এ শহরের চোখের দৃষ্টি খারাপ, হোর্ডিংয়ের মেয়েটির দিকে যেভাবে তাকায় , তাতে সে অস্বস্তিতে পড়ে গিয়ে আঁচল বা ওড়না ঠিক করে নেয় , হোর্ডিং ছেড়ে উড়ে যায় রাতের আকাশে , তারাদের ক্যাফেতে বসে একা একা আইস-টি খায় ; “আপনার চোখের দৃষ্টি খারাপ” – বলেছিল মনসুন রায় , কিন্তু পরদিনই “চোখে চোখে কথা বল, মুখে কিছু ….” করতে করতে , চশমাটা কপালে তুলে বলেছিল – ” আই লাইক ইয়োর জ্যাকেট , কোথা থেকে কিনেছেন ?” , এই চোখের খারাপ দৃষ্টি নিয়েই পথশিশুদের জন্যে নৈশ-স্কুল স্থাপন করে ফেলা যায় , স্ট্রে -ডগের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা যায় , ভালোবেসে ফেলা যায় কিনা জানা নেই, কারণ চোখের দৃষ্টি খারাপ হলে মেয়েদের দিকে তাকানো অনুচিত , না আই-স্পেশালিস্টের কাছে যাওয়া উচিত, বাবা রামদেব সেসব নিয়ে কিছু বলেননি এখনো। খারাপ চোখে কত ভালো ভালো জিনিস খারাপ লাগে – এস্থেটিক লঁজারি দেখে মনে হয় ধ্বংসস্তূপ , শপিং মল দেখে মনে হয় ভেঙে যাওয়া ঘর , চওড়া লিপস্টিক-স্মাইল দেখে মনে হয় হত্যার পরিকল্পনা , গল্প না , সত্যি – কল্পনা কুলশ্রেষ্ঠ বলেছিল – “আপনি যেভাবে আমার যেদিকে তাকিয়ে আছেন, অন্য কেউ হলে , আমি একটা থাপ্পড় মারতাম ” , তবু পরদিন বলেছিল – “লেট’স কফি ?…” ; চোখের দৃষ্টি নিয়ে আমার তেমন কোনো বক্তব্য নেই , চোখের দৃষ্টি খারাপ হলে মেয়েদের দিকে তাকানো অনুচিত , না আই-স্পেশালিস্টের কাছে যাওয়া উচিত, বাবা রামদেব সেসব নিয়ে কিছু বলেননি এখনো। তবে , জল পড়ে , পাতা নড়ে কিনা জানিনা , চোখ খারাপ বলে , চোখ থেকে জল পড়ে মাঝে মাঝে। কিছু কিছু শহর থাকে , যাদের চোখের দৃষ্টি ভালো – তারা নিয়ন দেখলে মৃত্যু ভাবেনা, নিয়ন-ই ভাবে, মনসুন রায় দেখলে বৃষ্টি ভাবেনা, মনসুন রায়-ই ভাবে , জাহাজ দেখলে হারানো নৌকা ভাবেনা , জাহাজ-ই ভাবে। তারা বিপজ্জনক বাঁক বা ঢেউয়ের দিকে তাকায়না , তাদের ভালো চোখ তখন বিপজ্জনক বাঁক আর ঢেউগুলো কিনে নেবার প্ল্যান বানায়। ভালো চোখ মানে ভালো চোখ, সেখান থেকে জল পড়েনা – পাথরের চোখ যেমন ….
