তবে, পিছনে তাকালে মনে হয় ১৯৬৭ সালটাও খুব জরুরি ছিল। সে বছর দাদা হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় ভালভাবে পাশ করে মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেল। নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তি হবার সুখের দিন ছিল সে সব। প্রি-মেডিক্যাল এর ক্লাস হয় প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেই সুবাদে বহির্জগতের নানা সরস গল্প ভাইবোনদের সার্কিটে ঢুকে আসে। শান্তশিষ্ট আমার আর ছোড়দার তুলনায় আমার বড় দাদা কল্যাণের (পরে, ডাঃ কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়) দুষ্টুমির গল্প কিংবদন্তী-সমান।
আড়াই বছর বয়সে দোতলার খোলা কার্নিশে হেঁটে বেড়িয়ে যে প্রতিবেশীদের আতঙ্ক উদ্রেক করেছিল, সে যে ট্রামের ভাড়া বাঁচিয়ে সাত বছর বয়সে বিস্কুট কিনে খাবে, এ যেন অবধারিত। দুষ্টুমির জীবন বিপন্নকারী পরিণামের চেয়েও মায়ের আতঙ্ক ছিল লোকাপবাদে। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’-র জাগতিক প্রয়োগের উজ্জ্বল উদাহরণ আমার মা কার্নিশ থেকে টুঁটি ধরে উদ্ধার করে আনা বড় ছেলেকে বুকে জড়িয়ে হাউ হাউ করে না কেঁদে, পিট্টি দিয়ে দুরমুশ করে দিতে পারতেন, কারণ, লোকের নালিশ তাঁর কাছে অসহ্য। কিন্তু যতই মা অস্থির হতেন লোকের নালিশে, বড়দা ততই নতুনতর দুষ্টুমির ডোমেনে চলে যেতে থাকত।
মনে পড়ল, তাঁর সান্নিধ্যের স্মৃতি আমার মনে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকলে কী হবে, তাঁকে আমি কোনওদিনও সামনাসামনি দেখিনি। কেন দেখিনি? তিনি কি ছোটদের সঙ্গে দেখা করতেন না? নিশ্চয়ই করতেন। তাঁর কাছে আঁকা-লেখা নিয়ে সন্দেশী ছোটরা যেত। গম্ভীর হলেও উদাসীন ছিলেন না সত্যজিৎ।
বিহারে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, বাচ্চা ডাকু হৈ, বাচ্চা দুশমন হৈ, এসব বলে বাবা মা গর্ব অনুভব করেন। কিন্তু চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনকারী মাস্টারদার উদাহরণ সত্ত্বেও বাঙালি মায়েরা অন্তত সেই যুগে শান্তশিষ্ট ভদ্রসভ্য সন্তানই কামনা করতেন। মেয়েদের তো কথাই নেই। তারা হবে জুড়নো ফ্যানে ভাতের মত ঠান্ডা। কাজেই দাদা যখন ক্লাস নাইনে ক্লাস টিচারের চেয়ারের (খালি, অবশ্যই) নীচে চকোলেট বোম ফাটানোর চক্রান্তে দোষী সাব্যস্ত হল এবং কেবল ক্লাসের ফার্স্ট বয় বলে রাস্টিকেট হল না, মায়ের লকআপে তার প্রহারের পরিমাণ দেখলে টালিগঞ্জ থানার বড়বাবুরও হৃদয় বিদারিত হত। যাই হোক এই বড়দাই ছিল সরা-ঢাকা জালার মতন আমাদের মাতৃশাসিত জীবনের একটি আধ আঙুল প্রমাণ ফাঁক, যে গবাক্ষপথে এনে দিত বাইরের খবর।
সম্ভবত ১৯৬৩ থেকে আমাদের বাড়িতে সন্দেশ পত্রিকা আসতে শুরু করল, কারণ চাঁদা দিয়ে আমরা তিন ভাইবোন গ্রাহক হলাম। একটি গ্রাহক সংখ্যা পেলাম, ২৫৯৮, যা দিয়ে যে কেউ লেখা পাঠাতে পারে। লেখার কাগজের কোনও অভাব ছিল না বাড়িতে। তবু বড়দা কেন জানি না, বাতিল ব্রাউন পেপার টুকরো করে কেটে সুতো দিয়ে সেলাই করে খাতা বানাত এবং তাতে কবিতা লিখত। সেইরকম খাতায় লেখা একটা কবিতা “বয় উত্তরে বাতাস, এখন শীতের মাস” সন্দেশে পাঠানো হল এবং ছাপাও হয়ে গেল অচিরে। শেষ দুটো লাইনও মনে আছে। “কুয়াশায় ঢাকা রবি। স্মরণে শীতের ছবি।”
তখনও কিন্তু আমি সন্দেশে কবিতা পাঠানোর কথা ভাবিনি। কেন জানি না। পড়াশুনো এবং গান শেখায় একটু বেশি করে জড়িয়ে যাচ্ছিলাম। এটাও সত্যি, আমার কবিতায় একটা বাঁক আসতে আরম্ভ করেছিল ১৯৬৫-র পর থেকে। ছন্দ ও আবেগের নানা কুয়াশা কেটে যাচ্ছিল। ১৯৬৯ সালে গুপী গাইনের বছরে, যে কবিতাটি লিখে আমি সন্দেশে পাঠালাম, তার বয়ন হয়েছিল ১৯৬৮ সালের এক ট্রেন যাত্রায়। সেই কথায় পরে আসব।