একদিন বিকেলে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে পড়লাম। সেকেন্ড ক্লাস স্লিপার। আমাদের ক্যুপে এক বিদেশি ছেলে ও তাঁর সঙ্গিনী একটি ভারতীয় মেয়ে। ট্রেন কূ বলে রওনা হয়েই ঘ্যাঁঅ্যাচ করে থেমে গেল! আমরা হতবাক। জানা গেল উড়ো ফোন এসেছে ট্রেনে বোমা আছে! বিদেশির চক্ষু ছানাবড়া। বারবার জিজ্ঞেস করছে পালানো উচিত কিনা। তবে আমাদের দেখে একটু বলভরসা পেয়েছে। খানিকবাদে পুলিশ কুকুর এসে সারা ট্রেনের অন্তর বাহির শুঁকে বলল, কিস্যু নেই, যত বাজে কথা আর হয়রানি! তখন ইঞ্জিন এক গাল হেসে থ্যাঙ্কুউউউউ বলে ট্রেন ছাড়ল।

আমরা দুরাত ট্রেনে কাটিয়ে জম্মু যাব। পথে আমাদের যাত্রাসঙ্গীদের সঙ্গে বকবক করে আমার ছেলে মেয়ের ভালোই কেটেছে। ওরা দিল্লিতে নেমে গেল। আমি ঝুলি থেকে ‘চাঁদের পাহাড়’ বের করলাম। আমি জোরে জোরে পড়ব, সবাই মন দিয়ে শুনবে। এইটা চলবে আমাদের পুরো ট্রিপ জুড়ে। উধমপুর পৌঁছে দেখি শ্রীনগর যাবার কোনও বাস নেই। সব বাস কাটরা যাবে। লোকজন পুণ্য অর্জনের জন্য বৈষ্ণোদেবী যাবে। অগত্যা গাড়ি নিতে হল। সকালে তেমন খাওয়া হয়নি। ঠিক হল, গাড়ি কোথাও দাঁড়ালে আমরা নেমে দূরে চলে যাব। ড্রাইভারকে যত বলি, কোনও জায়গায় দাঁড়িয়ে একটু খেয়ে নেব, সে খালি বলে ভালো জায়গায় খাব, চাওয়াল সবজি, ঘি ডালকে। আচ্ছা বাবা, তাই চলো। খিদেতে পেট ডাকাডাকি করতে শুরু করেছে, তখন আমরা সেখানে পৌঁছলাম। পরিষ্কার থালায় গরম গরম সরু চালের ভাত আর ফুলকপির তরকারি, তার ওপর ছোট এক বাটি জলের মতো টলটলে ঘি ঢেলে দিল! এবার বুঝলাম ঘি ডালকে কাকে বলে!

Dal Lake (3)
জহর টানেল পেরিয়ে কাশ্মীর উপত্যকা যেন রূপকথার দেশ

জহর টানেল পেরিয়ে কাশ্মীর উপত্যকা যেন রূপকথার দেশ। দেখে দেখে আশ মেটে না। পামপোরে ফুলের চাষ, সেই ফুলের রেণু থেকে জাফরান তৈরি হয়। যত এগোচ্ছি, তত দেখি প্রতি পঞ্চাশ মিটার অন্তর অন্তর একজন মিলিটারি দাঁড়িয়ে আছে অতন্দ্র প্রহরায়। খুব মনখারাপ হল। শ্রীনগর যখন ঢুকলাম তখন সন্ধ্যা নেমেছে। ঢোকার মুখেই কাশ্মীর ট্যুরিজ়মের অফিস। আমাদের যথারীতি কোনও হোটেলে বুকিং করা নেই। আমাদের বাসনা আমরা সরকারি ট্যুরিস্ট লজে থাকব। গাড়ি দাঁড়িয়েছে কি দাঁড়ায়নি, অন্ধকার ফুঁড়ে এক সাড়ে ছফুটি দেড়েল আমাদের দিকে ধেয়ে এল। বলে, আমি রেজিস্টার্ড গাইড, তোমাদের সস্তার ভালো হোটেলে নিয়ে যাব। আমরা বললাম, আমরা সরকারি ট্যুরিস্ট লজে থাকব। সে বলল ওটা এখন বন্ধ। পার্থকে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গেল, সে যে একজন গাইড সেই প্রমাণ সে দেবেই। খানিকবাদে আমার খেয়াল হল আমাদের তো দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে বসে থাকার কথা নয়! তিনজন নেমে বাইরে দাঁড়ালাম।

কিছুক্ষণ বাদে পার্থ আর ওই ভদ্রলোক ফিরে এলেন আর উনিও গাড়িতে চড়ে বসলেন। কথায় কথায় জানলাম যে পরদিন রমজানের প্রথম দিন। কোনও বাস ছাড়বে না! সুতরাং শ্রীনগরে দুরাত থাকতেই হবে! বেঙ্গল লজ নামে একটা ছোট হোটেলে উনি আমাদের নিয়ে গেলেন। সাদা সিলওয়ার কামিজ পরা লম্বা ফর্সা কাশ্মীরি হোটেল মালিক পরিষ্কার বাঙলায় বললেন, ‘নমস্কার, আসুন দাদা।’ আমরা চমৎকৃত। হোটেলটা লেকের পাশে নয়, তেমন কোন দৃশ্য দেখাও যায় না, কিন্তু আমাদের ভালোই লাগল।

পরদিন ভোরে উঠে পড়লাম। সবাই ঘুমোচ্ছে। আমি একা একা বেরিয়ে পড়লাম। বড় বড় বাড়ি যেগুলোতে পুলিশ বা মিলিটারি অধিগ্রহণ করেছে, সেগুলো কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। সাধারণ মানুষ তার মধ্যেই বাজারহাট করছে। ওসব বোধহয় ওদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। কোনও পর্যটকের টিকির দেখা নেই। কাশ্মীর সম্বন্ধে আমার ধারণা ছিল, যে পর্যটন ছাড়া ওদের বিশেষ কিছু নেই। সর্বৈব ভুল ধারণা। ওখানে কৃষিকাজ সবচেয়ে প্রধান। তাছাড়া কটেজ ইন্ডাস্ট্রি যথেষ্ট ভালো। হোটেলে ফিরে দেখি সকলে তখনও ঘুমুচ্ছে। এক চশমাপরা ভদ্রলোক এলেন দেখা করতে। বললেন লেকে বোটিং করতে নিয়ে যাবেন। বুঝলাম যে শ্রীনগরে পরিযায়ী পাখির মতো কিছু বাঙালি ট্যুরিস্ট দেখা গেছে এই সংবাদ ভালোই ছড়িয়েছে। রাজি হয়ে গেলাম ওঁর কথায়। জিজ্ঞেস করলাম, আজ তো রমজান শুরু, আপনার অসুবিধা হবে না? উনি বললেন আমার শরীর অসুস্থ, ওষুধ খাচ্ছিতাই আমি এখন নিয়ম পালন করব না, পরে করব। জানলাম যে আতুরে নিয়ম নাস্তিসব ধর্মেই চলে।

Dal Lake 2
ভদ্রলোক বললেন বললেন লেকে বোটিং করতে নিয়ে যাবেন

সেদিনটা বেশ কাটল শিকারায় ঘুরে। দেখি ছোট একটা ডিঙি নৌকায় একজন গয়না বিক্রি করতে চলে এল। লেকের ওপরেই কেনাকাটা চলল। “কাশ্মীর কি কলি” মনে পড়ে গেল। ফিরে এসে রোদ ঝলমলে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বাসডিপো গেলাম টিকিট কাটতে। অচেনা লোকজন বাচ্চাদের দেখে হাসছে, কেউ কেউ এসে গাল টিপে আদর করে যাচ্ছিল। রাস্তায় ওখানে বাচ্চাদের দেখা পাইনি, খুব অদ্ভুত লেগেছিল। আর একটা ব্যাপারও অদ্ভুত লেগেছিল। শাড়ি কিনতে গিয়ে বলেছি, এত তো সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে পারব না। দোকানদার বললেন আমরা ক্যুরিয়ারে পাঠিয়ে দেব। তারপর জাবদা খাতা খুলে অনেক নাম ঠিকানা দেখাতে লাগলেন যাদের উনি আগে পাঠিয়েছেন। আমি বললাম এত কেন দেখাচ্ছেন, আমি তো রাজি। উনি বললেন সবাই তো বিশ্বাস করতে চায় না। সত্যি আমরা একে অপরকে বিশ্বাস করতে কী করে যেন ভুলে গেছি। এটা যে কতবড়ো একটা ক্ষতি, তা আমি পদে পদে অনুভব করি।

Shikara In Dal Lake
সেদিনটা বেশ কাটল শিকারায় ঘুরে

সকালে বাসে চেপে রওনা হলুম। বাঁদিকের সিটে ছেলে আর আমি, ডানদিকে পার্থ আর মেয়ে। সোনমার্গ পেরিয়ে জোজি লা। দূর থেকে একটা বিরাট দেওয়াল মনে হয়। রমজানের দিনে দুপুরে কেউ খাবে না, তাও আমাদের জন্য বাস কিছুক্ষণ দাঁড়াল। জোজি লার পাহাড়ি পথে উঠছি, হঠাৎ ছেলে বলে উঠল, নীচে দেখো মা, একটা বড় বেড়াল। দেখি একটা স্নো লেপার্ড, গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যাচ্ছে তার শিকারের দিকে। এই প্রাণী সচরাচর দেখা যায় না। জোজি লা পেরিয়ে আমাদের সঙ্গী হল দ্রাস নদী। বড় বড় পাথর কাটিয়ে কুলুকুলু জল। কিন্তু খুব ন্যাড়া রুক্ষ জায়গা। পথে একটা ব্রিজ ভেঙে গেছে। আর্মির লোকজন সারাচ্ছে। বাসের জানালা বন্ধ করতে হয়েছে। না হলে জোরালো হাওয়ায় ধুলো উড়ে নাকে মুখে গালে ঢুকে যাচ্ছে, নিঃশ্বাস নেওয়াই কষ্টকর। দূরে ছোট ছোট বাঙ্কার। আর্মির লোকজন ওখানে থেকে পাহারা দেয়। কি কঠিন জীবন! ঘণ্টা দুয়েক পরে আবার চালু হল বাস। পেরিয়ে গেলাম দ্রাস গ্রাম। রোদ ঝলমলে কার্গিল পৌছোলাম।

শ্রীনগর থেকে লেহ দুদিন লাগে। যাত্রীরা কার্গিলে থাকে। লাদাখের দ্বিতীয় বড় শহর হল কার্গিল। শহরের একপাশ দিয়ে সুরু নদী বয়ে যায়। এই নদী মিশেছে সিন্ধু নদীতে। আমরা যথারীতি সরকারি ট্যুরিস্ট লজে থাকব ঠিক করেছি এবং কোনও বুকিং করতে পারিনি। বাসের এক সহযাত্রী, এক ইস্কুলমাস্টার, আমার হাত থেকে সুটকেস নিয়ে নিলেন এবং আমাদের পৌঁছে দিলেন ট্যুরিস্ট লজে। যেতে যেতে বললেন, পাহাড়ের মাথায় লজ, আপনি এই নিয়ে উঠতে পারবেন না। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা পেলাম না। ইনচার্জকে খুঁজতে পার্থ ভেতরে গেল আর মালপত্র নিয়ে আমি বাইরে, গেটের কাছে। হঠাৎ দেখি একপাল ছোট ছোট মুরগি দানা ঠুকরে ঠুকরে চলেছে। আমার ছেলেমেয়ে মনের সুখে ওদের তাড়া করলো। মুরগির দল বাঁচাও বাঁচাও বলে চেঁচিয়ে ছুট দিল। আমি অসহায় হয়ে দেখছি, কাউকে বকে ঝকে থামাতে পারছি না। 

Road trip to Ladakh
পাহাড়ি পথে গাড়ির যাত্রা

এমন সময় এক পক্বকেশ বয়স্ক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। পরনে ফাদারদের সাদা জোব্বা, গায়ের রং কালো। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি মালয়ালি? বললাম, না আমি বাঙালি। উনি খানিকক্ষণ আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ইতিমধ্যে পার্থ এবং অফিসার বেরিয়ে এল। অফিসার বললেন, ঘর নেই। ফাদার এগিয়ে এসে বললেন, কেন অমুক ঘর তো খালি। তেতো পাঁচন খাওয়া মুখ করে অফিসার বললেন, ওটা দেওয়া যাবে না; যদি কেউ এসে যায়? ফাদার ছাড়ার পাত্র নন। বললেন আর একটা বাড়ি তো আছে, সেখানে ঘর খালি নেই? অফিসার বাধ্য হয়ে সেখানে গিয়ে সবচেয়ে ওঁচা ঘরটা খুলে দিলেন। আমাদের সঙ্গে বসে চা বিস্কুট খেতে খেতে ফাদার বললেন, যদি তোমরা ঘর না পেতে, আমি আমার ঘরটা তোমাদের ছেড়ে দিতাম। বেড়াতে গিয়ে এই তো আমার পরম প্রাপ্তি। অচেনা, অজানা মানুষজন এক লহমায় আপনার হয়ে যায়। তাদের সহৃদয় ব্যবহার নতুন করে পৃথিবীটাকে ভালোবাসতে শেখায়।

পার্কাচিক হিমবাহ আমাদের গন্তব্যস্থল

কার্গিল থেকে একটা গাড়ি নিয়ে পরদিন সুরু নদী ধরে ধরে তার উৎস, অর্থাৎ দক্ষিণদিকে যাত্রা করলাম। এ অঞ্চলে বড়ো গাছ বিশেষ নেই, আছে চারণভূমি। এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার ডেকে নিয়ে গেল পাহাড়ের চড়াইতে। সেখানে পাহাড়ের ভেতর থেকে জল বেরিয়ে ঝর্ণা হয়ে নেমেছে। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। মাটির নীচে, ভূ-জলতল বরাবর, বা নীচে যে aquifer থাকে, সেখান থেকে জল গড়িয়ে আসে পাহাড়ের গা ভেদ করে। আঁজলা ভরে সেই ঠান্ডা, সুস্বাদু জল পান করলাম। সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। খানিকবাদে পৌঁছে গেলাম পানামিক। পানামিকের কাছে কুন ও নুন নামে এক জোড়া পর্বতশৃঙ্গ আছে। সেখান থেকেই নেমে আসে পার্কাচিক হিমবাহ, আমাদের গন্তব্যস্থল।

Mulbek
মুলবেকে ত্রিশ ফুট উঁচু মৈত্রেয় জাতক

গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা হেঁটে হিমবাহ দেখতে গেলাম। রাস্তার ওপারে হিমবাহ। মাঝখানে একটা প্রশস্ত, অগভীর খাদ। মোরেন দিয়ে ঢাকা হিমবাহ যতদূর দেখা যায় কুচকুচে কালো। বরফের নদীর এই রঙ? বাচ্চারা হতাশ হয়ে পারলে রোদচশমা খুলেই ফেলে! ওখানকার মানুষজন হিমবাহ চড়তে বারণ করল। বলল কদিন আগে আর্মির কিছু লোক ইকুইপমেন্ট না নিয়ে চড়ছিল, একজন ধ্বসে ভেতরে পড়ে গেছে, মারা গেছে। সেদিন রাতটা পানামিকে কাটিয়ে পরদিন কার্গিল ফিরলাম। এবার ট্যুরিস্ট লজে প্রথম বাড়িতে আশ্রয় মিলল। হাসিমুখে ফাদার টমাস আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। এই লজে রাঁধুনির নাম কাসিম। যতটা দৈর্ঘ্যে, ততটাই প্রস্থে। এর সঙ্গে আমার খুব জমে গেল। অনেক করে বায়না করলাম কাসিমভাই, রিস্তে বানাও। বলে, নেহি হোগা, মাস কো কুটনা পড়তা হ্যায়। মোট কথা দুপুরবেলা ও আর অত খাটবে না। বললাম আমি সাহায্য করব, কিন্তু চিঁড়ে ভিজল না। বলল, কাল বানায়েঙ্গে। তাতে আর কী লাভ, আমরা তো চলেই যাব পরদিন!

কাসিম আমাদের জন্য গাড়ি ঠিক করে দিল। জিপের মাঝের পুরোটাই আমাদের, সামনে পিছনে অন্য লোক বসবে। এদিকে পার্থ ওই অফিসারের সঙ্গে কথা বলে তিনগুণ দামে গাড়ি ঠিক করেছে, সেটা পার্কাচিক যাবার আগে। যখন জানলাম, তখন বললাম তাকে বারণ করে দাও। পার্থ তো শুনবে না, সে নাকি কথার খেলাপ করবে না। কাসিম আমার দিকে খুব করুণার দৃষ্টিতে তাকাল। ভাবখানা, এমন লোকের সঙ্গে তুমি কী করে বাস করো? আহা রে, তোমার কত কষ্ট!

যাই হোক, ভাগ্য ভালো, সেই গাড়ি কথা রাখেনি, অন্য কোথাও চলে গেছে। আমরা আরাম করে কাসিমের ঠিক করা গাড়িতে উঠে পড়লাম। আর কোনও যাত্রী ছিল না। ফাদার টমাস আমাদের সঙ্গে উঠলেন। ওঁকে একটি স্কুলে নামিয়ে দিতে হবে। সারা রাস্তা নানারকম ধাঁধা আর tongue twister খেলতে খেলতে আমরা ওঁর গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। এরপর আর কোনওদিন ওঁকে দেখিনি। মাসের পর মাস লাদাখে বসবাস করা ওই ফাদার টমাসকে আমি চিরকাল মনে রাখব।

Confluence of Zanskar and Indus Leh
লেহ-এর পথে সিন্ধু আর জাঁস্কার নদীর সংযোগস্থল

আমাদের গাড়ির চালক বেশ ছোট একটি ছেলে, বয়স ষোলো সতেরো। যেতে যেতে গল্প বলল কার্গিল যুদ্ধের সময় ওদের কেমন করে অন্ধকারে হেডলাইট না জ্বালিয়ে যাওয়া আসা করতে হত। পথে মুলবেক পড়ে, সেখানে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা ভাস্কর্য, তিরিশ ফুট উঁচু মৈত্রেয় জাতক। খরোষ্ঠি লিপিতে কিছু লেখাও আছে। নদীর পাশ দিয়ে রাস্তা। মাঝে মাঝে নদী হারিয়ে যায়। আমরা গ্রেটার হিমালয়ের উত্তর দিকে চলে যাবো। সেখানে মালভূমি। পাহাড়ের মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে যাওয়া নয়। পরিষ্কার রাস্তা বহুদূর অবধি দেখা যায়।

এক জায়গায় চালক বলল এখানে চুম্বক পাহাড়। গাড়ি নিউট্রাল গিয়ারে রাখলে গড়গড় করে পেছন দিকে চলে যায়! হাতে নাতে প্রমাণ পেলাম! ম্যাজিক যেন। পরে পড়েছি ওটা একটা চোখের ভুল। দূর থেকে লামায়ুরু গুমফা দেখলাম। পাহাড়ের কোলে ঝকঝকে মণির মতো। তারপর দেখতে দেখতে এসে পড়লাম নিমূ নামে একটা জায়গায়। সেখানে জাঁস্কার নদী মিশেছে সিন্ধু নদীতে। কী অপূর্ব সেই জায়গা! নিমূ-র কিছু পরে পৌঁছে গেলাম লেহ। এখানে বরফচূড়া দেখতে হলে দক্ষিণ দিকে তাকাতে হয়। সরকারি ট্যুরিস্ট লজ শহর থেকে একটু দূরে। সেখানেই ছিলাম। 

এখানেই আমার গল্প শেষ, গন্তব্যে পৌঁছে। শুধু উপসংহারে বলব, যে বাড়ি ফিরে দেখি ক্যামেরার ফিল্টারে ফাঙ্গাস ছিল, পার্থ খেয়াল করেনি, সব ছবি নষ্ট। এখানে যে ছবি দিয়েছি সেগুলো আমার পিসতুতো বোন কাকলির তোলা। ও ২০১৮ সালে গেছিল। আর আমার সব ছবি আছে আমার নিভৃত স্মৃতিতে অম্লান।

 

*ছবি সৌজন্য: কাকলি মজুমদার, The Himalayan Club, Wikimedia Commons

বিশাখা ঘোষ পেশাগত বাঁধনে বাঁধা অর্থনীতির সঙ্গে। কিন্তু মন চায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতে, আর অজানা পৃথিবীকে চিনতে। তাতে নিজেকেও তো চেনা হয়। আপনাকে জানাতে তাঁর ভারী কৌতূহল। ছাত্রাবস্থা কেটেছে প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁটাকল ক্যাম্পাস আর আইএসআই-তে। এখন কল্যাণী বিশ্ববিদ্য়ালয়ে অধ্যাপনা করেন। ভালোবাসেন আড্ডা মারতে।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *