাহেব আমাকে ইংরেজি দেখিও না, মাই নেম ইজ ইন্দুবালা।” ওস্তাদ মৈজুদ্দিনের পাহাড়ি ঠুংরি গেয়ে উঠলেন শিল্পী কার্পেটে বসে বসেই। অভিভূত সাহেবের মুখে একটিও কথা ফুটল না। যথাযোগ্য সম্মানে স্টুডিওতে আবারও প্রবেশ করলেন ইন্দুবালা। আর কোনও দিন সেখানে তাঁর প্রবেশপথ রুদ্ধ হয়নি।

জাগুলিয়ার বিখ্যাত বসুবংশের সন্তান, উনিশ শতকের প্রখ্যাত সাহিত্যিক, মনমোহন বসুর কনিষ্ঠ পুত্র প্রিয়নাথ বসু, ১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস। মনমোহনের পরামর্শে এই সার্কাসদলে যোগ দেন তাঁর মধ্যম পুত্র মতিলালও। পরিশ্রমী, কর্মকুশল প্রিয়নাথ ও মতিলালের যৌথ উদ্যোগে অল্প সময়েই সমগ্র ভারতে অশেষ সাফল্য লাভ করে গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস। এই সার্কাসের দলে ট্র্যাপিজ, ব্যালেন্সের খেলায় খ্যাতি লাভ করেছিলেন রাজবালা নাম্নী এক অল্পবয়সি বালিকা। খেলায় অসাধারণ দক্ষতা আর অঙ্গসঞ্চালনে আশ্চর্যরকম সাবলীলতার জন্য তার নাম হয়েছিল ‘বোনলেস রাজু’। বনবিষ্ণুপুরের চট্টোপাধ্যায় বংশের মেয়ে, মুখোপাধ্যায় বংশের বধূ, অকালে স্বামীহারা পুঁটি বোষ্টমীর কন্যা রাজবালা। ১৮৮৭ সালে রাজবালার জন্মের কিছু মাসের মধ্যেই মৃত্যু হয় পুঁটির। তারপর নানা ঘটনাচক্রে শিশু রাজবালার আশ্রয়স্থল হয় রামবাগান। এর অনতিদূরেই, ভাল্লুকবাগানে ছিল মতিলালের বাস। স্ত্রী অন্নদামোহিনী ও পরিবারবর্গ-সহ সেখানে থাকতেন তিনি।

১৮৯৮ সালে, সার্কাসদলের উজ্জয়িনী সফরে, মতিলাল বসু বিবাহ করেন রাজবালাকে। সে বছরই নভেম্বর মাসে (১৯শে কার্তিক), তাঁদের পাঞ্জাব সফরের সময়, অমৃতসরে জন্মগ্রহণ করেন ইন্দুবালা। সন্তানের জন্মের পর, কলকাতায় ফিরে সার্কাসের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেন রাজবালা। মতিলাল সার্কাসের দল নিয়ে নানা জায়গায় যেতেন। কলকাতায় এলে মাঝেমধ্যেই হাজির হতেন রামবাগানে। সেখানে মায়ের স্নেহে তখন বড় হচ্ছেন ইন্দু। সার্কাস ছাড়লেও সুকণ্ঠী রাজবালা সঙ্গীত আঁকড়ে ধরেছিলেন। সঙ্গীতে পারদর্শী মতিলাল কলকাতায় থাকলে, তাঁর কাছেই ধ্রুপদ শিখতেন রাজবালা। শিশু অবস্থায় ইন্দুবালার প্রথম গান শেখাও বাবারই কাছে। বিবাহের কিছু বছর পর মতিলাল-রাজবালার সম্পর্কে শৈথিল্য আসে। যোগাযোগের ঘটে সমাপ্তি। তখন রাজবালা আর শিশু ইন্দুর দায়িত্ব গ্রহণ করেন মতিলালের মামাতো ভাই জীবনকৃষ্ণ ঘোষ।
