আগের পর্ব পড়তে:
সুরসম্রাজ্ঞী পর্ব ১
সুরসম্রাজ্ঞী পর্ব ২
সুরসম্রাজ্ঞী পর্ব ৩
সঙ্গীতজীবনের প্রথম পর্বে যেখানেই খানিক থিতু হতে গিয়েছেন লতা মঙ্গেশকর, সেখানেই এসেছে বড় ধাক্কা। বাবা দীননাথের আকস্মিক মৃত্যুর পর যখন মাস্টার বিনায়কের চেষ্টায় খানিক আর্থিক সমৃদ্ধির মুখ দেখতে শুরু করেছেন, তখনই ১৯৪৭ সালে মাস্টারের মৃত্যু হয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আসে প্লে-ব্যাক জগতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অভাবনীয় সুযোগ। লতা মঙ্গেশকরের গলা শুনে সঙ্গীত পরিচালক হরিশ্চন্দ্র বালি তাঁকে গান গাইবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। স্টুডিয়োতে যখন গান রেকর্ড করছেন, তখন এক এক্সট্রার মাধ্যমে গুণী কম্পোজার গুলাম হায়দর জানতে পেরেছিলেন এক নতুন প্রতিভার কথা।
অচিরেই ডাক আসে লতার, গোরেগাওঁয়ের ফিল্মিস্তান স্টুডিয়ো থেকে। গুলাম হায়দরেরই সুর করা ‘হুমায়ুঁ’ (১৯৪৫) ফিল্মের গান সেদিন তাঁকে শুনিয়েছিলেন কিশোরী লতা। কণ্ঠের জাদুতে প্রথম শ্রবণেই এমন মুগ্ধ হয়েছিলেন গুলাম, যে গান রেকর্ড করে তিনি শোনান তৎকালীন বিখ্যাত বাঙালি প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়কে। শশধরের সংস্থা তখন দিলীপকুমার অভিনীত ‘শহিদ’ সিনেমার প্রযোজনা করছে। মহিলা কণ্ঠে প্লে-ব্যাকের জন্য চাই একজন গায়িকা। কিন্তু লতা মঙ্গেশকরের গলা শুনেই নাকচ করে দেন শশধর। গুলাম হায়দরকে জানান, ‘শহিদ’-এর গানের জন্য এমন কণ্ঠস্বর একেবারেই বেমানান। লতার এই প্রত্যাখ্যান গায়ে লেগেছিল মাস্টারজির।

এরপর হিন্দি ছবির জগতে প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে লতার প্রতিষ্ঠার পেছনে গুলাম হায়দরের অবদান বিপুল। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে, গুলাম হায়দর ফিল্মিস্তান স্টুডিয়োর কর্ণধারকে উদ্দেশ্য করে অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘মিস্টার মুখার্জি, আপনার নিজস্ব মত প্রকাশের অধিকার আছে, আপনি যা ইচ্ছে বলতেই পারেন, কিন্তু আমার কথাটাও শুনে রাখুন– আজ যাঁকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন, একদিন প্রযোজক-পরিচালকদের এই মেয়েটির দরজায় লাইন দিতে হবে।’ এই ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর গুলাম হায়দরের জেদ চেপে গেল, তিনি লতাকে নিয়ে গেলেন স্টুডিয়ো সিস্টেমের যুগে আর এক দাপটের প্রতিষ্ঠান ‘বম্বে টকিজ়’-এ। যাওয়ার জন্য ট্রেন ধরতে গোরেগাঁও রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে গুলাম হায়দর সুর করেছিলেন ‘মজবুর’ ফিল্মের সেই বিখ্যাত গান– ‘দিল মেরা তোড়া’। হাতের ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেটের টিনের ওপর আঙুলের টোকায় তাল রেখে গুনগুন করে এই গানের সুর বেঁধেছিলেন গুলাম হায়দর। আর মনে মনে ভেবেছিলেন, তাঁকে প্রমাণ করতেই হবে এইটুকু মেয়ের ওই পাতলা গলার আড়ালে লুকিয়ে আছে কী বিশাল সম্ভাবনা।
আরও পড়ুন: বাংলালাইভের বিশেষ ক্রোড়পত্র: সুরের সুরধুনী
স্টুডিয়োতে গিয়ে রিহার্সাল সেরে গানটি লতাকে দিয়ে রেকর্ড করেন গুলাম হায়দর স্বয়ং এবং সেখানে ঘোষণা রাখেন– ‘নূরজাহান আমার আবিষ্কার। তেমনই প্লে-ব্যাকের ভবিষ্যৎ সম্রাজ্ঞীকে প্রথম চিনতে পারার জন্য ইতিহাস আমাকে মনে রাখবে।’ ‘মজবুর’ ফিল্মে ছটি গান করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর যার মধ্যে দুটি গান ছিল গীতা রায়ের সঙ্গে। মুকেশের সঙ্গে গাওয়া ডুয়েট– ‘অব ডরনে কি কোই বাত নহি’ (রেকর্ড নং– N 35345) বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। এ ছাড়া লতা সোলো গেয়েছিলেন তিনটি– ‘দিল মেরা তোড়া’, ‘পিয়া মিলনে কো আ’ ও ‘দামন হ্যয় চাক… অব কোই জিকে কেয়া করে।’
‘পিয়া মিলনে কো আ’ গানটি ছিল ঠুমরি অঙ্গের এবং অনেকগুলো টেক করতে হয়েছিল। এই গানটি শুনে খেমচাঁদ প্রকাশ ও অনিল বিশ্বাসের মতো দিকপাল সঙ্গীত পরিচালকেরা লতার ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছিলেন। ‘মজবুর’ ছবির গান লিখেছিলেন নাজিম পাণিপতি। গীতিকার হিসেবে এই ফিল্মের গান তাঁকে এক উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ‘মজবুর’ ছবিটি সিলভার জুবিলি হয়েছিল। লতার ফিল্মি গানের কেরিয়ারে পথপ্রদর্শক গুলাম হায়দরের সুরে আর একবারই গাইবার সুযোগ পেয়েছিলেন, সেটাই শেষবারের মতো তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ। গুলাম হায়দরকে লতা ‘মাস্টারজি’ নামে ডাকতেন। একদিন সন্ধ্যেবেলা মাস্টারজি খবর পাঠালেন বম্বে টকিজ় স্টুডিয়োতে দেখা করবার জন্য, একটি গান রেকর্ড করার ব্যাপারে। লতা সেদিন পেটের অসুখে ভুগছিলেন, গায়ে জ্বরও ছিল। কিন্তু মাস্টারজির ডাক উপেক্ষা করতে পারলেন না।

পরেরদিন গুলাম হায়দর একটি ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক রেকর্ড করছিলেন এবং সেটা সে দিনই শেষ করতে হবে, ফলে অত ব্যস্ততায় লতার খোঁজ নেওয়ার সময় পেলেন না। চরম হতাশায় কাটল প্রায় সারাদিন। পেটের অসুবিধের জন্য খাওয়াও হল না লতার। বিকেলে কাজ শেষ করে বেরিয়ে যাওয়ার পথে ক্লান্ত লতাকে দেখে মাস্টারজির মনে পড়ে যায় গোটা ব্যাপারটা। তৎক্ষণাৎ লতাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে গীতিকারের কাছ থেকে গান নিয়ে তিনি সুর করতে বসলেন। সুর করা আর লতার গান তোলা প্রায় একই সঙ্গে চলল। এরপর যন্ত্রশিল্পীদের নিয়ে মিউজিক তোলা হল, সঙ্গে শুরু হল রেকর্ডিং। অসাধারণ সেই গান গাইতে গাইতে সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে গেলেন লতা। গানটি ছিল– ‘বেদর্দ তেরে দর্দ কো সিনে সে লগাকে রো লেঙ্গে’ (রেকর্ড নং – N 35529)।
কিন্তু যে ফিল্মের জন্য গানটি রেকর্ড করা হয়েছিল তার বদলে অন্য একটি ফিল্মে ব্যবহার করা হল ওই গান, যার নাম ‘পদ্মিনী।’ লিখেছিলেন, ওয়ালি সাহেব। গানটি জনসমক্ষে সাড়া ফেলতেই এইচএমভি রেকর্ডটির তিনটি প্রিন্ট প্রকাশ করেছিল ১৯৪৮ সালে। সেই রেকর্ডিংয়ের স্মৃতি ম্লান হওয়ার আগে, দু-একদিনের মধ্যেই গুলাম হায়দর পাকিস্তান চলে যান, আর ফিরে আসেননি। কিছুদিন বাদে নূরজাহানের ফোন মারফৎ লতা জানতে পারেন যে মাস্টারজি ক্যানসার রোগে আক্রান্ত। লতা তাঁকে ভারতে এসে চিকিৎসার কথা বলেছিলেন, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। তাই শ্রদ্ধেয় মাস্টারজিকে দূর থেকে শেষ প্রণাম জানান লতা মঙ্গেশকর।
গায়িকা-নায়িকা নূরজাহানের সঙ্গে মধুর সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। এক ইন্টারভিউতে লতা বলেছিলেন–
‘আমার একদা আইডল ছিলেন নূরজাহান, আমি ওঁকে নকল করে গাইবার চেষ্টা করতাম। আমার প্রথম দিকের গানে ওঁর প্রভাব স্পষ্ট। ‘বড়ি মা’ ফিল্মের সেটে যে আমাদের সম্পর্ক হয়েছিল, তা ক্রমশ গাঢ় হয়েছে। ওঁর মতো সুপারস্টার আমার মতো আনকোরা গাইয়েকে যে কেন প্রশ্রয় দিতেন জানি না, তবে উনি আমাকে নিরন্তর উৎসাহ দিয়েছেন। দেশভাগের পর নূরজাহান পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পরও নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ হত, দূরত্ব আমাদের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারেনি। আমরা একটা সময় ঠিক করে নিয়েছিলাম যখন দুজনেই ফ্রি থাকব সে সময় ফোনে কথা হবে। সেইমতো ফোন করতেন নূরজাহান, পরের দিকে আমিও করেছি অনেক। উনি আমার নতুন গান শুনতে চাইতেন, আমি ওঁর কাছে শুনতে চাইতাম পুরনো গান। তখন ছিল ট্রাঙ্ককলের যুগ, পরে জানতে পেরেছি টেলিফোন অপারেটার নাকি কান পেতে আমাদের কথাবার্তা, গান শুনতেন। পরে বেশ কয়েকবার আমাদের দেখাও হয়েছে।’

‘একবার সরকারিভাবে বোম্বাইয়ে এসেছিলেন নূরজাহান, সে সময়ে আরও খানিকটা অন্তরঙ্গ হওয়ার অবকাশ জুটেছিল। আমি যখন ফিল্মি গানের দরজায় দাঁড়িয়ে, তখন নূরজাহানের পাশাপাশি স্বমহিমায় ছিলেন সুন্দরী সুরইয়া। এ ছাড়াও শামসাদ বেগম, আমিরবাই কর্ণাটকী, জোহরাবাঈ, রাজকুমারীর মতো গায়িকারা তখন তুঙ্গ ফর্মে। ফলে প্রযোজক বা সঙ্গীত পরিচালকেরা আমাকে গান গাইতে দেওয়ার কথা ভাববারই সুযোগ পাননি। দেশভাগের পর নূরজাহান পাকিস্তানে চলে গেলেন, সুরইয়া ব্যক্তিগত কারণেই কমিয়ে দিলেন গান গাওয়া। বাকিরা বয়েসের সঙ্গে সঙ্গেই খানিকটা আড়ালে চলে যাওয়ায় নতুনদের সামনে কিছুটা ফাঁকা জায়গা তৈরি হল।’
তবে ফিল্মিস্তানের মতো রঞ্জিত মুভিটোন ফিল্ম কোম্পানির সঙ্গেও এক তিক্ত অভিজ্ঞতায় জড়িয়ে পড়েছিলেন লতা, সে কথাও তাঁর সাক্ষাৎকার থেকেই জানা যায়। চন্দুলাল শাহ্ তখন ওই কোম্পানির কর্তা। সবাই তাঁকে সমীহ করে সর্দার নামে ডাকত। রঞ্জিত মুভিটোন তখন বোম্বাইয়ে উল্লেখযোগ্য ফিল্ম নির্মাতা সংস্থা, ফলে তাদের ছবিতে গান গাইবার জন্য অডিশন দেওয়ার সুযোগ পেয়ে বেশ খুশি হয়েছিলেন লতা। চন্দুলাল গুজরাতি বলে লতা অবিনাশ ব্যাসের কাছ থেকে বেশ পরিশ্রম করে একটি গুজরাতি গান শিখে সেইটে তাঁকে শোনান। কিন্তু খুশি হওয়া তো দূর, শুনে চন্দুলাল তাঁকে বাতিল করেন। উপরন্তু তাঁর কণ্ঠস্বর নিয়ে সঙ্গীত পরিচালক খেমচাঁদ প্রকাশের কাছে খারাপ মন্তব্যও করেন।

খেমচাঁদজি কথাগুলো শুনে খুব রেগে ওঠেন। এ নিয়ে দু’জনের ঝগড়াঝাঁটিও হয়। চন্দুলাল মাসমাইনের কর্মচারী খেমচাঁদজিকে অপমান করেন। দুপুরের এই ঝগড়ার পরিণতি, সন্ধেবেলায় খেমচাঁদ প্রকাশের পদত্যাগপত্র এসে পড়ল চন্দুলালের টেবিলে, আর অচিরেই বোম্বে টকিজ় সসম্মানে ডেকে নিল ওই গুণী সঙ্গীত পরিচালককে। এই খেমচাঁদ প্রকাশের সুরেই ঊনপঞ্চাশ সালে লতা গাইলেন ব্লকবাস্টার হিট গান ‘আয়গা আনেওয়ালা’। ষাট বছর হয়ে গেল গানটার বয়স, তবুও আজও লোকে শোনেন। দেশে তো বটেই, বিদেশের অসংখ্য স্টেজে ওই গানটি গাইবার অনুরোধ আসত লতার কাছে, তিনি গাইতেন এবং শ্রোতারা উপভোগ করতেন। একেই বলে কালজয়ী গান। লতা বলেছিলেন, ‘আমার সৌভাগ্য, এমন অনেক গানই আমি গাইবার সুযোগ পেয়েছি।’ (চলবে)
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১২ এপ্রিল ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Twitter, Pinterest
বিশিষ্ট গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহক সঞ্জয় সেনগুপ্ত, গান বাজনা-র জগতে এক বিস্ময়কর নাম। কলকাতায় জন্ম হলেও ছেলেবেলা কেটেছে ওড়িশায়। দীর্ঘদিন এইচ.এম.ভি-র মতো ঐতিহ্যশালী সাঙ্গীতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। তাঁর অনবদ্য কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে প্রায় ১২০০ বই ও পত্র-পত্রিকায়, দেশ বিদেশ জুড়ে। সঙ্গীত ছাড়াও আগ্রহ নানা বিষয়ে। খেলাধূলা, মূলত ক্রিকেট ও সিনেমা সংক্রান্ত লেখায় তাঁর পান্ডিত্য ঈর্ষণীয়।
সন্জু, খুব ভাল লাগছে তোমার লতাজি’র ওপর লেখাগুলো পড়ে!👏👏👏