আজ থেকে প্রায় নব্বই বছর আগের কথা। ১৯৩১ সাল। জুন মাসের প্রচণ্ড দাবদাহ। জীবনে প্রথম একা একা রেলগাড়িতে চেপে চললেন এক তরুণী। গন্তব্য বোলপুর। লিখছেন,
‘সেই প্রথম দিনের যাত্রাটা আমি কখনো ভুলব না; তারপর হয়তো তিনশোবার ঐ ট্রেনে ঐ পথে গিয়েছি তবু সেই সাবেকি মোহটুকুর একটুখানি এখনো মনে লেগে আছে।’ বর্ণনা দিয়েছেন এমন, ‘খানা স্টেশন পেরিয়ে যেই না লুপ লাইন ধরা, অমনি সমস্ত জগৎটা গেলো বদলিয়ে। চেয়ে দেখলাম লালমাটি থেকে তখনো খরা যায়নি, বর্ষা সবে শুরু হয়েছে। গাছপালার সব অন্য চেহারা শাল, শিমুল, পলাশ, মহুয়া; ছোট ছোট পুকুরের চারিদিকে তালগাছ, বেঁটে বেঁটে খেজুর গাছ, মনসা গাছ। বাতাসেও যেন অন্য গন্ধ।’
এমন শোভা দেখতে দেখতে বিকেলে পৌঁছে গেলেন বোলপুর স্টেশনে। তাঁর জন্য ধীরেন্দ্রমোহন সেনকে পাঠানো হয়েছিল স্টেশনে। সঙ্গে অনঙ্গবাবুর ট্যাক্সিটাও। লড়ঝড়ে ট্যাক্সিতে চেপে ঝড়ঝড় করতে করতে পৌঁছে গেছিলেন মেয়েদের বোর্ডিং শ্রীভবনে। এরপর এল সেই মুহূর্ত। ‘আমাকে সোজা উত্তরায়ণের দক্ষিণের একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হল।’ সে ঘরেই তিনি পড়তেন, লিখতেন, ছবি আঁকতেন। এর আগে অবশ্য দু’জনের দেখা যে হয়নি, তা নয়।
শিলংয়ে থাকতেই দেখা হয়েছিল। শিলংয়ের ‘কেঞ্চেস ট্রেস’ অঞ্চলে একটি বাড়িতে বেশ কয়েকদিন সদলবলে থেকেছিলেন কবি। লীলা মজুমদার স্মৃতিচারণে লিখেছেন,
‘নিজে তাঁর ‘পুরাতন ভৃত্য’ পড়ে শুনিয়েছিলেন। শুনে আমরা মুগ্ধ। এমন মজা করে এমন মজার কবিতা কাউকে কখনো পড়তে শুনিনি। এমনি নির্বোধ ছিলাম তখন যে ঐ কবিতার বেদনার দিকটাই বুঝিনি তা কবিকে বুঝব কি করে!’ ছেলেবেলায় দেখা সেই স্মৃতিকথায় ছিল, ‘এমন সুন্দর বুড়ো মানুষও দেখিনি কখনো। আমাদের কনভেন্টে যীশুর যেসব ছবি আর মূর্তি ছিল, এ যেন তার চেয়েও সুন্দর। কি মিষ্টি গলার আওয়াজ! বলাবাহুল্য খুব একটা বেশি বয়সও ছিল না তাঁর, বড়জোর ৫৫ বছর। আমাদের কাছে সেই যথেষ্ট!’

সেদিন উত্তরায়ণের দক্ষিণের ঘরে ঢোকার সময় তবু মেয়েটির বুক ঢিপঢিপ করছিল। আসলে ‘এত কাছে থেকে একলা তাঁকে দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না’ এমন স্বীকারোক্তি করেছেন। প্রণাম করলেন কবিকে। কবি পাশের মোড়ায় বসতে বললেন। কথা শুরু হল।
‘প্রথমে ভেবেছিলাম আশা এক বছরের জন্য চলে যাচ্ছে, তোমার ঘাড়ে শিশু বিভাগ চাপাবো।’ আশা মানে আশা অধিকারী, পরে আর্যনায়কমের সঙ্গে যাঁর বিয়ে হয়। ‘তারপর ভেবে দেখলাম তার চাইতে আমার কলেজের বিএ ক্লাসে ইংরেজি অনার্স পড়াও আর যারা ম্যাট্রিক দেবে তাদের অঙ্ক কষাও।’
এমন প্রস্তাব শুনে মেয়েটি ভাবল ‘গুরুদেব যদি বলতেন কলাভবনের ছেলেদের রাঁধতে শেখাও, তাতেও আমি আপত্তি করতাম না।’ আসলে মেয়েটির মনের উপরে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের প্রভাব এতটাই গভীর ছিল, যে কবি যা করতে বলতেন প্রসন্ন মনে তা গ্রহণ করা তার পক্ষে সহজ ছিল। হ্যাঁ, সেদিনের সেই মেয়েটিই পরে লীলা মজুমদার নামে বিখ্যাত সাহিত্যিক হন।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং সম্পর্ক গড়ে ওঠার আদিকালে জানা যায়, লীলার ছেলেবেলায় অটোগ্রাফ সংগ্রহের নেশা ছিল। প্রশান্তকুমার মহলানবিশের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে পাঠিয়েছিলেন একটি খাতা। কবি সেই খাতায় লিখে দিয়েছিলেন একটি ছড়াও…
‘নামের আখর কেন লিখিস
নিজের সকল কাজে?
পারিস যদি প্রেমের আখর
রাখিস জগৎ মাঝে।’
স্বাক্ষর দিয়ে কবি তারিখ লিখেছিলেন ১লা আশ্বিন, ১৩২৯।

এই রবীন্দ্রনাথই ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় লীলার গল্প পড়ে চিঠি লিখেছিলেন লীলাকে। ‘তুমি ছোটদের জন্য সন্দেশ পত্রিকায় যে সব গল্প লেখ, আমি সেগুলো পড়ি। তুমি এক বছরের জন্য শান্তিনিকেতনে এসে, এখানকার শিশুবিভাগের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের কিছু শিখিয়ে দাও। যার হাতে এ কাজের ভার ছিল সে এক বছরের ছুটি নিয়েছে, সে ফিরে এলে তোমার যেমন ইচ্ছে হবে তাই করবে।’
লীলা মজুমদার তখন এমএ পাস করে দার্জিলিংয়ের মহারানি গার্লস স্কুলে পড়াতেন। কবির কাছ থেকে এমন প্রস্তাব পেয়ে তিনি অভিভূত হয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে দারুণ গরমের মধ্যে চলে গিয়েছিলেন বোলপুরে। শান্তিনিকেতনে এক বছর পড়ানোর অভিজ্ঞতা লীলা মজুমদার লিখেছিলেন তাঁর ‘আর কোনখানে’ আর ‘পাকদণ্ডী’ বইতে। শান্তিনিকেতনে পড়ানোর অভিজ্ঞতা লীলাদেবীর জীবনে যতটা আনন্দ দিয়েছিল, তারই পাশাপাশি অনেক অপ্রীতিকর ঘটনাও তাঁকে দুঃখিত এবং বিচলিত করেছিল।

একবার এই ব্যাপারে লীলা রবীন্দ্রনাথের কাছে রাগে-দুঃখে ফেটে পড়েছিলেন। সব শুনে রবীন্দ্রনাথ অভয় দিয়ে বললেন, ‘তাতে কী হয়েছে? তোমার গায়ে কি ফোস্কা পড়েছে? না আমি কিছু বলেছি?’ এরপর পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘আসলে নিজে ঠিক থেকো। কে কী বলল না বলল তাতে কিচ্ছু এসে যায় না।’ এ কথা শুনে সেদিন লীলার মন শান্ত হয়েছিল। এই সময়ে কবির সান্নিধ্য পেয়েছেন প্রায় রোজই এবং সেই স্নেহের উপহারস্বরূপ কবির লুচি-তরকারি-সন্দেশের ভাগও পেয়েছেন নিয়মিত।
এই মানুষটাই আবার স্বীকার করেছেন, ছেলেবেলায় তাঁদের বাড়িতে উঁচু তাকে নাগালের বাইরে রাখা ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘খেয়া’ কাব্যগ্রন্থটি। তা একবার একটু আচার রাখার জন্য ছোট্ট লীলার দরকার পড়েছিল কাগজের। ‘টুলের উপর দাঁড়িয়ে বইয়ের মধ্যেখান থেকে আধখানা পাতা ছিঁড়ে আচার রেখেছিলাম।’ এই নিয়ে বাড়িতে তাঁকে অনেক বকাবকি করেছিলেন অভিভাবকরা। ‘তখন শুনলাম তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ।’ বড় হয়ে সেদিনের এই কথা মনে পড়তেই খুব লজ্জা পেতেন লীলা।
রবীন্দ্রনাথের ৭০ বছরের জন্ম-জয়ন্তী উপলক্ষে ‘নটীর পূজা’ অভিনীত হল। ‘আমাকেও নিয়েছেন গুরুদেব ছোটো ভূমিকায়। ‘নটীর পূজা’য় আমি হলাম ভিক্ষুণী উৎপলপর্ণা।’ শেষ মহড়ার সময় রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদালানের এক মাথায় দাঁড়াতেন, আর বাকিরা দাঁড়াতেন অন্য মাথায়। নিউ থিয়েটার্স সেই অভিনয়ের ফিল্ম তুলেছিল। কবির কাছে সেটা ছিল নিউ থিয়েটার্সের বিশেষ অনুরোধ। তাই রাজি হয়েছিলেন।

তখন নিউ থিয়েটার্স খুব বেশি দিন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ‘বাংলা সবাক-চিত্রও তার নতুনত্ব হারায়নি, এমনি সময় ‘নটীর পূজা’ তোলা হল। তাও আবার স্টেজ প্রোডাকশনের ছবি, না আছে তাতে সিনারি না আছে যথেষ্ট জনগণোপযোগী রস-রসিকতা। শেষ পর্যন্ত যখন ছবি রিলিজ হল, জনতা রেগেমেগে চেয়ার ভেঙে, আলো ফাটিয়ে, টিকিটের দাম ফেরৎ চাইতে লাগল।’ এই সংবাদ পরিবেশন লীলা মজুমদারের নিজের। তখন তিনি লীলা রায়। আর রায় থেকে মজুমদার হয়ে ওঠার কালেই এই বিপত্তি, যা প্রমদারঞ্জনের জীবৎকালে ঘোচেনি।
এরপর লীলার জীবনে এল এমন একটি দিন যার জন্য তাঁকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল যাকে একাধারে পরম ও চরম আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। ডাক্তার সুধীন কুমার মজুমদারের সঙ্গে পারিবারিক যোগসূত্রের ফলে গোড়া থেকেই তাঁকে মনে ধরেছিল তরুণী লীলার। পছন্দ অবশ্য উভয়েরই ছিল। পাত্র হিন্দু, তাই বেঁকে বসলেন লীলার গোঁড়া ব্রাহ্ম বাবা প্রমদারঞ্জন রায়। বাবার অমতেই বিয়ে হল তাঁদের। হ্যাঁ, সই করে। পিতৃপদবী রায় বদলে হল মজুমদার।

বাবার অনড় ভাবের প্রতিক্রিয়ায় লীলা লিখছেন, ‘বাবা আমাকে ত্যাগ করলেন। পরদিন সকালে সব কথা ভুলে দুজনে গেলাম বাবাকে প্রণাম করতে। তিনি আমাদের দেখেই ঘর থেকে উঠে চলে গেলেন। শুধু ঘর থেকেই নয়, আমার জীবন থেকেই সরে পড়লেন।’ এরপর প্রমদারঞ্জন আরও আঠারো বছর বেঁচে ছিলেন, কিন্তু কখনও আর লীলা বা তাঁর ছেলে-মেয়ের দিকে ফিরেও চাননি। দীর্ঘ আঠারো বছর পরে তিনি যখন চোখ বুজলেন… লীলা এতটুকু ব্যক্তিগত অভাব বোধ করেননি। ‘যে অভাব, যে বেদনা ছিল, ঐ সময়ের মধ্যে তার মৃত্যু হয়েছে টের পেলাম।’ লিখেছেন লীলা।
এই বিয়ের দিন কলকাতায় প্রবল বৃষ্টি হয়েছিল। চারিদিকে জল জমে যায়। এমন জমা জলের মধ্যে ‘স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন। অবিশ্যি খাননি। সেকালে গাড়িও উঁচু হত। তাই আসতে পারলেন। রবীন্দ্রনাথের নিজের নকশায়, নিজের হাতে তৈরি ছোট একটি চামড়ার হ্যান্ডব্যাগ উপহার দিয়েছিলেন।’ সে উপহার তাঁর কাছে চিরকাল সমর্যাদায় সযত্নেই ছিল।
*ছবি সৌজন্য: wikipedia, britannica.com, parabaas
গ্রন্থঋণ:
১) ‘আর কোনখানে’: লীলা মজুমদার
২) ‘পাকদণ্ডী’: লীলা মজুমদার
৩) ‘এক বছরের গল্প’: লীলা মজুমদার
৪) ‘কোরক‘ সাহিত্য পত্রিকা, লীলা মজুমদার সংখ্যা
৫) ‘এক্ষণ’ ১৩৯৩ বার্ষিক সংখ্যা
৬) রবিজীবনী (বিভিন্ন খণ্ড): প্রশান্তকুমার পাল
৭) রবীন্দ্রজীবনী (বিভিন্ন খণ্ড) : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
৮) রবীন্দ্রনাথ ও রায় পরিবার: প্রসাদরঞ্জন রায়
প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।
অসাধারণ, লেখকের লেখা পড়ে আমরা পুনরায় সমৃদ্ধ হলাম। শ্রদ্ধা জানাই সেই মহীয়সী লেখিকাকে ও 🙏🙏