স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হওয়ার পর থেকে সেকালের বিশিষ্ট পাখোয়াজবাদক দুলি ভট্টাচার্যের সঙ্গতে রীতিমত ধ্রুপদের চর্চা আরম্ভ করেন রাজবালা। একসময় মেহফিলের গায়িকারূপে তাঁর বিশেষ খ্যাতিও লাভ হয়। রাজবালার গৃহে তখন থেকেই আরম্ভ হয় বহু সঙ্গীতগুণীর আগমন, বসতে থাকে গানের আসর। এমনই এক গানের আসরে, জীবনকৃষ্ণের গীতরসিক বন্ধুদের অনুরোধে ইন্দুবালার প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন। সুকণ্ঠী শিশুটির গানে মুগ্ধ হয়ে তাঁরাই পরামর্শ দেন তাকে গান শেখানোর। একসময় বাবা মতিলাল বসুর কোলে শিশু ইন্দুর গান শুনে কাকা প্রিয়নাথ বলতেন, “দাদা, ইন্দু দেখো, গাইয়ে হবে।” সেই গাইয়ে হওয়ার প্রস্তুতিই ইন্দুবালার আরম্ভ হয় চোদ্দো বছর বয়সে, গৌরীশঙ্কর মিশ্রের কাছে।
রামবাগানের বাড়িতে, রাজবালার আসরে আসতেন সঙ্গীতাচার্য লছমিপ্রসাদ মিশ্র। যন্ত্র ও কণ্ঠসঙ্গীতে, সে যুগে তিনি ছিলেন সঙ্গীতজগতের এক বিস্ময়। তাঁরই আত্মীয় ছিলেন গৌরীশঙ্কর মিশ্র। কাশীর প্রাচীন সারঙ্গ ধারার সুযোগ্য উত্তরসূরী গৌরীশঙ্করের বিশেষ পরিচিতি ছিল গহরজানের প্রধান সারঙ্গী হিসাবে। ১৯১১ সালে দিল্লিতে পঞ্চম জর্জের দরবারেও গহরজানের গানের সঙ্গে সারঙ্গ বাজান তিনি। এর ঠিক পরের বছর ইন্দুবালা নাড়া বাঁধেন গৌরীশঙ্করের কাছে। শেখেন গৌরীশঙ্করের ভাই কালীপ্রসাদের কাছেও। সারেগামা-র পাঠ শেষ হতে, ইমনে ‘বাঙ্গুরি মোরি মোরা জি না ছুঁয়ো’ দিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁর রাগসঙ্গীতের তালিম। একে একে ইন্দু শিখতে থাকেন আশাবরী, ভৈরবী, প্রভৃতি রাগ। বছরখানেক গান শেখার পরেই ঘটে আশ্চর্য ঘটনা।
গৌরীশঙ্কর মিশ্রের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রতি বছর জন্মাষ্টমী উপলক্ষে বসত গানের আসর। সেখানে কলকাতার তো বটেই, কাশীর শ্রেষ্ঠ কলাকারেরাও আসতেন। এই আসরেই ডাক পড়ল ইন্দুবালার। আগ্রহী শ্রোতা হয়েই গেছেন ইন্দু। গিয়ে দেখেন আসর আলো করে বসে আছেন গহরজান, আগ্রেওয়ালি মালকা, চুলবুল্লেওয়ালি মালকা, লখনউওয়ালি বেচুয়াবাঈ, জানকীবাঈ, সরমাবাঈ, কিরণবাঈ, যাদুমণি, শ্বেতাঙ্গিনী, কৃষ্ণভামিনী, কেরামতুল্লা খাঁ, ঠুংরির বিখ্যাত ওস্তাদ মৈজুদ্দিন প্রমুখ। মুগ্ধ হয়ে দেশখ্যাত গুণীদের পরিবেশন শুনছেন ইন্দুবালা। হঠাৎ কালীপ্রসাদ মিশ্র চুপি চুপি প্রশ্ন করলেন , ‘গাইবে?’ বিস্মিত ইন্দু প্রথমে ভেবেছিলেন ওস্তাদ নিশ্চয়ই মজা করছেন। ভুল ভাঙতে শেষ পর্যন্ত ভয়ে ভয়ে শুরু করলেন কালী ওস্তাদেরই কাছে শেখা ইমন। গান শেষ হতে গুণীজনেরা আরও গাইবার অনুরোধ জানালেন। গাওয়া হল ঠুংরি। এরপর খোদ গহরজানের নির্দেশে গাইতে হল আরও কিছু গান।
গৌরীশঙ্কর মিশ্রের কাছে শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই তাঁর সম্মতিক্রমে গহরজানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন ইন্দুবালা। কালী ওস্তাদের সামনেই ইন্দুর হাতে নাড়া বেঁধে দিয়েছিলেন গহর, তাঁর ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের বাড়িতে। সেদিনই শিখিয়েছিলেন ভূপালিতে টপ্পা ‘আ মিলা ম্যাহরাম ইয়ার’। পরে গহরজানের কাছে বিভিন্ন রাগের ঠুংরি, দাদরা, গজল, ইত্যাদি শিখেছিলেন ইন্দুবালা। শিখেছিলেন নাচ, আর আসরের নানান আদবকায়দা। তাঁরই কথায়, “অত বড় গাইয়ে (গহরজান), কত সাধ্যসাধনা করে কত পয়সা খরচ করে তবে তাঁর শিষ্যত্ব লাভ করা যায়। আর আমায় না বলতেই অমন করে কাছে টেনে নিলেন। অবাক হব বইকি! এ কি কম সৌভাগ্যের কথা!”
ইন্দুবালা যখন গহরজানের কাছে শিখছেন, কিংবা নানা মুজরোয় তাঁর সঙ্গে উপস্থিত থাকছেন, তখন গহরজানের গান আর আসরে সীমাবদ্ধ নেই — পৌঁছে গেছে সঙ্গীতরসিকদের ঘরে ঘরে। মাধ্যম — গ্রামোফোন রেকর্ড। তখন অবশ্য ‘কলের গান’ নামেই সে জিনিস অধিক পরিচিত। কলের গানে কণ্ঠ দিতে একদিন ইন্দুবালাও পেলেন আমন্ত্রণ। সময়টা গত শতকের দ্বিতীয় দশকের মধ্যভাগ। রেকর্ড করার প্রস্তাবটি ওঁর বাড়িতে নিয়ে আসেন গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ডিং বিভাগের ‘বড়বাবু’ ভগবতী ভট্টাচার্য, আর সেকালের বিখ্যাত গায়ক মোন্তাবাবু।
প্রথাগতভাবে গান শেখার পাশাপাশি, অনেক অনামি পরিচিতের সূত্রেও কিছু কিছু গান শিখেছিলেন ইন্দুবালা। কুমুদরঞ্জন মল্লিক রচিত ‘ওরে মাঝি তরী হেথা বাঁধবো নাকো’ কবিতাটি গানের আকারেই সেকালে প্রচলিত ছিল। কোনও অজ্ঞাতপরিচয় সুরকারের সুরে, মুখে মুখে ফিরে ইন্দুবালার কাছে পৌঁছেছিল এ গান। ওঁর কণ্ঠে ‘ওরে মাঝি’ শুনে গ্রামোফোন কোম্পানির কর্তৃপক্ষ ঠিক করেন এ গানের মধ্য দিয়েই নবীনা শিল্পীর কণ্ঠস্বর প্রথম রেকর্ড করা হবে। তখনও বৈদ্যুতিক রেকর্ডপদ্ধতির প্রচলন হয়নি। তখন রেকর্ড করা মানেই বিরাট এক চোঙের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে যথাসম্ভব জোর গলায় গান গেয়ে যাওয়া। উপরন্তু, পাশে বসে থাকতেন এক সাহেব, যাঁর কাজই ছিল গান গাইবার সময় শিল্পীর কণ্ঠ উঁচু পর্দায় উঠলে, তাঁর ঘাড় টেনে ধরে মাথাটা চোঙার ভেতর থেকে কিছুটা বের করে আনা, কিংবা নিচু পর্দায় গাওয়ার সময় মাথাটা ভেতরে এগিয়ে দেওয়া। শিল্পীর কণ্ঠস্বর এবং যন্ত্রীদের বাজনা চোঙ মারফৎ চোঙের অপর প্রান্তে ঘুরতে থাকা মোমের চাকতিতে পৌঁছত। আর পিনের আঁচড়ে সেই চাকতিতে ধরে নেওয়া হত গানটি। রেকর্ড করার এই জটিল ও কষ্টকর পদ্ধতিটি অনেকসময়েই শিল্পীদের ভয় পেয়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াত। কিন্তু ভগবতী ভট্টাচার্য, মোন্তাবাবু, দু’জনেই অভয় দিয়েছিলেন ইন্দুবালাকে। তখন ১৯১৬ সাল। (চলবে)
পরবর্তী পর্ব: ১০ ডিসেম্বর ২০২০।
জীবনে সবেমাত্র পেরিয়েছেন ছাব্বিশটি বসন্ত! বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সঙ্গীতসাধনায় রত। নেশা গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ। পত্রপত্রিকায় সঙ্গীতবিষয়ক বেশ কিছু নিবন্ধ লিখেছেন বাংলা ও ইংরাজিতে৷
Outstanding rendition of yester years legendary singer Indubala. So wonderfully, meticulously narrated by Sounak, cannot wait until next issue. Thank you Sounak for bringing out the jewels from the pages of forgotten history, giving us an opportunity to listen and walk thru the enchanting times immemorial
অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি পরের পর্বের জন্য।
অসাধারণ তথ্য সমৃদ্ধ লেখা।লেখককে সাধুবাদ জানিয়ে পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম ।
দারুণ লেখা! এতো তথ্য পূর্ণ খুব ভালো লাগে। পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।
কতো কিছু অামাদের অজানা ৷ পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম ৷
যেমন ভালো বিষয়বস্তু, তেমনই লেখার সাবলীল চলন। অনেককিছু অজানা তথ্যের পরিচয়ে ঋদ্ধ হলাম। ‘ওরে মাঝি তরী হেথা বাঁধবো নাকো’ এই গান যে কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের লেখা জানতাম না। ইন্দুবালার গলায় ও শোনা হয় নি, এখানে দেওয়া লিংক থেকে নিশ্চই শুনে নেবো। আমি শুনেছি বাংলাদেশের ইফফাত আরা খানের গলায়, সেখানে গানটা প্রচলিত বলেই জানানো হয়েছে। খুব ভালো লাগলো। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
অজানাকে জানার আনন্দ ই আলাদা… আর সেই আনন্দ ই তুমি আমাদের সবাইকে দিচ্ছ… আরো চাই.. আরো…
অপূর্ব!সমৃদ্ধ হলাম লেখা পড়ে।পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম ।
Excellent. Informative & as well as rich with many things which was unknown to me before read it.
Asadharon laglo….anek ajana tathyo jana gelo….
খুব ভালো লাগল,,,, সমৃদ্ধ হলাম।পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।,,,আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই
অপূর্ব, তথ্য সমৃদ্ব লেখা. খুব ভালো লাগলো. পরবর্তি পর্ব এর অপেক্ষায় রইলাম.
খুব ভালো লাগল। পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় রইলা।
Sri Rantidev Maitra has treasure in this regard.U may like to take his help.Adv Amitabha sen suggests.
ঋদ্ধ হলাম।
পরবর্তীপর্ব কবে পাচ্ছি?