মহাসিন্ধুর ওপার থেকে – শেষ পর্ব
গত শতকের প্রথম দিককার কথা। উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকোয় হরেন্দ্রকৃষ্ণ শীলের বাড়ির জলসাঘর তখনও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মার্গসঙ্গীতে দেশখ্যাত গুণীদের আগমনে, সঙ্গীত পরিবেশনে। সুরবাহারী হরেন্দ্রকৃষ্ণ যেমন খ্যাতনামা সঙ্গীতজ্ঞ, তেমনই সঙ্গীতের অকৃপণ পৃষ্ঠপোষক। তাঁরই শখের থিয়েটারে তখন সখিদের দলে অভিনয়, গান করতে আসত অনতিদূরস্থ শিমুলিয়ার অল্পবয়সী এক কিশোর। কুড়াত অকুণ্ঠ প্রশংসাও৷ প্রাণবন্ত কিশোরটির কণ্ঠ যত মধুর, প্রকৃতি ততই দুরন্ত। নেশা ঘুড়ি ওড়ানো আর গান- এই দুই নিয়েই দিন কাটে তার।
কিন্তু দুর্যোগের মেঘ ঘনিয়ে এল হঠাৎই। বয়স তখন তেরো। দেবেন্দ্রনাথ সেনের শ্রীকৃষ্ণ পাঠশালার (বর্তমানে কালীদাস পাল বিদ্যামন্দির) ফোর্থ ক্লাসের ছাত্র এই কিশোরটি একদিন ক্লাসে মাস্টারমশায়ের পড়া শুনতে শুনতে অনুভব করল তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। সঙ্গে চোখে অসহনীয় যন্ত্রণা। অনেক চিকিৎসা করেও ফল মিলল না। মাস দুয়েকের মধ্যে দৃষ্টিশক্তি চলে গেল চিরদিনের মত। বন্ধ হয়ে গেল স্কুলে যাওয়া, ঘুড়ি ওড়ানো। রয়ে গেল শুধু গান।
“সেই প্রচণ্ড আঘাতে কিছুদিন মনটা অসাড় হয়ে রইল গভীর হতাশায়৷ তারপর ঈশ্বর এলেন আমার ভাবনায়। কার কাছে দুঃখ জানাব, নালিশ জানাব? কার শরণ নিয়ে মনে সান্ত্বনা পাব? এমন কাউকে তো দরকার? তিনিই হলেন ঈশ্বর।” – প্রবীণ বয়সে বলেছিলেন সেদিনের কিশোর কৃষ্ণচন্দ্র দে।
১৮৯৪ সালের ২৪ অগস্ট, জন্মাষ্টমী তিথিতে উত্তর কলকাতার শিমুলিয়া অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন শিবচন্দ্র দে, রত্নমালা দেবীর কনিষ্ঠ সন্তান কৃষ্ণচন্দ্র। অতি অল্পবয়সে পিতৃহারা কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়িতে আসতেন এক বৈষ্ণব ভিক্ষুক- খঞ্জনি বাজিয়ে গান শুনিয়ে এগিয়ে দিতেন ভিক্ষাপাত্র। ততদিনে কৃষ্ণচন্দ্রের জীবনে অন্ধকার নেমেছে। মনোকষ্টে দিশাহারা হয়ে তাঁর কাটছে দিন। একদিন হঠাৎ শুনতে পেলেন সে ভিক্ষুক বাড়ির দুয়ারে দাঁড়িয়ে গাইছেন – “নয়ন মুদিলে দেখা যদি পাই অন্ধ করিয়া দাও গো।” জীবনদর্শন বদলে গেল কৃষ্ণচন্দ্রের। অন্তর্দৃষ্টির আগল গেল খুলে। এরপর? তাঁরই কথায়, “সুরের সাধনায় পেলাম সান্ত্বনা, পেলাম তাঁর করুণাময় পরশ।”

শিমুলিয়ার কাছেই দর্জিপাড়া। সেখানে থাকতেন শশীভূষণ দে। পেশায় উকিল হলেও, বেতিয়া ঘরানার গুরুপ্রসাদ মিশ্র, শ্রীজানবাঈয়ের শিষ্য শশীভূষণের, খেয়ালিয়া হিসাবে ছিল বিশেষ খ্যাতি। একসময় গ্রামোফোন রেকর্ডেও তাঁর গান শোনা গিয়েছিল। কৃষ্ণচন্দ্র দে-র মার্গসঙ্গীতে প্রথাগত শিক্ষার আরম্ভ শশীভূষণ দে-র কাছে। বাংলায় টপ্পার প্রচলন যে সময়ে, প্রায় সে সময় থেকেই যে সাঙ্গীতিক ধারাটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, তা টপ্-খেয়াল। সেকালের বৈঠকী গানের আসরে এ রীতির গানের ছিল বিশেষ আদর। পরবর্তীকালে রেকর্ডের আগমন হলে, লালচাঁদ বড়াল, মানদাসুন্দরী, প্রমুখ শীর্ষস্থানীয় শিল্পীদের কণ্ঠেও টপ্-খেয়াল অশেষ জনাদর লাভ করে।
টপ্পা সম্বন্ধে কৃষ্ণচন্দ্র দে-রও যে আগ্রহ ছিল, তা অনুমান করা যায়। পাঁচ বছর খেয়ালে তালিম নিয়ে তিনি যাঁর কাছে আসেন, তিনি সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। প্রখ্যাত টপ্পাশিল্পী মহেশ ওস্তাদের শিষ্য সতীশচন্দ্র, পাথুরিয়াঘাটার শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সভায় গায়ক ও তবলাবাদকরূপে নিযুক্ত ছিলেন। প্রথম জীবনে টপ্পাগায়ক ও পরবর্তীতে তবলাবাদক হিসাবে তাঁর খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়েছিল বহুদূর। শশীভূষণ দে-র কাছে খেয়ালশিক্ষা সম্পূর্ণ করে, তিন বছর সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে টপ্পা শিখেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। তাঁর সুরেলা কণ্ঠ ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিল সুদক্ষ, কারুকার্যমণ্ডিত। তবে সঙ্গীতশিক্ষা এখানেই সমাপ্ত হয়নি কৃষ্ণচন্দ্রের।
হোগলকুড়িয়ায় অম্বু গুহের কুস্তির আখড়া সেকালের কলকাতার বিখ্যাত স্থান। স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ, বাঘাযতীন, প্রমুখ যে মল্লবীরের কাছে অল্প বয়সে কুস্তি শিখেছিলেন, সেই অম্বিকাচরণ গুহের অপর পরিচয় ছিল সঙ্গীতগুণীদের মুক্তহস্ত পৃষ্ঠপোষকরূপে। তাঁরই উত্তরপুরুষ কুস্তিবিদ যতীন্দ্রচরণ ওরফে গোবর গুহ ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্রের চেয়ে কিছু বড়। যতীন্দ্রচরণও ছিলেন অম্বিকাচরণের মতোই সঙ্গীতপ্রেমী ও সঙ্গীতজ্ঞ। তাঁর বাড়িতে তখন নিয়মিত বসত বৈঠক। আসর আলো করতেন বহু গুণী শিল্পী। পাথুরিয়াঘাটার যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের উদ্যোগে কাশী থেকে কলকাতায় এসেছিলেন সরোদের বিখ্যাত শাহজাহানপুর ঘরানার আসাদুল্লা খাঁ (কৌকব) ও পরবর্তীকালে, তাঁর বৈমাত্রেয় বড়ভাই কেরামতুল্লা খাঁ। প্রথমে কৌকব ও তাঁর মৃত্যুর পর কেরামতুল্লা খাঁ’র কাছে সেতার শিক্ষা করেছিলেন যতীন্দ্রচরণ গুহ৷

