একদা ছাত্র, এখন অন্তরঙ্গ বন্ধু-অধ্যাপক দীপঙ্করের তোলা কুয়াশামাখা লাভার মায়াময় ছবি দেখে বহুকাল বাদে মনটা নেচে উঠল। দীপঙ্কর তখন সপরিবার লাভায় বেড়াতে গিয়েছেন। রয়েছেন ফরেস্টের কটেজেই। তৎক্ষণাৎ যাবার দিন স্থির করে ওকে ফোনে বললাম, ওখানে সবথেকে নিরিবিলি কটেজ কোনটা, জানাতে। সেই বুঝে বুকিং করে নেব। বেশি হাঁটাহাঁটিতে যাদের আপত্তি তাদের জন্য বাইরের দিকে রাস্তার ধারের কটেজগুলোই সুবিধের। আমরা যেহেতু এখনও ধকল সইতে পারি, ফলে দীপঙ্কর ওখানকার বিট অফিসার সাগর ছেত্রির সঙ্গে কথা বলে জানাল ‘ডুকপা এক নম্বর’টা বুক করতে। 

‘তবে মনে রেখো তোমাদের কপালে কিন্তু  প্রচুর ওঠানামা আছে’, ফোনে বেশ চিন্তিত শোনাল অধ্যাপকমশাইকে। জানুয়ারির একেবারে প্রথমেই দার্জিলিং মেলে চেপে বসলাম কর্তা-গিন্নিতে। এনজেপি থেকে গাড়ি ঠিক করাই ছিল। চালক নিলয় ভদ্রসভ্য ছেলে। প্রথমেই জানতে চাইল আলগড়া না গজলডোবা, কোনটা হয়ে যেতে চাই। গজলডোবা শুনেই কান খাড়া হল, পরিযায়ী পাখির জন্য বিখ্যাত জায়গাটা না? তাহলে একবার দেখে নেওয়া যাক। 

তিস্তা নদীর ওপর মস্ত বাঁধ, দু’ধারে প্রকাণ্ড জলাশয় আর ছোট ছোট দ্বীপের মতো, যেখানে এই শীতে পাখিদের হাট বসেছে। ওদের ভালভাবে দেখতে হলে জলের ধার দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করতে হয়। হাতে একটা গোটা দিন থাকলে ভাল, সঙ্গে জাঁদরেল বাইনোকুলার রাখাটাও জরুরি। তাছাড়া পাখিগুলোকে চেনা যায় এমন ছবি তুলতে গেলে গলায় ইয়া বড়কা মাইক্রোলেন্সওয়ালা ক্যামেরা ঝোলাতেই  হবে, নাহলে কিন্তু সবই বৃথা। আমরা স্রেফ ঢুঁ মারতে এসেছি, ফলে দূর থেকে পাখিদের জটলার শুধু একটু আভাস ঈঙ্গিত পেয়েই ধন্য হলাম

একপাশে বড় মাঠে সার দেওয়া সব খাবারের দোকান রয়েছে। গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমরা একটাতে বসলাম নাস্তা করতে। চায়ের সঙ্গে চিরাচরিত ডিমটোস্ট, সঙ্গে গরম গরম লঙ্কার বড়া। এবার চল পাহাড়ের দিকে, ওদলাবাড়ি হয়ে গরুবাথান ছাড়াতেই নেওড়াভ্যালির মধ্যে দিয়ে রাস্তা ওপরে উঠতে শুরু করল। পাহাড়ের কাছে এলেই মন যথারীতি চনমনে হয়ে ওঠে, গাড়ি থামিয়ে পাহাড়ের ব্যাকগ্রাউন্ডে নিজেদের ছবি তোলালাম নিলয়কে দিয়ে। এসব ক্ষেত্রে আবার সেলফি ঠিক চলে না। 

Lava Forest Officer
লাভার বনবিভাগের বিট অফিসার সাগর ছেত্রী

লাভায় পৌঁছতে প্রায় দুটো বাজল, বনবিভাগের চৌহদ্দিতে ঢোকার মুখেই রিসেপশন। দেখলাম সাগর ছেত্রী হাজির। ও-ই এখানকার ইন-চার্জ। আগে ওর বাবা এই দায়িত্বে ছিলেন, হঠাৎ মারা যাওয়াতে ছেলে হিসেবে কিছুদিন হল সাগর সেই কাজটা পেয়েছে। ছোকরা বেশ বিগলিত হয়ে আমাদের ওয়েলকাম জানাল। দীপঙ্কর স্যারের দোস্ত বলে কথা! বেশ কয়েকবছর দার্জিলিংয়ের কলেজে পড়ানোর সুবাদে নেপালি ভাষাটা যথেষ্ট রপ্ত দীপঙ্করের, পাহাড়ের হাল হকিকত সম্পর্কেও বেশ ওয়াকিবহাল, বুঝলাম সাগরের সঙ্গে ওর জমেছিল ভালই।

সাগর নিজেই আমাদের পৌছে দিল ‘ডুকপা এক নম্বর’ কটেজে। দেখেশুনে মনে হল আহা  এমনটিই তো চেয়েছিলাম! জঙ্গলের একেবারে শেষপ্রান্তে পাহাড়ের ধারে  প্রায় অদৃশ্য হয়ে থাকা একহারা কাঠের বাড়িটা বাকি কটেজগুলোর থেকে নিজেকে যেন কিছুটা দূরে সরিয়ে রেখেছে। উল্টোদিকের পাহাড়গুলোর মাঝখান দিয়ে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে লাভা গুম্পার মাথাটা, আর আছে শুধু পাখির আওয়াজ। কটেজের সরু বারান্দা বা সামনের খোলা জায়গায় গা এলিয়ে বসে কাটানো যায় সারাদিন। তবে সেটা আপাতত মুলতুবি রেখে আমরা বেরিয়ে পড়লাম লাঞ্চ সারতে।

বাজারের মোড় যেতে হলে ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে আবার কিছুটা উঠে বাইরের রাস্তায় গিয়ে সোজা নামতে হয়। তবে বেলা তিনটের সময়ও কনকনে ঠান্ডা, তাই হাঁটাহাঁটি করতে আমাদের একেবারেই কষ্ট হচ্ছিল না। ভালো পর্কের দোকানের খোঁজ করতেই সবাই একবাক্যে দেখিয়ে দিল ‘হোটেল চিপ অ্যান্ড টেস্টি’। ছোট্ট দোতলা বাড়ির একতলায় একটা কেবিনে খানতিনেক টেবিল পাতা, পাশে ছ্যাঁকছোঁক করে রান্না হচ্ছে। মালকিন পুষ্পা এগিয়ে আসতেই আগে মোমো অর্ডার দিলাম। 

উল্টোদিকে একজন দেখি পর্কের বড় বড় টুকরো দেওয়া ঝোল মেখে ভাত খাচ্ছে। বললাম, ওটাও খাব। লোকটির নাম জোসেফ। গাড়ি চালায় এবং পুষ্পার বর। যাবার সময় বলে গেল গাড়ির দরকার হলে খবর দিতে। পুষ্পার হাতের রান্না চমৎকার, সাদামাটা দোকান তাই দামও সস্তা। বলে এলাম, ‘রোজ কিন্তু এই পর্কের লোভে আসব।’ জিপস্ট্যান্ড থেকে একটা রাস্তা ওপরের দিকে উঠেছে। অন্যটা নেমে গেছে দোকানবাজারের মধ্যে দিয়ে গুম্পার দিকে, যেখানে আমরা গতবারে এসে ছিলাম। আমরা হাঁটা লাগালাম ওপরের দিকে। 

Lava driver
খাওয়াতে ব্যস্ত জোসেফ

কিছুটা এগিয়ে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম স্কেচ করতে। গিন্নি একটা দোকানে ঢুকে কফির অর্ডার দিলেন। দেখলাম এটা শুধু কফি শপ নয়, নানারকম কিউরিও আর উলের জিনিসও পাওয়া যায়। গিন্নি একটা সুন্দর লাল টুপি পছন্দ করেও দোনামোনা করতে লাগলেন। এদিকে দোকানের মাঝবয়সি হাসিখুশি মহিলাটিও খদ্দের হাতছাড়া করতে একেবারেই  নারাজ এবং শেষে তিনিই জিতলেন। এরপর থেকে সব ছবিতেই গিন্নির  মাথায় সেই টুপি একদম কায়েম হয়ে বসল।

তিনরাত লাভায় ছিলাম। প্রতিদিন সন্ধ্যে নামার পর ফিরে এসে কটেজের সামনে আলো আঁধারির মধ্যে বসে এক অলৌকিক নিস্তব্ধতা উপভোগ করে কাটিয়েছি। আমাদের এই অংশটায় নীচের দিকে নাথুলা ফরেস্ট ক্যান্টিন আছে। দিনেরবেলা বন্ধই পড়ে থাকে। তবে আগে থেকে বলে রাখলে  রাতের খাবার ওখান থেকেই বানিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দেয়।

এখন টুরিস্ট প্রায় নেই। ফলে ভাল কুকদের ছুটি দিয়ে আনাড়িরা কাজ চালায়। বেশিরভাগ জায়গায় দেখেছি এটাই দস্তুর। প্রথম রাতে যে মেয়েটি রুটি মাংস বয়ে নিয়ে এল, সেও এটা স্বীকার করল। খেয়ে তেমন মন ভরল না ঠিকই, কিন্তু এই সুন্দর পরিবেশের মধ্যে যে আনন্দ খুঁজে পেয়েছি, সেই তুলনায় ওই খামতি তেমন ধর্তব্যই নয়। 

সাধারণ টুরিস্টে্র কাছে লাভার আকর্ষণ বলতে শুধু ওই কাগেয়ু থেকচেন লিং গুম্পা। আমরা বোঁ করে একদিন ঘুরে এলাম। মস্তবড় খোলা ছাদ থেকে ওপাশে পাহাড়ের গায়ে  ছড়িয়ে থাকা জঙ্গল সমেত লাভা শহরটা দেখতে বেশ লাগে। অনেকখানি জায়গা নিয়ে এই গুম্পা। কিন্তু লামাদের তেমন ব্যস্ততা চোখে পড়ল না, সবই শুনশান। এই সময় কোনো পরব টরব নেই বলেই বোধহয়।

গুম্পায় আসা-যাওয়ার রাস্তাটা সরাসরি বাজার এলাকার মধ্যে দিয়ে। তবে শীতের চোটে সবার দেখলাম ঝাঁপ নামানো। ছুটকো ছাটকা দু’ একজন বিকেলবেলাতেই রাস্তার ধারে আগুন জ্বালিয়ে হাত-পা সেঁকছে। জিপস্ট্যান্ডের আশপাশে গুটিকয়েক দোকান ছাড়া সব বন্ধ। এমনকী আমাদের পুষ্পাও কোথায় জানি হাওয়া হয়ে গেছে। ওর রান্না পর্ক আর খাওয়া হয়নি এটা একটা আপশোস থেকে গেল।

তেমাথার ঠিক মোড়ে ছাউনিওলা পরপর বেঞ্চি পাতা। ভিড়ভাট্টাও নেই। ফলে গুছিয়ে বসলাম আঁকতে। সামনেই ‘হোটেল দেবিকা’ যার নিচটায় রেস্টুরেন্ট, পিছনে সবুজ পাহাড়ের দেওয়াল। রেস্টুরেন্টটা লিজ় নিয়ে চালাচ্ছেন চালসার লিটন মজুমদার। আমাদের ঘোরাঘুরি করতে দেখে বেরিয়ে এসে ভাব জমালেন। দুপুরে বাঙালির পেটেন্ট মাছভাত খাওয়াতে পারেন, মহা উৎসাহে সেটাও জানালেন। মহানন্দা থেকে নাকি চালানি মাছ আসে রোজ।

Lava Hotel
লাভার হোটেল দেবিকা

আমরা হুঁ হাঁ করে চলে আসছি, একজন চার্লস লটন মার্কা দশাসই চেহারার  নেপালি হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন, অগুনতি ভাঁজ পড়া মুখে সামান্য হাসির আভাস। আপাদমস্তক মোসাহেবি ঢঙে লিটন লোকটার সঙ্গে পরিচয় করাল ‘দেবিকা’র মালিক ঐতাসি তামাং বলে। তামাং সাহেবের গাড়ি এসেছে, উঠতে যাবেন, তারই মধ্যে ঝপ করে একটা  স্কেচ করে নিলাম। উনি যাবার সময় ঘোঁত ঘোঁত করে কিছু একটা বললেন বটে, কিন্তু ঠিক বোঝা গেল না।

*সব স্কেচ লেখকের করা। 

Debashis Dev

স্বনামধন্য এই অঙ্কনশিল্পী নিজেই এক সম্পূর্ন প্রতিষ্ঠান | তাঁর হাত ধরে নতুন করে প্রাণ পেয়েছে বাংলার কার্টুন শিল্প | সিগনেচার বেড়াল আর স্ব-নেচারটি কোমল, আত্মবিশ্বাসী, রসিক | বেড়ানো তাঁর নেশা | তাই ঝুলিতে রয়েছে বহু গল্প, সঙ্গে অসাধারণ সব স্কেচ | সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নিরলস সাধনার অমর ফসল ‘রঙ তুলির সত্যজিৎ’ |

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *