মাত্র ৩০০টাকা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন পনেরো বছরের কিশোরী| কেমন করে অন্ন সংস্থান করবেন তার কোনও ধারণা ছিল না| কিন্তু হার মানতে শেখেননি চিনু কালে| বাড়ি বাড়ি ঘুরে জিনিস বিক্রি থেকে রেস্তোরার ওয়েট্রেস থেকে এখন সফল ব্যবসায়ী অনেকটা পথ হেঁটেছেন উনি|

‘আজকে যদি কেউ আমাকে প্রশ্ন করে কোথা থেকে আমি সাহস সংগ্রহ করেছিলাম‚ তার উত্তর নেই আমার কাছে| শুধু জানতাম কিছু একটা করতে হবে| সেই সময় আমার মাত্র দু’জোড়া পোশাক ছিল আর এক জোড়া চটি| প্রথম দু’দিন আমি প্রচন্ড ভয়ের মধ্যে ছিলাম| কয়েক দিন লেগেছিল নিজেকে গুছিয়ে নিতে| অনেক চেষ্টার পর মাথার ওপর ছাদ খুঁজে পেয়েছিলাম|’ চিনু স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন|

যেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছিলেন চিনু সেখানে ওঁর সঙ্গে আরও অনেকে থাকত| প্রতি দিন সেখানে ২০টাকা করে দিলে তবেই শোয়ার জন্য একটা তোষক পাওয়া যেত| চিনু প্রথম দিকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছুড়ি‚ কাঁচি বিক্রি করতেন| এই ভাবে প্রতি দিন উনি ২০ থেকে ৬০টাকা রোজগার করতেন|

চিনুর কথায় ‘একটা জিনিস মনে রাখতে হবে সময়টা ছিল নয়ের দশকের শেষ দিকে| এখনকার থেকে সম্পূর্ণ অন্য সময় ছিল সেটা| তখন খুব সহজেই বাড়ি বাড়ি যাওয়া যেত জিনিস বিক্রি করার জন্য| কিন্তু যখনই আমার মুখের ওপর কেউ দরজা বন্ধ করে দিত আমি ভেঙে না পড়ে আরও দৃঢ়ঢচেতা হতাম|’

এক বছরের মাথায় চিনুর পদোন্নতি হয়| আরও তিন জন মেয়েকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ দেওয়া হয় ওঁকে| চিনুর কথায় ‘আমাকে সুপারভাইজার করে দেওয়া হল| ফলে আমার মাইনেও বাড়ে| ওই তিন জনকে প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে আমিও অনেক কিছু শিখলাম|’

ছোট থেকেই চিনু নিজে স্বাধীনভাবে কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন| কিন্তু ১৫ বছরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার ফলে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি| তবে কাজে করতে গিয়ে বহু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে যা ওঁকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।

পরে একটা রেস্তোরাঁয় ওয়েট্রেসের কাজ নেন চিনু| ‘আমাকে রোজ ৬টা থেকে ১১টা অবধি কাজ করতে হত| কঠিন পরিশ্রম করতে হত| কিন্তু আমি হার মানতে নারাজ ছিলাম| আরও কঠিন পরিশ্রম করতাম| তিন বছরের মধ্যে আমি যথেষ্ট টাকা জমিয়ে ফেলতে সক্ষম হই|’

২০০৪ সালে অমিত কালে নামের এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয় চিনুর| বিয়ের পর বেঙ্গালুরুতে পাড়ি দেন ওঁরা| এর দু’বছর বাদে মিসেস ইন্ডিয়া প্যাজেন্টে অংশগ্রহণ করেন চিনু| এই প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে চিনু বলেন ‘বাকিরা সবাই সুপার অ্যাচিভার ছিলেন| আর আমি পড়াশোনা অবধি শেষ করিনি| ভীষণ ভয় করছিল আমার| কিন্তু তা-ও মাথা নত করিনি| আমার জীবনে যে সব অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা সেই সময় কাজে লেগেছিল|’

মিসেস ইন্ডিয়ার চূড়ান্ত পর্যায় গিয়ে বাদ যান উনি| কিন্তু এর ফলে অন্য সুযোগ আসে চিনুর কাছে| ‘আমি ফ্যাশন নিয়ে বরাবর আগ্রহী ছিলাম| কিন্তু টাকা ছিল না শখ পূরণ করার|’ বলেন চিনু| মিসেস ইন্ডিয়া-য় অংশগ্রহণ করার ফলে মডেল হিসেবে পরিচিতি পান। ফ্যাশন ইন্ড্রাস্ট্রিতে কাজ করতে গিয়ে চিনু দেখলেন ফ্যাশন জুয়েলারির প্রচণ্ড চাহিদা আছে কিন্তু সেই ভাবে সরবরাহ নেই| তখনই নিজের জুয়েলারি ব্র্যান্ড আরম্ভ করার কথা ভাবেন উনি| 

চারু বলেন ২০১৪ সালে যখন আমি আমার সংস্থা আরম্ভ করেছিলাম| বেঙ্গালুরুতে একটা ৬ফুট বাই ৬ ফুট ঘর জোগাড় করা বেশ কঠিন ছিল| ছ’মাস লেগেছিল একটা জায়গা খুঁজতে|’

পাশ্চাত্য ও দেশি দুই ধরনের নকল গয়নাই আছে চারুর কালেকশনে| গয়নার দাম ২২৯ থেকে ১০,০০০টাকা অবধি| বেঙ্গালুরু ছাড়াও কোচি আর হায়দরাবাদ এই জুয়েলারি ব্র্যান্ডের দোকান আছে| ব্যবসা দাঁড়াতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছে| অনেকে বার প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছে ওঁকে| কিন্তু ভেঙে না পড়ে চারু লড়ে গেছেন| অবশেষে লাভের মুখ দেখেছেন | ওঁর কথায় ‘ ২০১৬-১৭ সালে ৫৬ লক্ষ টাকার ব্যবসা হয়| এর পরের বছর তা বেড়ে সাড়ে তিন কোটি টাকা হয়| গত বছর আয় হয় সাড়ে সাত কোটি টাকা|’

‘আমার বিশ্বাস রোজই আমরা কিছু না কিছু শিখতে পারি| আমি কোনও দিন ভুলব না কোথা থেকে আমি আরম্ভ করেছিলাম| আজ আমি ২৫জনকে মাইনে দিয়ে রেখেছি| আমি সব সময় কঠিন পরিশ্রমে বিশ্বাস করি| একই সঙ্গে নিজের ওপর বিশ্বাস হারাইনি আমি| যারা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেন আমি তাঁদের পাশে থাকব|’ জানিয়েছেন চারু|

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *