মাস দুই আগের কথা। নিউ জার্সির এক গানের অনুষ্ঠানে গাইব বলে বেছেছিলাম লতা মঙ্গেশকর-সলিল চৌধুরী জুটির একটি গান। আস্পর্ধা কত! গাইতে গিয়ে হাবুডুবু দশা! ছোট্ট ছোট্ট হিরের কুচির মতো সূক্ষ্ম কাজ ছড়িয়ে আছে এখানে ওখানে। সেসব নাহয় কোনওমতে আয়ত্তে আনা গেল। কিন্তু দম? নিঃশ্বাসটা নেব কোথায়? দম না নিয়ে একটানে এতটা গাইতে হবে? কী শক্ত কাজ রে বাবা! অথচ দেখি, লতা মঙ্গেশকর কী অবলীলায় সেই কাজটিই করে যাচ্ছেন! একবার নয়, বারবার! মাথা নুইয়েছি নির্দ্বিধায়।
দু‘মাস যেতে না যেতেই সরস্বতী পুজোর রাতে (স্থানীয় সময়) তাঁর চলে যাওয়ার খবর এল। সত্যিই তাহলে ‘ফুরাল প্রাণের মেলা, শেষ হয়ে এল বেলা?’ অন্তরে অন্তরে সে যে কী অভিঘাত, কী ঢেউ, তাকে প্রকাশ করি, এমন সাধ্য নেই। ‘নিশিদিন নিশিদিন বাজে স্মরণের বীণ’, কলম নামিয়ে রেখেছি। চোখের সামনে ডিজিটাল দুনিয়া উত্তাল, তাঁকে নিয়ে তুচ্ছাতিতুচ্ছ তথ্যটুকুও খবরবন্দি, ফিচারবন্দি হয়ে যাচ্ছে। এমন অসময়েই তাঁকে নিয়ে লেখার অনুরোধ রাখলেন এক সম্পাদক। এবং তৎক্ষণাৎ উপলব্ধি করলাম, লতা মঙ্গেশকরকে নিয়ে লিখতে বসা বোধহয় লতা-সলিলের গান গাওয়ার থেকেও বেশি শক্ত কাজ! “কী লিখি তোমায়”- হে ভগবান, সবাই তাঁকে নিয়ে জানা-অজানা সবকিছুই লিখে ফেলেছে! ‘বাকি কথা পরে হবে?’ বাকি আর কীইবা আছে?
তবু চেষ্টায় কী না হয়! বইপত্তর ঘাঁটতে ঘাঁটতেই “ঝিলিক ঝিলিক ঝিনুক খুঁজে পেলাম।” হাতে এসে গেল সাতরাজার ধন এক মাণিক। সেকথা শোনাবার জন্যেই এত মুখবন্ধ। ভারতীয় ছবির চার্লি চ্যাপলিন রাজ কাপুরের তিরানব্বইতম জন্মদিনে তাঁর ছেলেমেয়েরা, যাঁরা নিজেরাও সুখ্যাত শিল্পী, একটি অভিনব বই বার করার পরিকল্পনা করেন। ২০১৭ সালে প্রকাশ পায় ‘Raj Kapoor: The One And Only Showman’. সংকলক হিসেবে আছেন রাজ কাপুরের কন্যা, ঋতু নন্দা। বইটি অভিনব, কারণ একইসঙ্গে এটি আত্মজীবনী এবং জীবনী। রাজ কাপুরের নিজের কথাও যেমন লেখা আছে, সেইসঙ্গে পরিচিত বিশিষ্টজনেরা তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন। এর মধ্যেই আছে লতা মঙ্গেশকরের একটি লেখা। হদিশ পেয়েই আমাজ়নে সাঁতার কেটে সে বইয়ের কিন্ডল ভার্সনটি কুক্ষিগত করা গেল। তার থেকেই দু’কথা শোনাই।

সুরকার অনিল বিশ্বাস লতাকে নিয়ে গিয়েছিলেন রাজ কাপুরের কাছে। তখন রাজ কাপুরের ছোট্ট অফিসটি যে বাড়ির দোতলায়, তারই একতলায় রেকর্ডিং স্টুডিও। অনিল বিশ্বাস অনুরোধ জানালেন স্টুডিওতে এসে গান শোনার জন্যে। রাজ এলেন, শুনলেন, চুপচাপ চলেও গেলেন। পরের দিন ডাক এল মহালক্ষ্মী অফিস থেকে। রাজ কাপুর ডেকেছেন। তাঁর ছবিতে গান গাইতে হবে। উনিশ বছরের টিনএজার লতা বড্ড খুশি। পৃথ্বীরাজ কাপুরের খুব ভক্ত, কোলহাপুরে থাকতে ‘সিকন্দর‘ সিনেমা দেখে ফেলেছেন পনেরোবার। সেই পৃথ্বীরাজ কাপুরের ছেলে রাজ কাপুর তাঁকে ডেকেছেন! এ আনন্দ রাখবেন কোথায়?