স্মৃতির শহর কলকাতায় প্রচুর অদ্ভুত নামের গলি আর রাস্তা – “লাভলক স্ট্রিট / প্লেস” শুনলেই মনে হয় এখানে ল্যাম্প-পোস্টের ম্লান আলোয় কারা যেন ‘লিপ-লক’ করতে করতে নিজেদের ‘লাভ’-টাকে “এবার লক কিয়া যায়” নাকি ভাবছে ; “ম্যাঙ্গো লেন ” -এ যেন গরমকালে ঝরে পড়ছে হাজার হাজার হিমসাগর আম, আর সকলে সেই আম কুড়িয়ে নেবার জন্যে হুড়োহুড়ি করছে ; “ছকু খানসামা লেন “-এ যেন জুনের নির্জন দুপুরে নষ্ট বাবু খানসামাকে ডেকে বলছেন – ” যা, তোর আজ ছুটি …”, বলে বাড়ি ফাঁকা করে ফেলছেন গোপন কোনো ছক করবেন বলে ; “গুলু ওস্তাগর লেন ” বা “দর্জিপাড়া”-র ভুলভুলাইয়া গলিতে হাজার বছর ছায়ার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় এই বুঝি কোণের হলুদ বাড়ির ছাদ থেকে হাত নেড়ে উঠবেন গুলুবাবু – ” কী যে আপনারা রেমন্ডস থেকে স্যুট কেনেন , আমার কাছে আসুন স্যার , এখনো সেরা স্যুট আমিই বানাতে পারি …”
তবে, প্রতিটা নামের পেছনেই একটা ইতিহাস রয়েছে বটে। যেমন , বড়বাজারের কাছে একটা গলি আছে – “মুত গলি” , কেন এই নাম, কী তার ইতিহাস, এসব আর আলাদা করে বোঝানোর দরকার নেই নিশ্চয়ই। একটা গলির নাম “মুত গলি” …. শুধু ভাবি, কারা এই নাম কবে দিয়েছিল , নাকি কার্যকারণসূত্রে / মূত্রে লোকমুখে এই মহান নামটি প্রচলিত হয়ে গেছে, কারুর কোনো কপিরাইট নেই। তুমি দুঃখ কোরোনা “মুত গলি” , আমরা ধীরে ধীরে সুসভ্য হয়ে উঠে তোমার নাম “ফুল গলি” করে দেব , ফুলকুলিরা নাকে রুমাল ছাড়াই তোমার শরীর বেয়ে মনোরম সন্ধেতে প্রেমিকদের সঙ্গে দেখা করতে যাবে…
একটা বটম’স আপ ডিসেম্বর থাম্বস আপ জানায় শহরকে , আর দূরের রেলব্রিজের ওপর তখন গোধূলিরঙা শার্ট পরে দাঁড়িয়ে থাকে হারানো যুবক। দূরত্ব , বড় কঠিন এক পাহাড় – ট্রেক করে ফেলবো মনে করলেও , তত সহজে করা যায়না , যেমন হিপ-ফ্লাস্ক আর আইলাইনারের মধ্যে কোনো স্ট্র্যাপলেস যাতায়াত সহজে ধরা যায়না ; এই পার্টি-সিজনে পকেটে জ্বরের ওষুধ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে বালক , ভিকটোরিয়ার পরি তার মাথায় বুলিয়ে দেয় ম্যাজিক-পোশন , বলে – সেরে ওঠো … গ্যালিফ স্ট্রিটের দিকে তখন উড়ে যায় অশরীরী ঘোড়া। একটা বটমস আপ ডিসেম্বর আর একটা থাম্বস আপ শহরের মধ্যে একটা ডাকবাংলোপাড়া , একটা সাঁওতালি সন্ধে থাকে , শৈশবের লন্ঠন হাতে হেঁটে আসে দাদু , বীরভূমের লাল মাটি পেরিয়ে কেউ এসে দাঁড়ায় দেশের বাড়ির উঠোনে , কুয়ো থেকে জল তোলে চাঁদ। সামপ্লেস এলস থেকে রক্সি হয়ে যখন টাকিলা শটসময় প্রাইভেট পার্টির দিকে গাড়ি ছোটাচ্ছে শিকড়হীন কলকাতা , তখন আঙুলের ডগায় এক ফোঁটা নুন নিয়ে শিকড়ের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকে মহাকাল । ওই নুনটুকু ছাড়া সমস্ত টাকিলা-চুমুক চিরতার জল হয়ে যায় , যার নুন খেয়েছে তাকেই হত্যা করে হেসে ওঠে ক্ষণজন্মা রোবট-জীবন…
এই সময়ে যাঁরা বাংলা কবিতা লিখছেন , তাঁদের মধ্যে সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। সৌভিকের কাব্যভাষা স্বকীয় ও স্বতন্ত্র - নাগরিক বিষন্নতা , সমাজসচেতনতা , মাঝে মাঝে কালো ঠাট্টা বা শ্লেষ ও নস্টালজিয়া তাঁর কবিতায় নানাভাবে ফিরে ফিরে আসে। লিখেছেন ছোট-বড় প্রায় সমস্ত বাণিজ্যিক ও লিটল ম্যাগাজিনে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সংখ্যা তেরো, ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে 'কবিতাসমগ্র ১'। কবিতার জন্যে ভাষানগর-মল্লিকা সেনগুপ্ত পুরস্কার, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পুরস্কার সহ পেয়েছেন আরও একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। গদ্যকার হিসেবেও উজ্জ্বল, এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত গদ্যের বইয়ের সংখ্যা তিন । বড় পর্দাতে অভিনেতা হিসেবেও তাঁকে মাঝে মাঝে দেখা যায়।
প্রিয় শহর কলকাতাকে অন্য চোখে দেখলাম, আপনার লেখনীতে…
অসম্ভব ভালোলাগা রইল।