কিশোর কৃষ্ণচন্দ্রের গুণের সঙ্গে তাঁর যখন পরিচয় হয়, তখন তাঁর বাড়ির সান্ধ্য-বৈঠক আলো করেন কেরামতুল্লা খাঁ, প্রসিদ্ধ তবলিয়া দর্শন সিং, জমিরুদ্দিন খাঁ, প্রমুখ। গোবর গুহের সহযোগিতায়, তাঁরই বাড়িতে ওস্তাদ কেরামতুল্লার কাছে নাড়া বাঁধেন কৃষ্ণচন্দ্র। তিন বছর নানা রাগরাগিণীতে খেয়াল ও তারানার উচ্চতর তালিম নেন ওস্তাদজির কাছে৷ ঠুংরির প্রবাদপ্রতীম মৌজুদ্দিন, ভাইয়াসাহেব গণপৎ রাও, প্রমুখের সঙ্গে তবলা সঙ্গতের অসংখ্য অভিজ্ঞতার ফলে দর্শন সিং-এর সংগ্রহে ছিল অমূল্য কিছু ঠুংরি। সেই ধারার গান কৃষ্ণচন্দ্রের কণ্ঠে তুলে দিয়েছিলেন স্বয়ং দর্শন সিংজি। ওস্তাদ জমিরুদ্দিনের কাছেও বহু ঠুংরি শিখেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। প্রখ্যাত গুরুদের তালিম আর শিষ্যের একান্ত নিষ্ঠার মণিকাঞ্চনযোগে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কণ্ঠে তখন ধীরে ধীরে স্থায়ী আসনটি তৈরি করে নিচ্ছেন সুরসরস্বতী।
১৯১৬ সাল। বৌবাজারের বেচারাম চন্দ্রের বাড়ির সঙ্গীতাসরের খ্যাতি তখন শহরের সঙ্গীতরসিকদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। এ বাড়িরই এক আসরে আমন্ত্রিত হয়েছেন কেরামতুল্লা- তাঁর সরোদবাদনই সেদিনের প্রধান আকর্ষন। আছেন দর্শন সিংও। দর্শকের আসনে আসীন কৃষ্ণচন্দ্র। কেরামতুল্লা ডেকে নিলেন তাঁর শিষ্যটিকে। ঘোষনা করে দিলেন- এই ছেলেটির গান শুনুন। তারপর কী হল?
দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়ের বয়ানে:
“দরাজ, ভরাট তাঁর গলা প্রথম থেকেই অমনোযোগী শ্রোতাদের মন আকর্ষণ করে নিল। গলা শুধু তৈরি নয়, বড় দরদী। হৃদয়গ্রাহী ভাব দিয়ে গান করছেন এমন ভাবে যে শ্রোতাদের মন অনুরণিত হয়ে উঠেছে সেই সুরে। তাল-লয়েও কোন খুঁত নেই। যেমন স্বচ্ছন্দ সুরবিহার, তেমনি তালেও পারদর্শিতা৷ অনায়াস দ্রুতগতির ও নানা রীতির তানকর্তব, রাগের সুনিপুণ বিন্যাস, প্রাণস্পর্শী কণ্ঠস্বর। প্রথম শ্রেণীর গায়কের সমস্ত গুণই সেই তরুণের মধ্যে বর্তমান। সুরতাং কলাবত ও বোদ্ধা সকল শ্রোতারাই তাঁর গানে পরিতৃপ্ত হতে লাগলেন। আসর সজীব হয়ে উঠল সুরে সুরে। তাল-লয়ের কাজেও এমন প্রবীণতা এই বয়সে সুলভ নয়। তাঁর গানের সঙ্গে ওস্তাদ আবিদ হোসেন এবং দর্শন সিং দুজনেই বাজালেন পালা করে এবং সাবাস দিলেন। তালের কঠিন পরীক্ষার সসম্মানে উত্তীর্ণ হলেন নবীন গায়ক। ভারতবিখ্যাত ওস্তাদদের সামনে তিনি সমান দাপটে দুঘন্টা ধরে তেলেনা আর খেয়াল গেয়ে গেলেন। একাই আসর মাত করলেন সেদিন।”
এরপর কোনওদিন ফিরে তাকাতে হয়নি কৃষ্ণচন্দ্র দে-কে। গ্রামোফোন রেকর্ডের তখন রমরমার যুগ। রাধিকা গোস্বামী, নারায়ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কে. মল্লিক, মোন্তাবাবু, কিংবা মানদাসুন্দরী, কৃষ্ণভামিনীর গান তখন রেকর্ডের হাত ধরে শোভা পাচ্ছে সঙ্গীতমোদীদের ঘরে ঘরে। ১৯১৬ সাল। হরেন্দ্রকৃষ্ণ শীলের বাড়ির এক জলসায় কৃষ্ণচন্দ্রের গান শুনলেন গ্রামোফোন কোম্পানির প্রখ্যাত মার্কেটিং রিপ্রেজেন্টেটিভ ভগবতীচরণ ভট্টাচার্য। ফল? বেলেঘাটায়, গ্রামোফোন কোম্পানির স্টুডিওতে শুভাগমন হল তরুণ কৃষ্ণচন্দ্র দে-র। পরের বছর প্রকাশিত হল ওঁর প্রথম রেকর্ড- একপিঠে কাফি-সিন্ধুতে ‘মা তোর মুখ দেখে কি হয় না’, অন্যপিঠে ভূপালীতে ‘আর চলে না, চলে না, মাগো, তোমা বিনা দিন চলে না।’ তারপর একটি বছরের বিরতি।
১৯১৯ সালে- ‘পোড়া প্রাণে মরমজ্বালা কত সই’, ‘শুধু চোখের দেখায় প্রাণসখা প্রাণ তো বোঝে না’। রেকর্ড প্রযুক্তির হাত ধরে কৃষ্ণচন্দ্রের যাত্রা আরম্ভ হলেও প্রকৃত অর্থে জয়যাত্রা আরম্ভ হতে আরও একটি বছরের অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ১৯২০ সাল। মালকোষের সুরে, আবেগমথিত কণ্ঠে কৃষ্ণচন্দ্র দে মায়ের চরণে সমর্পণ করলেন অন্তরের বেদনাভার –
ওমা দীনতারিণী তারা,
দিনে দিনে দিন কেটে গেল মাগো,
কতদিন আর রব তোমা-ছাড়া।
পাঠাইলে যদি এ ভবসংসারে,
কেন চিরপরাধীন করিলে আমারে,
পরাধীনতার সহে না যাতনা,
নে মা কোলে তুলে ওগো দুখহরা।।
কৃষ্ণচন্দ্রের পরবর্তী যাত্রা – সত্তার বলে, সাধনার গুণে, স্বাধীন, উন্নতশির শিল্পী হওয়ার; আর ইতিহাস – শুধুই উচ্চ থেকে উচ্চতর শিখর জয়ের।
পরবর্তী ঘটনার তারিখ ১৯২৪ সালের ৬ই আগস্ট। মনোমোহন নাট্যমন্দিরে সেদিন মঞ্চস্থ হয় যোগেশচন্দ্র চৌধুরীর ‘সীতা’ নাটক। রামচন্দ্রের চরিত্রে শিশিরকুমার ভাদুড়ি, সীতা প্রভা দেবী। প্রথম রজনীতেই দর্শকাসনে উপবিষ্ট দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নাটোরের মহারাজা যোগীন্দ্রনাথ রায়ের মত স্বনামধন্যেরা। বৈতালিকের ভূমিকায় মঞ্চে এলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। মঞ্চে তখন সীতাহীন রামদরবার। প্রজাবৎসল রামচন্দ্রের আদেশে সীতা তখন বনবাসে। বিষন্নবদনে সিংহাসনাসীন রাম। সীতার শূন্য আসন লক্ষ করে গেয়ে উঠলেন বৈতালিক –
কোথায় সীতা! কোথায় সীতা!
জ্বলছে বুকে স্মৃতির চিতা,
কাজলা রাতের বেদনবাঁশী
বাজছে করুণ স্বরে।
অন্ধকারের অন্তরেতে
অশ্রুবাদল ঝরে,
লক্ষ্মীহীন এ শূন্যপুরী,
মন যে কেমন করে।।
মুহুর্মুহু এনকোরে ভরে উঠল নাট্যমন্দির। ‘সীতা’ নাটকের গানগুলির মধ্য দিয়ে কৃষ্ণচন্দ্রের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল বহুদূর। মার্গসঙ্গীতের আসরে বহুপ্রশংসিত কৃষ্ণচন্দ্র দে জয় করেছিলেন বাংলার বঙ্গমঞ্চও। তাঁর কণ্ঠে ‘সীতা’-র ‘অন্ধকারের অন্তরেতে’ এবং ‘জয় সীতাপতি সুন্দরতনু প্রজারঞ্জনকারী’ গানদুটির জনপ্রিয়তার কারণে গ্রামোফোন কোম্পানি রেকর্ড আকারেও প্রকাশ করেছিল ১৯২৬ সালে।
একসময় সঙ্গীতের পাশাপাশি অভিনয়কেও যে আন্তরিকভাবে ভালবেসেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র, তার প্রমাণ, ‘সীতা’ ছাড়াও, অ্যালফ্রেড থিয়েটারে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জামাতা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বসন্তলীলা’, মনমোহন নাট্যমন্দিরে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ (১৯২৫), রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ (১৯২৬), শরৎচন্দ্রের ‘ষোড়শী’ (১৯২৭), মিনার্ভায় জলধর চট্টোপাধ্যায়ের ‘সত্যের সন্ধান’ (১৯২৮), রঙমহলে তাঁরই ‘অসবর্ণা’ (১৯৩২), শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘প্রলয়’ (১৯৩৭), প্রভৃতি বহু নাটকে তাঁর মঞ্চাবতরণ। যদিও বর্তমান নাট্যমোদীর সেসব নাটকে তাঁর অভিনয়ের কোনও নমুনা পাওয়া অসম্ভব, তবু রেকর্ডের মাধ্যমে নানা নাটকে কৃষ্ণচন্দ্র দে গীত বেশ কিছু সঙ্গীত রক্ষিত থাকায়, সেই অনন্য সুরপ্রবাহে ভাসতে ভাসতে তাঁর অভিনয়ের দৃশ্য কল্পনা করে নেওয়া যায় সহজেই।

নাট্যসঙ্গীত সম্বন্ধে কৃষ্ণচন্দ্র লক্ষ করেছিলেন, “গান হল তার (নাটকের) কায়া আর ভাব হল তার প্রাণ… দর্শকদের প্রাণে রসকে ঘনীভূত করতে হলে চাই সুরের উন্মাদনা – আর সেই সুর এমন হওয়া চাই যাতে গায়ক ও শ্রোতা তন্ময় হয়ে যাবে। আত্ম-ভোলা গায়ক প্রাণের দরদ দিয়ে তার গান গাইবে – আর সেই সুরের অশ্রান্ত ধারায় স্নাত হয়ে শ্রোতা ভুলে যাবে তার অস্তিত্ব- তা সে সুর মিশ্র হোক অমিশ্র হোক- ভাঙা হোক গড়া হোক তাতে যায় আসে না, কেবল লক্ষ্য থাকবে গায়কের- নাটকের অগ্রগতির দিকে।” হয়তো তাই ‘সত্যের সন্ধান’-এর কবি, ‘চন্দ্রগুপ্ত’-এর ভিক্ষুক, ‘প্রলয়’-এর অমরনাথ, বা ‘অসবর্ণা’-র বাণীকণ্ঠরূপী কৃষ্ণচন্দ্রের অভিনয় দেখতে না পেলেও, রেকর্ডে ‘স্বপন যদি মধুর এমন হোক সে মিছে কল্পনা’, ‘আমার কবিতা হারায়ে ফেলেছি এই বলে আমি কাঁদি’ (সত্যের সন্ধান), ‘ঘন তমসাবৃত অম্বর ধরণী, গর্জে সিন্ধু চলিছে তরণী’, ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কী সঙ্গীত ভেসে আসে’ (চন্দ্রগুপ্ত), ‘আঁধারের ডম্বরুতালে জেগে ওঠে মরণের গান’ (প্রলয়), কিংবা ‘নেচেছ প্রলয় নাচে হে নটরাজ তাথৈ তাথৈ’ (অসবর্ণা) শুনলে কল্পচক্ষে যেন ফুটে ওঠে নাটকের দৃশ্যগুলি। কায়ার মন্দিরেই যে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত থাকে, তা এ গানগুলি শুনলে আর কৃষ্ণচন্দ্রের নাট্যসঙ্গীতভাবনা স্মরণ করলে স্পষ্টত অনুভব করা যায়!
*ছবি সৌজন্য: লেখক
জীবনে সবেমাত্র পেরিয়েছেন ছাব্বিশটি বসন্ত! বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সঙ্গীতসাধনায় রত। নেশা গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ। পত্রপত্রিকায় সঙ্গীতবিষয়ক বেশ কিছু নিবন্ধ লিখেছেন বাংলা ও ইংরাজিতে৷
ওনার পিতা কি সঙ্গীতজ্ঞ নীলাক্ষ গুপ্ত?