এখন দেখি লক্ষ্মী বা সরস্বতীপুজোয় খিচুড়ি, লাবড়া, পায়েস রান্না করে ঠাকুরের ভোগ দেওয়া হয়। দিনকালের পরিবর্তন হয়েছে। তাই ঠাকুরমশাইরা আর আপত্তি তোলেন না। সব বাড়িতেই ভোগ নিবেদন করে মন্ত্র পড়েন। এই পরিবর্তনটাই ভাল হয়েছে, ঠাকুরের কাছে তো সবাই সমান! ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য, নবশাখ ইত্যাদি জাতবিচার যত উঠে যায় ততই মঙ্গল।

আমাদের ছোটবেলায় কিন্তু ভোগ দেওয়া ব্যাপারটা এমন সহজ সরল ছিল না। লক্ষ্মীপুজো বা সরস্বতীপুজো তখনও ঘরে ঘরেই হত। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়ি ছাড়া অন্নভোগ দেওয়ার অধিকার কারুর ছিল না। বেশ মনে পড়ে, লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন বাবার সঙ্গে আমরা দুই ভাইবোন বাজারে যেতাম, কারণ অনেক বাজার হবে, বয়ে আনতে হবে। ছোট লক্ষ্মীপ্রতিমা বা সরা, ধানের শিস, নারকোল, কলাগাছের খোল ছাড়াও আলাদা করে খই, ময়দা, সুজি, গুড়, কিসমিস, ঘি কেনা হত। কারণ, রান্নাঘরের আঁশের ছোঁয়া লাগা জিনিস ঠাকুরের ভোগে চলবে না।

Kojagori Lakshmi Puja
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো মানেই সরা কিংবা ছোট্ট প্রতিমা

পুজোরদিন সকাল থেকে মা আমাকে চান করিয়ে ধোয়া শাড়ি পরিয়ে কাজে লাগিয়ে দিতেন। নারকোল কুরনো, খইয়ের ধান বাছা, লুচির ময়দা মাখা এইসব খুচরো সাহায্য। তবে তার জন্য উপোস করে থাকতে হত। তখন ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি। শাড়ি সামলে এইসব কাজ করতে গিয়ে মনে হত ভাইয়ের তুলনায় অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছি।

মা স্নান করে একখানা পুরনো প্রায় পিঁজে যাওয়া বিষ্ণুপুরী রেশমি কাপড় পরে কাজে লাগতেন। ঠাকুরের জন্য আলাদা উনুনে আঁচ দিয়ে পুজোর জন্য তুলে রাখা পেতলের কড়াইতে ভোগ তৈরি হত। লুচি, হালুয়া, নারকোল নাড়ু, গুড় আর খইয়ের উখড়া বা ঘরোয়া মুড়কি। তারপর ফলটল কাটা, দূর্বো বাছা– আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে বহাল থাকতাম।

Lakshmi Puja Alpana
চালের গুঁড়োর আলপনা

চাল বেটে সেই গোলা দিয়ে আলপনা দেওয়া অবশ্য পুরোটাই আমার কাজ– মা শুধু ধানের ছড়া, লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ, পেঁচা আঁকার কথা মনে করিয়ে দিতেন। আমি জিজ্ঞাসা করতাম:
দীপ্তিদের বাড়ির মতো আমাদের খিচুড়ি লাবড়া হয় না কেন?
ওরা ব্রাহ্মণ তো তাই। আমাদের অন্নভোগ দিতে নেই।
খই তো ধান থেকে হয়, কত ধান ফেললাম।
তর্ক করিস না তোট্রাঙ্কের উপর আর আর আলমারির গায়ে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ এঁকেছিস?

চালের হাঁড়ি, কাপড়ের আলমারি আর ট্রাঙ্কের উপর মা লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ আঁকতে হততাহলে নাকি অন্নাভাব থাকবে না, অনেক কাপড়জামাও হবে। জোড়া পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটতে মায়ের কষ্ট হবে ভেবে আমি প্রথমে বাঁ পা, একটু এগিয়ে ডান পা- মাঝে ধানের ছড়া আঁকতাম। মা আপত্তি করেননি। তবে জামাকাপড় তেমন বেশি কিছু হত না। টানাটানি সংসারে লেগেই থাকত। কিন্তু পুজোর দিন ওসব কেউ মনে রাখে নাকি? ঠাকুরমশায় অনেকবাড়ি পুজো সেরে আসতে মহা দেরি করতেন, ভাই আর আমি অস্থির হয়ে পড়তাম। বাড়ির পুজো শেষ হলে তবে তো পাড়াসফরে বেরব!

যাদবপুরে তখন প্রায় সবই বাঙালবাড়িকোজাগরী লক্ষ্মীপুজো সব বাড়িতেই হত। কিন্তু দীপ্তিদের বাড়ির পুজোর টান আমাদের কাছে আলাদাকারণ ওরা চক্রবর্তী, বামুনবাড়ি, অন্নভোগ দেওয়া হত আর আমাদের দুই ভাইবোনের প্রসাদ পাওয়ার নেমন্তন্ন থাকত। প্রতিবছরই এক মেনু ভোগের– প্রচুর ঘি দেওয়া গোবিন্দভোগ চাল আর সোনামুগ ডালের খিচুড়ি, গোল চাকা চাকা বেগুনভাজা আর স্বর্গীয় স্বাদের লাবড়া, শেষপাতে পায়েস।

ওদের বড়ো শোবার ঘরখানাতে দীপ্তি, কাজলদা আর গোবিন্দদা মিলে সতরঞ্চি বা বিছানার চাদর ভাঁজ করে পেতে দিত। আমরা বসলেই সামনে ধোয়া কলাপাতা পড়ত, মাটির খুরিতে জল। বাড়ির ছেলেমেয়েরা আর ওদের বাবা পরিবেশন করতেন। প্রতিবারই মনে হত খিচুড়ির গন্ধটা এবার আরও ফাস্টোক্লাশ হয়েছে। আমরা সবাই বেশি খেয়ে ফেলতাম, বাড়ি ফিরলে মা ঠাট্টা করে বলতেন, ‘প্রসাদ কণিকামাত্র, ভোজনে সোয়াসের।’ অনেকরাতে দেখতাম আকাশে নিটোল গোল রুপোর থালার মতো চাঁদ উঠেছে। দু’লাইন মনে পড়ত, কার লেখা ভুলে গিয়েছি।

Lakshmi_Puja_prasad
অব্রাহ্মণের বাড়িতে প্রসাদ মানে খই মুড়কি নাড়ু মোয়া ফল…

        ‘শঙ্খধবল আকাশগাঙে শুভ্র মেঘের পালটি মেলে,
        জ্যোৎস্নাতরী বেয়ে তুমি ধরার ঘাটে কে আজ এলে।

যাদবপুর ছেড়ে কবেই চলে এসেছিপরপর দুই উপযুক্ত ছেলে মারা যাওয়ার পর দীপ্তিদের বাড়ির কোজাগরী পুজোতেও ভাঁটার টান লেগে গিয়েছিল। এখন বোধহয় বামুনবাড়ির ভোগ ব্যাপারটাই নেই। সেসব উঠে গিয়ে ভালই হয়েছে। কিন্তু স্মৃতির অ্যালবামে একটুও মলিন হয়নি সেইসব রাত্রি, পিতলের মস্ত ডেকচি টানতে টানতে ঘরে ঢুকে গোবিন্দদা বলছে, ‘কোনদিক থেকে শুরু করব দিতে, বল সবাই। আমরা জনা সাতআটেক পাড়ার ছেলেমেয়ে একসঙ্গে হাত তুলে দাবি জানাচ্ছি– আমার দিক থেকে!

লক্ষ্মীর আর এক নাম শ্রী– বড়ো শ্রীমন্ত ছিল সেইসব দিন। এখনও সেই খিচুড়ি আর লাবড়ার সুঘ্রাণ পাই। নাকি অতীত বলেই সুন্দর? কে জানে! 

চাকরিজীবনের শুরুতে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন এবং পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হয়ে অবসরগ্রহণ করেন। গৌড় বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও সামলেছেন। গল্প ও প্রবন্ধ লিখছেন কয়েক দশক। নারী ও সমাজ বিষয়ে ওঁর প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *