যথাসময়ে রেকর্ড হল। রেকর্ডের স্যাম্পল এসে পৌঁছল শিল্পীর হাতে। দুঃখে সেই রেকর্ড নিজে হাতে ভেঙে ফেললেন ইন্দুবালা। কারণ? রেকর্ড বাজানোর যন্ত্র তাঁর কাছে নেই। কোম্পানি থেকে গ্রামোফোন উপহার এল অভিমানী শিল্পীর বাড়িতে। প্রথম রেকর্ডের গানেই অবাক করা সাফল্য লাভ করেছিলেন ইন্দুবালা। ওঁর গাম্ভীর্যপূর্ণ অথচ মধুর, সুরেলা কণ্ঠের আবেদন সাড়া জাগিয়েছিল শ্রোতাদের মনে। ‘ওরে মাঝি’-র জনপ্রিয়তার কারণে এক সময় এ গান পুনর্বার রেকর্ড করতে হয়েছিল ওঁকে। তখন আরও পরিণত ইন্দুবালার গায়ন। গানের চারটি স্তবকের চার রকম ছবি স্বরক্ষেপণের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে কী অপূর্বভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন শিল্পী! উদাত্ত স্বরে মাঝিকে সম্বোধন করে আরম্ভ হলেও শেষপর্যন্ত এ গান আত্মকথনই।

তাই যখন ভাবগম্ভীর অথচ মৃদুস্বরে ইন্দুবালা গেয়ে ওঠেন, ‘ওই নদীর ওই ঘাটেতে এমনি সাঁঝে আমার প্রিয়া/ যেত ছোট কলসীটিরে কোমল তাহার কক্ষে নিয়া’, কিংবা ফুটিয়ে তোলেন সেই ঘাটেই প্রিয়ার শেষ স্মৃতির ছবি, ‘ওই নদীর ওই কূলে, তটিনীর ওই কোমল কূলে/ দিয়েছি সেই স্বর্ণলতায়, আপন হাতে চিতায় তুলে’, তাঁর আবেগঘন, অন্তর্মুখী উচ্চারণে নিমেষেই অনুভব করা যায় এ গানটির গভীরে থাকা তীব্র বিরহবেদনাকে। পুরুষের বয়ানে রচিত ‘ওরে মাঝি’, নারীকণ্ঠেও কীভাবে অর্থপূর্ণ হয়ে উঠে অন্তর স্পর্শ করতে পারে, তার প্রমাণ ইন্দুবালার এই রেকর্ড।

বিশের দশকের গোড়া থেকেই গ্রামোফোন কোম্পানি নিয়মিত প্রকাশ করতে থাকে ইন্দুবালার গানের আটাত্তর পাক রেকর্ড। ‘তুমি এস হে, তুমি এস হে’, ‘সর সর সুন্দর শ্যাম, আমি বারি লয়ে চলে যাই’, ‘আহা কত অপরাধ করেছি আমি চরণে তোমার মা গো’, ‘তীর্থবাসী হওয়া মিছে, মায়ের রাঙা চরণ ছাড়া রে মন’, প্রভৃতি গান শোনা যেতে থাকে রসিক শ্রোতার ঘরে ঘরে। রেকর্ডসঙ্গীতের এই আদিযুগে, বাঙালি শিল্পীদের বাংলা ভিন্ন অন্যান্য ভাষার গান রেকর্ড করার অধিকার ছিল না। কোম্পানির কর্তাদের ধারণা ছিল, বাঙালি শিল্পীরা অন্যান্য ভাষা যথাযথভাবে উচ্চারণ করতে পারেন না। এজন্য হিন্দুস্থানি মার্গসঙ্গীতে দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও ইন্দুবালার পূর্বেকার অনেক বাঙালি শিল্পী সে ধারার গান রেকর্ড করার সুযোগ পাননি। বাঙালি শিল্পী সম্বন্ধে কোম্পানির এই মনোভাবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান ইন্দুবালা। প্রতিবাদে বাংলা গান গাওয়াও বন্ধ করা স্থির করেন। সর্বজনপ্রিয় শিল্পীর এই অব্যর্থ প্রতিবাদের পরেই কোম্পানির হিন্দি রেকর্ড বিভাগ আর বাংলা রেকর্ড বিভাগের মধ্যে মধ্যস্থতার ফলে ইন্দুবালা সুযোগ পান হিন্দি গান রেকর্ড করার। নিজের গায়নদক্ষতা এবং উচ্চারণের শুদ্ধতা সম্বন্ধে অসচেতন ছিলেন না গহরজানের এই শিষ্যা!

Indubala
মৈসোরের রাজসভাগায়িকা মনোনীত হয়েছিলেন ইন্দুবালা। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

বিশের দশকের শেষভাগে প্রকাশিত কাফি রাগে ‘জগ ঝুঠা সারা সৈয়াঁ’ আর মান্দ-এ ‘বিষয় বাত মম’ গানদুটি ইন্দুবালারই প্রথম হিন্দি গানের রেকর্ড নয়, বাঙালি শিল্পীর রেকর্ড করা প্রথম অ-বাংলা গান। এই রেকর্ডটির হাত ধরেই বাঙালি শিল্পীর দক্ষতার পরিচয় পৌঁছয় বাংলার ভৌগোলিক সীমার বাইরে। একে একে বাংলার অন্যান্য গুণী শিল্পীরাও পেতে থাকেন বিভিন্ন ভাষায় গান করার সুযোগ। এরপর বহু হিন্দি ও উর্দু ঠুংরি, দাদরা, চৈতি, গজল, নাৎ প্রভৃতি রেকর্ড করেছিলেন ইন্দুবালা। লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে অদ্যাবধি বহুজনপ্রিয় ঠুংরি ‘মোহে পনঘট পে নন্দলালা’ এক সময় এমনই জনপ্রিয় ছিল ইন্দুবালার কণ্ঠে! আবার বহুশ্রুত ‘মোমের পুতুল মমির দেশের মেয়ে নেচে যায়’, ‘দূর দ্বীপবাসিনী, চিনি তোমারে চিনি’, ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর, নমো নমো’ গান তিনটির সুর কাজী নজরুল ইসলাম আহরণ করেছিলেন ইন্দুবালা-গীত বিখ্যাত তিনটি গান যথাক্রমে ‘বাঁকি রসিলি নঈ পনহারি পনঘট পর জল ভরনেকো যায়’, ‘শ্যাম গিরিধারি তোসে কৈসে ম্যায় মিলুঁ’ ও উর্দু নাত ‘যব নূর-এ-খুদা হামকো দুবারা নজর আয়া’-র থেকে! গ্রামোফোন কোম্পানিতে হিন্দি, উর্দু গান রেকর্ড করার সূত্রেই ইন্দুবালা সংস্পর্শে এসেছিলেন ওস্তাদ জমিরুদ্দিন খাঁ-র। ওস্তাদ মৈজুদ্দিন ও গহরজানের শিষ্য বিশিষ্ট ঠুংরি গায়ক ওস্তাদ জমিরুদ্দিন তখন কোম্পানির প্রধান প্রশিক্ষক। ওঁরই তত্ত্বাবধানে নানা ধারার হিন্দি, উর্দু গানের শিক্ষা নেন ইন্দুবালা। শিক্ষা নেন মৈজুদ্দিনের ঠুংরিরও। সঙ্গীতের বিষয়ে অতি যত্নশীল অথচ কঠোরস্বভাব ওস্তাদ জমিরুদ্দিনের কাছে ইন্দুবালারই মতো, শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।

গত শতকের তৃতীয় দশকের শেষদিকে, গ্রামোফোন কোম্পানির প্রধান প্রশিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা গজলের পথিকৃৎ কাজী নজরুল তখনই গজল-অঙ্গের গান তুলে দিয়েছিলেন ইন্দুবালার কণ্ঠে – ‘রুমুঝুম রুমুঝুম কে এলে নূপুর পায়ে’। এ গানের মধ্য দিয়েই ইন্দুবালার নজরুলগীতি রেকর্ড করার সূচনা। তখন ১৯২৯ সাল। এরপর একে একে ‘কেন আনো ফুলডোর আজি বিদায়বেলা’, ‘এ আঁখিজল মোছো প্রিয়া, ভোলো ভোলো আমারে’, ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর, নমো নমো’, ‘কেউ ভোলে না কেউ ভোলে অতীত দিনের স্মৃতি’, ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে কুড়াই ঝরাফুল’, ‘নিরজনে সখি বলো বঁধূয়ারে’, প্রভৃতি নজরুল-সৃষ্ট গজল অঙ্গের গান প্রকাশিত হয় শিল্পীর কণ্ঠে। প্রকাশিত হয় ঠুংরি, ভজন, ইত্যাদি ধারার নজরুলগীতিও। এক সময় ইন্দুবালার অনন্য পরিবেশনে বিখ্যাত হয়েছিল তিলং রাগাশ্রিত ঠুংরি ‘এ সজন তুম কাহেকো নেহা লগায়ে’। একই অঙ্গে ও রাগে, ওঁর জন্য কাজী নজরুল রচনা করেন ‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’, যা সে সময়ে জনপ্রিয় হয়েছিল তো বটেই, আজও বহুশ্রুত।

Indubala
গান রেকর্ডিং করছেন ইন্দুবালা দেবী। সঙ্গে রয়েছেন আর এক দিকপাল গায়িকা আঙুরবালা এবং হারমোনিয়মে উস্তাদ জমিরুদ্দিন খান সাহেব। ছবি সৌজন্য – facebook.com

মার্গসঙ্গীতের ঘরানা থেকে রেকর্ডজগতে আসা ইন্দুবালার মতো শিল্পীদের কণ্ঠমাধ্যমে শুনে, কাজী নজরুল আপন খেয়ালে করা নানা সাঙ্গীতিক পরীক্ষানিরীক্ষার শ্রুতিমাধুর্য ও যাথাযথ্য সহজেই পরখ করে নিতেন। কখনও বা সরাসরি জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতেন কোনও গানের সুর কেমন হয়েছে। ইন্দুবালা লিখেছিলেন, “কাজীদার গানের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যগুলি আমার সবচেয়ে ভালো লাগত তা হল, গানে ঠুংরির ঢং আর গানের লয়কারি। হিন্দি গানের ভাঙা সুরও চমৎকারভাবে গানে জুড়ে দিতেন কাজীদা। এ ছাড়া গজলের মত শায়র-ঢঙে সুর রচনা করে তিনি গায়ক ও শ্রোতাকে মাতিয়ে তুলতেন। ফলে আমরা যারা খেয়াল ও ঠুংরির গানের জগৎ থেকে বাংলা গানের আসরে এসেছিলাম তারা কাজীদার গানের মধ্যে বেশ রগড় আর সুরের মজা পেয়ে গেলাম।”

কাজী নজরুলের গানের সুরবৈচিত্র সম্বন্ধে যেমন একরাশ মুগ্ধতা ছিল ইন্দুবালার, তেমনই ছিল কবির গানের কাব্যিক মূল্য নিয়ে। দীর্ঘদিন কাজী নজরুলের সান্নিধ্যলাভের কারণেই হয়তো বা ওঁর সযত্ন মনযোগ ছিল গানের কাব্যমূল্যের দিকে। সুরের সাম্রাজ্যে ওঁর অসামান্য দক্ষতা কাব্যকে অবহেলার ধাক্কায় কখনওই সরিয়ে রাখেনি। এর প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে ত্রিশের দশকে প্রকাশিত ইন্দুবালার গানের অসংখ্য রেকর্ডে। খেয়াল কিংবা ঠুংরি অঙ্গের গানে শিল্পী যেমন অসামান্য আলাপ, বিস্তার, তানে সুরের রেশটি ধরে রেখেছেন দক্ষ হাতে, তেমনই উচ্চারণের দার্ঢ্য, পেলবতায়; মীড়, গমকের সুচিন্তিত প্রয়োগে আর আন্তরিক পরিবেশনে অক্ষুণ্ণ রেখেছেন কাব্যিক মূল্য। বাংলা গানে তো বটেই, মূলধারার রাগসঙ্গীতেও ইন্দুবালা বজায় রেখেছেন ওঁর এই বৈশিষ্ট্য, যা এ ধারার গানে সর্বক্ষেত্রে লক্ষিত হয় না। সুর ও বাণীর মধ্যে মনযোগের এই অপূর্ব বণ্টনে শিল্পীর গান শ্রুতিমধুরই শুধু নয়, হৃদয়স্পর্শী হয়ে উঠেছে সবসময়।    (চলবে)

পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৭ ডিসেম্বর।

সুরের আকাশে দীপ্ত ইন্দু: পর্ব ১

জীবনে সবেমাত্র পেরিয়েছেন ছাব্বিশটি বসন্ত! বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সঙ্গীতসাধনায় রত। নেশা গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ। পত্রপত্রিকায় সঙ্গীতবিষয়ক বেশ কিছু নিবন্ধ লিখেছেন বাংলা ও ইংরাজিতে৷

6 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *