অর্ধসূর্যের দেশে: প্রথম পর্ব

বাংলাদেশেও ব্রিটিশ রাজত্বের আগে থেকেই বজায় ছিল এই দাস প্রথা। কিন্তু ব্রিটেনে এর তীব্র বিরোধীতার ফলস্বরূপ ১৮৪০ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে বাংলা থেকে তা লোপ পায়। তবে আফ্রিকাতে অতি দীর্ঘ সময় ধরে এই নারকীয় প্রথা স্থায়ী হয়েছিল। এই নিষ্ঠুর জঘন্য প্রথা সেখানে যুগের পর যুগ টিঁকে থাকার অনেকগুলো কারণ আছে।

প্রথমত, প্রথম থেকেই তারা তাদের গোষ্ঠীপতি ও অদেখা নানা দেবতার কাছে মনে মনে বলিপ্রদত্ত। সাদা চামড়ার লোকদের তারা প্রথমে দেবতাই ভেবেছিল। কষ্টসহিষ্ণু সরল পরিশ্রমী এই মানবগোষ্ঠীর রক্ত ঘাম ও চোখের জলের ফায়দা তুলেছে পশ্চিম দুনিয়া। দ্বিতীয়ত, আফ্রিকান গোষ্ঠীপতিদের নির্বোধ লোভ। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এরা গ্রাম কে গ্রাম উজাড় করে মানুষ তুলে দিয়েছে বিদেশিদের হাতে, শুধু মূল্যহীন বিলাস সামগ্রীর লোভে। তৃতীয়ত, ভৌগোলিক অবস্থান। আটলান্টিকের তীর ধরে গ্রামগুলো থেকে অত্যন্ত সহজে পাচার হয়ে গিয়েছে হাজার হাজার কালো মানুষ। কত পরিবারের পাঁচটি প্রজন্মই কেটেছে ক্রীতদাস হিসেবে। বিখ্যাত তারকা গায়ক মাইকেল জ্যাকসনের পূর্বপুরুষ ছিলেন এই বাডাগ্রিরই বাসিন্দা।

নিজেদের রাজার বিশ্বাসঘাতকতায় নিয়তিকে স্বীকার করে স্বাধীন কালো মানুষের দল অসহায় দাসের জীবন মেনে নিত প্রথমে। তারপর সহ্য করতে না পেরে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করত। পালাতে গিয়ে বিশেষভাবে শিক্ষিত কুকুরের খাদ্য হত। সর্বসমক্ষে নির্মমভাবে অত্যাচারিত হত অন্যদের শিক্ষা দেবার জন্য। এইসব ছবি রাখা আছে মিউজিয়ামে। আশ্চর্য উপায়ে তাদের একটি দল বিদেশী প্রভুদের শায়েস্তা করেছিল। তারা যখন বুঝতে পেরেছিল তাদের সন্তানও হবে ক্রীতদাস, তখন তারা সন্তানধারণ বন্ধ করে দিয়েছিল। ইতিহাসের এই কলঙ্কজনক অধ্যায়ের বিবরণ অতি সাধারণভাবে ধূলিধূসরিত হয়ে পড়ে আছে। লোহার বিবর্ণ শিকল, হাতকড়া ইত্যাদি চোরেদের আগ্রহের বস্তু নয়। তাই পাহারাও নেই। শুধু অতলান্তিকের হাওয়ার হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাস জানিয়ে যাচ্ছে কত মানুষের চোখের জল এই সাগরে মিশে আছে।

abeokuta city Nigeria
পাখির চোখে আবেওকুটা শহর

এই দিনেই বাডাগ্রির পর গেলাম আবেওকুটায়। লাগোস থেকে প্রায় দুশো মাইল দূরে বাঙালিরা আসেন মাছ কিনতে। ভেটকি, পার্শে, ট্যাংরা সবই পাওয়া যায়। মাছ যে অত সুস্বাদু হতে পারে, আবেওকুটার মাছ না খেলে জানতেই পারতাম না। অনেকেই আমাকে বলেছিলেন বরফে জমিয়ে এই মাছ দেশে নিয়ে আসতে। কারা নাকি এইভাবেই এখানকার চিংড়ি দেশে নিয়ে গিয়েছেন। মাছের আয়তন ও স্বাদ দেখে মনটা একটু দূলে উঠেছিল কলকাতার মৎস্যপ্রিয় আত্মীয় বন্ধুর জন্য। এর থেকে ভালো উপহার আর কি হতে পারে? শেষটায় অবশ্য সাহসে কুলোয়নি। 

আবেওকুটা বিশাল পাথরের স্তুপের জন্য বিখ্যাত। লিফটে করেও পাহাড়ের মাথায় ওঠা যায়। এখানেই প্রথম বেশ কয়েকজন টুরিস্ট চোখে পড়ল। বেশিরভাগই কালো মানুষ। আমাদের মতো খয়েরি বা সাদা নেই। আমি মুগ্ধ হলাম সম্পূর্ণ অন্য কারণে। ছোটবেলায় শান্তিনিকেতনে যে খোয়াই দেখেছিলাম সে তো এখন সম্পূর্ণ ইতিহাস। আবেওকুটায় দেখলাম সেই লাল ঢেউ খেলানো খোয়াই উদ্ধত গর্বিত ভঙ্গিতে নির্জন দাঁড়িয়ে আছে মাইলের পর মাইল জায়গা জুড়ে।

লেগোসের রবিবার দেখে অবাক হয়ে গেলাম। সাগরের দিকে ছুটে চলা নদীর মতো এরকম চার্চগামী মিছিল আগে কখনও দেখিনি। কতরকম ঝলমলে পোশাক আর চুলের বাহার করে এরা চার্চে যায়। গান-বাজনা সামাজিকতা ট্যালেন্ট শো আত্মীয় বন্ধুর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ সব ওই চার্চে। একটি চার্চে দেখলাম আমাদের মন্দিরের মতো বাইরে জুতো ছেড়ে সবাই ভেতরে ঢুকছে। প্রত্যেকে নিজের রোজগারের অন্তত টেন পার্সেন্ট নিয়ম করে চার্চকে দেয়।

স্কুল কলেজ হাসপাতাল দোকান বাজার অফিস নিয়ে ‘ক্যাননল্যান্ড চার্চ’ বিশ্বের অন্যতম ধনী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এর কোনও পরিষেবাই চার্চের বলে সস্তা নয়। খরচের যা বহর, মধ্যবিত্তদের পক্ষেও সম্ভব নয়। আমাদের ফুটপাতের সিঁদুর মাখানো ইট যে ভাবে মার্বেল মন্দির হয়ে যায়, ঠিক সেভাবে এখানেও একটা সামান্য ছাউনি বিশাল চার্চ হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ কোনও না কোনও শক্তির কাছে মাথা নত করে থাকতে ভালোবাসে এখনও। হয় মোড়ল নয় চার্চ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুই জায়গাতেই। সেইজন্যই বুঝি এতদিন ধরে দাসপ্রথা টিঁকে ছিল।

রাজার বিশ্বাসঘাতকতায় নিয়তিকে স্বীকার করে স্বাধীন কালো মানুষের দল অসহায় দাসের জীবন মেনে নিত প্রথমে। তারপর সহ্য করতে না পেরে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করত। পালাতে গিয়ে বিশেষভাবে শিক্ষিত কুকুরের খাদ্য হত। সর্বসমক্ষে নির্মমভাবে অত্যাচারিত হত অন্যদের শিক্ষা দেবার জন্য। এইসব ছবি রাখা আছে মিউজিয়ামে। আশ্চর্য উপায়ে তাদের একটি দল বিদেশী প্রভুদের শায়েস্তা করেছিল। তারা যখন বুঝতে পেরেছিল তাদের সন্তানও হবে ক্রীতদাস, তখন তারা সন্তানধারণ বন্ধ করে দিয়েছিল। 

আমাদের নাইজেরীয় কাজের মেয়েটি অসুস্থ হলে পর গ্রামের ওঝার কাছে গেল। পাশের বাড়ির শিক্ষিত ভদ্রলোকটি ডাক্তারের বদলে চার্চের জলপড়ায় বেশি বিশ্বাসী। সেই জন্য আধুনিক চেহারার সঙ্গে গ্রাম্য আদিম বিশ্বাস, সংস্কার, ধর্মাচরণ সবই প্রবলভাবে বর্তমান নাইজেরিয়ার সমাজে। অভিবাদনের খুব ঘটা। দিনের প্রতিটি প্রহরে যতবার দেখা হয় একমুখ হাসি ও বিনয় নিয়ে গুড মর্নিং, গুড আফটারনুন। এমনকী দিনের মধ্যে আর দেখা হবার সম্ভাবনা না থাকলে সকাল দশটাতেই বিদায়কালে গুড নাইটটাও সেরে রাখে। প্রথম দিন শরীর হাঁটু পর্যন্ত নুইয়ে ড্রাইভার জন গুড মর্নিং বলে জিজ্ঞেস করেছিল ‘হাউ ওয়াজ ইয়োর নাইট?’ তখন অবাক হলেও পরে দেখলাম ওটাই রেওয়াজ। 

Cathedral_Church_of_Christ_Lagos
আমাদের মিষ্টির দোকানের মতো পাড়ায় পাড়ায় চার্চ

শুনলাম যে কোন কর্মারম্ভেই প্রেয়ার মাস্ট। ক্লাস শুরুর আগে প্রার্থনা শুরু হল। ভাবছি এইবুঝি শেষ হবে। অন্তহীন প্রার্থনা থেকে আবিষ্কার করলাম এরা ভগবানকে থ্যাংকস জানাচ্ছে ঊনকোটি চৌষট্টি জিনিসের জন্য। তার মধ্যে ঋতা ম্যাডামকে পাঠিয়ে ট্রেনিংয়ের কথাও আছে। তালিকায় স্কুলের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি আরও সব মাথারা এল সারি বেঁধে।

বিনয় ও প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রায় সবার মধ্যেই। যদি কখনও ক্লাসের মধ্যে হেঁচেকেশে ফেলি বা ঢেঁকুর তুলি, সবাই মিলে ‘সরি ম্যাডাম, সরি ম্যাডাম’ করে ওঠে। একসঙ্গে উদ্বিগ্নমুখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, যতক্ষণ না ধাতস্থ হই। যেন আমার হাঁচি কাশির জন্য ওরাই দায়ী। একদিন ক্লাসে খেয়াল করলাম ফেইথ ঘুমে ঢলে পড়ছে। এমনিতে মেয়েটি বুদ্ধিমতী মনোযোগী। পড়ানো থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
– কাল রাতে ঘুমোওনি?
– না।
– কেন?
– প্রেয়ার করছিলাম।
আমি সত্যি ভেবেছি ও ঠাট্টা করছে। তারপর শুনি প্রতি সপ্তাহে একদিন ওরা রাত নটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত নেচে-গেয়ে প্রার্থনা করে। ঘুমন্ত মানুষ শয়তানের কাছে অসহায়। তাই জেগে থেকে অশুভ শক্তির বিনাশ কামনা করা হয়। সামান্য নিয়মবদল করে বিভিন্ন চার্চে এই রকম নানা কর্মকাণ্ড লেগেই থাকে। ওদের কাছে নানা রকম গল্প শুনে আমার আর আশ মেটে না। চার্চ প্রধানকে এরা প্যাস্টর বলে। তারা প্রভূত প্রভাবশালী। অসবর্ণ বিয়ের থেকে সম্পত্তি ঘটিত গোলমাল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সবই তারা নিয়ন্ত্রণ করে।

বিয়ের সময় ছেলেকে বেশ দাম দিয়ে বউ কিনতে হয়। এখানে বলে রাখি ভারতবর্ষে মেয়েপক্ষ এই টাকা দেয় এবং টাকার পরিমাণ মনের মতো না হলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে এই খবর এরা রাখে এবং এই অসভ্য নিয়ম এখনো টিঁকে আছে বলে বেশ অবাক হয়। যাই হোক এদের ব্রাইড প্রাইসের দরদস্তুর পর্যন্ত প্যাস্টরের দায়িত্ব। প্যাস্টর মত না দিলে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ পর্যন্ত সম্ভব হয় না। প্যাস্টররা যে যার মতো করে বাইবেলের ব্যাখ্যা করেন। যিনি যত জনচিত্ত জয় করতে পারেন তাঁর চার্চ সাধারণ মানুষের ভয়-ভীতি ভক্তিকে কেন্দ্র করে ততই ধনী আর ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। 

Dance in Nigerian Wedding
বিয়ে থেকে শুরু করে সব অনুষ্ঠানেই নাচ থাকবেই। নাচ এঁদের রক্তে

আমাদের মিষ্টির দোকানের মতো পাড়ায় পাড়ায় চার্চ। তাদের অদ্ভূত সব নাম– রিয়েল জেসাস চার্চ, অনেস্ট জেসাস চার্চ, হাউস অফ লাভ চার্চ, রিডিম ক্রিশ্চান চার্চ ইত্যাদি। যেকোনও কারণেই হোক, সমস্ত পৃথিবী জুড়েই কিন্তু কালো মানুষদের চার্চপ্রীতি অতুলনীয়। এখানে চার্চগুলোতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিজস্ব বিচিত্রানুষ্ঠান হতে দেখেছি। বিনোদনে যত সক্রিয়, মানুষের বিপদে তত নয় এখানকার চার্চগুলো। সাধারণ নাইজেরিয়ানরা জীবনে ফুটবল ছাড়া চার্চেই তাদের মনপ্রাণ সমর্পন করেছে। প্যাস্টররা সব দারুণ ইভেন্ট ম্যানেজার ও সঞ্চালক। তাই চার্চ ঘিরেই এদের জীবনের সুখদুঃখ, আনন্দ। সেইজন্য গরিবস্য গরিব পর্যন্ত তার শ্রেষ্ঠ পোশাকটি পরে মেকআপ করে যখন চার্চে যায়, তখন বোঝার উপায় থাকে না যে পয়সা নেই বলে দুদিন উপোস দিয়ে এসেছে। এখানকার চার্চগুলো ভারতবর্ষের মতো কোনওরকম সমাজ কল্যাণমূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে না। এমনকী চিকিৎসা বা অশুভ শক্তি তাড়াবার জন্য যে জলপড়া, তার জন্য পর্যন্ত পয়সা নেয়। রোজগারের মোটা অংশের বদলে রবিবার সকালের বিনোদনটুকু ফ্রি। 

নানা ভাষার দেশ বলে নাইজেরিয়ায় ইংরেজিটাই যোগাযোগের ভাষা। সব দেশেই তৃণমূল স্তরের মানুষ খুব সীমিত শব্দভাণ্ডার দিয়েই কাজ চালায়। আমাদের দেশে ইংরেজিটা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভাষা বলে আমার অনভ্যস্ত কানে এদের কথোপকথন মাঝে মাঝে বড়ই অদ্ভুত শোনাত। যেমন কম বা বেশি বোঝাতে একটা কথাই এরা ব্যবহার করে ‘বিগ অর স্মল’। সেইজন্য গাড়িটা আচমকা বেশি ঠান্ডা হয়ে গেলে কর্তা ড্রাইভারকে নির্দেশ দিতেন ‘স্মল দ্য এসি।’ বাড়াতে হলে বলা হত ‘বিগ দ্য এসি।’ ‘আই ডান কাম’ মানে আমার আসা হয়েছে অর্থাৎ এসেছি। এই রকম আরও অজস্র।

শুনলাম প্রতি সপ্তাহে একদিন ওরা রাত নটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত নেচে-গেয়ে প্রার্থনা করে। ঘুমন্ত মানুষ শয়তানের কাছে অসহায়। তাই জেগে থেকে অশুভ শক্তির বিনাশ কামনা করা হয়। সামান্য নিয়মবদল করে বিভিন্ন চার্চে এই রকম নানা কর্মকাণ্ড লেগেই থাকে। ওদের কাছে নানা রকম গল্প শুনে আমার আর আশ মেটে না। চার্চ প্রধানকে এরা প্যাস্টর বলে। তারা প্রভূত প্রভাবশালী। অসবর্ণ বিয়ের থেকে সম্পত্তি ঘটিত গোলমাল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সবই তারা নিয়ন্ত্রণ করে।

কোর্সের শেষ দিন ছাত্রীরা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। প্রতিটা গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য ইয়োরবা ভাষায় বুঝিয়ে শুরু হল অনুষ্ঠান। সে কী উদ্দাম নাচগান হাততালি– পা ও কোমরের সাংঘাতিক কারুকাজ। অনুষ্ঠান শেষে আমার জন্যই বিশেষভাবে বানানো নাইজেরিয়ার প্রধান খাবার ‘ইয়াম’ প্ল্যান্টিন ও গারি সুন্দর বাসনে করে নিয়ে এল। প্রায় সব রান্নাতেই এরা শুকনো চিংড়িমাছের গুঁড়ো দেয় বলে আমার গন্ধ লাগছিল। তবুও হাসিমুখে খেলাম। ছাত্রীরা আফ্রিকার উইচক্রাফটের বই ও ওদের পোশাক উপহার দিল। বলাবাহুল্য আরম্ভে ও অন্তে সেই লম্বা প্রেয়ার।

লেগোসে যে কটি ভারতীয় ও বাংলাদেশী পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, তাদের আতিথেয়তা ও উষ্ণতার কোনও তুলনা নেই। শুক্রবার রাত থেকেই নেমন্তন্নের পালা শুরু হয়ে যেত। সবার বাড়িতে এক মানুষ লম্বা ফ্রিজার। তার মধ্যে সম্বৎসরের রসদের সঙ্গে দেশের দই মিষ্টি পাটালিগুড় জমে বরফ হয়ে আছে। প্রত্যেকের বাড়িতে দেখতাম গ্লোরি, হ্যাপিনেস, চ্যারিটিরা আলুর দম, মাছের কালিয়া, মাংসের ঝোল, চাটনি, পায়েস রান্নায় ওস্তাদ। রুটি লুচি পরোটা, বাঙালি রাঁধুনির দক্ষতায় গরম গরম পরিবেশন করে চলেছে রাত এগারোটা বারোটা পর্যন্ত। একটি ব্যাপারে বাঙালি-অবাঙালি সবারই মিল দেখেছি। নাইজেরিয়া তাদের ঘরের বকাটে ছেলের মতো। নিজেরা যথেচ্ছ গাল দেন কিন্তু বহিরাগতরা বললে বড়ই কষ্ট পান। 

সমস্ত পৃথিবী জুড়েই কিন্তু কালো মানুষদের চার্চপ্রীতি অতুলনীয়। এখানে চার্চগুলোতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিজস্ব বিচিত্রানুষ্ঠান হতে দেখেছি। বিনোদনে যত সক্রিয়, মানুষের বিপদে তত নয় এখানকার চার্চগুলো। সাধারণ নাইজেরিয়ানরা জীবনে ফুটবল ছাড়া চার্চেই তাদের মনপ্রাণ সমর্পন করেছে। প্যাস্টররা সব দারুণ ইভেন্ট ম্যানেজার ও সঞ্চালক। তাই চার্চ ঘিরেই এদের জীবনের সুখদুঃখ, আনন্দ। 

এখানে আসার আগে সবাই নাইজেরিয়ায় পদে পদে ডাকাতি লুটতারাজ নিয়ে ভয় দেখিয়েছিল। কোনও কারণে রাস্তায় গাড়ি দাঁড়ালে যেন কখনওই জানালার কাচ না-নাবানো হয়, এইসব উপদেশ হাই কমিশন থেকেই দিয়ে দেওয়া হয়। এখানে এসেও যে কোনও জমায়েতে নানারকম রোমহর্ষক ডাকাতির গল্প শুনেছি। আমি খুবই সুরক্ষিত এলাকায় থাকি। ছ’টা বাজতে না বাজতেই চারদিকের লোহার গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। সকাল বেলা কিছু বোঝা যায় না। স্থানীয় লোকজনকেও দেখি নিশ্চিন্ত মনে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছে। ভাবি আমাদের দেশেও তো  অহরহ কত ঘটনাই ঘটছে। আমার চোখে তো কিছুই পড়ছে না। একটু বোধহয় অতিরঞ্জিত করেই বলা। এই করে এমন চমৎকার সমুদ্র পাহাড় জঙ্গল লালমাটির দেশে পর্যটন শিল্প গড়েই উঠল না।

কিন্তু চাপা টেনশন বোঝা গেল রাত্রিবেলা নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরবার সময়। ডাকাত দেখিনি, তবে সশস্ত্র পুলিশের ছড়াছড়ি। পুলিশের টর্চের আলো দেখামাত্র গাড়ির ভেতরের আলো জ্বেলে দিয়ে গাড়ি থামিয়ে দিতে হয়। নির্দেশ পালন না করলে পুলিশের গুলি করার অধিকার আছে। এটুকু বলতে পারি, আমার অন্তত প্রবাসে দৈবের বশে জীবতারা খসে যাবার মতো কোনও ঘটনা ঘটেনি। তবে এই চাপা ভয়ের ভাবটার জন্যই স্থানীয় বাজারহাট রাস্তাঘাটে স্বাধীনভাবে ঘুরে ফিরে বেরিয়ে আরও ভালো করে এই দেশটাকে জানা হল না, এই আফসোস নিয়ে নাইজেরিয়া থেকে বিদায় নিলাম।

 

*ছবি সৌজন্য: Tripadvisor, Wikimedia Commons

বাংলা সাহিত্য নিয়ে শান্তিনিকেতন ও প্রেসিডেন্সিতে পড়াশোনা। পরে শিক্ষাঙ্গনকেই বেছে নিয়েছেন কর্মজগত্‍ হিসেবে। তবে লেখালিখিই প্রথম ভালবাসা। ছোটদের ও বড়দের –-- দু'রকম লেখাতেই সমান স্বচ্ছন্দ। ছোটদের ও বড়দের গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি শান্তিনিকেতনের মেয়েদের হস্টেল জীবন নিয়ে তাঁর লেখা 'শ্রীসদনের শ্রীমতীরা' পাঠকসমাজে সমাদৃত। প্রিয় বিষয় সিনেমা, নাটক, রহস্য ও ইতিহাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *