*আগের পর্বের লিংক: [], [], [], [], [], [], [], [], [], [১০], [পর্ব ১১]

এবছর সত্যজিৎ জন্মশতবর্ষ কিছুটা ছায়াচ্ছন্ন হয়ে রইল নির্বাচনী ফলাফলের কোলাহলে। তবু বাঙালি লেখক শিল্পীরা ত্রুটি রাখেননি।নতুন বই বেরিয়েছে সত্যজিতের ফিল্ম, তাঁর লেখা, অলঙ্করণের মূল্যায়ন ও স্মৃতি, সোশ্যাল মিডিয়ায় ফিরে ফিরে আসছে তাঁকে নিয়ে নিজস্ব স্মৃতিমালা। আমার ছোটবেলা ও কলেজ জীবনের বন্ধুরাসোমেশ্বর ভৌমিক, উজ্জ্বল চক্রবর্তী, দেবাশিস মুখাপাধ্যায়ের নতুন বই আমাকে ফেরায় সেই ষাটের দশকের মাঝামাঝি দিনগুলিতে, যখন সত্যজিৎকে চেনার পর্বটি মনের কাছে বিকশিত হচ্ছে। 

এছাড়া অতি বিশিষ্ট ও সত্যজিতের ছবির চরিত্রদের লেখা তো আছেই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে কিছুদিন আগেই হারিয়েছিএকেবারেই সান্ত্বনাহীনভাবে। শঙ্খ ঘোষকে ডানার ঝাপটে নিয়ে গেছে মৃত্যুর বাজপাখি। বাংলা জয়ের যজ্ঞে আয়োজিত আট পর্বের নির্বাচনে অনাবশ্যক রক্ত ঝরেছে। আর হ্যাঁ, পাছে মনীষাকে, স্বাধীন চিত্তবৃত্তিকে সম্মান জানানোর মতো কোনও লজ্জাজনক কাজ তাঁরা পাছে ভুলেও করে ফেলেন, তাই কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে সত্যজিৎ শতবর্ষ আয়োজন করার কোনও প্রস্তাব চোখে পড়েনি। কলকাতায় থাকা হল না, ১লা বৈশাখ, ২রা মে, ২৫শে বৈশাখ। গাঢ় বিষাদে ডুবে রইল ২১শে এপ্রিল। গেলেও হয়তো কোনও জনসমাগমের মধ্যে থাকতে পারতাম না। বা হতেও পারত না তেমন কোনও আয়োজন।

আমার একটি  সাম্প্রতিক উপন্যাসের অনুবাদকে কেন্দ্র করে যাদের সঙ্গে পরিচয়, তেমন দু’টি কাগজ, মুম্বইকেন্দ্রিক, জানতে চাইল, সত্যজিৎ রায়ের বহুমুখিতা আমি শৈশবে অনুভব করেছিলাম কিনা এবং আমার সাহিত্যজীবনে সন্দেশ পত্রিকার ভূমিকা কী ছিল। দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর আপেক্ষিকভাবে সহজ। প্রথমটি নিয়ে আমাকে ভাবতে হল। মনে পড়ল, তাঁর সান্নিধ্যের স্মৃতি আমার মনে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকলে কী হবে, তাঁকে আমি কোনওদিনও সামনাসামনি দেখিনি। কেন দেখিনি? তিনি কি ছোটদের সঙ্গে দেখা করতেন না? নিশ্চয়ই করতেন। তাঁর কাছে আঁকা-লেখা নিয়ে সন্দেশী ছোটরা যেত। গম্ভীর হলেও উদাসীন ছিলেন না সত্যজিৎ। ছোটদের জন্য ফিল্ম তৈরির পর্ব আরও জমজমাট হয়ে উঠেছিল সন্দেশকে ঘিরে, কারণ ক্ষুদে পাঠকদের হাতে যেন নেমে এসেছিল আকাশের মস্ত চাঁদ। 

Satyajit Ray
বিশপ লেফ্রয় রোড নামের একটা রাস্তায়, যেটা মধ্য কলকাতায়, সেখানে আমাদের বিশ্বখ্যাত সম্পাদক থাকেন

১৯৬৯ থেকে ১৯৭৪যে পর্বে সন্দেশের পাতায় আমি উজাড় করে দিচ্ছি আমার কবিতা, মুক্তগদ্য, কবিতায় লেখা চিঠি, সেই পর্ব সত্যজিতের কর্মজীবনেরও ব্যস্ততম সময়। কিন্তু সন্দেশের জন্য তাঁর সময় ও মনোযোগ তাতে কমেনি। তখন লেখা হচ্ছে ছোট ও বড়দের জন্য একইরকম সম্মোহক গল্প সব। বঙ্কুবাবুর বন্ধু, শিবু আর রাক্ষসের কথা, খগম। যেমন গল্প, তেমন নিখুঁত অলঙ্করণ, তেমনই গল্প বলার ভঙ্গি। যতদূর মনে পড়ছে, ফেলুদা এসেছে পরে। ‘বাদশাহী আংটি’ সন্দেশে ১২টি সংখ্যায় ধারাবাহিক বেরিয়েছিল ১৯৬৬-৬৭তে। ১৯৬৯-এ বই হয়ে প্রকাশ। ওই বছরেই ‘গুপীগাইন বাঘাবাইন’ ফিল্মের সাড়াজাগানো আত্মপ্রকাশ। গানের সুরে, সংলাপে, ভূতের রাজার আবির্ভাবের উল্লাসে ভেসে যাচ্ছে কলকাতা। তখন ভিস্যুয়াল মিডিয়া এত সর্বব্যাপী ছিল না। টিভি আসেনি। খবর কাগজে কখনওসখনও ছাড়া সত্যজিতের ছবিই বা আমরা কত দেখতাম? 

তবু জানতাম, বাড়ির কাছে ত্রিকোণ পার্কে সন্দেশের দফতর। ওখানে দাদা আমার লেখা দিয়ে আসে। বিশপ লেফ্রয় রোড নামের একটা রাস্তায়, যেটা মধ্য কলকাতায়, সেখানে আমাদের বিশ্বখ্যাত সম্পাদক থাকেন। তিনি আবার লেখক শিল্পী চলচ্চিত্র পরিচালক। ইচ্ছে করলেই যাওয়া যায়। কিন্তু গিয়ে কী করব, কী বলব, মুখচোরা আমার মাথায় আসত না। তাছাড়া কারও কাছে কেবল নিজের পরিচয়টুকু দেবার জন্য গিয়ে দাঁড়ানো, কোনওদিনই ভালো পারিনি। বলাই বাহুল্য, এই অনমনীয় আচরণের জন্য বাংলার বহু বিশিষ্ট মানুষের সংসর্গ ও সান্নিধ্য পাইনি। তার জন্য মনে দুঃখ আছে, তবে নিজেকে বদলানোর কোনও ইচ্ছে নেই।

তবে, পিছনে তাকালে মনে হয় ১৯৬৭ সালটাও খুব জরুরি ছিল। সে বছর দাদা হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় ভালভাবে পাশ করে মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেল। নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তি হবার সুখের দিন ছিল সে সব। প্রি-মেডিক্যাল এর ক্লাস হয় প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেই সুবাদে বহির্জগতের নানা সরস গল্প ভাইবোনদের সার্কিটে ঢুকে আসে। শান্তশিষ্ট আমার আর ছোড়দার তুলনায় আমার বড় দাদা  কল্যাণের (পরে, ডাঃ কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়) দুষ্টুমির গল্প কিংবদন্তী-সমান। 

আড়াই বছর বয়সে দোতলার খোলা কার্নিশে হেঁটে বেড়িয়ে যে প্রতিবেশীদের আতঙ্ক উদ্রেক করেছিল, সে যে ট্রামের ভাড়া বাঁচিয়ে সাত বছর বয়সে বিস্কুট কিনে খাবে, এ যেন অবধারিত। দুষ্টুমির জীবন বিপন্নকারী পরিণামের চেয়েও মায়ের আতঙ্ক ছিল লোকাপবাদে। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’-র জাগতিক প্রয়োগের উজ্জ্বল উদাহরণ  আমার মা কার্নিশ থেকে টুঁটি ধরে উদ্ধার করে আনা বড় ছেলেকে বুকে জড়িয়ে হাউ হাউ করে না কেঁদে, পিট্টি দিয়ে দুরমুশ করে দিতে পারতেন, কারণ, লোকের নালিশ তাঁর কাছে অসহ্য। কিন্তু যতই মা অস্থির হতেন লোকের নালিশে, বড়দা ততই নতুনতর দুষ্টুমির ডোমেনে চলে যেতে থাকত। 

মনে পড়ল, তাঁর সান্নিধ্যের স্মৃতি আমার মনে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকলে কী হবে, তাঁকে আমি কোনওদিনও সামনাসামনি দেখিনি। কেন দেখিনি? তিনি কি ছোটদের সঙ্গে দেখা করতেন না? নিশ্চয়ই করতেন। তাঁর কাছে আঁকা-লেখা নিয়ে সন্দেশী ছোটরা যেত। গম্ভীর হলেও উদাসীন ছিলেন না সত্যজিৎ। 