প্রথম গান রেকর্ড হল ‘বরসাত’ ছবির জন্যে। ‘জিয়া বেকরার হ্যায়’। শঙ্কর-জয়কিষেণ জুটির শঙ্কর তবলায় আর জয়কিষেণ হারমোনিয়ামে। লতা চটপট গানের সুরটা তুলে নিলেন। রেকর্ডিংয়ের পর শোনেন, রাজসাহেব জয়কিষেণকে সাবধান করছেন, “একটু নজর রেখো মেয়েটার দিকে। ক্ল্যাসিক্যাল শিখেছে, ও কি আর কমার্শিয়াল ফিল্মের গান ঠিকঠাক গাইতে পারবে?” লতা শুনতে পেলেন। সত্যিই তো, সে নতুন, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আগে তো গায়নি! মনখারাপ, সেই সঙ্গে জেদ। দেখিয়ে দেবেন, লতা মঙ্গেশকর কমার্শিয়াল ছবিতে গান গাইতে পারে কি না! ‘বরসাত’ ছবির সবগুলো গান গাইলেন প্রাণ ঢেলে। একদিন শুনলেন রাজ সাহেব নিজে তাঁকে অনুরোধ করছেন, একটা গানের আগে একটু ভৈরবীর আলাপ জুড়ে দিতে। দিলেন। শুনে রাজ সাহেব মুগ্ধ। কিশোরী মেয়েটি বুঝল, তার পুরস্কার সে পেয়ে গেছে। বরসাত ছবির সবক‘টি গান মানুষের মন জয় করে নিল। সেদিন থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

তারপর থেকে সুরের আকাশে ডানা মেলার অবাধ স্বাধীনতা। মেলোডির খুঁটিনাটি রাজ কাপুর লতা মঙ্গেশকরের ওপরেই ছেড়ে দিতেন। শুধু চাইতেন একটু আলাপ যেন থাকে। গানের আগে একটু সুরের মূর্ছনা। তবেই তো সে গান লক্ষকোটি মানুষের হৃদয় ছুঁতে পারবে! সেই আলাপের রেশ ধরেই উঠে এল ‘আওয়ারা’ ছবির গানের রেকর্ডিংয়ের স্মৃতি। এ গানও ভৈরবীতে বাঁধা। সেই শঙ্কর-জয়কিষেণ জুটির সুর। ‘ঘর আয়া মেরা পরদেসি’। গাইবেন লতা মঙ্গেশকর, সঙ্গে আছেন মান্না দে। মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টে দেড়শো জন মিউজিশিয়ান। পঞ্চাশজন সহশিল্পী কোরাসে গলা মেলাবেন। পর্দায় থাকবেন রাজ-নার্গিস জুটি।
সেইমতো সবাই সকাল ন‘টায় স্টুডিওতে পৌঁছে গেছেন। লতা, মান্না ও অন্য সহশিল্পীরা গানটা তুলে নিলেন। কথা, সুর রপ্ত করে নিচ্ছেন। রাজ কাপুর এলেন দেরিতে। শুনেই গান অপছন্দ হল। এরকমটা তিনি চাইছেন না। সারাদিনের পরিশ্রম জলাঞ্জলি গেল। রাজ সাহেব গানটা ভালোই বোঝেন। তাঁর কথা অমান্য করার সাধ্য নেই কারোর। আবার শুরু হল মাজাঘষা। কিছুতেই আর মনোমতো হয় না! রাজ সাহেব পারফেকশনিস্ট। লতাও তাই। সেই সকাল ন‘টা থেকে পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে গান গাইছেন। তাতে লতার একটুও আপত্তি নেই। কিন্তু কী যেন একটা মিলছে না! সুর, লয়, তাল সব মিলে যে ম্যাজিকটা তৈরি হবে, সেটাই অধরা থেকে যাচ্ছে। রাজ কাপুর রেগেমেগে জয়কিষেণকে বলে বসলেন, “I don’t want a popatiya song!”

তারপর নিজেই হাল ধরলেন। আগাগোড়া বদলে দিলেন গানটাকে। রিদমে এল বৈচিত্র্য। বিভিন্ন লয় আর তালের ঠেকা, মাঝে মাঝেই দ্রুততালে লগ্গি, একই গানে যে কতরকম বৈচিত্র্য এল! ম্যান্ডোলিন সম্পূর্ণ সহযোগিতা করছে, কোরাসের শিল্পীরা প্রাণ ঢেলে গাইছেন, লতার গলার সুর জাদু ছড়িয়ে দিচ্ছে। অভূতপূর্ব সমন্বয়, হারমোনি। ভৈরবী রাগে ছোট্ট একটু আলাপও জোড়া হল। রাজ সাহেবের প্রিয় ভৈরবী আলাপ। এই করে করে রাত তিনটের সময় যে রেকর্ডিংটি হল, শুনে সন্তুষ্ট হলেন। বললেন, “চল, এবার তাহলে কিছু খাওয়া যাক!” প্রায় দুশো মানুষের বিরাট দল। সবার পেটভরা খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন সেই রাতে। লতা মঙ্গেশকর লিখেছেন সে অসাধারণ ভোজের কথা।

পুরো টিম রাস্তায় বসে গেল পাত পেড়ে। রাত তখন তিনটে। চাদর বিছিয়ে দেওয়া হল লম্বালম্বি করে। নিশুত রাতে রাস্তা নির্জন। তখনকার দিনে গাড়িঘোড়াও অত ছিল না। পুরো ইউনিট বেশ তৃপ্তি করে ভরপেট খেয়ে বাড়ির পথে পা বাড়াল। ‘আওয়ারা’ ছবি রিলিজ করল। গান সুপারহিট। আসমুদ্রহিমাচলের লক্ষকোটি মানুষের মন জিতে নিল। বইটিতে এমনি অনেক টুকরো টুকরো স্মৃতির মণিমাণিক্য দিয়ে মালা গেঁথেছেন লতা মঙ্গেশকর। রাজ সাহেবের সঙ্গে যে ঝগড়াও করেছেন, সে কথা বলতেও ভোলেননি।
লতা মঙ্গেশকরের ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর গুণী সুরকার। সত্যম শিবম সুন্দরম ছবিতে রাজ সাহেব হৃদয়নাথকে চাইলেন সুর দেওয়ার জন্যে। লতা ভাইকে বলে-টলে রাজি করালেন। হৃদয়নাথ নাকি ফিল্মে সুর দিতে খুব উৎসাহী ছিলেন না! তারপর তো লতা গেছেন আমেরিকায়, গানের অনুষ্ঠান করতে। সেখানেই শুনতে পেলেন হৃদয়নাথ বাদ পড়েছেন রাজ কাপুরের ছবি থেকে। খুব রেগে গিয়েছিলেন। দেশে ফিরে খুব চেঁচিয়েছিলেন রাজজির ওপর, “কেন এমন করলেন? আপনি বললেন বলেই তো আমি ভাইকে বলেকয়ে রাজি করালাম!” ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ ছবি রিলিজ করেছিল লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলালের সুরে। গান কিন্তু গেয়েছিলেন সেই এক ও অদ্বিতীয় লতা মঙ্গেশকর। সেখানে কোনো বদল ছিল না। এমনই সব টক-ঝাল-মিষ্টিতে ভরা স্মৃতিচারণ। জানতে গেলে পড়ে ফেলুন বইটি। ঠকবেন না।
সংগ্রামী ইঞ্জিনিয়ার, পেশায় কনসালট্যান্ট। শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে চর্চা। অল ইন্ডিয়া রেডিওর এ গ্রেড শিল্পী। লেখালেখির অভ্যাসও ছোট্টবেলা থেকে, বাবা-মা'র উৎসাহে। বর্তমানে কর্মসূত্রে নিউ জার্সির পার্সিপেনি শহরে বসবাস। তবে বিদেশে বসেও সাহিত্যচর্চা চলে জোর কদমে। নিউ জার্সি থেকে প্রকাশিত 'অভিব্যক্তি' ও 'অবসর' পত্রিকার সম্পাদক। এছাড়া ‘উদ্ভাস’, ‘প্রবাসবন্ধু’, টেকটাচটক, ‘গুরুচণ্ডা৯’, 'ইত্যাদি ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখিকা।
Madhubala non, oi chhbite Nargis achhen.