ক্রিকেট ব্যাটটা তেলচিটে সোফায় ছুড়ে ফেলে বেরিয়ে এল তোয়া। নিত্যদিন এ অশান্তি আর নেওয়া যাচ্ছে না। কালকের ম্যাচটা হয়ে গেলেই মানুদাকে বলতে হবে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে। এ বাড়িতে থাকলে এ অশান্তি পিছন ছাড়বে না। বাবাকে আর রোখা যাচ্ছে না। রোজ বাড়ি ফিরলেই একবার করে সেই একই চিটচিটে প্রসঙ্গে কথা। চাকরিটা ও করতে পারবে না, আগেই জানিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকেই চাপটা বেড়েছে। গরিব বাপ সনাতনকে মন খুলে খিস্তিও দিতে পারে না তোয়া। মায়ের শরীরের যা হাল, তাতে বাপ একা কদ্দিন এই বিপুল খরচ টানতে পারবে সন্দেহ আছে। শালা আন্তর্জাতিক স্তরে যতই ছেলে-মেয়ে সমান বেতনটেতন হোক, এখনও এসব ছোট লেভেলের টুর্নামেন্টে পুরোটাই ফোঁপরা। টাকা বেশি নেই। যেটুকু হাতে আসে, জিম আর ডায়েটেই চলে যায়। বাকি কিছু থাকলে মায়ের ওষুধ।
মনে মনে একথা সেকথা নাড়তে নাড়তে বরতির মাঠে এল তোয়া। কাল এখানেই তার মরা বাঁচার ম্যাচ। মাঠটা বাইরে থেকে ঘেরা। তবে এই মাঠে তোয়া ছোট থেকে খেলছে। এর প্রতিটা ঘাস ও চেনে। মাঠের বাইরে দাঁড়ালেই কোথা থেকে যেন একশো ঘোড়ার তেজ আসে মনে। ভিখিরির সংসার ছাপিয়ে মনে ভিড় করে একটা টকটকে লাল বল, স্ট্যাম্প আর গ্যালারির তুমুল আওয়াজ। কলকাতার অনামী ক্লাব নবীন সংঘের ও সেরা স্পিনার। বল হাতে কাঁপন ধরিয়ে দিতে পারে বিপক্ষের যে কোনও ব্যাটসম্যানের। মানুদা বলে, ওর বল নাকি বুঝতেই পারে না কেউ, গ্রিপ থেকে বল ছাড়ার পর হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘোরে তোয়ার গুগলি! ও অতশত বোঝে না, শুধু যখন দুটো আঙুল আর বুড়ো আঙুলের মাঝে বল রেখে বলের সিমে চাপ দেয়, তখন যেন বল নয়, গোটা সংসারটাকে ঘুরিয়ে দিতে চায় তোয়া। বনবন করে ঘুরে যায় মায়ের অসুখ, বাবার ধার, সংসারের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় দশা। আর এই সব মিলেমিশে গিয়েই বিপক্ষের স্ট্যাম্প উড়িয়ে দেয়। তোয়া দেখেছে, গরিবিয়ানার যে শক্তি, তা পৃথিবীর কোনও সিমে নেই।
গরিব বাপ সনাতনকে মন খুলে খিস্তিও দিতে পারে না তোয়া। মায়ের শরীরের যা হাল, তাতে বাপ একা কদ্দিন এই বিপুল খরচ টানতে পারবে সন্দেহ আছে। শালা আন্তর্জাতিক স্তরে যতই ছেলে-মেয়ে সমান বেতনটেতন হোক, এখনও এসব ছোট লেভেলের টুর্নামেন্টে পুরোটাই ফোঁপরা। টাকা বেশি নেই। যেটুকু হাতে আসে, জিম আর ডায়েটেই চলে যায়।
দূর থেকে তোয়াকে দেখেই ছুটে এল নিধি। ওদের দলের ওপেনার।
‘আরেহ, তোর কাছেই তো যাচ্ছিলাম। তুই এখানে? আজ প্র্যাকটিসে গেলি না? মানুদা খুব রাগ করছিল।’
‘আর প্র্যাকটিস! কী হবে খেলে? করতে তো হবে সেই বাবার ঠিক করে দেওয়া টাইপিস্টের কাজ!’
‘কী বলছ গুরু, তুমি হলে নবীন সংঘের জেম! যাকে বলে লাকি চ্যাম। তুমি কোথায় ইন্ডিয়া ক্যাপ পরবে তা না… যত আনশান কথা। যাক, শোন, যা বলতে তোর কাছে যাচ্ছিলাম। মানুদা বলেছে, তোকে আজই একবার বাড়িতে দেখা করতে, এখনই যা।’ বলেই হুশ করে সাইকেলটা চালিয়ে কিটব্যাগটা পিঠে বেরিয়ে গেল নিধি।

পায়ে পায়ে মানুদার বাড়ির দিকে এগোচ্ছে তোয়া। কত কী মনে পড়ে যাচ্ছে এখন। এই মানুদার হাতেই তৈরি ও। বাবা নিজে ভালো ক্রিকেট খেলত। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়তে পড়তেই বাবার বাপটা মরল। বাবার খেলা গেল ঘুচে। ভেবেছিল, ছেলে হলে ক্রিকেটার করবে। মেয়ে হওয়ায় ক্রিকেটার করতে পারবে না ভেবে একটু দমে গেলেও ওকে কোনওদিন অনাদর করেনি। মানুদা বাবার চেয়ে একটু ছোট হবে। একসঙ্গে খেলত। বাবার খুব ন্যাওটা ছিল। পরে কোচিংয়ে চলে আসে। বড় বড় ক্লাবেও কোচিং করিয়েছে। কিন্তু ওরা নাকি কোচিংয়ে বড্ড নাক গলাত। কর্পোরেট নিয়মে মানুদা টিমকে খেলাতে চাইত না বলেও ঝামেলা ছিল। একদিন ওদের এক কর্মকর্তার ছেলেকে ব্যাকডোর দিয়ে ট্রায়ালে পাঠায়নি বলে ওরা যাচ্ছেতাই অপমান করে মানুদাকে। কনট্র্যাক্ট শেষ হওয়ার আগেই মুখের উপর মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছিল। তার জন্য জরিমানাটানাও হয়। শেষে মানুদার উকিল কীভাবে যেন কেসটা জিতে যায়। তোয়ার মনে আছে চাকরি ছেড়েই বাবার সঙ্গে দেখা করতে ছুটে এসেছিল মানুদা। বাবা সেদিন মানুদাকে খুব ঝেড়েছিল। হালকা হালকা মনে পড়ছে তোয়ার। মানুদা বাবাকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদছিল। হঠাৎই বাবা বলে বসল, ‘আমার ঘরেরটার তো ক্রিকেটে খুব আগ্রহ, একা একাই দেওয়ালে বল ড্রপ খাওয়ায়, রক্ত বুঝলি তো! কিন্তু ও তো মেয়ে। নইলে তোকে দিয়ে দিতুম আজ। বলতাম, ‘যা শালা, বাঘের বাচ্চা বানিয়ে দেখা। বড় ক্লাব তোকে যে অসম্মান করেছে, তাদের ডেরায় একে পাঠিয়ে প্রতিশোধ নে!’
হঠাৎ কান্না থামিয়ে বাবার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মানুদা। তারপরেই সরমাকে ডেকে বলে, ‘বউদি, সনাতনদা কোনওদিনই মানেনি ক্রিকেটটা মেয়েরাও পারে। ও ভাবে রিস্টের জোরই সব। তুমি তোমার মেয়েটাকে আমায় দেবে বউদি? আমি ওই ছোটলোক ক্লাবকে উত্তর দেওয়ার আগে তোমার বরটাকে উত্তর দেব। বাঘের বাচ্চা করব একে!’
কনট্র্যাক্ট শেষ হওয়ার আগেই মুখের উপর মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছিল। তার জন্য জরিমানাটানাও হয়। শেষে মানুদার উকিল কীভাবে যেন কেসটা জিতে যায়। তোয়ার মনে আছে চাকরি ছেড়েই বাবার সঙ্গে দেখা করতে ছুটে এসেছিল মানুদা। বাবা সেদিন মানুদাকে খুব ঝেড়েছিল। হালকা হালকা মনে পড়ছে তোয়ার। মানুদা বাবাকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদছিল।
মা বাবার খেলা দেখেই প্রেমে পড়ে। তবে ক্রিকেট নিয়ে খুব বেশি পড়াশোনা বা আগ্রহ কোনওটাই মায়ের ছিল না। তবু মেয়ে খেলবে ভেবে ভালো লেগেছিল বোধহয়। মা শুধু একটাই কথা বলেছিল, ‘দেখো ঠাকুরপো, মেয়ের ইস্কুলে যেন অসুবিধা না হয়!’ বাবার ওজরআপত্তি আর ধোপে টেকেনি। তাছাড়া মেয়েদের ক্রিকেট বলতে তখন ঝুলনের নামটুকুই অল্পস্বল্প জানে লোকে। তাই বাপ-মা কেউই ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নেয়নি। নিয়েছিল শুধু মানুদা। লোকাল ক্লাবও মানুদাকে ফেরায়নি। একটা ক্রিকেট কোচিংয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। জনা দশেক ছেলেমেয়ে শিখত। ছেলেই বেশি। ছেলেদের সঙ্গে খেলতে হবে বলে বেশিরভাগ মেয়েদের বাড়ি থেকে এমনিতেই ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখেনি। তার উপর আবার বড় দল থেকে লাথ খাওয়া মানুর কোচিং! তার চেয়ে রবীন্দ্রসংগীত শেখা ভালো। বৈপ্লবিক কিছু চাইলে ক্যারাটে আছে তো!
সেই শুরু হল তোয়ার ছুট। ভোর পাঁচটায় আট বছরের তোয়ার ঘাড় ধরে তুলে তাকে মাঠের ধারে দাঁড় করিয়ে কসরত শুরু করে দিত। তারপর মাঠটা বার দশেক পাক খাওয়ানো। ব্যাট বল কিনে দেওয়া তোয়ার সংসারে বাড়াবাড়ি। সনাতন ওই বাড়াবাড়ির পথ মাড়ায়নি। মানুদার দেওয়া সেকেন্ড হ্যান্ড ব্যাট আর বলেই দিন কাটত তোয়ার। মোড় ঘুরল তোয়ার ক্লাব থেকে নীতিশ বাংলার ট্রায়ালে দারুণ ব্যাট করার পর। মানু যে শুধু কথায় কাটে না, কাজেও কাটে বুঝে গেল লোকাল ক্লাব। তারপর ক্রিকেট কোচিংয়ের জন্য একটা জিমও খুলে দিল ক্লাব। কাজ বাড়ল তোয়ার। মানুদা রোজ দু’ঘণ্টা করে জিমে কাটানোর রুটিন করে দিল। সেই থেকেই মানু কোচের হাতেই তৈরি হচ্ছে তোয়া। পাখি যেমন একটু একটু করে খাবার এনে শাবককে খাওয়ায়, মানুও তাঁর দলের ছেলেমেয়েদের মনে শরীরে একটু একটু করে ক্রিকেট এনে দেয়। আলাদা করে মেয়েদের একটা টিমও হল কালে কালে। সকালে দু’ঘণ্টা, বিকেলে তিন ঘণ্টা মাঠে কাটাতে হয় তোয়াদের। এর মধ্যেই ফ্রি-হ্যান্ড, জিম, সাঁতার, নানা অ্যারোবিক্স। সপ্তাহে একদিন ক্রিকেট ছাড়া অন্য খেলা খেলে শরীরকে টোনড রাখা। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা একই রুটিন। তোয়া স্পিনার, ওর হাতে সহজাতভাবে বল পাক খায়। তার মধ্যে গুগলি, নতুন নতুন নানা সিমের অস্ত্র পুরে দিয়েছে মানু। আর একটু ঘষলে ক্যারমটাও ভালোই করবে। নিরীহ গোবেচারা চেহারার মেয়েটা যে পাঁট ফুট ন’ইঞ্চির সুঠাম ছিপছিপে চেহারায় বিপক্ষের ত্রাস হয়ে উঠবে তা কে জানত! অজান্তেই নিজের হাতদুটোর দিকে তাকাল তোয়া। লম্বা কম্বা করতলে ভাগ্যরেখা অনেক জায়গায় উঠে গিয়েছে। কড়া চামড়া। বলের সঙ্গে ঘষা খেয়ে খেয়ে নমনীয়তা কমেছে। বরং বেশ রুক্ষ। প্রথম প্রথম দুঃখ হত। চেনা হাতদুটো বদলে যাচ্ছে দেখে। দাঁতে দাঁত চিপে মেনে নিত তোয়া। পরে বড় হয়ে ক্রিকেটকে নিজের হাতের চেয়েও বেশি ভালোবসে ফেলল। আর হাত দুটোও আরও রুক্ষ করা শুরু করল শুধু কালকের দিনটাকে দেখবে বলেই।
মানুদা বারান্দা থেকেই তোয়াকে আসতে দেখেছে। তোয়া ঢুকেই দেখল এক গ্লাস বেদানার রস টেবিলে রাখা আছে। বিকেলে এই সময়টা অন্যদিন ওর জিম থেকে ফেরার সময়। আজ যায়নি। বড় ম্যাচের আগে জিমে যেতে বারণ করে মানুদা। ওতে হ্যামস্ট্রিংয়ে টান লাগতে পারে। তবে জিম থেকে ফেরার পর ফলের রসটা খেতে ভোলে না। আজ বাড়িতে ফালতু কিচাইনে ওটাই ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু মানুদা জানল কী করে? এক ঢোকে রসটা শেষ করে মানুদার ঘরের মোড়াটা টেনে বসল।
‘তুই আজ প্র্যাকটিসে যাসনি কেন?’ চোখা অ্যাটাকে মানু।
তুমি তো জানো সব, বাড়ির কী অবস্থা! বাবা আর খেলতে দেবে না বলছে। ওসব ট্রায়ালে যেতে হবে না বলে গত তিন দিন ধরে অশান্তি করছে।’ গুম হয়ে রইল তোয়া।
‘কেন? যেতে হবে না কেন? এই ট্রায়ালটা ভালোভাবে পেরোলে তোকে আর পিছন ফিরতে হবে না তোয়া। কাল বেঙ্গলের সিলেক্টর আসছে। তুই জানিস এই ম্যাচটা কত দামি? সেভেন বুলেটস দারুণ টিম। তাদের এগেনস্টে কিছু করে দেখাতে পারলে বড় ক্লাবের দরজা খুলে যাবে। এই দিনটার জন্যই তো এত খাটতিস!’
‘সবই জানি। কিন্তু বাড়িতেও যে আর চলে না মানুদা। এত খরচ আর টানতে পারছে না বাবা। ক’টা টুর্নামেন্ট পাই বল? কত টাকা আসে ওতে? নতুন ব্যাট-প্যাড নাহয় তুমি কিছুটা দাও বলে চলে। কিন্তু জিম, খাওয়ার খরচ, এক্সারসাইজ কিট… বোলারদের আর ব্যাটসম্যানের মতো কদর কোথায় বল? সবাই রান দেখতে আসে। তোমাকে বললাম, আমাকে একটু মাঝের দিকে ব্যাট করতে পাঠাও, হাতটা ব্যাটেও খুলে গেলে একটা হিল্লে হতে পারত…।’

‘সনাতনদা কি এই চাকরিটা নিয়েই ঝামেলা করছে?’ চোখ দিয়ে শিষ্যকে মেপে নিতে চাইল মানু।
‘হ্যাঁ, গত তিন মাস ধরে একটা চাকরির চেষ্টা করছে আমার জন্য। কারখানার বড়বাবুকে বলে একটা টাইপিস্টের কাজও জোগাড় করেছে। বড়বাবুর কোন বন্ধুর কোম্পানি, টাইপিস্ট নেবে।’
এই অবধি শুনেই হা হা করে হেসে উঠল মানু। ‘তুই করবি টাইপ! স্পিড আছে তোর?’
‘নেই তো! সেই উচ্চ মাধ্যমিকের পর বাবার জোরাজুরিতে ভর্তি হয়েছিলাম। সার্টিফিকেটটা আছে। চেনাজানার চাকরি তো, ওই দিয়েই হয়ে যাবে বলছে। ওখানে ঢুকে দু’এক মাস প্র্যাকটিস করলেই স্পিড উঠে আসবে।’
‘হুঁ।’ কথাগুলো একমনে শুনল মানু। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়ার ঢঙে বলল. ‘শোন তোয়া, কাল পায়ের পজিশন ঠিক রাখবি। ওদের যা টিম, আমাকে স্পিনের উপর নির্ভর করতেই হবে। শেষ ওভারগুলো যদি পাস, একটা বলও ওয়াইড বা নো করবি না। মনে রাখিস, ওয়াইড বা নো দেখতে ভালোবাসে না বড় ক্লাবের সিলেক্টররা। কাল অকারণে ক্যারম করতে যাবি না। ওটা তোকে আর একটু শেখানো বাকি আছে। বরং গুগলিতে শান দে। ওটা তোর সেরা অস্ত্র হবে কাল।’
ওদের যা টিম, আমাকে স্পিনের উপর নির্ভর করতেই হবে। শেষ ওভারগুলো যদি পাস, একটা বলও ওয়াইড বা নো করবি না। মনে রাখিস, ওয়াইড বা নো দেখতে ভালোবাসে না বড় ক্লাবের সিলেক্টররা। কাল অকারণে ক্যারম করতে যাবি না। ওটা তোকে আর একটু শেখানো বাকি আছে। বরং গুগলিতে শান দে।
লোকটা বলে কী! এত কথা শোনার পর কাল কীভাবে খেলবে তা নিয়ে কথা বলছে! হবে কী আর খেলে? সেই তো টাইপিস্টের খটখট নাচছে কপালে। তোয়ার কথাটা বোধহয় পড়তে পারল মানু। বলে উঠল, ‘আর শোন, আজ আর বাড়ি ফিরে কাজ নেই। আমি নিধিকে বলে দিচ্ছি, তোরা দু’জন আজ ক্লাবের রেস্টরুমে রাতটা কাটিয়ে দে। গল্প করে সময় নষ্ট করবি না। খেয়ে সাড়ে ন’টা দশটায় ঘুমিয়ে পড়।’ আমি তোদের কিটব্যাগ ওখানে পাঠিয়ে দেব। সকালে ব্রেকফাস্ট করে টানা মাঠে আসবি। নার্ভ ফেল করবি না।’
***
কাঁটায় কাঁটায় ন’টায় মাঠে পৌঁছল তোয়ারা। বাকিরাও এসে গিয়েছে। সেভেন বুলেটস তাদের কোচের কাছে ভোকাল টনিক নিচ্ছে। মানুদা এসব দেয় না। ওর কাছে মাঠে নেমে পারফর্ম করাই সব। মনের জোর নাকি মন থেকেই আসে। বরং ম্যাচে কিছু ভুল করলে খোঁচা মারতে মানুদা ওস্তাদ। গা জ্বালিয়ে দেয় একেবারে! ওটাই তোয়াদের ভোকাল টনিক। টস শেষ। তোয়াদের ব্যাটিং দিয়েছে ওরা। টসে হারলেই তোয়ার মনটা কু ডাকে। তোয়া একেবারে ন’ নম্বরে ব্যাট করতে নামবে। ক্লাবঘরে গিয়ে বড় প্রোজক্টরে চোখ রাখল ও। নিধি ব্যাট-প্যাড পরে নেমে পড়ল। এই মেয়েটাও বেশ খেলে। হাতে কভার ড্রাইভটা ভালো। একটাই ঝামেলা, মেয়েটার টাইমিং নিখুঁত নয়। এদিকটা নিয়ে মানু খুব ঘষছে। আজ কী হয় দেখা যাক।
ক্যামেরা তাক করল ক্লাবহাউজের ভিআইপি বক্সের মতো করে সাজানো ঘেরা জায়গাটায়। মাথায় হ্যাট আর চোখে সানগ্লাস পরে বসে আছেন বিশ্বমোহন বসু। কলকাতা ক্লাব ক্রিকেটে ওঁর নাম জানে না এমন লোক নেই। সিলেক্টর বলতে তার মানে এঁর কথাই বলেছিল মানুদা! নিধি শুরুটা ভালোই করল। ৮ ওভারে একটা ইয়র্কার বুঝতে না পেরে চালিয়ে খেলতে গিয়ে বোল্ড হতে হল। কিন্তু তারপর আর সেভাবে জ্বলে উঠতে পারছে না কেউ। ওদের করুণা তিরকে নামের বোলারটা একাই তিনটে উইকেট নিয়ে নিল। ওর সামনে আজ দাঁড়ানোই যাচ্ছে না। তোয়াদের স্কোর দাঁড়াল ২০ ওভারে ৬ উইকেটে ১৫৭। টি-টোয়েন্টির বাজারে এমন কিছু বাজারগরম স্কোর নয়। ওদের ওপেনার বেশ ফর্মে। মাঠে নামার আগে মানুদা কী যেন বলে গেল তোয়াদের ক্যাপ্টেন সোমালিকে। প্রথম ওভারে রিয়া রানটা বেঁধে রাখল। দু’টো সিঙ্গল ছাড়া কিছু এল না। সেকেন্ড ওভারও নির্বিঘ্নেই কাটল। থার্ড ওভার থেকে তেড়েফুঁড়ে উঠল সেভেন বুলেটস। তোয়াকে ওই ওভারেই এনেছে সোমালি। দু’ওভারে ২৪ রান দিয়ে তোয়া তখন কোণঠাসা। পরপর দুটো চার আর একটা ছক্কা এক ওভারেই খেয়ে বসে আছে। শালা বাপটা খেলা দেখতে এলে আজই সব শেষ। দর্শকের আসনে যত দূর চোখ যায় একবার দেখে নিল তোয়া। ভালো বোঝা যাচ্ছে না। ওকে আর এক ওভার মতো বল করিয়ে বল দেওয়ার আর সাহস দেখাচ্ছে না সোমালি।
জলপানের বিরতির সময় ও আর মাঠ থেকে বেরয়নি। তোয়া ছাড়া সব বোলার একটা-দুটো করে উইকেট পেয়েছে। অনিয়মিত বোলার রুকসানাও একটা উইকেট পেয়েছে আজ। এক কোণে দাঁড়িয়ে কান্নাটা লুকোচ্ছিল তোয়া। মা কি একটু হলেও ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল? তাই কি মানুদার এককথায় মেয়েকে ওর হাতে তুলে দিয়েছিল। নিজেকে শাস্তি দিতে ইচ্ছে করছে তোয়ার। সেভেন বুলেটসের জিততে আর আটটা রান বাকি। হাতে চারটে উইকেট। হঠাৎ দেখে মানুদা ছুটে ওর দিকে আসছে। সঙ্গে একটা লম্বা খাম।
‘শোন তোয়া, সনাতনটা এটা আমাকে এসে দিয়ে গেল। তোর টাইপিস্টের চাকরিটা হয়ে গেছে। আজ ওরা বাড়িতে একটা ফর্মাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠিয়েছে। আমার মনে হয়, ক্যারম বল শিখে তোর আর কাজ নেই। কাল থেকে হারাধনের টাইপস্কুলে যাস বরং। একটু স্পিড উঠবে।’
এক কোণে দাঁড়িয়ে কান্নাটা লুকোচ্ছিল তোয়া। মা কি একটু হলেও ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল? তাই কি মানুদার এককথায় মেয়েকে ওর হাতে তুলে দিয়েছিল। নিজেকে শাস্তি দিতে ইচ্ছে করছে তোয়ার। সেভেন বুলেটসের জিততে আর আটটা রান বাকি। হাতে চারটে উইকেট। হঠাৎ দেখে মানুদা ছুটে ওর দিকে আসছে।
মানুদার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে প্রায় হু হু করে কেঁদে ফেলল তোয়া। মাঠে ততক্ষণে লোকজন ফিরে আসতে শুরু করেছে। সোমালির কানে কানে আবার কী একটা বলে গেল মানুদা। স্ট্র্যাটেজি নিশ্চয়ই। হাতা দিয়ে তুরন্ত চোখ মুছে মাঠে ঢুকল তোয়া। সোমালি এগিয়ে আসছে ওর দিকে। এ কী! ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনে ও কী করবে!
চোখে চোখ রেখে বলটা দিয়ে সোমালি চলে গেল। পিচে পা ঘষে প্রস্তুতি নিচ্ছে তোয়া। এই বিপুল দুই ওভারের ভার ওর উপর! আর কত অপমান যে লেখা আছে কপালে! স্টান্স নিচ্ছে ব্যাটসম্যান। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে ও কে সামনের সারিতে এগনোর চেষ্টা করছে? সনাতন না! বাবা মাঠে এসেছে? তোয়া বাক্যিহারা। প্রায় ছ’-সাত বছর পর মাঠে এল বাবা। তোয়ার খেলা নিয়ে কোনও উৎসাহ সেভাবে কোনওকালেই দেখায়নি। টুকটাক খবরটবর নিত। মেয়েদের ফুটবলে সনাতনের আগ্রহ নেই। সেই সনাতন আজ নিজের মেয়ের ইনিংস দেখবে! এই লোকটাই ওকে টাইপিস্ট করতে চেয়েছে না? মাথা থেকে সব সরিয়ে ফেলতে চাইছে তোয়া। ব্যাটসম্যানের স্টান্স আর ফুটস্টেপ ছাড়া কিছু দেখছে না। বলের সিমে চাপ দিয়ে আঙুলের কায়দায় আলতো করে বলটা ছাড়ল তোয়া। সাদা বল ঘূর্ণির মতো ঘুরে ঘুরে আছড়ে পড়ছে পিচে। ব্যাটসম্যানের কিছু বুঝে ওঠার আগেই পিচ থেকে আচমকা লাফিয়ে ইন সুইং করে বলটা উড়িয়ে দিল মিডস্টাম্প!

আউট!
তারস্বরে চিৎকার গোটা মাঠ জুড়ে। বাবা ঠেলাঠেলি করে একটা জায়গা করতে চাইছে প্রথম সারিতে। সতীর্থরা আনন্দ করে গেল। কোনওকিছুই যেন ওকে আর স্পর্শ করছে না। একজন হবু টাইপিস্ট তার জীবনের শেষ ম্যাচ খেলছে। বল হাতে লাইনে ফিরল তোয়া। পরের বল লাইন আপ ঠিক রেখেই হল। রান পেল না সেভেন বুলেটস। তার পরেরটাও ডট। নিজের শরীর, পা আর ব্যাটসম্যান ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না তোয়া। এটাই মানুদার সেরা শিক্ষা। শেষ তিন বলে রান হল দুই। সেভেন বুলেটসের এবার দরকার এক ওভারে ছয়। টানটান ম্যাচে গোটা মাঠে পিন পড়লেও শব্দ হবে। ওভারটা সামলে দিয়ে নিজের ফিল্ডিংয়ে ফিরে গেল তোয়া। তোয়ার মুখে যুদ্ধহারার ক্লান্তি। তাও ভালো এই ওভারটা সুযোগ পেতে একটু মুখরক্ষা হল। সোমালির ডাকে ঘুরে দাঁড়াল তোয়া। ছুটে এসে ওর হাতে বলটা প্রায় গুঁজে দিল সোমালি। চোখে চোখ রেখে কেটে কেটে বলল, ‘তুই টাইপিস্ট হবি নাকি ক্রিকেটার এই সিদ্ধান্ত এবার তোর। মানুদা আমাকে সব বলেছে। এই ম্যাচটা হারলেও আমরা ক্রিকেটই খেলব। কিন্তু তুই শালা টাইপিস্ট বনে যাবি। বুঝে নে কী হবি।’ কথাগুলো বলেই এক দৌড়ে ফিল্ডিংয়ে ফিরে গেল সোমালি।
ভূতগ্রস্তের মতো বোলিং লাইনে দাঁড়াল তোয়া। তার মাথার মধ্যে অবিরাম টস চলছে, টাইপিস্ট নাকি ক্রিকেটার, ইন্ডিয়া ক্যাপ নাকি এঁদো চিত্তরঞ্জন সরণির ঘরটা?
নিজের শরীর, পা আর ব্যাটসম্যান ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না তোয়া। এটাই মানুদার সেরা শিক্ষা। শেষ তিন বলে রান হল দুই। সেভেন বুলেটসের এবার দরকার এক ওভারে ছয়। টানটান ম্যাচে গোটা মাঠে পিন পড়লেও শব্দ হবে। ওভারটা সামলে দিয়ে নিজের ফিল্ডিংয়ে ফিরে গেল তোয়া। তোয়ার মুখে যুদ্ধহারার ক্লান্তি।
দাঁতে দাঁত চেপে বলটা ধরল তোয়া। লাইন, লেংথ ঠিক রেখে বলটা মাপে মাপে ফেলল তোয়া। এক রান নিয়ে স্ট্রাইক রোটেট করল ওরা। জীবনের সেরা শিক্ষাগুলোকে গেঁথে গেঁথে নিজের ওভার সাজাচ্ছে তোয়া। পরের তিনটে বল ডট। গ্যালারি থেকে চিৎকার বাড়ছে। পরের বলটা… এ কী! একটুর জন্য আগে গ্রিপ থেকে বেরিয়ে গিয়েছে তোয়ার। বলটা করেই চোখে বুজে ফেলেছে কয়েক সেকেন্ড! সপাটে মারল সেভেন বুলেটস। চার না হলেও হেসেখেলে তিন হয়েই যায়। একটা বিরাট টাইপমেশিন সারা মাঠ জুড়ে নেচে বেড়াতে লাগল তোয়ার চোখের সামনে। খটাখট শব্দ ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্যালারি জুড়ে। কী একটা চেঁচিয়ে বলল সোমালি। এক বল, দু’রান। এক হলেও ম্যাচ টাই। তোয়া কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। শরীরের ভিতর থেকে একটা গরম বেরচ্ছে। যে মনটা পুড়ে যাচ্ছে, এ কি তারই তাপ?
বোলিং এন্ডে দাঁড়িয়ে তিন আঙুল দিয়ে বলটা চাপল তোয়া। ইনিংসের শেষ বল। মধ্যমা আর বুড়ো আঙুল দিয়ে চেপে, ক্যারমের ঘুঁটি ছাড়ার মতোই বলটা বাড়িয়ে দিল ব্যাটসম্যানের দিকে। বলটা ঠিক জায়গা মতো পড়ে অদ্ভুত একটা টার্ন নিল। তোয়া অ্যাকশন না পাল্টানোয় বলের মুভমেন্ট ধরতে পারল না বিপক্ষ। একেবারে পারফেক্ট ক্যারম বল! অফ স্টাম্প ছিটকে উইকেট উড়ে গেল হাওয়ায়। আম্পায়ার নিয়মমাফিক আঙুল তোলার আগেই গোটা গ্যালারি প্রায় নেমে এসেছে মাঠে। সোমালি, নিধি, টুম্পারা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছে তোয়াকে। সতীর্থদের ভালবাসায় মাঠে পড়ে যাচ্ছে তোয়া। সবকিছু ঝাপসা দেখছে ও। দূর থেকে দেখল মানুদা পাগলের মতো দৌড়ে আসছে। তোয়াকে এক হ্যাঁচকায় তুলে বলল, ‘এখুনি চল, বিশ্বমোহনবাবু তোর সঙ্গে একবার দেখা করতে চাইছেন।’
বন্ধুদের কাঁধে চেপে মাঠের বাইরে যেতে যেতে অফ স্টাম্পের উইকেটটার দিকে ফিরে তাকাল একবার। মাঠের মধ্যে ঢুকে যত্ন করে উইকেটটা ফের জায়গামতো গেঁথে দিচ্ছে কে ও? সনাতন না! সংসারের ফাঁকফোকর ঠিক যেভাবে গেঁথে দেয় সনাতন, এক্কেরে ওইভাবে।
অলঙ্করণ: শুভ্রনীল ঘোষ
ছবি সৌজন্য: Shutterstock, Openthemagazine, Flickr, Needpix,
পেশায় সাংবাদিক ও বাচিক শিল্পী। লেখালেখি করেন একাধিক বাংলা পত্র পত্রিকায়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'জলপাই অরণ্যের পারে'।