বিহারে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, বাচ্চা ডাকু হৈ, বাচ্চা দুশমন হৈ, এসব বলে বাবা মা গর্ব অনুভব করেনকিন্তু চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনকারী মাস্টারদার উদাহরণ সত্ত্বেও বাঙালি মায়েরা অন্তত সেই যুগে শান্তশিষ্ট ভদ্রসভ্য সন্তানই কামনা করতেন। মেয়েদের তো কথাই নেই। তারা হবে জুড়নো ফ্যানে ভাতের মত ঠান্ডা। কাজেই দাদা যখন ক্লাস নাইনে ক্লাস টিচারের চেয়ারের (খালি, অবশ্যই) নীচে চকোলেট বোম ফাটানোর চক্রান্তে দোষী সাব্যস্ত হল এবং কেবল ক্লাসের ফার্স্ট বয় বলে রাস্টিকেট হল নামায়ের লকআপে তার প্রহারের পরিমাণ দেখলে টালিগঞ্জ থানার বড়বাবুরও হৃদয় বিদারিত হত। যাই হোক এই বড়দাই ছিল সরা-ঢাকা জালার মতন আমাদের মাতৃশাসিত জীবনের একটি আধ আঙুল প্রমাণ ফাঁক, যে গবাক্ষপথে এনে দিত বাইরের খবর। 

সম্ভবত ১৯৬৩ থেকে আমাদের বাড়িতে সন্দেশ পত্রিকা আসতে শুরু করল, কারণ চাঁদা দিয়ে আমরা তিন ভাইবোন গ্রাহক হলাম। একটি গ্রাহক সংখ্যা পেলাম, ২৫৯৮, যা দিয়ে যে কেউ লেখা পাঠাতে পারে। লেখার কাগজের কোনও অভাব ছিল না বাড়িতে। তবু বড়দা কেন জানি না, বাতিল ব্রাউন পেপার টুকরো করে কেটে সুতো দিয়ে সেলাই করে খাতা বানাত এবং তাতে কবিতা লিখত। সেইরকম খাতায় লেখা একটা কবিতা “বয় উত্তরে বাতাস, এখন শীতের মাস” সন্দেশে পাঠানো হল এবং ছাপাও হয়ে গেল অচিরে। শেষ দুটো লাইনও মনে আছে। “কুয়াশায় ঢাকা রবি। স্মরণে শীতের ছবি।”

তখনও কিন্তু আমি সন্দেশে কবিতা পাঠানোর কথা ভাবিনি। কেন জানি না। পড়াশুনো এবং গান শেখায় একটু বেশি করে জড়িয়ে যাচ্ছিলাম। এটাও সত্যি, আমার কবিতায় একটা বাঁক আসতে আরম্ভ করেছিল ১৯৬৫-র পর থেকেছন্দ ও আবেগের নানা কুয়াশা কেটে যাচ্ছিল। ১৯৬৯ সালে গুপী গাইনের বছরে, যে কবিতাটি লিখে আমি সন্দেশে পাঠালাম, তার বয়ন হয়েছিল ১৯৬৮ সালের এক ট্রেন যাত্রায়। সেই কথায় পরে আসব।

কলকাতায় জন্ম, বড় হওয়া। অর্থনীতির পাঠ প্রেসিডেন্সী কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতা দিয়ে লেখক জীবন আরম্ভ। সূচনা শৈশবেই। কবিতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ, ছোটদের জন্য লেখায় অনায়াস সঞ্চরণ। ভারতীয় প্রশাসনিক সেবার সদস্য ছিলেন সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময়। মহুলডিহার দিন, মহানদী, কলকাতার প্রতিমা শিল্পীরা, ব্রেল, কবিতা সমগ্র , দেশের ভিতর দেশ ইত্যাদি চল্লিশটি বই। ইংরাজি সহ নানা ভারতীয় ভাষায়, জার্মান ও সুইডিশে অনূদিত হয়েছে অনিতা অগ্নিহোত্রীর লেখা। শরৎ পুরস্কার, সাহিত্য পরিষৎ সম্মান, প্রতিভা বসু স্মৃতি পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবন মোহিনী দাসী স্বর্ণপদকে সম্মানিত। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমীর সোমেন চন্দ পুরস্কার ফিরিয়েছেন নন্দীগ্রামে নিরস্ত্র মানুষের হত্যার প্রতিবাদে। ভারতের নানা প্রান্তের প্রান্তিক মানুষের কন্ঠস্বর উন্মোচিত তাঁর লেখায়। ভালোবাসেন গান শুনতে, গ্রামে গঞ্জে ঘুরতে, প্রকৃতির নানা রূপ একমনে দেখতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *