গানে গানে ইন্দুবালা যেমন মেহফিলের রসিকদের প্রাণ ছুঁয়েছিলেন, ছুঁয়েছিলেন রেকর্ড-শ্রোতাদের প্রাণ, তেমনই সুরে সুরে স্পর্শ করেছিলেন বেতারের শ্রোতাদের। ১৯২৭ সালে ১ নং গার্স্টিন প্লেসে কলকাতা বেতারকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ঠিক পরদিন থেকেই ইন্দুবালা ছিলেন বেতারের শিল্পী। কলকাতায় তো বটেই, ওঁর গান সম্প্রচারিত হত দিল্লি, বম্বে, লখনউ প্রভৃতি শহরে, এমনকী সুদূর দক্ষিণের ত্রিচিতেও। বাঙালি শিল্পীদের মধ্যে সম্ভবত ইন্দুবালাই প্রথম, বেতারমাধ্যমে যাঁর কণ্ঠ ভারতের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল, বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, তামিল প্রভৃতি ভাষায় নানা ধারার গানের মধ্য দিয়ে। বেতারের পত্রিকার মাধ্যমে একসময় দেশের সর্বত্র পৌঁছে গিয়েছিল ইন্দুবালার এক বিরল সম্মানলাভের সংবাদ। 

সময়টা ১৯৩৬ সাল। রেকর্ডে, বেতারে, মেহফিলে, এমনকী মঞ্চে, ছায়াচিত্রের জগতে ইন্দুবালার গানের তখন জয়জয়কার। এমনই সময় মৈসোর রাজদরবারের সভাগায়িকার পদ অলঙ্কৃত করার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন শিল্পী। সুরের রাজ্য মৈসোরের তৎকালীন রাজা চতুর্থ কৃষ্ণরাও ওডেয়ার ছিলেন ইন্দুবালার সঙ্গীতের বিশেষ অনুরাগী। শিল্পীর স্মৃতিতে উজ্জ্বল ছিল মৈসোরের দরবারে সঙ্গীত পরিবেশনের প্রথম স্মৃতি। তাঁরই বয়ানে, “যথাসময়ে রাজদরবারে নিয়ে যাওয়া হল। যেমন সেখানে জাঁকজমক তেমন লোকজনের ভিড়। যে সে লোক নয় সব রাজ-রাজড়ার ভিড়। তাছাড়া গাইয়ে বাজিয়েদের দল তো রয়েইছে। চোখে যেন ধোঁয়া দেখলাম। কিন্তু তখন তো আর ফেরার উপায় নেই। অতএব কাঁপতে কাঁপতেই শুরু করে দিলাম গান। গান শেষ হতে অবশ্য সাহস গেল বেড়ে, কেননা চারিধারেই শুনি তারিফ আর বাহবা।”

মৈসোরের দরবারে, জীবনের অন্তিম পর্বে সভাগায়িকা হয়েছিলেন গহরজান। পরবর্তীকালে তাঁরই সুযোগ্যা শিষ্যা ইন্দুবালা, ভারত স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত টানা এগারো বছর অলঙ্কৃত করেছিলেন সেই পদ। তবে পাকাপাকিভাবে ব্যস্ত শিল্পীকে কখনওই থাকতে হয়নি মৈসোরে। প্রতি বছর দশেরার উৎসবের সময় আর মহারাজার জন্মদিনে মৈসোরের দরবারে সঙ্গীত পরিশনের আমন্ত্রণ পেতেন তিনি। সেখানে পরিবেশিত বিভিন্ন গান রিলে হত ব্যাঙ্গালোর, মাদ্রাজ, প্রভৃতি শহরে। এভাবেই দক্ষিণভারতে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছিলেন ইন্দুবালা। কালক্রমে নিজাম মীর ওসমান আলি খাঁয়ে’র আমলে হায়দ্রাবাদের দরবারে, দ্বিতীয় বীর সিংহের আমলে টিকমগড়ের দরবারে, রাজা দ্বিতীয় মান সিংহের আমলে জয়পুরের দরবারে গান গেয়ে হয়েছিলেন সম্মানিতা। সেকালের প্রায় সমস্ত অভিজাত সঙ্গীতাসরেই ইন্দুবালার ছিল উজ্জ্বল উপস্থিতি। সমগ্র ভারতের সুররসিকদের কাছে ছিল বিশেষ আদর।

ইন্দুবালার জীবনের বৈশিষ্ট্যই তার বৈচিত্র। মার্গসঙ্গীত ঘরানার শিল্পী হয়ে আগ্রহভরে একদিন তিনি বুঝে নিতে চেয়েছিলেন বাংলা কাব্যসঙ্গীতকে। বাংলা গানের সাফল্যের সীমা অতিক্রম করে এগিয়ে গিয়েছিলেন সর্বভারতীয় স্তরে। ঘরোয়া গানের আসর থেকে দেশখ্যাত দরবার, রেকর্ড থেকে রেডিও, সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন প্রতিটি ক্ষেত্রে। সবাক ছায়াচিত্রের জন্মলগ্ন থেকে বহু ছবিতে এবং তারও বহুপূর্ব থেকে অসংখ্য নাটকে, অভিনয় ও গান করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। আগ্রহভরে শিখে নিয়েছেন নানা ভাষা, সেই শিক্ষার যথাযথ প্রয়োগ করেছেন গানে। জীবনের অন্ধকারকে স্বীকার করেও বারবার এগিয়ে গেছেন আলোর সন্ধানে, আবার সাফল্যের আলোয় স্নান করে দিনশেষে ফিরেও এসেছেন মাটির কাছাকাছি। 

Angur and Indu
শেষ বয়সে দুই কিংবদন্তী। বাঁয়ে আঙুরবালা, পাশে ইন্দুবালা। ছবি সৌজন্য – facebook

নানা শখের মধ্যে, সিগারেট, দেশলাইয়ের খোল কেটে ঘরবাড়ি তৈরি করার শখ ছিল ইন্দুবালার। নিজেরই হাতে বানানো এমনই এক ছোট্ট বাড়ির নাম দিয়েছিলেন ‘ইন্দুবালা হাউস’। শিশুকাল থেকে, উত্তর কলকাতার যে অঞ্চলে একটু একটু করে বড় হয়েছিলেন, যে অঞ্চল সাক্ষী ছিল তাঁর জীবনের সমস্ত সুদিন, দুর্দিনের, সেই রামবাগানেই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত থেকেছিলেন তিনি। অধিক স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় কিংবা সমাজের মূলস্রোতে প্রবেশ করার প্রলোভনে অতীতকে অস্বীকার করেননি কোনও দিন। গভীর ভালবাসায়, মমত্ববোধে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সমাজপরিত্যক্তাদের, এগিয়ে এসেছিলেন নানা উপায়ে তাঁদের স্বনির্ভর করে তোলার ব্রতে; অকুতোভয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের ওপর শোষণ, অত্যাচারের বিরুদ্ধে। রামবাগান ইন্দুবালার সংগ্রামের সাক্ষী, সাক্ষী তাঁর শৈশবের সঙ্গীতশিক্ষার, তাঁর অসংখ্য সঙ্গীতাসরের, কাজী নজরুলের মতো বহু গুণীর আগমনের। এ অঞ্চলের যোগেন দত্ত লেনের বাড়িটিই ছিল তাঁর বার্ধক্যের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। 

“দুনিয়া সুদ্ধ সকলে বলে যে আপনি ভদ্রপল্লীতে যান, স্কুল করুন, আপনার জিনিস সব দান করুন, শেখান, ইত্যাদি ইত্যাদি। তা হয় নাকি… তিন পুরুষের বাস কি ভাঙতে পারি! পারবো না… শেষ জীবনে কোথায় মরব জানি না, তবু এই পাড়ায় মরবার আশা রাখি”, লিখেছিলেন ইন্দুবালা। তাঁর সে ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছিল। ১৯৮৪ সালের নভেম্বরের শেষ দিনে রামবাগানেই প্রয়াত হয়েছিলেন ইন্দুবালা। নিজের পরিচিতির সঙ্গে কৃত্রিমভাবে ‘ভদ্রতা’-র ছাপ আরোপের প্রতি কোনও দিন আকর্ষিত হননি ইন্দুবালা, অথচ আত্মসম্মানবোধে থেকেছেন চির-অটল। হুঙ্কারে জানিয়েছেন প্রতিবাদ, কখনও বা অল্প প্রাপ্তিতেও মেতেছেন আনন্দে। নিজেকে নিয়েই কখনও বা করেছেন হাসাহাসি। প্রথম যু্গের রেকর্ডে গানের শেষে ইংরাজিতে ওঁর বিখ্যাত ঘোষণা ‘মাই নেম ইজ ইন্দুবালা’ শ্রোতৃমহলে ওঁকে পরিচিত করে। এটিই ছিল তাঁর জানা একমাত্র ইংরাজি কথা — শেষজীবনের এক সাক্ষাৎকারে হাসতে হাসতে নিজেই স্বীকার করেছিলেন বহু ভাষায় গীত পরিবেশনে সম্যক ক্ষমতাময়ী, বহু ধারার সঙ্গীতে সুদক্ষা, বহু রাজদরবারে সম্মানিতা, অগণিত শ্রোতার অন্তরে স্থান করে নেওয়া সুরসম্রাজ্ঞী ইন্দুবালা দেবী!

সুরের আকাশে দীপ্ত ইন্দু পর্ব ২

জীবনে সবেমাত্র পেরিয়েছেন ছাব্বিশটি বসন্ত! বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সঙ্গীতসাধনায় রত। নেশা গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ। পত্রপত্রিকায় সঙ্গীতবিষয়ক বেশ কিছু নিবন্ধ লিখেছেন বাংলা ও ইংরাজিতে৷

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *