সুরসম্রাজ্ঞী: পর্ব ১

ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের অসাধারণ তালিম, পাশাপাশি বহু সঙ্গীতগুণীর শিক্ষা, ধারাবাহিকভাবে গুণী সঙ্গীত পরিচালকদের নির্দেশনায় পরিণত লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠমহিমা এবং গভীর উপলব্ধিসঞ্জাত গায়নশৈলী ক্রমশ অমোঘ সুরে অধিকার করেছে সাত দশকের, তিন প্রজন্মের শ্রোতার হৃদয়। তাঁর বিশিষ্ট নির্মাণ, গায়কির নিজস্ব ঘরানা এক দুর্লভ সংযোজন। তাই আজও লতা মঙ্গেশকর নিজেই নিজের তুলনা। একটি সম্পূর্ণ জাতি ও গোটা দেশের সঙ্গীতবোধ এবং চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে বিগত কয়েক দশক জুড়ে যিনি বিরাজ করছিলেন সেই সঙ্গীতগুণী আমাদের দিয়ে গেছেন অমূল্য রত্নের সম্ভার। সেইসব মণিমুক্তো সাদরে গ্রহণ করেছি আমরা যারা ভারতীয় সঙ্গীতকে উচ্চ মর্যাদার সঙ্গে বসিয়েছি মনের মণিকোঠায়।

গানের মর্ম আত্মস্থ করার মুনশিয়ানায় বরাবরই সুদক্ষ ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। এর নেপথ্যে যদিও তাঁর শাস্ত্রীয় তালিমের অবদান অনস্বীকার্য। উচ্চাঙ্গ সংগীতচর্চাই তাঁকে শিখিয়েছিল, কীভাবে কণ্ঠস্বরে নাটকীয়তা তৈরি করতে হয়, আবেগে গলা ভাসিয়েও কীভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয় সুরের উপর। তাঁর একাধিক কালজয়ী গানেও এই সংযমবোধকেই আশ্রয় করেছিলেন সুরসম্রাজ্ঞী। লতাকণ্ঠের বিভিন্ন রসের গান কোথাও যেন তাঁর ব্যক্তিজীবন ও ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন। শ্রোতা থেকে গানের উত্তরসুরি, একথা সকলেই বলেছেন যে ব্যক্তিগত জীবনে যে ঘরোয়া ভাবমূর্তিকে আজীবন সযত্নে লালন করেছেন লতা, সেই আটপৌরে যাপনের প্রভাব তাঁর সঙ্গীতজীবনেও প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে। 

Lata Mangeshkar 7
তাঁর একাধিক কালজয়ী গানে সংযমবোধকে আশ্রয় করেছিলেন সুরসম্রাজ্ঞী

লতা মঙ্গেশকরের গানে যে প্রেম বরাবর ধ্বনিত হয়েছে, তা প্রাচুর্যহীন। তিনি নিজেও যে এমন প্রেমেরই সমর্থক ছিলেন। যে প্রেমের ভিত আতিশয্যে, যে প্রেমে প্রদর্শনই সর্বস্ব, সেই প্রেমে কখনওই বিশ্বাস করেননি কিংবদন্তি। তাই নিজের জীবনে তিনি যেভাবে প্রেমকে খুঁজে পেয়েছেন, তারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন গানে। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা তাঁর এই প্রেমের পথকে প্রশস্ত করেছে। আর এখানেই তাঁর ক্লাসিকাল গানের তালিম তাঁকে যে আবেগসমুদ্রে ভাসিয়েছে, সেই অনুভব গানে আরও মূর্ত করে তুলেছেন লতা। আর এই অভিনবত্বই কোথাও না কোথাও আপামর ভারতবাসীর আত্মাকে ছুঁয়ে গিয়েছে। প্রকৃত প্রেমে যে কাতরতা থাকে, যে নিষ্ঠা থাকে ভালোবাসার প্রতি, লতার গানে তা খুঁজে পেয়েছি আমরা। আর সেই কারণেই হয়তো তাঁর গানকে এত কাছের এত আপন মনে হয়েছে শ্রোতাদের। 

ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতিকে আধার করে শ্রোতাদের সঙ্গে এমন সংযোগস্থাপন আর ক’জনই বা করতে পেরেছেন ! তাই তাঁর গান এখনও একটা গোটা জাতির অনন্য সম্পদ হয়ে রয়ে গিয়েছে। তাঁর গানে স্বপ্ন দেখতে শিখেছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের শ্রোতারা, শিখেছেন ভালবাসার গভীরতা বুঝতে। আর তাই আনন্দে, বিরহে বরাবর লতারই আশ্রয় খুঁজেছেন সকলে। এভাবে ছুঁয়ে যেতে পারলেন বলেই বোধহয় আমাদের প্রেমজীবনের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে লতা থেকে যাবেন চিরকাল। শিল্পী হিসেবে লতা মঙ্গেশকরের ব্যাপ্তি ভাষায় বর্ণনা করা দুরূহ। তিন সপ্তক জুড়ে বিরাজ করত তাঁর কণ্ঠ। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রশিক্ষিত হলেও, সঙ্গীতজীবনে তিনি সবচেয়ে বেশি গান প্লে-ব্যাকেই গেয়েছেন।

হালফিলের গানবাজনা লতাকে আর তেমন টানত না। তাঁর সুখস্মৃতি অতীত ঘিরে, তাই কথায় কথায় তিনি ফিরে যেতেন পঞ্চাশ-ষাটের দশকে। সে বড় সুখের সময় নিশ্চয়ই, তবে আরও পিছিয়ে যেতে হবে লতার শিকড় সন্ধানে। লতার মুখে যখন বুলি ফুটেছে তখনও সিনেমা কথা বলতে শেখেনি। সে ছিল থিয়েটারের গানের রমরমার দিন। সেই থিয়েটারের গান ছিল আশৈশব গানপ্রেমী লতার কম বয়েসের বিনোদন। লতার নিজের কথায়– ‘ছেলেবেলায় আমাদের ছিল যাযাবরের জীবন। বাবা নাটকের দল নিয়ে এ শহর থেকে ও শহরে ঘুরে বেড়াতেন আর আমরা দলের লটবহরের মতোই সঙ্গে যেতাম’। এটাই লতা মঙ্গেশকরের উল্লেখযোগ্য শৈশবস্মৃতি। 

লতার বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর তখন মারাঠি নাট্যমঞ্চের এক যুগন্ধর প্রযোজক-গায়ক-অভিনেতা। লতার পরিবার হার্দিকর বংশের উত্তরসূরি। আদি বাসভূমি গোয়ায়। এই পরিবারের পূর্বপুরুষদের কেউ কেউ পর্তুগিজ আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে শহিদ হয়েছিলেন। বাড়ির পাশেই ছিল মঙ্গেশদেবের মন্দির। কুলদেবতা মঙ্গেশের সূত্রেই পরিবারের পদবির সঙ্গে যোগ হয় ‘মঙ্গেশকর’ বংশের আদি পদবি ছিল ‘ভাট’ অর্থাৎ পূজারি ব্রাহ্মণ এবং তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল ‘অভিষেকী’ খেতাব। 

Dinanath Mangeshkar
লতার বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর মারাঠি নাট্যমঞ্চের এক যুগন্ধর প্রযোজক-গায়ক-অভিনেতা

উনিশ শতকের শেষ দিকে এই পরিবারের প্রধান ছিলেন ভিখম ভাট অভিষেকী। তাঁর ছেলে গণেশ ভাট মঙ্গেশদেবের মন্দিরে কথকতা করতেন। গণেশ ভাট ও তাঁর সঙ্গীতজ্ঞ মারাঠি স্ত্রী জেসুবাইয়ের প্রথম সন্তান দীননাথ। বড়দের কাছে অধীর আগ্রহ নিয়ে লতা শুনেছেন তাঁর বিখ্যাত বাবার অতীতকথা। ছেলেবেলা থেকেই দীননাথের কণ্ঠে গান আসত স্বাভাবিক স্ফূর্তিতে। তখন কলের গানের শৈশব, গাইয়েদের জন্য রেডিও বা সিনেমার মতো কিছুই সুলভ ছিল না, ফলে নাটকই ছিল প্রধান মাধ্যম। দীননাথের মা তাঁর সন্তানকে অনিশ্চিত নাট্যজগতে ঠেলে না দিয়ে আসরে বাজানোর জন্য সারেঙ্গি শেখবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। কিছুদিন শেখাবার পর গুরু একদিন শিষ্যকে বাজার থেকে মদ কিনে আনবার ফরমায়েশ করেন। সুরা সম্পর্কে ভীতি থেকে দীননাথ সেই যে গুরুগৃহ ছাড়লেন আর ফেরেননি শেখানে। অথচ ভাগ্যের কী পরিহাস, যে সুরার থেকে দূরে থাকার জন্য তিনি একদা গুরুকে ত্যাগ করেছিলেন , সেই সুরার উপর অতিরিক্ত নির্ভরতাই একদিন দীননাথের জীবনীশক্তি দ্রুত কেড়ে নিল। 

Lata Family
লতা মঙ্গেশকরের পারিবারিক ছবি

সারেঙ্গির সঙ্গে দীননাথ তবলা শিখতে শুরু করেন, পাশাপাশি গান। জিনিয়াস দীননাথের গাইবার ধরন ছিল সেকালের নাট্যদলের দিকপাল গায়ক-অভিনেতা বাল গন্ধর্বের মতো। তাঁর গাওয়া গান শুনে সতীর্থরা পরামর্শ দিয়েছিলেন গানে মন দিতে। পন্ডিত ওহজেবুয়ার সান্নিধ্যে বিশুদ্ধ রাগসঙ্গীতের তালিমও নিয়েছিলেন দীননাথ। তখন তিনি গায়ক-অভিনেতা হিসেবে রীতিমত বিখ্যাত। মহারাষ্ট্রের তৎকালীন কয়েকটি নাট্যদল দেখেছিল পুরুষ ও নারী উভয় চরিত্রে দীননাথের দক্ষ অভিনয় ও তাঁর গাওয়া মনমাতানো গান। ফলে সকলেই চাইছিলেন এই প্রতিভাবান শিল্পীকে দলে পেতে। দীননাথের অসাধারণ গান শুনে বাল গন্ধর্ব বলেছিলেন, ‘মঙ্গেশিগ্রাম থেকে বোম্বাই পর্যন্ত টাকা বিছিয়ে দিতে পারি যদি ছেলেটি আমার দলে যোগ দেয়।’ 

চোদ্দো বছরের বালক দীননাথকে দক্ষিণ-পশ্চিম মহারাষ্ট্রের থিয়েটার কোম্পানি যে কোনও মূল্যে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। দীননাথও চাইছিলেন আত্মপ্রকাশের মঞ্চ, তাই তিনি প্রথমেই পূজারি পদবি ‘অভিষেকী’ ত্যাগ করে কুলদেবতার নাম অনুসারে ‘মঙ্গেশকর’ পদবি নিয়ে ভ্রাম্যমাণ নাটকের দলে যোগ দিলেন। দীননাথ, ‘কির্লোস্কর সঙ্গীতমণ্ডলী’ দলের সদস্য হিসেবে মহারাষ্ট্র, দিল্লি এমনকী কলকাতাতেও হিন্দি ও উর্দু নাটকে অভিনয় করেন। আঠারো বছর বয়সে তিনি তৈরী করেন নিজস্ব নাট্য দল ‘বলবন্ত সঙ্গীতমণ্ডলী’। তাদের প্রথম প্রযোজনা ‘শকুন্তলা’। ক্রমশ দীননাথ এবং তাঁর নাট্যদলের সমৃদ্ধি ঘটতে লাগল, বাড়তে লাগল প্রভাব ও প্রচার।

মারাঠি নাটকের অন্যতম ব্যক্তিত্ব দীননাথ নিজের পছন্দে বিয়ে করেন শেঠ হরিদাস রামদাস লাড-এর কন্যা ঊনিশ বছরের নর্মদাকে। ১৯২২ সালে অনুষ্ঠিত সে বিয়ের তিনদিনের আনন্দ অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল দীননাথের নাট্যদলের নতুন প্রোডাকশন ‘কাঁটো মে ফুল’। বিয়ের চার বছরের মাথায় দীননাথ এবং নর্মদার একটি কন্যা সন্তান জন্মায়। তার তেমন বাঁচার আশা ছিল না। দীননাথের শ্যালিকা সেবন্তীর অক্লান্ত পরিশ্রমে বেঁচে গেল শিশুটি, তবে বাঁচানো গেল না নর্মদাকে। এদিকে সেবন্তী ক্রমশ বিপত্নীক দীননাথ এবং নবজাতকের নির্ভরতার কেন্দ্র হয়ে উঠলেন। কালক্রমে সেবন্তী হলেন দীননাথের ঘরণী এবং এই পরিবার ভারতীয় সঙ্গীত জগতে ঐতিহাসিক অবদানের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে রইল। সেবন্তীর নতুন নামকরণ হল সুদ্ধামতি। 

Lata Mangeshkar
দিদির সঙ্গে তিন বোন। একেবারে বাঁয়ে বসে লতা মঙ্গেশকর, ডাইনে বসে তুতো বোন মালতী। পিছনে ছোট দুই বোন মিনা ও আশা

মাস্টার দীননাথ খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে গেলেন তিরিশ বছরে পা দেওয়ার আগেই। এক সময় তাঁকে মারাঠি নাটকে শ্রেষ্ঠ গাইয়ে-অভিনেতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। অসাধারণ সুরেলা কণ্ঠ ছিল দীননাথের, সঙ্গে সুবিশাল রেঞ্জ। নাট্যসঙ্গীতের পাশাপাশি রাগসঙ্গীতেও তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কণ্ঠস্বরটি ছিল একটু হালকা চালের। এক বন্ধু দীননাথকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাঁর কণ্ঠস্বরের ওজন বেড়ে যাবে যদি প্রতিদিন এক চামচ করে ব্র্যান্ডি পান করা যায়। এই উপদেশের সূত্র ধরে দীননাথের জীবনে অনুপ্রবেশ ঘটে ঘাতক সুরার, যা তাঁর জীবনীশক্তিকে দ্রুত ক্ষয় করবার পথ প্রশস্ত করেছিল। তবে সে ধ্বংসের আগে নির্মাণের কাজটি সেরে ফেলেছিলেন দীননাথ। মারাঠি নাটকের ক্ষেত্রে রীতিমত আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। বোম্বাইয়ে ব্রিটিশ আমলে অসাধারণ প্রেক্ষাগৃহ রয়্যাল অপেরা হাউসে দীননাথের নাটক অভিনীত হত। সন্ধ্যার বদলে ম্যাটিনি বা দুপুরের শো-এর সেটাই ছিল সূত্রপাত। পাঁচ টাকা দাম ছিল টিকিটের দীননাথের ‘ভাববন্ধন’ নাটকের। প্রায় একশো বছর আগের পাঁচ টাকা কতখানি মহার্ঘ্য ছিল সহজে অনুমান করা যায়। 

সে সময় বিস্তর অর্থ উপার্জন করেছিলেন দীননাথ। মহারাষ্ট্রের সাংলিতে তেরোটি ঘরসহ এক বিশাল বাড়িতে থাকতেন তিনি। অসংখ্য ব্যাঙ্কে তাঁর অ্যাকাউন্ট ছিল। সেই আমলে দীননাথের একটি নাটক প্রযোজনার ব্যয় ছিল প্রায় আশি হাজার টাকা। গোয়ায় এক বিশেষ প্রজাতির আম ও কাজুবাদামের চাষ ছিল দীননাথের। আড়াই লক্ষ টাকা দিয়ে দুটি পাহাড় কিনেছিলেন তিনি, তাঁর আভিজাত্যের ঘোষণা হিসেবে। জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাসী, দীননাথের কিছু ভবিষ্যদ্বাণী মিলে গেলেও নিজের ভবিষ্যত দেখতে পাননি তিনি। (চলবে)

 

পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৯ মার্চ
*ছবি সৌজন্য: Starsunfolded, Wikibio, Pinterest

বিশিষ্ট গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহক সঞ্জয় সেনগুপ্ত, গান বাজনা-র জগতে এক বিস্ময়কর নাম। কলকাতায় জন্ম হলেও ছেলেবেলা কেটেছে ওড়িশায়। দীর্ঘদিন এইচ.এম.ভি-র মতো ঐতিহ্যশালী সাঙ্গীতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। তাঁর অনবদ্য কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে প্রায় ১২০০ বই ও পত্র-পত্রিকায়, দেশ বিদেশ জুড়ে। সঙ্গীত ছাড়াও আগ্রহ নানা বিষয়ে। খেলাধূলা, মূলত ক্রিকেট ও সিনেমা সংক্রান্ত লেখায় তাঁর পান্ডিত্য ঈর্ষণীয়।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *